তালুকদার সাহেবের কুলখানি
রসুলপুরের তালুকদার বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব । আব্দুর রশিদ তালুকদার সাহেবের মৃত্যুর আজ চল্লিশ দিন পার হচ্ছে, আজ তাঁর কুলখানি । আশেপাশের দশ বারো গ্রামের গন্যমান্য মানুষ তো বটেই, তার উপর আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শী আর রবাহূত অনাহূতের দলে ভরে গেছে তালুকদার সাহেবের বাড়ি আর সামনের চত্বর ।
বাষট্টি বছর বয়সে হঠাৎ মারা গেলেন তালুকদার সাহেব । মৃত্যুর কারণ অজানা । মানুষ যখন তখন মরতেই পারে । মৃত্যুর কারণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না গ্রামাঞ্চলে ।
অঢেল সহায় সম্পত্তি, টাকা পয়সা আর সর্বোপরি বিশাল প্রভাব প্রতিপত্তি রেখে গেলেন বিপত্নীক আব্দুর রশিদ তালুকদার ।
গ্রামে যে বিশাল মাদ্রাসা বানিয়ে গেছেন সেই মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল, শিক্ষক আর সমস্ত ছাত্ররা আজকের কুলখানিতে হাজির । তারা সবাই বৈঠক ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে বসে মাথা নেড়ে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করছে । প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মাথায় ফেজ টুপি পরে এক নং হাকিমপুরী জর্দা দেওয়া পান চিবুতে চিবুতে তেলাওয়াত তদারক করছেন আর মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলছেন পিচিক পিচিক করে । হাতে একটা পানের বোঁটার ডগায় খানিকটা চুণ নিয়ে মাঝে মাঝেই সেই চুণ জিভে ঠেকাচ্ছেন । পরনে তাঁর পায়জামা পাঞ্জাবী আর তার উপর সোনালী নক্সা করা কালো হাতা কাটা মুজিব কোট ধরণের কোট । এরই ভিতর মাদ্রাসা কমিটির সেক্রেটারী এসে বেশ খানিকটা মাতব্বরী ভাব নিয়ে ছাত্রদের কোরআন খতম করার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে গেছেন আর প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে বলে গেছেন সবকিছু যেন ঠিকমত চলে । প্রিন্সিপ্যাল সাহেব এই সেক্রেটারী লোকটাকে দুচোখে দেখতে পারেন না । লেখাপড়া তেমন কিছুই জানে না ব্যাটা, বনে গেছে সেক্রেটারী । যতোসব দালাল বদমাসের দল । তালুকদার সাহেবের আত্মীয় বলে এতদিন কিছু বলেননি । এবার তালুকদার মরেছে, এই সেক্রেটারীকে আচ্ছামত দেখে নেবেন তিনি ।
বাগানে বড় বড় চুল্লী খুঁড়ে তাতে রান্না হচ্ছে ভাত, মাশকলাইয়ের ডাল আর সাত সাতটা বিশাল বিশাল গরুর মাংস । যারা গরু খায় না তাদের জন্য রান্না হচ্ছে খাসীর গোস্ত আলাদা হাঁড়িতে । চারিদিকে বিশাল হৈ হৈ কারবার চলছে । এটাকে একটা শোকের বাড়ি মনে না হয়ে মনে হচ্ছে কোন এক উৎসবের বাড়ি ।
বাগানের ধারে থালা বাটি ঘটি পেতে বসে গেছে একদল ফকির মিসকিন । পরম ধৈর্য সহকারে বসে আছে কখন বড়লোকদের খাওয়া শেষ হবে আর কখন তারা খানিকটা উচ্ছিষ্ট ভোগ করতে পারবে ।
রান্না প্রায় শেষের দিকে । তালুকদার সাহেবের বড় ছেলে করিম তালুকদার খাবার দাবারের ব্যাপারটা তদারক করছে । ইতিমধ্যেই গ্রামের লোকজনদের একটা ব্যাচকে খেতে বসানো হয়েছে বারান্দায় পাতা বিশাল জাজিমে । খেতে খেতে তারা গল্প করছে তাদের মধ্যে কে তালুকদার সাহেবের বেশী কাছের আত্মীয় । কেউ আবার নিজেকে তালুকদার সাহেবের সম্পত্তির হকদার বলেও দাবী করছে । কুদ্দুসপুর গ্রামের আলহাজ্ব সুলেমান মিয়াঁ বলছে তালুকদার সাহেবের সাথে হজ্বে গিয়ে কি হয়েছিল ।
“শোনেন, আমি আর তালুকদার সাহেব হজ্বে গিয়ে একসাথেই থাকতাম । কাবা শরীফের সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝে তওয়াফ করার সময় কি হয়েছে, তালুকদার সাহেব তো ফিট হয়ে গেলেন । লাখ লাখ মানুষের পায়ের নীচে পড়ে আলুর ভর্তা হয়ে যেতেন তিনি যদিনা আমি খপ করে তাঁকে চেপে ধরে বাইরে নিয়ে আসতাম” ।
তখন বেহায়া ধরণের একজন বলে উঠলো, “ কিন্তু তালুকদার সাহেব তো বেঁচে থাকতে একদিন বলেছিলেন ফিট হওয়ার সময় নাকি উনার হাত থেকে সোনার চেনওয়ালা ঘড়িটা হারিয়ে গিয়েছিল । তো আপনি তালুকদার সাহেবের সাথেই তো ছিলেন, তাঁকে টেনে তুলে বাঁচালেন, কিন্তু ঘড়িটার কি কোন খোঁজ পেয়েছিলেন?
এবার সুলেমান মুখটা কাঁচুমাচু করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু করিম তালুকদার এসে পড়ায় সবাই চুপ মেরে গিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল । সারির শেষের দিক থেকে একজন বলে উঠলো, “এদিকে একটু ভাত দিবেন ভাই? একজন খাদেম ভাতের গামলা নিয়ে এগিয়ে গেল ।
করিম ভরাট গলায় ঘোষণা দিল, “খাওয়া শেষ হওয়ার পর মোনাজাত হবে, আপানারা দয়া করে মোনাজাত শেষ না করে যাবেন না” ।
পরপর অনেকগুলো ব্যাচে খাওয়া হল । বাড়ির ভিতরে মহিলাদের খাওয়া শেষ । তালুকদার গিন্নী মারা গেছেন কয়েক বছর আগেই । করিমের বউই অন্দর মহলের দায় দায়িত্ব সামলালো আরো সব মহিলাদেরকে সাথে নিয়ে ।
ফকির ফাকরা মিসকিনদের খাওয়াও শেষ । এবার বিশেষ মোনাজাত হবে মরহুম আব্দুর রশিদ তালুকদার সাহেবের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ।
মোনাজাত শুরু করলেন তালুকদার সাহেবের বানানো মসজিদের ইমাম সাহেব । উপস্থিত সকলে হাত তুলল । মহিলারা হাত তুললেন পর্দার আড়াল থেকে । ইমাম সাহেব আরবীতে বেশ কিছু দোয়া দুরূদ পাঠ করে এবার শুরু করলেন তালুকদার সাহেবের গুণগান । তাঁর মৃত্যুতে যে মাদ্রাসার ছেলেগুলো এতিম হয়ে গেল একথা বলার সাথে সাথে মাদ্রাসার ছাত্ররা ডুকরে কেঁদে উঠলো । তিনি যে একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক ছিলেন একথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পর ইমাম সাহেব তাঁর দীন ইসলামের প্রতি ভক্তির কথা বয়ান করে তাঁর সকল গুনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করার জন্য আল্লার কাছে সুপারিশ করতে করতে নিজেই ডুকরে কেঁদে ফেললেন ।
অন্দর মহলে মহিলারা কান্না সামলাতে পারছে না সবাই কম বেশী কাঁদছে দোয়া করতে করতে । কেউ কেউ আবার কাঁদছে খানিকটা জোর করেই, পাছে আবার অন্যেরা না বলে তুই তো কাঁদিস নি ।
কাঁদছে তালুকদার বাড়ির কাজের বুয়া রহিমাও । তার কান্না নকল কান্না নয় । তার কান্না বুকের ভিতর থেকে উথলে উথলে উঠছে । হাউ মাউ করে কাঁদতে মন চাইছে তার । এক হাতে দোয়া করছে আর এক হাতে শাড়ির আঁচল নিয়ে চোখের পানি মুছছে সে । চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না সে । বাড়িতে এত খাবার অথচ সারাদিন কিছুই খায়নি সে, খাবারের গন্ধই সহ্য করতে পারছে না । খালি বমি বমি ভাব ।
তালুকদার সাহেবকে তার বমি সমস্যার কথা একদিন খুলে বলেছিল সে মাস দেড়েক আগে । তিনি খানিকক্ষণ হতভম্বের মত চুপচাপ থেকে ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন । তারপর লোহার সিন্দুক খুলে বিগত স্ত্রীর পাঁচ ভরি সোনার একজোড়া বালা বের করে ওকে দিয়ে বললেন, তুই চিন্তা করিস না, কয়েকদিনের মধ্যেই তোকে বিয়ে করব আমি’ । এর সাতদিনের মাথায় মারা গেলেন তালুকদার সাহেব ।
সে বালা আজ রহিমা হাত থেকে খুলে ফেলেছে । বালা পরবে কি করে, সে তো এক প্রকারের বিধবাই ।
শুধু হাজার মানুষের সামনে চিৎকার করে আসল কথাটা বলতে পারছে না ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:২০