আমাদের প্রাইমারী স্কুলে ছেলে, মেয়ে সবাই একসাথে পড়তাম। ক্লাসের ভিতর বেঞ্চগুলো দুই কলামে সাজানো, বামদিকের কলামে মেয়েরা, ডানে ছেলেরা। বাংলার স্যার হচ্ছেন আকবর স্যার। ইয়া স্বাস্থ্যবান হোমরা চোমরা জাঁদরেল চেহারা। প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার না হয়ে পুলিশের ঘুষখোর এসপি, ডিএসপি বা নিদেনপক্ষে দারোগা হলে মানাতো ভাল। কিন্তু বেচারা যে কেন দরিদ্র স্কুল শিক্ষক হতে গেলেন তা আমার মাথায় আজও ঢুকেনা।
আমরা চোর ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী সব। চোর ক্লাস মানে হচ্ছে গিয়ে ঐ সব ক্লাসেরই একটা পদবী থাকে, যেমন-
ওয়ান –ফুলের বাগান
টু – খায় মুরগির গু
থ্রী – পায়খানার মিস্ত্রী
ফোর – হেড মাষ্টারের জুতা চোর
ফাইভ সিক্স মনে নেই, তবে
সেভেন – বিয়ে করবেন?
সেই ছড়া মোতাবেক আমরা বর্তমানে চোর পর্যায়ে আছি।
আকবর স্যারের ক্লাসে বাংলা হাতের লেখা জমা দিতে হয় তিনি ক্লাসে আসার আগেই। ছেলে মেয়েরা যার যার বাংলা হাতের লেখা খাতার পৃষ্ঠাটা খুলে উল্টা করে স্যরের টেবিলে জমা দেয়, খাতার উপর খাতা জমা হতে হতে উঁচু একটা খাতার টাওয়ার হয়ে যায়। তিনি ক্লাসে এসে প্রথমেই খাতা গুলো দুইহাতে ধরে উল্টানো অবস্থা থেকে সোজা করবেন। তারপর একটি একটি করে খাতা দেখবেন আর সই করবেন। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন খাতাগুলো একে একে যার যার বেঞ্চে পৌঁছিয়ে দেয়। যে যত আগে খাতা জমা দিয়েছে সে তত আগে খাতা ফেরত পায়। অন্যরা কে কি ভাবত জানতাম না তবে আমার মনে হত আমি খাতাটা আগে জমা দিই, তাহলে ওটা আগে ফেরত পাবো।
আকবর স্যার আসেন সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে। তাঁকে জীবনে একদিনই শার্ট প্যান্ট পরে ক্লাসে আসতে দেখা গিয়েছিল। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। তিনি যখন শার্ট প্যান্ট পরে ক্লাসে এসে চেয়ারে বসলেন তার দু এক মিনিটের মধ্যেই ক্লাসে মৃদু গুঞ্জন শুরু হল। গুঞ্জনটা শুরু হয়েছিল মেয়েদের দিক থেকেই, তারপর তা আস্তে আস্তে ছেলেদের মধ্যেও সংক্রমিত হল। গুঞ্জনটা ক্রমে ক্রমে কলহাস্যে রূপান্তরিত হল। স্যার ভাবছেন তিনি আজ প্যান্ট শার্ট পরে আসায় তাঁকে খুব স্মার্ট লাগছে তাই ছেলে মেয়েরা সেটা নিয়েই বুঝি উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছে। তিনি খুব খুশী হয়েছেন তবে নিজের রাশভারী ভাবটা নষ্ট করতে চাইছেন না, বেশ খানিকটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে হুঙ্কার দিচ্ছেন, “অ্যাই চোপ বাঁদরের দল”। মাঝে মাঝে আবার হাতের বেতটা দিয়ে টেবিলে সপাং করে বাড়ি মেরে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন – বেশী হৈ চৈ করলে বেতটা টেবিলে না মেরে আমাদেরকেই মারবেন, এমনই একটা ভাব নিচ্ছেন। কিন্তু আজ যেন ভয় দেখিয়েও ছেলেমেয়েদের হাসি হল্লা থামানো যাচ্ছে না। ছেলেমেয়েরা যেন আজ বুঝেই নিয়েছে নতুন প্যান্ট শার্ট পরা আকবর স্যার আজ মারবেন না। প্যান্ট শার্টের যে মর্যাদা তিনি আজ পাচ্ছেন তা আমাদেরকে মারধোর করে নষ্ট করতে চান না তিনি।
কিন্তু আসল ঘটনাটা যে অতি ভয়ঙ্কর তা অনুধাবন করলাম একটু পরে। ক্লাসের অন্যদের দৃষ্টি অনুসরণ করে স্যারের টেবিলের তলা দিয়ে যখন দৃষ্টিপাত করলাম তখন এক নিমেষে বুঝে গেলাম সবার হাসির কারণ। প্যান্ট পরলে যে প্যান্টের সামনের বোতাম তিনটে লাগাতে হয় (সেকালে জিপ ছিল না) তা আকবর স্যারের মত আজীবন পায়জামা পরা মানুষ বোধহয় খেয়াল করেননি। তার উপর তিনি হচ্ছেন গিয়ে প্রাচীনপন্থী মানুষ, প্যান্ট পরার আগে যে ছোট বাচ্চাদের মত জাঙ্গিয়া পরে নিতে হয় সেটাও বোধহয় তাঁর খেয়াল ছিল না। ছেলেমেয়েদের টেবিলের তলা দিয়ে তাঁর প্যান্টের দিকে তাকানো দেখে তিনি ভেবেছিলেন প্যান্টটা বোধহয় খুব সুন্দর হয়েছে তাই এত তাকানো হচ্ছে, তাই তিনিও একবার নিজের প্যান্টের দিকে তাকাতে গেলেন আর অমনি যা বোঝার বুঝে গেলেন। এরপর আর কেউ ক্লাসে থাকে?
সবাই খুব হাসাহাসি করলেও আমার কিন্তু খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। হাজার হলেও স্যারের মত আমিও একজন পুরুষ, তাঁর পুরুষাঙ্গ দলে দলে মেয়েরা দেখে ফেলা আর আমারটা দেখে ফেলার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয়নি; হোক না স্যারেরটা প্রকাণ্ড আর আমারটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।
এরপর সাতদিন আকবর স্যার স্কুলে আসেননি। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তাঁর নাকি জ্বর হয়েছিল। সাতদিন পর যথারীতি আবার সেই চিরাচরিত পায়জামা পাঞ্জাবী।
মাসখানেক পর একদিন এই মহান আকবর স্যারের বাংলা ক্লাস শুরুর আগে এমনি করেই আগে ভাগে টেবিলে খাতা জমা দিয়ে বেঞ্চে ফিরে আসছি এমন সময় দেখি কানিজ যাচ্ছে খাতা জমা দিতে। যাচ্ছে যাক, সেটা কোন ব্যাপারই না, খাতা তো জমা দিতেই পারে, কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি সে তার খাতাটা জমা দিচ্ছে আমার আগের পজিশনে। আমি রেগে গিয়ে তাকে বললাম, এই কানিজ, তুই তো আমার পরে খাতা এনেছিস, তাহলে আমার আগের পজিশনে রাখলি যে?
সে সরি বলা তো দুরের কথা, উল্টো আমার উপর রেগে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, একশো বার রাখবো, কী করবি তুই”? বলে আমার দিকে মারমুখী হয়ে তেড়ে এল।
এই কানিজ হচ্ছে ক্লাসের মধ্যে মহা ধড়িবাজ আর শয়তান টাইপের মেয়ে। যত অকর্ম কুকর্মের হোত্রী হচ্ছে এই কানিজ। মেয়ে হয়েও আমগাছ পেয়ারাগাছের উপর উঠে বসে থাকে। মাঝে মধ্যে ছেলেদেরকেও দুয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে দেয়। সেই আকবর স্যারের প্যান্টের বোতামের ব্যাপারে হাসাহাসির সূত্রপাত করেছিল, তাই ওর উপর আমার অবচেতন মন থেকেই একটা প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল সেদিন থেকেই। আজ ওর আমার উপর চিৎকার শুনে মেজাজ একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ক্রোধে একেবারে অন্ধ হয়ে আমিও সমান তালে চিৎকার দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলাম, “আমি তোকে বিয়ে করব”!!!
ভেবেছিলাম এটাই বুঝি খুব বড় গালি দেয়া হল। আমার কথায় কানিজের মত মেয়েও একেবারে হতভম্ব। সে হম্বিতম্বি থামিয়ে দিয়ে হতবিহবল দাঁড়িয়ে রইল, যেন স্বপ্ন দেখছে। ক্লাসের সবাই কয়েক সেকেন্ড সাইলেন্ট থেকে ব্যাপারটা বোধহয় অনুধাবন করল, তারপর একযোগে বাঁধভাঙ্গা বন্যার পানির মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ক্লাসের ভিতর হট্টগোল শুনে আকবর স্যার বেত হাতে ছুটে এলেন টিচার্স রুম থেকে। এসে বললেন, “অ্যাই চোপ বাঁদরের দল, এত হৈ চৈ কিসের”?
“স্যার, টুটুল কানিজকে বিয়ে করবে”। সবাই একযোগে বলে উঠল।
“কী বললি”?
“জ্বী স্যার, টুটুল নিজের মুখে বলেছে একথা, আমরা নিজের কানে শুনলাম”।
এবার স্যার সিনেমার রোবটের মত স্লো মোশনে আমার দিকে ঘুরলেন, আমি তখনো স্যারের টেবিলের পাশে দাঁড়ানো, আমার সামনেই কানিজ দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন সিনেমায় নায়কের সামনে নায়িকা দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনের সামনা সামনি দাঁড়ানো দেখে স্যার ঘটনার সত্যতা আঁচ করে ফেললেন। তারপর স্যারের বেতের জীবন সার্থক হল আমার উপর দিয়ে। আমি বেত্রাঘাতে জর্জরিত হচ্ছি আর ভাবছি, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। স্যারের প্যান্টের বোতাম নিয়ে হাসাহাসির বিরুদ্ধে আমিই সোচ্চার হয়েছিলাম, আর সেই স্যারই আমাকে মারছে!!!
অনেক মেরেও স্যারের সুখ মিটলো না। তিনি বললেন, “দাঁড়া, তোর বাবা আসুক স্কুলে, তাঁকে বলব তুই বিয়ে করতে চাস, তোর যেন বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়”। বাবাকে তিনি বোধহয় বলেননি, কারণ এব্যাপারে বাবার কাছ থেকে মারধোর খেতে হয়নি আর। তবে শাপে বর হয়েছিল যেটা, সেটা হল কানিজের মত ইবলিশ শয়তান একবারে কেঁচোর মত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। অন্যদের সাথে যাওবা একটু আধটু দুষ্টামি করত, আমাকে দূর থেকে আসতে দেখলেই একেবারে চুপ। শান্ত শিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথা নিচু করে চলত সে, ঠিক যেন নতুন বউ, বরের সামনে আসতে খুব লজ্জা পাচ্ছে।