somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের লিপি আপা

২০ শে আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের পাড়ার লিপি আপা অসম্ভব ঢঙ্গী একটা মেয়ে। কথাবার্তায়, চলাফেরায় কি যে ঢং করে ! উঃ, অসহ্য লাগে দেখলে। তার উপর আছে রূপচর্চার বাহার। কলেজে পড়ে বিএ ক্লাসে, কথা যখন বলতে শুরু করে তখন মনে হয় কোন বিরোধী দলের মহিলা এমপি বুঝি সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে সরকারী দলকে তুলোধুনো করছেন। কলেজে কি একটা পার্টি যেন করে, ভবিষ্যতে এই মেয়ে এমপি মন্ত্রী হলে দেশ ও জাতি উদ্ধার হয়ে যাবে। খুব যে বড়লোকের মেয়ে তা কিন্তু নয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার কিন্তু মনে হবে যেন ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই।
একদিন হয়েছে কি, আমি আমবাগানের ভিতরের হাঁটা রাস্তাটা দিয়ে শর্টকাট মেরে বাজারের দিকে যাচ্ছি এমন সময় দেখি ওদিক থেকে লিপি আপাও শর্টকাট মেরে এদিকেই আসছে। অবাক হলাম বেশ খানিকটা এই ভেবে যে মেয়েরা একা একা কখনও এই নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে যায় না, সেখানে লিপি আপা, হোক না সে যতই স্মার্ট আর খান্ডার, হাজার হলেও একটা বঙ্গললনা তো, এই রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে একটু খটকা লাগবেই। তবে অবশ্য লিপি আপাকে অন্য একদিন এই বাগানে হাঁটতে দেখেছিলাম কলেজেরই একটা ছেলের সাথে। দুজনে দুজনার হয়ে হেসে হেসে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। দুএকবার যেন অনিচ্ছাকৃত ভাবে হাতে হাত ঠেকেও যাচ্ছিল তাদের।
আজ একলা আসছে। কাছে আসতে দেখলাম একটু একটু খোঁড়াচ্ছে। খোঁড়ানোর কারণটা বুঝলাম যখন আমার দৃষ্টিটাকে ধীরে ধীরে উপর থেকে নামাতে নামাতে পায়ের কাছে নিয়ে এলাম। আর কিছুই নয়, একটা স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে তাই এই দুর্দশা। আমাকে ডাক দিয়ে বলল, “ এই ছোঁড়া, আমার স্যান্ডেলজোড়া একটু বাসায় দিয়ে আয় তো”। শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। কোথাকার কোন লাটসাহেবান এসেছেন তার স্যান্ডেল আমাকে বইতে হবে! তবে সিনিয়র মেয়ে, সরাসরি না বলতেও পারি না তাই চালাকী করে বললাম, “লিপি আপা, তোমার একটা স্যান্ডেল তো ভাল আছে, ওটা পরে বাসায় যাও আর ছেঁড়া স্যান্ডেলটা বরং আমাকে দাও –আমি মোড়ের খগেন চামারকে সারাতে দিই।
লিপি আপা রেগে গিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে নিয়ে তেড়ে উঠে বলে, “যা ভাগ এখান থেকে, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারিস তুই? চড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দিব পাজী কোথাকার!
আমি যেন তার মারের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছি এমন একটা কৃত্রিম ভয়ের ভাব করে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। যাক বাবা, কোন মহিলার জুতা স্যান্ডেল বহন করার হাত থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। আসলে কিছু লম্পট ধরণের ছেলে থাকে যারা মেয়েদের তল্পিবাহক হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে, তারা ভাবে মেয়েদের যে কোন ফরমায়েশ পালন করলেই বুঝি তার প্রেমে পড়তে পারা যাবে, সবসময় জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর করতেই ব্যস্ত থাকে তারা। মেয়েরাও কম যায়না, তারা এইসব গর্দভ মার্কা ছেলেদেরকে চাকর বাকরের মত খাটিয়ে নেবে আর শেষকালে যখন ছেলেটা প্রেম নিবেদন করবে তখন মেয়েটা বলবে, তোমার তো আমার চাকর হবার মত যোগ্যতাও নেই, তখন ছেলেটা ছ্যাঁকা খাওয়া নায়কের মত মনের দুঃখে হেরোইন, ফেন্সিডিল ধরবে। লিপি আপাও বোধহয় ছেলেদের কাছ থেকে এইধরনের সার্ভিস পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত, তাই অবলীলায় আমাকে এধরনের হুকুম করার সাহস পেয়েছে। জানে না তো আমি কি ধরণের চীজ, জানলে মুখ সামলে কথা বলত।
কিন্তু ঘটনা এদিকে ভয়ানক সিরিয়াস। কপালে ভোগান্তি থাকলে যা হবার তাই হয়েছে। কোন এক পাতাকুড়ানী আমবাগানে পাতা কুড়াচ্ছিল, সে দূর থেকে লক্ষ্য করেছে লিপি আর আমার মধ্যে কি যেন কথা হল আর তারপরই স্যান্ডেল নিয়ে আপার তাড়া করা। সিনেমায় নাটকে নায়িকা যেমন ভিলেনকে জুতা স্যান্ডেল নিয়ে মারতে উঠে তেমনি বুঝি লিপি আমাকে মারতে ছুটেছে। নির্জন আমবাগানে এক তরুণ আরেক তরুণীকে কী বলতে পারে তা সে দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে নিয়ে যা বোঝার বুঝে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে মাকে সব মনের মাধুরী ঢেলে বলে দিয়েছে। মা আবার বাবাকে নালিশ করে আমার মত চরিত্রহীন ছেলের পিঠের চামড়া তোলার ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন। আমি বাড়ি ফিরলেই আমার পিঠের চামড়া তুলে ফেলবেন। একেবারে সৌদি আরবের মত বিচার, ঘটনার আদ্যপান্ত না শুনেই শাস্তি ফাইন্যাল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দুএকজন করে আমাদের বাড়ির সামনে জমায়েত হচ্ছে আর উঁকিঝুঁকি মারছে আমার পিঠের চামড়া তোলার দৃশ্য দেখার জন্য।

সেই লিপি আপার বিয়ে যখন হয়ে গেল এক পয়সাওয়ালা দুবাইওয়ালার সাথে তখন আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। আহা, এখন কি হবে তার সেই কলেজী প্রেমিকের? আর কি হবে তার তল্পিবাহকদের? তারা তো এখন মনের দুঃখে ড্রাগ ধরে ফেলবে আর ড্রাগের আড্ডায় বসে অন্য মাতালদের সাথে নিজের মিথ্যা প্রেমের গল্প বলে সমবেদনা আদায় করবে। মাতাল বন্ধুরা উত্তেজিত হয়ে বলবে, প্রেমিকা তোমাকে এভাবে ঠকাল? দাও ওর গায়ে অ্যাসিড মেরে।

বিয়ের পর লিপি আপা আরও স্মার্ট আর সুন্দরী হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন। পয়সার অভাবে এতদিন যেসব দামী পোশাক কিনতে পারেনি, দামী বিউটি পার্লারে যেতে পারেনি এখন দুবাইওয়ালা স্বামীর পয়সায় সেসব দেদারসে করছে। কদিন আগে স্বামীর সাথে ঢাকায় গেছিল বেড়াতে, সেখান থেকে স্বামীর পকেট উজাড় করে বাজার করে ফিরেছে। স্বামী অবশ্য ফেরেনি, লিপি আপার কাছ থেকে ঢাকাতেই বিদায় নিয়ে দুবাই পাড়ি জমিয়েছে।
লিপি আপা তার বাজার সওদা আর নব্য বড়লোকী হাবভাব পাড়ার সবাইকে দেখাতে ব্যস্ত। পাড়ার ছেলেরা কেউ সেদিকে নজর দিচ্ছেনা যেমনটা দিত তার বিয়ের আগে। আসলে বিবাহিতা মেয়ে যতই সুন্দরী হোক না কেন তার দিকে সম্ভাবনাময় দৃষ্টিতে বোধহয় ছেলেরা তাকাতে পারে না আর খুব একটা ইন্টারেস্টও দেখায় না। সিনেমার নায়িকাদের বিয়ে হয়ে গেলে যেমন তাদের দর্শক কমে যায় অনেকটা তেমনি।
তবে মেয়েরা নজর বেশী দিচ্ছে আর আপার সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
একদিন বিকেলে দেখি আপা পাড়া বেড়াতে বের হয়েছে দামী দামী সব অলঙ্কার পরে। হাতে ছোট প্লাস্টিকের বাক্সের মত কী যেন একটা। জিনিষটা কী প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে দেখি ওটা একটা ভাঁজ করা পকেট নোটবুকের মত। ভাঁজ খুললে একদিকে অনেকগুলো চারকোণা বাটন আর অন্য দিকে ছোট একটা পর্দা, অনেকটা ক্যালকুলেটরের মত। দুটো বড় বাটন আছে তাতে লাল আর সবুজ রঙের দুটো টেলিফোনের ছবি আঁকা। আপা একটু পর পর সেটার ভাঁজ খুলছে আর বোতামগুলো টিপছে। বোতাম টেপার সময় টুঁট টিঁট আওয়াজ বের হচ্ছে, তারপর আপা ওটাকে কানের কাছে নিয়ে হ্যালো হ্যালো বলছে। আন্দাজ করলাম ওটা মোবাইল ফোনই হবে। কিছুদিন আগে ঢাকা গিয়ে দেখেছিলাম রাস্তার ধারে, বিল্ডিঙের ছাদে বড় বড় সাইন পোস্ট আর হোর্ডিংয়ে মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন। একটা হচ্ছে সিটিসেল আর অন্যটা গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন। সিটিসেলের বিজ্ঞাপনে এক স্যুটপরা হ্যান্ডসাম সিনিয়র বসকে দেখা যাচ্ছে কানে এই লিপি আপার মত জিনিষ নিয়ে পোজ দিচ্ছেন আর গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনে বিটিভির এক হালাল সাবানের মডেল সবগুলো দাঁত বের করে হাসছেন।
কিন্তু ঢাকা থেকে অনেক দূরে এই অজ পাড়াগাঁয়ে তো দূরের কথা আমাদের জেলা শহরেও কোথাও মোবাইল ফোন দেখিনি। বড়দের কাছে শুনেছিলাম ঢাকা শহরেই শুধু মোবাইল ফোন কাজ করে। নেটওয়ার্ক না কি যেন বলছে সেটা নাকি ঢাকার বাইরে নাই। একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, আপা ওটা মোবাইল ফোন না কি?
আপার বেশ বিজ্ঞের মত জবাব, “হ্যাঁ, তোর দুলাভাই দুবাই যাবার আগে কিনে দিয়ে গেল ৯৫ হাজার টাকায়। লাখ টাকাই দাম, তবে পরিচিত দোকান, তাই পাঁচ হাজার কমেই পেলাম”।
“গ্রামীণফোন না সিটিসেল, আপা”?
“দূর গাধা, কী যা তা বলছিস, এটা অনেক দামী ফোন, গ্রাম সিটি সবখানেই চলে”।
“কিন্তু আপা, এই গ্রামে তো মোবাইলের নেটওয়ার্কই নাই, তাহলে তোমার ফোন চলছে কিভাবে”?
“ওরে উজবুক, তুই কি আমার সঙ্গে আবারও ইয়ার্কি মারিস? তোর দুলাভাই এত টাকা খরচ করে মোবাইল কিনে দিতে পারলো আর নেটওয়ার্ক কিনে দিতে পারবে না? যে ঘোড়া কিনতে পারে সে চাবুকও কিনতে পারবে। গ্রামে নেটওয়ার্ক নাই তো কি হয়েছে? ঢাকা থেকেই নেটওয়ার্ক কিনে দিয়েছে”।
দুবাইওয়ালা বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা, তারা কিনতেও পারে নেটওয়ার্ক। বউকে যারা ভালবাসে তারা আকাশের চাঁদও কিনে দিতে পারে, নেটওয়ার্ক তো মামুলী ব্যাপার।


সিঙ্গাপুর
০৫ই আগস্ট ২০১২


১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×