বোম্বাই শহরের নামটা তখন সবেমাত্র বদল করে মুম্বাই করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণ মুম্বাই বলতে তখনও খুব একটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। আমরা আবার তাঁদের দেশে পরদেশী, আমরা তো বোম্বাই বা ইংরেজি স্টাইলে বম্বে বলতেই পারি। তবে বোম্বাই বলি আর মুম্বাই বলি, আমরা ছোটবেলা থেকেই এই বোম্বাই শব্দটার সাথে পরিচিত। মানে, বোম্বাই লিচু, বোম্বাই আম বা বোম্বাই মরিচ নামগুলো খুব ব্যবহৃত হোত। কোন জিনিষের নামের আগে বোম্বাই থাকলেই তা বিখ্যাত কিছু একটা হয়ে যেত।
তো সেই বোম্বাই থেকে বাড়ি ফিরছি এক বিশেষ ট্রেনিং শেষে। ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস বা তৎকালীন ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ভিটি থেকে ট্রেন, দুই দিন লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে। বিদেশী নাগরিক হওয়ার সুবাদে বিনা ঝামেলায় পেয়ে গেছি এসি বার্থের টিকিট। এ দেশে ট্রেনের টিকিট পাওয়া আর সোনার হরিণ ধরা প্রায় একই ব্যাপার। তবে বিদেশী পাসপোর্ট আর ডলার থাকলে এই সোনার হরিণ যেন ছন্দে ছন্দে হেঁটে এসে হাতে ধরা দেয়। আমার কাছে ও দুটো বস্তু বেশ ভালই ছিল, তাই টিকিট পেতে বেগ পেতে হয়নি। তবে দাদাদের ডলার কামানোর কৌশল দেখলে অবাক হতেই হয়। ট্রেনের টিকিট বেচেও কেমন কড়কড়ে সুগন্ধি ডলারগুলো কামিয়ে নিল। আমাদের রেলমন্ত্রীদের মাথায় কবে যে অমন বুদ্ধি হবে?
সকাল ছ’টায় গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে উঠে আসন খুঁজে নিয়ে বসলাম। বাঙ্গালীর ট্রেন, কলকাতা যাবে, আদর করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের নামে নাম রাখা। এসি বার্থ। আশপাশের যাত্রীদের দিকে এক নজর বুলিয়ে নিলাম, মানে তাদের একটা সার্ভে করে নিলাম আর কি। বেশীর ভাগই বাঙ্গালী যাত্রী। এই কিপটেদের দেশে যারা এমন ব্যয়বহুল কামরায় ভ্রমণ করছে তারা হয় নেহায়েৎ ভাগ্যবান, ভাগ্যবতী বড়লোক নয়তো সরকারী বড়কর্তা গোছের কেউ হবে। মনে মনে একটু মুচকি হাসলাম এই ভেবে যে আমার এইসব সহযাত্রীরা যদি জানতো আমি এদের স্বদেশী তো নইই বরং এমন এক দেশ থেকে এসেছি যে দেশের মানুষকে এরা ফকির মিসকিন ছাড়া আর কিছুই ভাবে না তাহলে এক্ষুনি আমাকে বলতো, নেমে যাও মশাই এই কামরা থেকে, দেখছ না এটা এসি কামরা?
মুম্বাই থাকার সময় দেখেছি হাজার হাজার কি লাখ লাখ মানুষ বস্তিতে মানবেতর ভাবে বাস করে। সে বস্তি রেললাইনের ধারে, রাস্তার ফুটপাথের উপরে আবর্জনার স্তূপে, আর কোথায় নয়? আর হাস্যকর ভাবে এককথায় দাদারা হেঁ হেঁ করে নাক সিটকিয়ে বলে দিচ্ছেন এরা সব নাকি বাংলাদেশ থেকে এসে তাঁদের দেশটাকে একেবারে যাচ্ছেতাই বানিয়ে ফেলল। আমি দাদাদের বলি, দাদারা, তোমরা আবার কবে থেকে দাতা হাতেম তাই অথবা হাজী মহসিন হলে যে এরা বাংলাদেশী জেনেও থাকতে দিচ্ছ তোমাদের দেশে? তোমরা পুশব্যাক না কি যেন করতেই এত ব্যস্ত থাক যে মাঝে মধ্যে নিজের দেশের নাগরিককেও আমাদের দেশে পুশব্যাক করে দাও। তোমরাতো এটুকুও জাননা যে বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশী হয়ে যায় না। যত্তোসব বেকুবের দল!
ট্রেন চলছে সাঁই সাঁই করে উল্কার বেগে। একটু পরেই ডাইনিং কার থেকে এল স্টুয়ার্ড, নাস্তা আর দুপুরের খানার অর্ডার নিতে। একেকজন যাত্রীর সামনে যাচ্ছে আর খাবারের অর্ডারটা নোট বইতে লিখে নিচ্ছে। দুপুরের খাবারের মেনু নেই, শুধু জিজ্ঞেস করছে আমিষ না নিরামিষ খাবেন। মানে নন-ভেজ না ভেজ। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা, কি অর্ডার দিব। দাদারা আমাদেরকে ফকির মিসকিন যাই ভাবুন না কেন আমরা তো বাড়িতে শুধু এক ধরণের তরকারী দিয়ে ভাত খাই না। আমরা এক বেলার সাধারণ খাবারই খাই মাছের দোপেঁয়াজা, সজনে ডাঁটা দিয়ে ছোলার ডাল, পটলের ভাজি, আলু-মুরগির ঝোল, টম্যাটোর সালাদ, আরও কত কি। আমিষ আর নিরামিষ আলাদা করে খাওয়ার কি আছে? তাই আমার সামনে যখন স্টুয়ার্ড ব্যাটা এলো তখন জিজ্ঞাসা করলাম আমিষ আর নিরামিষের আইটেমগুলোর নাম। ব্যাটা একটু অবাক হয়েই মেনু বলল। অবাক হওয়ার কারণ বুঝলাম, আমিই একমাত্র যাত্রী যে কিনা তাকে মেনু জিজ্ঞাসা করেছে। মেনু শুনে অর্ডার দিলাম আমিষ আর নিরামিষ দু’টোই আনতে। স্টুয়ার্ড তো এবার আরও অবাক, সাথে সাথে অবাক আশপাশের যাত্রীরাও। বলে কি? আমিষ নিরামিষ দুটোই কেউ একসাথে খায় নাকি? জাত পাত কিচ্ছু নেই নাকি লোকটার? স্টুয়ার্ড এবার আমাকে বোঝানোর ভঙ্গীতে বলছে, সাহেব, পঁয়তাল্লিশ টাকা খরচ পড়বে কিন্তু। আমি বলি, পড়ুক পঁয়তাল্লিশ টাকা, কুছ পরওয়া নেহি। আমাকে পঁয়তাল্লিশ টাকার ভয় দেখায় ব্যাটা উল্লুক কোথাকার!
নাস্তা আসতে শুরু করেছে। ব্যাগ থেকে নতুন একটা কেয়া লেমন সাবান বের করে টয়লেটের দিকে হাঁটা দিলাম। মুখ হাত ধুয়ে আসনে ফিরে এলাম। সাবানটা বেসিনেই রেখে এসেছি, সাবান রাখার যে গর্তটা রয়েছে বেসিনের উপর, সেখানে। ভেজা পিচ্ছিল সাবান হাতে করে আনার চাইতে ভাবলাম নাস্তা খাওয়ার পর তো আবার হাত ধুতে হবে, কাজেই সাবানটা বেসিনেই থাক।
নাস্তা শেষ করে হাত ধুতে গিয়ে দেখি বেসিনের সামনে বেশ লম্বা লাইন। যাত্রীরা একে একে বেসিনে যাচ্ছেন আর আমার নতুন সাবানটা দিয়ে পরম যত্নে কচলে কচলে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে আসছেন।
এবার হাত ধুচ্ছেন এক শুকনো চিমসে বাঙ্গালী দাদা। ধুতি পাঞ্জাবী পরা, ফর্সা চেহারা, পায়ে চটিজুতা। চোখে গোল রিমের চশমা। কাঁধে ঝুলছে খয়েরী রঙের চাদর। চোখে মুখে বেশ একটা গম্ভীর গম্ভীর আভিজাত্যের ছাপ। বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে। তিনি আমার সাবানটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে ঘষতে ঘষতে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার মত বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের উদ্দেশ্যে – দেখছেন মশাইরা কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার ফল? বিগত নির্বাচনে আপনারা যে সঠিক দলকেই ভোট দিয়েছিলেন তার মোক্ষম প্রমাণ হচ্ছে গিয়ে আমার হাতের এই দামী সুগন্ধী সাবানটা। আঃ, আমাদের এই সরকার রেলের যে কী উন্নতি সাধন করেছেন এই এক বছরে তা অসাধারণ। বিগত কোন সরকারের আমলে দেখেছিলেন মশাই রেলের এমন উন্নয়ন? আগে কখনো ট্রেনে এমন লাক্সারী সাবান দেয়া হত? এখন নিজের চোখে দেখুন এই সরকারের কাজ। পরবর্তী ইলেকশনে আপনারা কাকে ভোট দেবেন সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না।
আমি হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্ড কারখানা দেখছি আর ভাবছি দেশে বিদেশে রাজনীতির একি এক অনন্য অপরূপ রূপ! যেন সব শেয়ালের এক রা!
২৭শে জুলাই ২০১২
১২ই শ্রাবণ ১৪১৯