রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ার পর মনে সাধ জেগেছিল আমিও লিখবো আমার ছেলেবেলা। আমার ছেলেবেলা লেখা তো আর আমার মত লোকের পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয় তাই ভাবছি আমার ফুটবলবেলাটা আগে লিখে নিই, তারপরে আস্তে ধীরে বাকী বেলাগুলোর কথা নাহয় লেখা যাবে।
ছোটবেলায় আমরা যে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে থাকতাম তার এক কোণায় একটা ভাঙ্গা ঘর ছিল, সেই ঘরের ভিতর একদিন অভিযান চালাতে গিয়ে তার ভিতরের ভাঙ্গা খাটটার তলায় একটা ফুটবল কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ফুটবলটা পেয়ে আমিতো আনন্দে আটখানা। বলটার ভিতর বাতাস নেই তবু সেটাকে নিয়ে বাইরে গিয়ে খুব আনন্দে লাথি মারতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি আমাদের পাড়ার বড় ভাই হায়দার ভাই আমাকে ডাকছে; ডেকে বললো, ‘বাঃ সুন্দর বল তো’!
হায়দার ভাই হচ্ছে আমাদের পাড়ার একজন ক্ষুদে সমাজসেবী ধরনের ছেলে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ওস্তাদ। কার হাঁসটা হারিয়ে গেছে, কার ছেলের অসুখ, কে বিপদে পড়েছে, পাড়ার রাস্তায় কোথায় বৃষ্টির পানি জমে আছে – এ সব সমস্যার সমাধান করাই হল হায়দার ভাইয়ের কাজ। তার এ ধরনের পরোপকারী গুণের কারণে পাড়ার সবাই এক নামে তাকে চেনে। আর পাড়ায় যত স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আছে তাদের মহলে হায়দার ভাইয়ের যে একটা বিশেষ খাতির আছে সেটা সেই ছোটবেলাতেও আমি বেশ ভালই বুঝতে পারতাম। হায়দার ভাইয়েরও সাজগোজ আর চালচলন বেশ লেডীকিলার গোছের ছিল, মেয়েদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একেবারে সিনেমার নায়কদের মত এমনভাবে চলতো যে মেয়েরা তো বটেই, ছেলেরা পর্য্যন্ত বেশ খানিকটা তাকিয়ে দেখতো।
তো সেই হায়দার ভাই যখন আমাকে ডাকছে, আমার তখন নিজেকে বেশ খানিকটা বড় মনে হতে লাগলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ আমাকে দেখছে কি না। হায়দার ভাই আমাকে ডাকছে – এ ব্যাপারটা আমার বন্ধুরা জানলে বন্ধুমহলে আমার খাতিরটা যে বেশ বেড়ে যাবে তা কে না জানে, আর আমাদের ক্লাসের বদমাস মেরাজ আমাকে মেরে আমার চুম্বক কেড়ে নেয়ার সাহস ভবিষ্যতে আর কক্ষনো পাবে না।
হায়দার ভাই বলল, ‘আয়, বলটা পাম্প করে আনি সাইকেলের দোকান থেকে। আজ বিকেলে স্কুলের মাঠে ম্যাচ খেলবো তোর বল দিয়ে। তোকে বানাবো গোলকীপার’।
আমিতো খুশীতে আত্মহারা, আমার বল দিয়ে ম্যাচ খেলা হবে, তাও আবার আমি হব গোলকীপার, এত আনন্দ কোথায় রাখি? তবে ব্যাপার হল গোলকীপার জিনিষটা কী সেটা তো জানিনা। খেলার মাঠে গোলকীপার কী করে তাও ঠিক বুঝতে পারছি না। অগত্যা খানিকটা ইতস্ততঃ করে হায়দার ভাইকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, গোলকীপারের কাজটা কী।
হায়দার ভাই খুব বিজ্ঞের মত ঘাড় নেড়ে মাথার লম্বা চুলগুলোকে নাচিয়ে বলল, ‘ তোকে কিচ্ছু করতে হবে না, শুধু গোলপোস্টের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি, ব্যস, তাহলেই গোলকীপার হয়ে গেলি’।
শুনে তো আমার আনন্দ আর ধরেনা। এবার একটু একটু বুঝতে পারছি গোলকীপার কাকে বলে। ফুটবল খেলার মাঠে দেখেছি বটে দুজন ছেলেকে মাঠের দুই প্রান্তে বাঁশের তৈরী দুটো ফ্রেমের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে। তাহলে ঐ ফ্রেমদুটোই গোলপোস্ট, আর তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাই গোলকীপার! কোন কোন গোলপোস্টের পিছন দিকটায় আবার মাছ ধরার জাল টাঙ্গানো থাকে, খেলার সময় যেন পাখিরা বিরক্ত করতে না পারে সেজন্যই বোধহয় জাল টাঙ্গিয়ে রাখে। আমার দাদার বাড়িতে লিচুগাছে অমনি করেই জাল টাঙ্গানো থাকতো বাদুড়ের কবল থেকে লিচু রক্ষা করার জন্য।
তারপর বড়দের মুখে শুনেছি কোন গোলকীপার যেন অনেকগুলো গোল খেয়ে ফেলেছে তাই সবাই খুব বকাবকি করছে। ছেলেটা নিশ্চয় খুব পেটুক হবে, তা না হলে কেউ একা অনেকগুলো গোল খায় ?
দুপুরে বাসায় খাবার সময় বলটাকে পাশেই রাখলাম, পাছে আবার হারিয়ে না যায়। আবুল মেকারের দোকান থেকে পাম্প দেওয়া হয়েছে ওটায়, বেশ সুন্দর লাগছে এখন।
বিকেলে স্কুলের মাঠে বল নিয়ে গেলাম। সেখানে পাড়ার বেশ কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে হায়দার ভাই কী সব বলছে, ব্যাক, হাফব্যাক, সেন্টারফরওয়ার্ড, পেনাল্টি শর্ট, ফাউল, রেফারী, লাইন্সম্যান, কর্নার কিক আরও কি সব, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। আমি মাঠে ঢুকতেই আমার বল নিয়ে সবাই লাথি মারতে শুরু করল। এবার দেখি আমাদের পাশের পাড়ার আরো কিছু ছেলে এসে জুটলো মাঠের ভিতর, তাদের মধ্যে সেই শয়তান মেরাজও আছে। ধীরে ধীরে মাঠের চারপাশটা আশ পাশের পাড়ার ছেলে মেয়েতে ভরে গেল। হায়দার ভাই আমাকে একটা গোলপোস্টের নীচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি, কোথাও যাবিনা একদম’।
ঠিক আছে, ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকবো, নট নড়ন চড়ন।
হায়দার ভাইয়ের বাঁশী বাজলো, আর সাথে সাথে শুরু হল ফুটবল খেলা। পাশের পাড়া বনাম আমাদের পাড়ার ম্যাচ। দর্শকদের হৈ হৈ রৈ রৈ চিৎকারে কান পাতা দায়। সবাই আপন আপন পাড়ার খেলোয়াড়দেরকে উৎসাহ যোগাচ্ছে চিৎকার করে। বল নিয়ে সব খেলোয়াড় দৌড়াতে ব্যস্ত। আমি তো গোলকীপার, কি মজা, আমাকে একটুও দৌড়াতে হচ্ছে না। হাজার হলেও আমিই বলের মালিক, আমি কেন দৌড়াতে যাবো? তবে আমার বিপরীতে যে গোলকীপার খেলছে সে কিন্তু মোটেও দাঁড়িয়ে নেই, সে বেশ লাফালাফি করছে। সে খেলার নিয়ম জানে বলে মনে হচ্ছে না। হায়দার ভাই বারবার বলে দিয়েছে গোলরক্ষককে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে আর সে কিনা গোলরক্ষক হয়েও লাফাচ্ছে বোকার মত।
এবার বলটাকে লাথি মারতে মারতে আমার গোলপোস্টের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে, চিৎকারটা আগের চাইতে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। বল এসে গেছে একেবারে আমার সামনে, সবাই গোল গোল বলে চিৎকার করছে, তারপর বলটা ওপাড়ার এক খেলোয়াড়ের লাথি খেয়ে আমার পাশ দিয়ে গোলপোস্টের ভিতর ঢুকলো। আমি সোজা দাঁড়িয়ে রইলাম, হায়দার ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। চারিদিকে শুধু চিৎকার আর হাততালি। খেয়াল করলাম আমাদের পাশের পাড়ার বেশ কিছু ছেলে আমার নাম ধরে ডাকছে আর আমাকে সাবাস দিচ্ছে। আমি আনন্দে আটখানা হয়ে ভাবছি, বাঃ আমার কী প্রশংসা, আমার খেলা নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছে, নইলে বিরোধী দলে আমার এত নামডাক আর প্রশংসা হচ্ছে কেন? ওপাশের গোলকীপারের তো কেউ নাম করছে না। মনে মনে যখন এই ভাবছি তখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত দেখি ছুটে এলো হায়দার ভাই এবং আমার দলের খেলোয়াড়েরা। আমাকে ঘিরে ধরে চারদিক থেকে গালিগালাজের বন্যা বইয়ে দিল একযোগে। আমিতো হতভম্ব, বুঝতে পারছি না আমকে এত গালি দিচ্ছে কেন আমারই দলের ছেলেরা। যে হায়দার ভাই একটু আগেই আমাকে এত খাতির করে মাঠে নামালো সেই কিনা আমার উপর এত খাপ্পা!
এর মধ্যে কে একজন আমাকে এমন একটা অকথ্য ভাষায় গালি দিল যেটা শুধু ঊর্দু আর হিন্দি ভাষাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। খেলা শেষ হল একসময়। একদিকে নিজ পাড়ার ছেলেদের গালি আর অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রশংসা শুনতে শুনতে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম আর ভাবতে লাগলাম এর পর আর কখনো নিজের পাড়ার দলে খেলবো না, ও পাড়ার ছেলেরা কত ভাল, ওদের দলেই খেলবো এর পর থেকে। বাসায় ফিরে রাগে অপমানে ফুটবলটাকে চাকু দিয়ে ফুটো করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
তারপর কত দিন গেছে বছর গেছে আমার বয়স অনেক হয়েছে কিন্তু আমার আর কোন দলেই খেলা হয়নি। খেলার মাঠে গিয়ে মারামারি রক্তারক্তি দলাদলি দেখে ভয়ে খেলার ধারে কাছেও যাইনি কোনদিন। মাঝেমধ্যে টিভিতে খেলা দেখি বাসায় বসে। গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে পাকিস্তান বনাম ভারতের খেলা দেখছিলাম। এক বিখ্যাত ব্যাটসম্যান প্রতিটি ব্যাট করার সময় দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কী যেন বলছে। কী বলছে সেটা শুনতে না পেলেও ক্লোজআপে তার বলার ভঙ্গিটা এবং ঠোঁট নাড়ানো যখন দেখলাম তখন আমার সেই ছোটবেলার ফুটবল ম্যাচের গালির কথা মনে পড়ে গেল। আরে, এ যে সেই ঊর্দু হিন্দি গালিটাই দিচ্ছে!