রামপাল প্রকল্পের জন্য বাগেরহাটে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে অনেক পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বালু ভরাটের মাধ্যমে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হয়েছে । আর এ 'দু'টো হলোঃ
১। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পিডিবি এবং
২। ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন, এনটিপিসি।
এই প্রকল্প হবে বাংলাদেশের পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মাত্র ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটারের মধ্যেই যদিও এর মধ্যে সরকারিভাবে দাবি হচ্ছে যে এটি সুন্দরবনের বাফারজোনের ১৪ কিলোমিটার দূরে হচ্ছে, যা সুন্দরবনের বনাঞ্চল, পরিবেশ এবং জীবসম্পদের জন্য মারাক্তক ভাবে বিপদজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের টিকে থাকাও আশংকাজনক। আর সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই প্রকল্প হবে কয়লাভিত্তিক যার নির্মাণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরুৎসাহিত করা হয় অথবা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইনও । যেহেতু এটি পরিবেশবান্ধব না । মানুষ এবং জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর। যেমনঃ কানাডা এবং ফ্রান্সে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন প্রমাণ করতে হবে যে এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় আর যদি যথেষ্ট পরিমান ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে তা অনুমোদিত হবে না এবং জনমত।
প্রথমে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কোনও প্রকার পরিবেশ বিপর্যয় বিষয়ক যাচাই এবং গবেষণা না করে সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে সরকারি সমীক্ষাতেই দেখা যায় যে এটি পরিবেশ ক্ষতিকারক এবং বিশেষ করে সুন্দরবনের সংরক্ষিত জীববৈচিত্র্যের জন্য আরো মারাক্তক ক্ষতিকর হবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি হবে বিভিন্ন দেশ থেকে আর যেহেতু সুন্দরবন সংলগ্ন নদীপথ জাহাজ চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয় এই কয়লা ছোট ছোট নৌকা এবং লঞ্চের মাধ্যমে বহন করে নিয়ে আসতে হবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পযন্ত ।
আর এই মালামাল ওঠানামা এবং চলাচলে রয়েছে ময়লা পানি ও পরিবেশে নিঃসৃত হওয়ার সম্পূর্ণ ঝুঁকি। আর তার ফলে আবর্জনা তেল, জাহাজ,লঞ্চ,নৌকা চলাচলে জলদূষণ ইত্যাদিতে সুন্দরবন এবং সংলগ্ন পরিবেশের জল ও বায়ু দূষণ। শুধু তাই না, এই চলাচলে সৃষ্ট ঢেউয়ে প্লাবিত হবে আশপাশের জমি এবং ক্ষয় হবে সুন্দরবনের ভূমি যা সুন্দরবনের গাছগাছালির জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। তাছাড়াও রয়েছে নির্মাণকাজ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর ফলে সৃষ্ট শব্দ দূষণ ও আলো দূষণ যা সুন্দরবন এবং এর আশপাশের জনপদের মানুষ ও প্রাণীদের জীবনচক্রে বিশেষ ক্ষতিকর প্রভাব ।শুধু সুন্দরবনই না বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের মানুষ এবং জনপদের জন্য ব্যাপারটি বেশ ক্ষতিকর হবে। ইতিমধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে যে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের পাশে বসবাসকারী মানুষজন দীর্ঘমেয়াদে ৩ বা ৬ গুণ বেশি আক্রান্ত হন ক্যানসার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এভং নিউরোডিজেনারিটিভ স্নায়ুরোগে । আর যেহেতু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট বায়ু এবং জল দূষণ মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। অবশ্য এর মধ্যে সরকার বলছেন যে এই প্রকল্পের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে অথচ এই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে যারা এখন ভূমি এবং কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এইসব এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা হচ্ছে মাছ আহরণ, সুন্দরবন থেকে গাছগাছালি মধু ইত্যাদি আহরণ এবং কৃষিকাজ । বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট দূষণে দীর্ঘমেয়াদে যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবন বিনষ্ট হবে তখন আরো অধিক মানুষ ভূমি এবং জীবিকাহীন হয়ে পড়বে। এর অর্থ যা দাঁড়ালো তা হল অল্প কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের বিনিময়ে নষ্ট হচ্ছে হাজার মানুষের জীবন এবং জীবিকা।অতএব উপরক্ত হিসাব থেকেই বুঝা যাচ্ছে যে এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য কোন ভাবেই লাভজনক কিছু না। ধারণা করা হচ্ছে যে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম হবে স্বাভাবিক বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি অর্থাৎ পিডিবিকে লোকসানজনক ভর্তুকি দিতে হবে অথবা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তাছাড়াও রয়েছে এই প্রকল্পের জন্য গৃহীত ঋণ এবং তার সুদের হারের লোকসান।এনটিপিসি যদি এই প্রকল্প ভারতের অংশের সুন্দরবনের আশপাশে করতে চাইতো তবে অনুমতি পেতো না।
ভারতীয় আইন মতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং জনবসতির ১৫থেকে ২৫ কিলোমিটারের ভিতরে এই ধরনের প্রকল্পের অনুমোদন নেই। তবে এনটিপিসি কেন বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে এসে ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটার মধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহী।উল্লেখ্য আছে ভারতের মধ্যপ্রদেশে এই এনটিপিসি আরেকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন পায়নি। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশিরা নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি। তাজমহলের সৌন্দর্যহানি যেন না হয় পরিবেশ দূষণের কারণে যেজন্য ভারতীয় সরকার এর আশপাশের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ধরনের বিশাল কারখানা যা পরিবেশ দূষণ করতে পারে এবং বিমানবন্দর স্থাপন কিংবা বিশাল প্রকল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করেছে।অথচ আমাদের দেশে সুন্দরবন সংরক্ষণে এমন আইন তো নেই বরং আমরা উঠেপড়ে লেগেছি সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে । কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অন্যান্য ধরনের যেকোনও ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে পরিবেশে। তাছাড়া রয়েছে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, লেড, ছাই ইত্যাদি গ্যাস এবং ভারী ধাতুর পরিবেশে নির্গমন, ফলে এসিড বৃষ্টি অবধারিত, আর তার ফলে অনায়সে ধসে পড়বে সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছগাছালি এবং প্রাণীদের জীবনচক্র, যেহেতু তাদের খাদ্য ও বায়ু বিষাক্ত হয়ে পড়বে। মানুষের জন্যও এই প্রভাব একই ভাবে কাজ করবে।সর্বোপরি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশ, বিশেষ করে সুন্দরবন ও সংলগ্ন মানুষ, জনপদ ও বনাঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর এবং ভৌগলিকভাবে বেমানান ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক একটি বিদুৎ প্রকল্প।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১৫