মনে করুন, একটি উপস্থি্ত বক্তৃতার প্রতিযোগী আপনি। আপনার ভাগ্যে টপিক উঠলো "নির্বাক চলচ্চিত্র", আর আপনাকে এ নিয়ে ৫ মিনিট বলতে হবে,আর ভাববার জন্য সময় দেয়া হলো ১ মিনিট। কি ভাববেন ঐ সময় ? হুমমম, নির্বাক চলচ্চিত্র মানেই চার্লি চ্যাপলিন।আর? তখুনি চার্লি চ্যাপলিনের পর আপনার সামনে আরেকজনের নাম ভেসে উঠবে, আর সেই মানুষটিই হলেন বাস্টার কিটন। সাইলেন্ট ফিল্ম জগতের এক অনন্য প্রবাদপুরুষ।
সাইলেন্ট যুগের যে কয়জন বিখ্যাত কমেডিয়ান ছিলেন, তাদের মধ্যে আলাদা করে তিনজনের নাম বলতে হয়,যাদের কীর্তি মানুষ আজও মনে রেখেছে ।তারা হলেন চালি চ্যাপলিন, হ্যারল্ড লয়েড আর আরেকজন বাস্টার কিটন। অথচ তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে অসফল হয়েছিলেন এই বাস্টার কিটন।তবে অনেক ক্রিটিকদের মতে, দারুন সব হিউমার আর অসাধারন সিগনেচার স্টাইলের জন্য বাস্টার কিটন চ্যাপলিনের থেকেও এগিয়ে ছিলেন।
কমেডির একটা মজার ব্যাপার আছে আর তা হলো কমেডিকে একটা নির্দিষ্ট টাইমফ্রেমের মাঝে বাঁধা যায় না, কমেডি একটা টাইমলেস জিনিস।২০ বছর বছর আগেও যা ফানি ছিলো তা ৫০ বছর পরেও ফানি লাগে।কমেডিগুলোর সেই দৃশ্যগুলোতে মানুষ নিজেকে কোনো না কোনো এক জায়গায় আবিষ্কার করে, হয়তো সেখানে চারপাশের দৃশ্যপটটা একটু পাল্টায়, এই যা !!
বাস্টার কিটনের সিগনেচার স্টাইলের ব্যাপারে বলছিলাম। একটা জিনিসের কথা না বললেই নয়, আর সেটা হলো তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান। তাকে বলা হতো "দ্যা গ্রেট স্টোন ফেস", কারন তার ট্রেডমার্ক ফিজিক্যাল কমেডি হলেও সেখানে তার মুখের এক্সপ্রেশান তেমন একটা বদলাতো না, সকল দৃশ্যেই তার মুখের অভিব্যক্তিগুলো কেমন জানি একই রকম কঠিন এবং পাথুরে দেখাতো।কিন্তু সেই নো রিঅ্যাকশান চেহারা থেকে কমেডি গুলো এতোটাই চমৎকার আর অর্থবহ হয়ে ফুটে উঠতো যে তাকে নিয়ে বলা হতো, "Keaton just didn't need to smile or laugh - that was the audience's job."
এইবার বাস্টার কিটন সম্পর্কে কিছু জেনারেল ইনফো দেই।১৮৯৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর আমেরিকার ক্যানসাস রাজ্যের পিকুয়াতে জন্মগ্রহন করেন তিনি।তার পুরো নাম ছিলো Joseph Frank Keaton, বাস্টার কিটন ছিলো তার স্টেজ নেম।তবে এই বাস্টার নামের পিছনে একটা মজার তথ্য জানাই, যদিও এইটার সত্যটা কতোটুকু জানা নেই। কিটনের বয়স যখন ৪ বছর তখন নাকি গ্রেট ম্যাজিশিয়ান হ্যারি হুডিনি তাকে এই নিকনেমটি দিয়েছিলেন।
বাস্টার কিটন প্রফেশনাল লাইফে শুধুমাত্র একজন কমিক অ্যাক্টরই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একাধারে একজন ফিল্ম মেকার, প্রোডিউসার এবং রাইটার।
বাস্টার কিটনের ফুল লেংথ ফিচারড ফিল্মগুলোর মধ্যে Our Hospitality (1923), The Navigator (1924), Sherlock Jr. (1924), Seven Chances (1925), The Cameraman (1928), and The General (1927) উল্লেখযোগ্য।বিশেষ করে Sherlock Jr. (1924) এবং The General (1927) এর কথা বলতেই হয়।
The General (1927) মুভিটি যখন মুক্তি পায় তখন আমেরিকায় চলছে সিভিল ওয়ার, মুভিটির প্লটও আবর্তিত হয়েছিলো একটি অ্যাকচুয়েল ওয়ারটাইম ইনসিডেন্টকে কেন্দ্র করে।স্বয়ং বাস্টার কিটন এই মুভিটিকে নিজের প্রাউডেস্ট অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে মনে করলেও মুক্তির পর এটি সবার কাছ থেকে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া পায়।কারো কারো মতে, একটি নিছক কমেডি ঘরানার মুভিতে শুধু শুধুই এতোটা ড্রামাটিক করবার কি দরকার ছিলো? আবার অনেকে সিভিল ওয়ারকে নিয়ে একটি কমেডি মুভি বানানোয় কিটনের বিচক্ষণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এইরকম একটি ব্যায়বহুল মুভির এমন ফিডব্যাকের পর কিটনের মুভি মেকিংয়ের উপর পুরোপুরি কর্তৃত্বের ক্ষমতা কিছুটা বিলোপ পায়। তার ডিস্ট্রিবিউটর ইউনাইটেড আর্টিস্ট তার মুভির ব্যয় এবং স্টোরি এলিমেন্টের তদারকির জন্য একজন প্রডাকশান ম্যানেজার নিয়োগ করেন।এরপর সেই ফরম্যাটে বাস্টার কিটন আরো দুইটি মুভি বের করেন।এরপর তিনি হলিউডের সবচেয়ে বৃহৎ স্টুডিও Metro-Goldwyn-Mayer (MGM) এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।এরই মধ্যে হলিউডে চলে আসে সবাক মুভি। সবাক মুভির আগমন, নিজের মুভি মেকিংয়ের উপর কর্তৃত্বের ক্ষমতা লোপ আর সেইসাথে কিছু ব্যাক্তিগত সমস্যা (মাত্রারিক্ত মদ্যপান এবং অন্যান্য )---সবমিলিয়ে বাস্টার কিটনের গোটা ক্যারিয়ারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং বাস্টার কিটন নিজেই তা স্বীকার করেছেন, তার মতে MGM এর সাথে চুক্তির পরের সময়টুকু তার জীবনের সবচেয়ে বাজে অধ্যায় ছিলো যা তার ক্যারিয়ারকে ভীষন ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো।
MGM এর সাথে তার যে বিবাদটি শুরু হয়, তার মূলে ছিলো বাস্টার কিটন যেভাবে চাইতেন MGM নাকি তার কোনো কথাই তেমন শুনতে চাইতো না, যেমন অনেক দৃশ্যে MGM চাইতো কিটনের বিপদজনক দৃশ্যগুলো্তে স্টান্ট ডাবল ব্যবহার করা হবে যেটা কিটন খুবই অপছন্দ করতেন।তবে এইটা ভেবে নেয়াটা একেবারেই বোকামি হবে যে, সবাক যুগে কিটন একেবারেই ফ্লপ খেয়েছিলেন। সেই MGM এর আন্ডারেই কিটন আমাদের উপহার দিয়েছেন অনেক নান্দনিক আর ব্যাবসাসফল মুভি, যার মধ্যে রয়েছে The Passionate Plumber, Speak Easily,What! No Beer? ইত্যাদি। তবে এরমাঝেই ক্ষোভ কিংবা অভিমান কিংবা MGM এর চাপে যাই হোক না কেন ততোদিনে পরিচালনা একেবারেই ছেড়ে দেন বাস্টার কিটন। MGM এর সাথে তার ভয়াবহ ঝামেলা বাধে ১৯৩৩ সালে, What! No Beer? মুভিতে কাজ করার সময়, তখন ভীষনরকম মনোমালিন্যের পর মুভিটি রিলিজের পর MGM থেকে বহিষ্কার হন কিটন।
MGM এর তিক্ত ঘটনার পর কিটন কিছুদিন ইউরোপে গিয়ে দুইটি মুভি বের করেন,এরপর Educational Pictures, Columbia Pictures এবং টেলিভিশন মিডিয়াতে অনেক উল্লেখযোগ্য এবং এপিক কিছু কাজ করেছেন।মাঝখানে সেই MGM এ রাইটার এবং এডভাইজার হিসেবে বেশ কয়েকটি মুভিতেও ছিলেন।
প্রফেশনাল লাইফে বেশ কয়েকটি পুরষ্কার আর সম্মানে ভূষিত হন তিনি।হলিউডের ওয়াক অফ ফেম তালিকায় দুইবার তার নাম রয়েছে, 6619 নাম্বারে মোশন পিকচার এবং 6321 নাম্বারে টেলিভিশানে অনবদ্য ভূমিকার জন্য তিনি এই সম্মানে ভূষিত হন।Entertainment Weekly তাকে নির্বাচিত করেছে One of the 7th Greatest Director of all time দের একজন হিসেবে।এছাড়া তিনি American Film Institute এর The 50 Greatest Screen Legends তালিকায় ২১ তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬০ সালে কমেডিতে বিশাল অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ একাডেমি তাকে বিশেষ সম্মাননাসূচক অস্কার প্রদান করে।
একটা মন খারাপ করা ইনফো দেই, আগেই বলেছি সাইলেন্ট এজের কমেডিয়ান হিসেবে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন Charlie Chaplin, Harold Lloyd আর এই বাস্টার কিটন।এদের প্রত্যেকেই নিজেদের ফিল্ম প্রোডিউস করা থেকে শুরু করে স্ক্রিপ্ট ও পরিচালনা ---পুরোটাই নিজেরা কন্ট্রোল করতেন।কিন্তু শুধুমাত্র কিটন তার স্টুডিও এবং ফিল্মগুলো MGM এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন যেখানে চ্যাপলিন আর লয়েড উভয়েই তাদের ফিল্মের মালিকানা নিজেদের কাছেই রেখেছিলেন। ফলাফল, চ্যাপলিন আর লয়েড সময়ের আবর্তনে বিশাল টাকা-পয়সার মালিক হন আর কিটন অর্থনৈতিক আর ব্যাক্তিগত সমস্যায় ক্রমশই জড়িয়ে পড়েন।
আজ সেই গ্রেট কমেডিয়ানের ৪৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী।১৯৬৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি উডল্যান্ড হিলস, ক্যালিফোর্নিয়াতে ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান তিনি। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্র্দ্ধা। আজ এতো বছর ধরে জেনারেশান আফটার জেনারেশান আমাদের হাসিয়েই যাচ্ছেন সেলুলয়েডের পাতার সেই বাস্টার কিটন। তিনি আজ নেই, অথচ তার সেই মহান কাজগুলোই তাকে অমরত্ব এনে দিয়েছে।আগামী ২০৫০ সালেও কোনো এক কিশোর তার মুভি দেখে বজ্রপাতের চেয়েও বেশি জোরে হেসে উঠবে আর বলবে, তোমায় স্যালুট বাস্টার কিটন, তোমায় রেড স্যালুট।
আজ আর নয়, এই পোস্টে তার জীবন নিয়ে একটু আলোকপাত করলাম, সামনের কোনো এক পোস্টে তার কিছু ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করবো।
BUSTER KEATON WALK OF FAME (HOLLYWOOD):