ছবি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের উপর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ।
ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি গত সোমবার ঢাকার মোহাম্মদপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের জেনেভা ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং নানান মন্তব্য করেন। জানা যায়, ক্যাম্প পরিদর্শনের পর মরিয়ার্টি সাংবাদিকদের বলেন, "এই উর্দুভাষীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার হাইকোর্টের রায়ের পর কী ঘটেছে তা দেখার জন্য আমি এখানে এসেছি।" তিনি আরো বলেন, "বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী উর্দুভাষী বিহারীদেরও বাঙালিদের মতো সমঅধিকার পাওয়া উচিত।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
কাউকে কোনো বিষয় সম্পর্কে পরামর্শ দেবার আগে নিজে তা করি কিনা সে সম্পর্কে চিন্তা করে নেয়া উচিত। মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন ঢাকাতে দাঁড়িয়ে আড়াই লক্ষ বিহারীদের সুযোগ সুবিধা ও অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, ঠিক সে মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ অবৈধভাবে বসবাসকারী (অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট) মানুষ ন্যুনতম নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।
মারিয়ার্টির নিশ্চয়ই জানা আছে, তার সরকারের নীতির কারণে তার নিজের দেশের অবৈধ ইমিগ্র্যান্টরা বঞ্চিত ও অমানবেতর অবস্থায় বসবাস করে। এমনকি সব মার্কিনদের উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য ওবামার প্রস্তাবিত বিলেও এই এক কোটির বেশী মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকার করা হয়েছে। অবৈধদের সেদেশে শুধু বিনা চিকিৎসাতেই মরতে হয় তা নয়, অবৈধ ইমিগ্র্যান্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বঞ্চিত হয় কাজের সুযোগ সহ অন্যান্য আইনগত ও অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা থেকে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক প্রতি বছর হাজার হাজার ইমিগ্র্যান্টকে জোরপূর্বক বিদেশে ফেরত পাঠানোর কঠোর সমালোচনা করে থাকে। বিভিন্ন রিপোর্টে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনের কঠোর নিন্দা করে থাকে। এ আইনের সুযোগে নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও কোনো ব্যক্তিকে সামান্য অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ বছরের মার্চে প্রকাশিত এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, বৈধভাবে বহু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার পরও সামান্য অপরাধে সাজা ভোগ করার পর তাদের বিদেশে ফেরত পাঠানো হয়। সামান্য এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে ট্রাফিক অফেন্স ও শপ লিফটিং।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি ৯১ হাজার মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাশ হওয়ার পর থেকে এ অবস্থা সবচেয়ে বেশী খারাপ হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী মোট ৬ লাখ ৭২ হাজারেরও বেশী মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি ডিরেক্টর অ্যালিসন পার্কার এক রিপোর্টে বলেন, এদের (জোরপূর্বক বিদেশে ফেরত পাঠানো) মধ্যে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশক ধরে বৈধভাবে বসবাস করছেন। অনেকেই সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য ও ছোট বাচ্চা আছে যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। অনেককেই তাদের স্ত্রী, সন্তান কিংবা বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়, জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, পরিবারের একজনকে এভাবে বিদেশে ফেরত পাঠানোর ফলে পরিবারগুলো মারাত্মক সমস্যায় পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারগুলো ভেঙ্গে যায়।
বিহারীদের পরিচয়
জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী বিহারী মাত্রই একথা স্বীকার করে যে, তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও এই বিহারীরা অনেক বাঙালিকে হত্যা করে। যদিও সেসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশে নিহত ৩০ লক্ষ মানুষের একটা বিরাট অংশকেই হত্যা করেছিল এরা। ১৯৭১ সালের সময়কার গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের নানা সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণমূলক বই থেকে সে সময়কার বিহারীদের ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে ওঠে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারিয়ার্টির হয়তো জানা নেই, বিহারীরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং তার আগে ও পরে এ দেশের অধিবাসীদের কিভাবে কচুকাটা করেছিল। অসংখ্য লুটপাট, হত্যা ও ধর্ষণের জন্য তারা অভিযুক্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা এ চক্রের অন্যতম কীর্তি। শুধু অস্ত্র হাতে নিতে সক্ষম টগবগে যুবকদেরকেই তারা হত্যা করেছে তা নয়। কবী ও লেখক, শিক্ষক, চলচ্চিত্রকার কিংবা সাংবাদিক কেউই তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। দেশের নীতি নির্ধারণে সক্ষম হাজার হাজার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের তারা হত্যা করেছে। সেসব হত্যাকাণ্ডে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের নেতৃত্বকে মেধাশূন্য করে ফেলা।
অনেকেই মনে করেন, স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্টী তাদের সে চক্রান্তে পুরোপুরি সফল হয়েছে। কারণ সেসব হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা এ দেশ এখনো সামলে উঠতে পারেনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসা দেশের অচলাবস্থা, নানান রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, দেশ পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণে ন্যূনতম পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বুদ্ধির শূন্যস্থানকেই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশে বিহারীদের আইনগত ভিত্তি
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারিয়ার্টির নিশ্চয়ই জানা আছে, বাংলাদেশ থেকে এসব হত্যাকারী, ধর্ষণকারী ও নির্যাতনকারীদের বের করে দেয়া হয়নি। তাদের থাকতে দেয়া হচ্ছে কয়েকটা ক্যাম্পে। তবে তাদের এ ক্যাম্পগুলোতে থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিহারীরা ইচ্ছে করলেই ক্যাম্পের বাইরে থাকতে পারে। তাদের কাজের ক্ষেত্রেও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত একথা শোনা যায়নি যে, বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে এদেশে চাকরি পেতে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে কোনো বিহারীর বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়েছে। বিহারী ক্যাম্পে গিয়ে তার উত্তর পাশের জমজমাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখলেই যে কারো এ সন্দেহ দূর হবে।
তবে অতীতে বিহারীরা কাগজে কলমে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছিল না। এ কারণে তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের দাবি জানিয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে।
বাংলাদেশের হাইকোর্ট এ সমস্যার একটা সমাধান দেয় গত বছরের ১৮ই মে। হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশের ১১৬ টি ক্যাম্পে বসবাসরত ১ লাখ ৬০ হাজার উর্দুভাষী 'আটকেপড়া পাকিস্তানীর' মধ্যে যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নাবালক ছিল বা এর পরে জন্ম নিয়েছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক বলে রায় দেয়। আইন অনুযায়ী তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিসহ নাগরিক সুবিধা পাওয়ার যোগ্য বলেও অভিমত দেয় আদালত। ওই রায়ের পর এসব ক্যাম্পে বসবাসরত অধিকাংশ উর্দুভাষী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
মরিয়ার্টির পরামর্শ ও বাস্তবতা
মরিয়ার্টির মন্তব্যগুলো পড়লে একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে বিহারীদের জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি বলেছেন, "আমি মনে করি বাংলাদেশের একটি সংবিধান রয়েছে এবং তাতে খুব স্পষ্ট করেই বলা আছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিচারে এদেশের সব নাগরিক সমান অধিকার পাবে। এসব উর্দুভাষী তাদের নাগরিক। তারা সরকারেরই নাগরিক"। এ বিষয়টি উর্দুভাষী বিহারী ও বাংলাদেশ সরকারের নিষ্পত্তি করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের চিকিৎসা কিংবা কাজ করতে যেমন বাধা দেয়া হয় বাংলাদেশের বিহারীদের ক্ষেত্রে তেমন বাধা নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিসংখ্যানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপোর্ট করা বা বের করে দেয়া বৈধ ও অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ও তাদের ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারে যেমন দুঃখজনক ব্যাপার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখা যায় এদেশের বিহারীদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যাপার দেখা যায় না।
বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বিহারী বলে চিকিৎসা করতে দেয়া হয়না কিংবা কোনো স্কুলে তাদের বাচ্চাদের ভর্তি করা হয়না এমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়না। দেশের যে কোনো স্থানে তারা কাজ করতে পারে। ঢাকার বেশ কয়েকটা রুটের বাসে বিহারী ড্রাইভার, হেলপারের আধিপত্য দেখা যায়। এ নিয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে তেমনটা শোনা যায়নি।
একথা সত্যি যে, বিহারীদের বসবাসকারী ক্যাম্পগুলোতে তারা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় গাদাগাদি করে থাকে। তবে তাদের এ দুর্দশার কারণ সরকারের কোনো আইন নয়। নদী ভাঙ্গন কিংবা প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগের শিকার হয়ে ঢাকা শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশের নাগরিকদের অবস্থা বিহারীদের চেয়ে বহু গুণে খারাপ।
শেষ কথা
বাংলাদেশের বিহারীদের যেহেতু সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে তাই এ নিয়ে মরিয়ার্টির চিন্তিত হবার তেমন কোনো কারণ দেখা যায় না। মানবাধিকার সমুন্নত করার উদ্দেশ্য থাকলে মরিয়ার্টির নিজ দেশের আইন দ্বারা বঞ্চিত প্রায় সোয়া এক কোটি অবৈধ মানুষের পাশে দাড়ানোই ভাল। আর যদি উদ্দেশ্য থাকে গরীব ও অভাবী মানুষদের পক্ষে কাজ করার, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিস্বরণের ফলে সৃষ্ট গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে দ্রুত বর্ধনশীল প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাড়ানোই সমীচিন। ঢাকা শহরের বস্তিবাসীদের বিরাট অংশ নদী ভাঙ্গন কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে স্থানচ্যুত হয়েছে এবং বর্তমানে ঢাকার বস্তিগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, জেনেভা ক্যাম্পের আটকে পড়া পাকিস্তানীদের চেয়েও তাদের অবস্থা অনেক খারাপ।
তথ্যসূত্র:
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (http://www.hrw.org), বিডিনিউজ (http://www.bdnews24.com/bangla), উইকিপিডিয়া (http://www.wikipedia.org)
আরো বিস্তারিত দেখুন......
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://www.hrw.org/node/82173
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১০ রাত ১:৪৯