আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থা
আমেরিকা ও ব্রিটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা মূলত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিনির্ভর। যারা স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স করে রাখে তারা চিকিৎসা সুবিধা পায়, অন্যরা পায় না। জানা যায়, প্রতি বছর কয়েক কোটি আমেরিকান স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স করে না। যেসব আমেরিকান নাগরিক চিকিৎসা ইন্স্যুরেন্স করে না তাদের অনেককেই জরুরি চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়। অনেকে চিকিৎসার টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে।
মাইকেল মুরের বিখ্যাত ডকুমেন্টারি মুভি সিকোর কথা অনেকের মনে থাকতে পারে। মাইকেল মুর আমেরিকানদের চিকিৎসাসেবা বিষয়ে একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা। এমনকি নাইন-ইলেভেনে টাওয়ারগুলো ধসে পড়ার পর সেখানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে যেসব দমকলকর্মী আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসাও অর্থাভাবে হচ্ছিল না।
ব্রিটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা
অন্যদিকে ব্রিটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত। এর পরিচালনায় আছে ব্রিটেনের ৬ দশকের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস। ব্রিটিশরা যে বছর ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তার পরের বছরই, ১৯৪৮ সালের ৫ জুলাই প্রত্যেক ব্রিটিশ নাগরিকের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবশ্য ব্রিটেনে আসা বিদেশিরাও এ স্বাস্থ্য সুবিধার সুফল পান।
মাইকেল মুরের ডকুমেন্টারি সিকোর এক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার খবর নেওয়ার জন্য ব্রিটেনের হাসপাতালে চিকিৎসা খরচের খোঁজ নেওয়া হয়। এনএইচএস হাসাপাতালে এসে টাকা দেওয়ার জন্য কোনো কাউন্টার খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ব্রিটিশরাও চিকিৎসার বিনিময়ে খরচ কত হলো, এমন প্রশ্ন শুনে হাসাহাসি করে। পরে অবশ্য তিনি একটি ক্যাশিয়ারের কাউন্টার খুঁজে পান, যেখান থেকে শুধু টাকা বাইরে দেওয়া হয়; কিন্তু ভেতরে নেওয়া হয় না। সেখানে জিজ্ঞেসা করে তিনি জানতে পারেন এনএইচএস হাসপাতালগুলোতে রোগীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, এজন্য কোনো কাউন্টারও রাখা হয়নি। কারণ ব্র্রিটেনের সরকারি এনএইচএসের হাসপাতালগুলোর সব সেবাই সাধারণ মানুষের জন্য ফ্রি (ব্যতিক্রম দাঁত ও চোখ)।
ব্রিটিশ এনএইচএসের হাসপাতালগুলো যথেষ্ট উন্নত। সারা ব্রিটেনে ছড়িয়ে থাকা হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার দ্বার সবার জন্যই খোলা। ভর্তির সময় কখনোই রোগীর আর্থিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। কারণ এনএইচএসের চিকিৎসায় টাকা-পয়সার বিনিময় হয় না। বহু বাংলাদেশি ছাত্র কিডনিসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা এখানে বিনামূল্যেই পেয়েছেন। বিভিন্ন কারণে ব্রিটেনে অবস্থানকারী বহু বাংলাদেশি মা তাদের সন্তান জন্মদানকর্ম এ হাসপাতালগুলোতে নিরাপদে ও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করতে পেরেছেন। আমিসহ আমার বহু বন্ধু প্রায়ই এ হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিতে পারছি।
সোয়াইন ফ্লু বিষয়ে এনএইচএসের তৈরি বাংলা নির্দেশিকা
ওবামার প্রস্তাব
আমেরিকানদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বনাম ব্রিটেনের সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে উন্নত স্বাস্থ্য সুবিধা-এ দুই ধারার উদাহরণ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ব্রিটিশ স্বাস্থ্যসেবাই হয়তো বেশি আকর্ষণ করেছে। এজন্যই এনএইচএস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব আমেরিকানের জন্য সমানমানের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আসার জন্য ওবামা সম্প্রতি আলোচনা শুরু করেছেন। ওবামা প্রস্তাব দিয়েছেন আমেরিকার চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের জন্য এনএইচএসের মতো করে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে এক দশকে প্রায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
ওবামার প্রস্তাবের বিরোধিতা
ওবামাবিরোধী রাজনৈতিক ও ডানপন্থিরা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন বেশ জোরেশোরেই। তারা এ 'হেলথ কেয়ারের' সমালোচনা করে একে বলছেন 'ওবামা কেয়ার'। জানা যায়, এ বিরোধিতায় অন্যতম ইন্ধন জোগাচ্ছে আমেরিকার চিকিৎসা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো। যারা এতদিন ধরে চলে আসা ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত। এ উদ্দেশ্যে বিরোধী আমেরিকানরা এনএইচএসের বিরোধিতা করে নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এনএইচএসে চিকিৎসা হয় না, খরচ কমানোর জন্য বুড়ো ও প্রতিবন্ধীদের বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলা হয় ইত্যাদি কথাও বলছেন অনেকে।
অন্যদিকে যেসব মার্কিন নাগরিক ইন্স্যুরেন্স করে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন তাদের অনেকে ওবামার এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করছেন। তারা ভয় পাচ্ছেন, গরিব আমেরিকানদের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার জন্য তাদের ইন্স্যুরেন্স খরচ বেড়ে যেতে পারে।
এনএইচএস নিয়ে বিতর্ক
ওবামার নতুন স্বাস্থ্য পরিকল্পনা যেহেতু ব্রিটিশ এনএইচএস অনুসরণ করে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাই বিরোধীরা সরাসরি এনএইচএসের নানা বিরোধিতা করছেন। আর এনএইচএসের বিরোধিতা করা বক্তব্যগুলো ব্রিটিশ এনএইচএসের কর্তাব্যক্তিদের কানে এসে পেঁৗছেছে। এ কারণে তারাও এনএইচএসবিরোধী সেসব যুক্তি খণ্ডন করতে লেগে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পাবলিক হেলথ ফ্যাকাল্টির প্রেসিডেন্ট ড. অ্যালান ম্যারিওন ডেভিস বলেন, 'এনএইচএস অত্যন্ত ভালো কাজ করে, যা বলা হচ্ছে ওসব অত্যন্ত বাজে কথা।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আমেরিকার তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির কম অংশ খরচ করি; কিন্তু বিভিন্ন স্বাস্থ্য সূচকে যেমন গড়আয়ুর দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছি।'
তবে এ কথা সত্য যে, ব্রিটিশদের হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়। ডাক্তার স্বল্পতা এর অন্যতম কারণ। বর্তমানে ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্রিটিশ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমেরিকানদের এ হার অনেক কম।
ড. ম্যারিয়ন ডেভিস স্বীকার করেন, আমেরিকার ধনীদের জন্য স্বাস্থ্যসুবিধা ব্রিটেনের চেয়ে ভালো এবং দ্রুত। কিন্তু তিনি জানান, অধিকাংশ রোগীরই তা প্রয়োজন হয় না। একজন বিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ক্যারল সিকোরা জানান, ব্রিটেনের মানদণ্ড অনুযায়ী আমেরিকানরা অতিরিক্ত চিকিৎসা পান। কিন্তু তিনি বলেন, আমেরিকার বহু মানুষ কোনো ধরনের চিকিৎসা পায় না, এটি সত্যিই একটি সামাজিক অপরাধ।
ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া
এনএইচএস বিষোদ্গারের জবাবে সাধারণ ব্রিটিশরা বিভিন্ন ব্লগে এনএইচএসের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করছেন। অনলাইন সাইট টুইটারের ব্লগাররা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন। দাদের উই লাভ দি এনএইচএস এ বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার। একজন ব্লগার লিখেছেন, 'আমি আমাদের হেলথ সার্ভিস নিয়ে গর্বিত। এটি গত একশ' বছরে আমাদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।'
অনেকে আবার এনএইচএস থেকে কী ধরনের সুবিধা পেয়েছেন তা বর্ণনা করছেন। যেমন_ 'আমার বাবা গত বছর এনএইচএস থেকে হার্ট সার্জারি করে জীবন রক্ষা করেছেন'-বলছেন ক্লেয়ার থম্পসন নামে এক ব্লগার। অধিকাংশ ব্লগারের লেখাতেই ব্রিটিশদের এনএইচএস সম্পর্কে গর্ব করতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞানী প্রফেসর স্টিফেন হকিংকে এ বিতর্কে টেনে এনেছেন আমেরিকানরাই। তাদের অনেকেই বলেছিলেন, এনএইচএসের হাতে থাকলে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বাঁচতে পারতেন না। কারণ এমন প্রতিবন্ধী একজন মানুষকে হয়তো বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা থাকত না।
কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং গত বুধবার এ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এনএনইচএসের প্রশংসা করেন এবং জানান, "এনএইচএস ছাড়া তিনি হয়তো বেঁচে থাকতে পারতেন না"।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সুবিধা মূলত দুটি ধারা অনুযায়ী চলে আসছে। একঃ সরকারি হাসপাতালের স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা, দুইঃ বেসরকারি ডাক্তার চেম্বার ও হাসপাতালের চিকিৎসা।
তবে দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে কোনো ধারার চিকিৎসাই গরীব মানুষদের জন্য বিনামূল্যে নেই। এ কারণে চিকিৎসার খরচ যোগাতে বহু মানুষকে সর্বশান্ত হতে হয়। পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে আবেদন। বহু মানুষ চিকিৎসার খরচ যোগাতে না পেরে অকালে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলো মূলত গরীব মানুষদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব হাসপাতালে রয়েছে দুর্নীতি সহ বহু ধরনের সমস্যা।
আমেরিকা ও ব্রিটেনের অনুসরণে ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য সেবা হয়তো এখনি চালু করা সম্ভব নয়। কিন্তু তবু দেশের জনসাধারণের চিকিৎসা সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। এ কাজে ব্রিটিশ এনএনইচএসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
------------------------------------
তথ্যসূত্র
------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:২১