{ ডিসক্লেইমার: ১ম পর্বে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার চেষ্টা করিনি, কেবল তিনটি বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরেছি যেন আগ্রহীরা নিজেরা ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করতে পারেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার সম্পূর্ণই স্কলারদের। শেষ পর্বে ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু ধারণা টুকে রাখছি। আগ্রহ বজায় থাকলে ভবিষ্যতে আরেকটু গভীরে যেতেও পারি। সম্পূর্ণ লেখাটি দারাশিকো ডট কম-এ পাওয়া যাবে }
‘সুদী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে আদতে কোন পার্থক্য নেই, ইসলামী ব্যাংক ঘুরিয়ে সুদ খায়, বাকীরা সরাসরি খায়’ – ইসলামিক ব্যাংকিং এর বিষয়ে এটা খুব প্রচলিত অভিযোগ। ইসলামিক ব্যাংকিং বিরোধিরা তো করেনই, সুদের বিপক্ষে অবস্থানকারী অনেক ইসলামপন্থীও এই অভিযোগ করেন। আরেকটি প্রচলিত অভিযোগ তোলেন – সাধারণত ইসলামিক ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিয়েছেন এমন ব্যক্তি। অভিযোগটি হলো – ‘ইসলামিক ব্যাংক যদি লাভ-লোকসানের শর্তেই ঋণ দেয় তাহলে আমার ব্যবসায়ের লোকসান কেন বহন করে না?’ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার আগে থেকেই জানা ছিল, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এ সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনার কারণে নতুন করে বিষয়টা সামনে এলো। এই পোস্টে তিনটি বই সহ ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ক আরও কিছু আলাপ করবো।
‘ইসলামী ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?‘ – এই শিরোনামে যে বইটি পড়েছি সেটা পিডিএফ, লেখক হামিদা মুবাশ্বেরা। সম্ভবতঃ লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে লিখেছিলেন এবং এই লিখাগুলোকেই সংকলিত করে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। হামিদা মুবাশ্বেরা একই সাথে কনভেনশনাল ও ইসলামিক ইকনোমিক্স এবং শরীয়াহ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, লেখক হিসেবেও বাংলাদেশের অনেক ইসলামপ্রেমীর নিকট সুপরিচিত। পিএইচডি গবেষক এই লেখকের ইসলামিক ইকনোমিক্স বিষয়ে কয়েকটি আর্টিকেল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
হামিদা মুবাশ্বেরার বইতে সংক্ষেপে এবং সরাসরি ইসলামিক ব্যাংকগুলো ঘুরিয়ে সুদ খায় কি-না সে প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং কী, সুদ কী, ইসলামিক ব্যাংকগুলো কী পদ্ধতিতে ব্যাংকিং করে ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর কর্মকান্ডে যদি সুদের মিশ্রণ ঘটে তবে ব্যাংকগুলো কি করে এবং ইসলামিক ব্যাংকগুলো যদি সুদ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকতে না পারে সেক্ষেত্রে গ্রাহকের বা সাধারণ জনগণের কী করা উচিত সে বিষয়েও তিনি লিখেছেন।
মাত্র ২৭ পৃষ্ঠার এই পিডিএফ ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রথম ধাপ হতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে, হামিদা মুবাশ্বেরা ব্যাংকার নন এবং তিনি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হতে এই লিখাগুলো লিখেছেন। এছাড়া পুস্তকাকারে প্রকাশের উদ্দেশ্যে লিখলে যতটা ব্যপ্তি এবং গোছানো হতো ততটা নয় কিন্তু এজন্য পাঠককে হতাশ হতে হবে না। হয়তো ভবিষ্যতে তিনি এই বিষয়ে চমৎকার একটি বই প্রকাশ করবেন।
হামিদা মুবাশ্বেরার বইয়ের ঘাটতি পূরণের জন্য এবং ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ে আরও একটু ভালো জানার জন্য মোহাম্মদ আবদুল মান্নান রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা‘ বইটি পড়া যেতে পারে। এই বইতে কনভেনশনাল অর্থনীতি, সুদ, ইসলামী ব্যাংকিং ইত্যাদি বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকারের বয়ান পাওয়া যাবে।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আইবিবিএল দখলের পূর্বে তিনিই এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইসলামী ব্যাংকিং-এ তিনি প্রায় সাতাশ বছরের অভিজ্ঞ। লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন বলে জেনেছি।
দুই শতাধিক পৃষ্ঠার এই বইতে তিনি একদম প্রাচীনকালের ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম স্কলারদের অবদান, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার ইতিহাস ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। এছাড়া সুদ কী, সুদ কিভাবে হতে পারে, কুরআন-হাদীসে সুদ বিষয়ে কী বলা রয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো তিনি অল্প কিছু পৃষ্ঠায় ব্যক্ত করেছেন। তারপর কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে ইসলামিক ব্যাংকিং এর উদ্ভব, অগ্রগতি, বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং ইত্যাদি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সুদভিত্তিক ও ইসলামিক ব্যাংকিং এর তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন কিছু জায়গায়। এরপর ইসলামিক ব্যাংকিং এর পদ্ধতি, চ্যালেঞ্জ, প্রচলিত সমালোচনা ও তার জবাব এবং কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন শেষের অধ্যায়গুলোতে।
সুপাঠ্য এই বইটি ইসলামিক ব্যাংকিং পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম। এছাড়া, ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে প্রচলিত কিছু সমালোচনার জবাব বা ব্যাখ্যা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামিক ব্যাংকিং এর সাথে সুদের মিশ্রণ সম্পর্কে ইসলামিক ব্যাংকিংগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ কী সে বিষয়ে জবাব পাওয়া যাবে এই বইতে। তবে, যেহেতু আইবিবিএল এর তৎকালীন এমডি এই বইটির লেখক, সেহেতু তিনি এই বইটিকে ইসলামিক ব্যাংকিং-এর প্রচারণার লিখেছিলেন বলে ধারণা করি। কিন্তু, আমি এই বইটিকে গুরুত্ব দিতে চাই এই কারণে যে, এই বইয়ের লেখক দীর্ঘ সময় ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং ইসলামিক ব্যাংকিং এর সমস্যা ও এর জবাব/সমাধান সম্পর্কে তিনিই ভালো জানবেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গোপন করে গিয়েছেন কি-না সেই বিষয়টি ইসলামিক ব্যাংকিং এর সাথে জড়িত অথবা গভীর ধারণা রাখেন এমন কেউ বলতে পারবেন।
আবদুল মান্নানের বইটিই ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ে জানার জন্য যথেষ্ট, তবে কেউ যদি ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ‘ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া’ বিষয়ে আরেকটু গভীরে যেতে চান তিনি মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা‘ বইটি পড়তে পারেন। এই বইটিও হামিদা মুবাশ্বেরার বইয়ের মতো ইসলামিক ব্যাংকিং বিষয়ে প্রচলিত কিছু বিষয়ের জবাব প্রদান করার চেষ্টা করেছে তবে এর বৈশিষ্ট্য হলো – এখানে ইসলামিক ব্যাংকিং এর অনুসৃত বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর আরেকটু গভীর আলোচনা করা হয়েছে। লেখক অনেকগুলো উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একশ ত্রিশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দুর্বল দিক হলো লেখক সম্পর্কে তথ্যের অভাব – কিচ্ছুটি নেই। বোধকরি তিনি কোন একটি ইসলামিক ব্যাংক এর কোন কর্মকর্তা।
উপরিল্লিখিত তিনটি বইয়ের মধ্যে বিস্তারিত ধারণার জন্য আবদুল মান্নান এবং সংক্ষেপে ধারণার জন্য হামিদা মুবাশ্বেরার বইটি পড়ার জন্য বলবো। সুদ থেকে যারা বেঁচে থাকতে চান এবং ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে যাদের ধারণার ঘাটতি আছে তাদের জন্য বইগুলো নিঃসন্দেহে উপকারী।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২৩ সকাল ৮:৫১