সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে,
উঠুন, সেহরি খান, রোজা রাখুন!
সুবহে সাদিকের এক ঘন্টা আগে মসজিদ থেকে এলান ভেসে আসে। প্রতিদিন। এলাকার মুসলমানদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ার এই দায়িত্ব পালন করেন মসজিদের মুয়াজ্জিন। আশেপাশের আরও চার পাঁচটা মসজিদ থেকে প্রায় একই সময়ে এই আহবান জানানো হয়। তারপর পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ মিনিট পরে আবার ঘোষণা আসে:
আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে।
আজ সেহরির শেষ সময় ৪টা ৩২ মিনিট।
মুয়াজ্জিনের এই আহবানে কোন সুর নেই। মাইক আসার আগে পাড়ায় যুবকের দল গান গজল গেয়ে ঘুম ভাঙ্গাতে আসতো। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মুসলমানের কানে ভেসে আসতো –
উঠো মুমিন সেহরি এলো
রহমতের দ্বার খুলে গেলো।
সেহরির জন্য ডাকার এই প্রথা বাংলাদেশে চলছে কয়েক শতাব্দী ধরে। গ্রামে গঞ্জে কিভাবে ডাকা হতো সে বিষয়ে কোন তথ্য পাইনি, কিন্তু এই ঢাকা শহরের পুরাতন অংশে সেহরির জন্য আহবান রীতিমতো উৎসব হিসেবে পালিত হতো। এটি প্রচলিত ছিল কাসিদা নামে। কাসিদা এক ধরণের কবিতা এবং এর ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বিস্তৃতি আছে। এই অঞ্চলে সাধারণত রমজানে, মহররম ও ঈদের সময়ক উর্দু-ফার্সি ভাষায় কাসিদা গাওয়া হতো। এর সাথে থাকতো নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্র যেমন কাশি, শিঙ্গা, থালা, হারমোনিয়াম ইত্যাদি।
সেহেরির আহবানের সূত্র খুঁজতে গেলে এই কাসিদা ধরে এগোলেই মিশর, পারস্য ঘুরে মদীনা পর্যন্ত যাওয়া যাবে কিন্তু সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। তবে ঢাকায় কাসিদা এসেছে মুঘলদের হাত ধরে। নবাব আবদুল গণির আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয় এবং তখন গড়ে উঠা মহল্লাগুলোতে বিভিন্ন উৎসবে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়। নবাব আহসান উল্লাহর সময়ে এর প্রসার আরও বৃদ্ধি পায় বলে জানা যায়।
ঢাকায় রমজানে যে কাসিদা গাওয়া হতো সেখানে বাংলা, উর্দু আর ফার্সি ভাষার সংমিশ্রন থাকতো। এই কাসিদার দুটি ভাগ আছে। পনেরো রমজান পর্যন্ত যে কাসিদা গাওয়া হতো সেখানে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে রমজানের ফজিলত তুলে ধরা হতো, অন্যদিকে শেষ পনেরো দিনে রমজানকে বিদায় জানিয়ে কাসিদা গাওয়া হতো।
এখন কি পুরান ঢাকায় কাসিদা গাওয়া হয়? না। দৈনিক প্রথম আলোতে একজন কাসিদা শিল্পীর সংবাদ ছাপানো হয়েছিল ২০১৫ সালে। তার কাসিদা ছিল ‘মুমিন মুসলমান, সেহেরি খান। রোজদার, দিলদার, ওঠো; রাত তিন বাজগিয়া’, আর বাদ্যযন্ত্র ছিল টিন-লাঠি।
বাংলাদেশ থেকে কাসিদা অথবা দলগতভাবে গজল গেয়ে সেহরির জন্য ডেকে তোলার সংস্কৃতি হারিয়ে গেলেও বিশ্বের বহু মুসলিম-প্রধান দেশে এখনও সেহরিতে বৈচিত্রপূর্ণভাবে ডেকে তোলার উপায় প্রচলিত আছে৷ এর মধ্যে অন্ততঃ একটা জেনে চোখ কপালে উঠেছে।
ত্রিশ বছর আগে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে একদল মানুষ অন্যদেরকে সেহেরির সময় ডেকে তুলত, সেই প্রথা এখনও আছে মিশরে, মরক্কোতে, আছে তুরস্কেও। মিশরে যারা এভাবে ডেকে তুলে তাদেরকে বলা হয় মেসেহারাতি। এই প্রথা চারশ বছরের পুরাতন এবং মিশরে অটোমান শাসনের সময়ে শুরু হয়। বলা হয়, মিশরের একজন শাসক উতবা বিন ইসহাক নিজেই রমজান মাসে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কবিতা পাঠ করতেন এবং সেহরি ও ইবাদতের জন্য ডাকতেন।
তুরস্কে যারা সেহরির সময় লোকদের ডেকে তুলে তাদের হাতে থাকে ঢোলের মত বাদ্যযন্ত্র। অটোমান শাসনের সময় থেকে এই প্রথা চলে আসছে। মরক্কোতে যারা সেহরির সময় ডেকে তুলে তাদেরকে বলা হয় নাফর। তাদেরকে স্থানীয়রা নির্বাচিত করে এবং রমজানের শেষের দিকে পুরস্কৃত করা হয়। বকশিশের প্রচলন অন্যান্য দেশেও আছে।
সুদানের মেসেহারাতি দলে শিশুও থাকে। তারা বাড়ির দরজায় গিয়ে সেই বাড়ির লোকজনের নাম ধরে ডাকে সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগার জন্য। ভারতেও মেসেহারাতি আছে, অনেক স্থানে তাদেরকে বলা হয় সেহরি খান। এরাও ঢোল-তবলা নিয়ে গান গেয়ে মানুষকে সেহরির জন্য ডেকে তুলে। তবে এই প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।
হয়তো বিশ্বাস করবেন না – কিছু দেশে সেহরির সময় লোকদের ডেকে তোলার জন্য কামান ব্যবহার করা হয়। যেমন তুরস্ক। সেখানে দৈনিক তিনবার কামান দাগানো হয় – সেহরির শুরু ও শেষের সময় এবং ইফতারের সময়। মিশরে, লেবাননেও কামান দাগানো হয়, তবে সেটা ইফতারের সময়। কামান দাগানোর এই রীতি লেবাননের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় দুইশ বছরের পুরাতন এই রীতির নাম মিদফা-আল-ইফতার।
দুবাইতেও ইফতারের সময় কামান দাগানো হয়। ২০১৮ সালের এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সে বছর ছয়টি স্থানে ইফতারের সময় কামান দাগানো হবে এবং এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পুলিশের ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিটি হ্যাপিনেস-কে। দশ মাইল দূর থেকে শোনা যাবে এই তোপধ্বনি।
এমনকি পাকিস্তানের ভুপালেও কামানের শব্দে সেহরির সময় ডেকে তোলা হয়। আড়াইশ বছরের পুরাতন এই প্রথায় যে কামান দাগানো হয় তা শোনা যায় আশেপাশের পঞ্চাশের বেশি গ্রামে।
স্বাভাবিকভাবেই জানতে ইচ্ছে হবে – মক্কা মদীনায় সেহরির জন্য কিভাবে ডাকা হতো? রোযা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরী সনে। রাসূল (স) তখন মদীনার বাসিন্দা। বলা হয়, ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল (রা)-কে সেহরির সময় ডেকে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ জন্য দুজন মুয়াজ্জিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। অন্যজন ছিলেন ইবনে উম্মে মাকতুম। হাদীসে আছে, রাসূল (স) বলেছেন, “বেলাল রাতে আযান দেয়। অত:এব তোমরা বেলালের আযান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আযান দেয়া পর্যন্ত।”
মদীনায় এবং পরবর্তীতে মক্কায়ও এভাবে মানুষকে সেহরির জন্য ডাকা হতো। মক্কায় এদেরকে বলা হতো জমজমি। মক্কা ও মদীনায় এর সাথে লাঠির মাথায় আগুন নিয়ে পথে পথে ঘুরতেন তারা। উদ্দেশ্য ছিল – শব্দে যদি কেউ ঘুম থেকে না জাগে, তাহলে আলোর কারণে জাগবেন। আলো জ্বালানোর এই প্রথা অবশ্য মিশর, তুরস্ক, মরক্কো সহ আরও অনেক দেশে চালু আছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে সেহরিতে ডাকার যে প্রথা তার তুলনায় বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এই প্রথা খুব একটা জাঁকজমকপূর্ণ নয়, কখনও ছিলও না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সময়ের ব্যবধানে কাসিদা থেকে শুরু করে কোরাসে গজল গাওয়ার সুরেলা রীতি তো হারিয়েছেই, তার পরিবর্তে মসজিদের মাইক হয়ে উঠেছে সেহরির ডাকের আবশ্যকীয় যন্ত্র এবং যন্ত্রণা।
সেহরির সময় মাইকের ব্যবহার প্রসঙ্গে শায়খ আহমাদুল্লাহর বক্তব্য নিয়ে কিছু কথা বলা আবশ্যক। প্রথমতঃ তার বক্তব্যকে বেশিরভাগ মানুষই ভুল অনুধাবন করেছেন বলে মনে হয়। সেহরিতে ডাকাডাকির বিরোধিতার তুলনায় মাইক ব্যবহারের বিরোধিতা করা উনার উদ্দেশ্য ছিল বলে আমি মনে করি। যদি তাই হয়, তবে আমিও মাইক ব্যবহারের বিরোধিতা করি। এটা কোন সংস্কৃতিই না, কেবল বিভিন্ন মসজিদের মুয়াজ্জিনের নিয়ম মেনে সেহরির জন্য ডাকের মধ্য দিয়ে কোন সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে বলেও আমি মনে করি না।
তবে হুজুরের বক্তব্যের বিরোধিতাও আমি করি। মাইক শুধুমাত্র রমজান মাসে সেহরির আগে ব্যবহার করা হয় না। শীতের সময়ে ওয়াজ মাহফিলে অনুষ্ঠানস্থল থেকে অনেক দূর পর্যন্ত মাইক স্থাপন করে, জুমার দিনে আজানের মাইক ব্যবহার করে বয়ান-খুতবা প্রদানের ক্ষেত্রেও মাইকের ব্যবহার করায় কল্যাণের তুলনায় অকল্যাণ বেশি হয় বলে মনে করি। এই বিষয়ে হুজুর কিছু বলতে পারতেন। তাছাড়া এই বিষয়গুলো মসজিদ-মাহফিল কমিটির ক্ষমতাধীন এবং তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হলেই বন্ধ করা সম্ভব হয়, এজন্য ফেসবুকের আমজনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলা ভালো কোন পন্থা হতে পারে না।
আমি চাই খালি গলায় দুরুদ-গজল গেয়ে সেহরি খাওয়া আর ইবাদত বন্দেগীর জন্য মানুষকে ঘুম ডেকে তোলার সেই সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলতে, তখন কি সাথে থাকবেন হুজুর?
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে অন্যান্য পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৪:২৮