সাহান এবং মোহন, দু'ভাই।
তখন সাহানের ছিল ১০ কি ১১ বছর বয়স, মোহন ছিল ৪ কি ৫বছর। সাহানের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে সাহানকে নিয়ে যাচ্ছিল সাহানের মা আর বাবা। যৌথ পরিবার থাকার সুবিধার্থে মোহনকে দেশেই রেখে যাওয়া হচ্ছিল। ছোট্ট থাকতেই এরা দু'ভাই মামা-খালাদের আদরেই বড়, তাই কোনো সমস্যা হবেনা। এয়ারপোর্টের বিদায়ের সময় মামার কোলে থেকে হাত নেড়ে বিদায় দিয়েছিল মোহন। প্লেনের সিটে বসে সেই দৃশ্যই বারবার চোখে ফিরে আসছিল সাহানের। সাহানের মা জিজ্ঞেস করল,
- মন কি বেশি খারাপ সাহান?
-না আম্মু, মোহনটার জন্য কেমন যেন করছে।
- আমরা ক'দিন পরই ফিরে আসবো বেটা।
- মোহনটা বারবার ফিরে তাকাচ্ছিল আসবার সময়। খুব কষ্ট লাগছে আম্মু।
- আহা, ক'দিন পরই ফিরে আসবো সোনা। আর মোহন তো ভাল থাকবে। সবাই আছে না?
মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে দেয় সাহান। এই মূহুর্তে তার মনে হয় আর কিছু নয়, মোহনকে কাছে পেলেই সবথেকে খুশি।
অনেক বছর পর।
সাহান স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবে।
এয়ারপোর্ট বসে আছে তারা দু'ভাই। একটু দূরে সাহানের বন্ধু বসে, যে কিনা সাহানের সঙ্গেই বাইরে যাচ্ছে পড়াশুনার জন্য। মোহনের মনটা খুব খারাপ। বড়ভাইকে দূরে কোথাও যেতে সে দেখতে পারেনা। দু'ভাই যেন একই আত্মা।
- ঠিকমত পড়াশুনা করবে, ওকে? সাহান বলল।
-হুমম
- রাত করে বাসায় ফিরবেনা?
-হুমম
-আমি কিন্তু প্রতিদিন ফোন দেবো। আর মেইল তো দেবই।
-হুমম
- আম্মুর কথা শুনবে। এখনতো আমি নেই তাই আম্মু পিট্টি দিলে কিন্তু রক্ষা করবার কেউ নেই, বলে হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সাহান।
-হুমম
- কি হুমম হুমম করছো মোহন? কিছু বলো?
- ভাইয়া, তোমার বাইরে না গেলেই কি হয়না? দেশে থেকেই তো কত মানুষ মাষ্টার্স করছে। তারা কি পড়াশুনা করেনা?
- দেখো মোহন, এভাবে বললে আমার খুব খারাপ লাগে। আমি কি যেতে চাই সবাইকে ছেড়ে? আমাকে আব্বু গবেষক হিসেবে দেখতে চান, সেটা হতে হবে না?
- হুমম
প্লেনে বসে সাহানের মন বেশ খারাপ হয়ে উঠে। মা-বাবার জন্য যত না হয় এর থেকে বেশি হয় ছোট্ট ভাইটার জন্য। দেখতে দেখতে কিভাবে বড় হয়ে গেল মোহন, কিন্তু তার কাছে এখনও সেই ছোট্টটিই আছে। সাহানের বন্ধু বলে,
- তুই এত নরম মনের কেন রে সাহান?
- আমার ভাল লাগছেনা দোস্ত, আমি জানি মোহন খুব একলা হয়ে গিয়েছে। ক'দিন কিভাবে যে ওর দিন যাবে সেটা আমিই বুঝি।
এর মাঝে কেটে গেল আরও কিছু বছর।
ঘটে গেল সাহান আর মোহনের জীবনের সবথেকে বড় দুর্ঘটনাগুলো। তাদের মা চলে যাবার ১০ মাস পরই চলে গেলেন তাদের সবথেকে প্রিয়বন্ধু বাবা। পি.এইচ.ডি ছেড়ে, পৃথিবীর সেরা টেকনোলজী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির লোভনীয় চাকরি ছেড়ে সাহান এসে গেল দেশে। শুধুমাত্র তার ছোট্ট ভাইটার জন্যে। পরিবারের বিশাল ব্যবসার কোনো বিন্দু-বিসর্গ যার ছিল না জানা, সেই সাহান এসে সবকিছুর হাল ধরল। রাত-দিন পরিশ্রম করে সবকিছু শিখবার চেষ্টা করে গেল। তার ভাইটাকে বুঝতে দিল না মা-বাবার অভাব। গবেষক হবার স্বপ্নকে শেষ করে দিল সাহান। কিন্তু এতে কোনো দুঃখ নেই তার।
সেই এয়ারপোর্টেই আবারও দু'ভাই বসে।
উচ্চশিক্ষার জন্য এখন মোহন বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছে।
- ভাইয়া, আমি না গেলে কি হয় না?
- নাহ, তোমাকে অবশ্যই আরও বড় হতে হবে। আর সবাই এমন সুযোগ পায়না।
- আমি গেলে তুমি একা হয়ে যাবে অনেক।
- আরে নাহ, সবাই আছে না বাসায়। আর সেখানে যাবার পর একদম মন খারাপের কিছু নেই। সব ঠিক করা আছে সেখানে। আমি তোমাকে ফোন দেবো দিনে বেশ ক'বার।
- তোমার খারাপ লাগবেনা ভাইয়া? আমি চলে গেলে অনেক একা হয়ে যাবে তুমি, আমি জানি।
- নাহ একা হবোনা। তোমাকে পাকা পাকা কথা বলতে হবেনা। আই আ্যাম এ স্ট্রং ম্যান।
কি রকম শক্তিশালী সাহান সেটা মোহন জানে। সে জানে আজ তার ভাইটা তার বিদায়ের পর সময় কাটাবে তার মা-বাবার কবরের পাশে বসে চোখের জল ফেলে।
চলে যায় সময়।
কিন্তু যতই দিন যাক না কেন, দু'ভাই কোনো ভাবেই পারেনা তাদের একে অন্যকে এক মূহুর্তের জন্য ভুলে যেতে।
একদিন বাসায় সাহান খেতে বসে। এটা সেটার মাঝে প্লেটে তুলে নেয় টমেটো দিয়ে বড় মাছের তরকাড়ি। শুধু ভাতের সাথে মাখতেই থাকে। ভাত মুখে তুলতে পারেনা সাহান। বড় মাছ দিয়ে টমেটোর তরকাড়ি মোহনের খুব পছন্দের খাবার। চোখে পানি চলে আসে তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায়। কত দিন হলো ভাইটাকে দেখেনা সে।
দুপুরের লাঞ্চের সময়ে রাস্তার পাশের এক ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে মোহন। ছোট্ট একটি পিজ্জা আর কোল্ড ড্রিংক নিয়ে বসে এক কোণে। একা কামড় খেয়েই মনে পড়ে ভাইয়ার কথা। তার ভাইয়ার প্রিয় ছিল পিজ্জা। দু'ভাই একসাথে কত মজা করে পিজ্জা খেত। কাড়াকাড়ি লেগে যেত বাসায় পিজ্জা আনলে। খাবারগুলো না খেয়েই চলে আসে বাইরে মোহন।
মাঝে মাঝে বিকেলে পার্কে যেয়ে বসে মোহন। দেশের বাইরে আসবার পর তার শুধু এই একটি জায়গাতেই আসতে ভাল লাগে। ছোট্ট বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখে সে বসে বসে। একদিন দেখে সে ৮ কি ৯ বছরের একটি ছেলে ৫ বা ৬ বছরের একটি বাচ্চার হাত ধরে হাঁটছে। বোঝাই যায় দু'ভাই তারা। দু'জনের হাতেই আইসক্রিম। হঠাৎ ছোট্ট ভাইটার আইসক্রিম হাত থেকে পড়ে গেলে বড় ভাইটা নিজের আইসক্রিম ছোট্ট ভাইটার হাতে তুলে দেয়। ছোট্ট ভাইটা এক কামড় বসিয়ে বড় ভাইয়ের মুখের কাছে আইসক্রিম তুলে ধরে। বড়টা বারবার না করা সত্ত্বেও ছোট্টটার জেদের কাছে হার মেনে কামড় দেয় আইসক্রিমে। দু'ভাই হেঁটে চলে যায় আর আইসক্রিম ভাগাভাগি করে খেতে থাকে। দৃশ্যটা দেখে মোহনের চোখ জোড়া ভিজে আসে। তার মনে হতে থাকে, তার ভাইটা তাকে ছাড়া আসলেই কত একা। এসময় তার ভাইয়ের পাশে তার বড় দরকার।
এক রাতে সাহানের মনটা যেন কেমন করছে।
রাত ৩টার মতন হবে। বিছানা ছেড়ে মোহনের ঘরে চলে আসে। বাতি জ্বালিয়ে মোহনের বিছানায় বসে সে। মনটা তার অনেক খারাপ, অনেক একা সে আজ। পৃথিবীতে তার আপন বলতে আছে শুধু এই ছোট্ট ভাইটি। কিন্তু তাও সে কত দূরে।
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে। এত রাতে কে আসবে বাড়িতে সে ভেবে পায়না। বাইরের কেউ হলে দারোয়ান ইন্টারকমে বলতো। মনে হয় বাসারই কেউ হবে, মামা বা খালা। দরজা খুলে সাহান তাজ্জব বনে যায়।
মোহন তার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে।
-আমি চলে এলাম ভাইয়া, একেবারে চলে এলাম। আর কখনো যাব না তোমাকে ছেড়ে।
সাহান কিছু বলেনা, শুধু পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে ছোট্ট ভাইটাকে। অশ্রুই যদি পারে বলে দিতে সবকিছু তো কি দরকার মুখে কিছু বলবার।
খাওয়া-দাওয়া শেষে ভোরবেলাতে মোহন ঘরে চলে যায় ঘুমাতে।
সাহান কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকবার পর ধীর পায়ে চলে আসে মোহনের দরজার সামনে। আলতো করে দরজাটা খুলে দেখে মোহন ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত হচ্ছে ঘরটা। এর থেকেও স্নিগ্ধ আর আলোকিত আজ সাহানের মন। আবারও আলতো করে দরজাটা লাগায় যেন মোহন টের না পায়। দু'চোখ হতে তার অশ্রু বেয়ে নামে। এটা কষ্টের নয়, আপনজনকে কাছে পাবার অশ্রু।
সাহান জানেনা যে মোহন তখনও ঘুমায়নি। মোহন জানে যে তার ভাইটা তাকে দেখতে এসেছিল। কতই না ভালবাসে ভাইটা তাকে। চোখ হতে টপ করে অশ্রুর ফোঁটা পড়ে বালিশে। এই অশ্রুও আপনজনকে কাছে পাবার, এই অশ্রু আপনজনকে ভালবাসার।
একেই মনে হয় বলে আনন্দাশ্রু।
[ গল্প ]