সাতসকালে বসে গেল চিত্রকর পূবেরই এক ঘরে। জানালা দিয়ে দেখা যায় দূর কোনো এক গ্রাম, পাশ দিয়ে যায় নদী। নদীর দিকে চোখ বুলিয়েই শুরু করে তার চিত্রণ।
আঁকছে সে তার মনের ছবি, মনের রঙে রাঙিয়ে। সময়ের সাথে সাথে মিশে যায় সে তার চিত্রেরই মাঝে। কোনো ক্লান্তি নেই, জড়তা নেই এঁকেই চলেছে চিত্রকর।
জীবন্ত হয়ে যায় চিত্র, চিত্রকরের তুলির ছোঁয়ায়। গাছের শুকনো পাতা উড়ে যায় কাশবনেরই মাঝে। বাতাসের পরশে মনের দোলায় নাচতে থাকে কাশবন। মুক্ত হয়ে আকাশপানে উড়াল যে দেয় কাশফুল।
আকাশপানে হাত-পা মেলে, নিচ জগতের আভা দেখে উড়তে থাকে সে কাশফুল। দূরদেশের এক অভিযানের, উড়ন্ত কিছু পাখি দেখে সে। পাখির দল ডানা ঝাঁপটিয়ে চলছে তাদের পথ নিরন্তর। হঠাৎ এক দেশে এসে, এক ছোট্ট পাখি হয়ে পড়ে দলছুট।
নেমে যায় নতুন এক দেশে, নতুন কিছুর দেখবার আশায়।
এক গাছের ডালে বসে পড়ে। গির্জার ঢং ঢং ঘন্টা শুনে। পাশের গির্জায় লোক হুলস্থুল। ব্যস্ত সবাই কারও অপেক্ষায়। কালো পোশাকের পুরুষ নামে, হাতে ধরা এক শ্বেত রমনী। শ্বেত পোশাক যেন তার রঙে গেছে মিশে। আনন্দিত সব তালি বাজায়। মেয়েটি ফুলের তোড়া ছুড়ে মারে। সেই তোড়াটি ধরার হিড়িক পড়ে।
কালো গাড়িটি চলছে ছুটে, গতি অনেক দুরন্তর। দু'পাশ শুধু সবুজ জমি। রাস্তা শুধুই খালি। নব্য বিবাহিত রমনী ওড়না দেয় বাতাসে ভাসিয়ে। ওড়না বাতাসে উড়াল দিয়ে, চায় আবার সেই রমনীর স্পর্শ পেতে। গাড়ি ছুটে যায় দুর্বার, নতুন এক গন্তব্যের আশায়।
ছোট্ট কিশোরী দৌঁড়ে বেড়ায়, সবুজ জমির মাঝখানে। হঠাৎ এসে সেই ওড়না জড়িয়ে ধরে, আগলে ধরে মমতায়। ওড়না জড়িয়ে জমির মাঝখানে, কিশোরী দাঁড়ায় দু'হাত মেলে। মেঘ জমেছে আকাশে। বৃষ্টি হবে শেষ বেলাতে। কিন্তু মেঘ শুধু মুচকি হাসে। ভাবছে, খুকি বোঝ কি আমার মনে আছে?
মেঘ হতে মুক্ত হয়ে বৃষ্টি নামছে পৃথিবীর তরে। কে ছুঁবে প্রথম কিশোরীর হাত, এই নিয়ে হয় বৃষ্টির প্রতিযোগীতা। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির অনুভবে, কিশোরীর মন নেচে উঠে। দু'হাত মেলে দৌঁড়ে যায়, জমির ফসল মাথা নাড়তে থাকে কিশোরীর আনন্দে।
মেঘ উড়ে যায় দিগন্তপানে। ভেসে চলে যায় দূর এক দেশে।
সবুজ যেখানে আছে শুধু তারই অপেক্ষায়। থাকুক অপেক্ষায়, বিনা কারণে দেবো কেন বর্ষা, ভাবে শুধু মেঘ।
সবুজ ফসল আকুতি জানায়, কিন্তু কেউ শুনেনা সেই আহবান।
মেঠো পথে বাউল এসে যায়। বেজে উঠে তার একতারা। স্নিগ্ধ হয়ে যায় আকাশ বাতাস, মোহিত হয় মেঘমালা। ঝর ঝর করে নেমে পড়ে মেঘের সব কথামালা। ফসল শুধু দেহ নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানায় বাউলকে। বাউল শুধু গান গেয়ে যায়, পথ হেঁটে যায় কোন এক অজানায়।
মেঠো পথের ফুলের মাঝে, ফড়িং থাকে আর প্রজাপতি। রঙিন প্রজাপতি উড়ে চলে যায়, সাথে নিয়ে যায় ফুলের সুবাস। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে খোলা জানালায় প্রবেশ করে। ঘরময় শুধু ঘুরে বেড়ায়। ক্লান্ত প্রজাপতি আলতো করে যায় মিশে রঙিন ক্যানভাসে ।
চিত্রকর তুলির শেষ আঁচড়ে প্রজাপতির ডানা এঁকে দেয়।
শেষ করে তার চিত্রণ। একবার দেখে নেয় তার সৃষ্টি, ঠোটের কোণে হাসি ফুটে দেখে নিজের কর্ম। দেয়ালেতে ঠাই হয় সেই রাঙানো চিত্রণ।
কফির মগে চুমুক দিয়ে আবারও চোখ বুলায় চিত্রকর তার কর্মের দিকে।
সন্তুষ্টিতে আসে তার প্রফুল্লতা। নিয়ে বসে যায় আবারও এক সাদা ক্যানভাস। নতুন বর্ষের চিত্র তো শুরু হবে এখন। আগের বর্ষের তো হল মাত্র শেষ। দেয়ালেতেই আছে সেই আগের বর্ষের চিত্রণ।
চিত্রকরের নকশী শুধু থাকবে যে তার চিত্রণে।