আর দু'দিন বাকি স্কুল ছুটির।
এরপর ঈদের জন্য বেশ লম্বা ছুটি পুলকের। ছুটির পর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নতুন ক্লাশে উঠবে পুলক। এখন সে ক্লাশ ফোরে পড়ছে। পাশের ফ্লাটের রাতুলের সাথে সে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করে। মাঝে মাঝে অবশ্য তার আম্মুও তাকে নিয়ে আসে আবার নিয়ে যায়। কিন্তু তার রিকশা নয়, হেঁটে হেঁটেই স্কুলে আসা-যাওয়া করতে ভাল লাগে।
অন্যসব বাচ্চা থেকে পুলক মনে হয় একটু আলাদা। স্কুল ছুটি হলে সবাই যখন মাঠে বসে খেলা করে, সে তখন মাঠের পাশের আমগাছ তলায় বসে বসে সবার খেলা দেখে। রাতুলের সাথে যখন স্কুল থেকে আসে, তখন রাস্তার চারপাশ দেখতে দেখতে আসে। তার কাছে জগৎটা কেমন যেনো অদ্ভুত লাগে। সবাই কেমন যেনো ছুটে চলছে জগতে।
পুলকের মা রিনাও কিছুটা বুঝতে পারে তার ছেলেটা একটু অন্যরকম। মনে হয় বেশি শান্ত ছেলেটা।স্কুল থেকে এসেই সুন্দর করে গোসল করে খেয়েদেয়ে একটু ঘুম দেবে। ঘুম থেকে উঠে হয়ত স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করবে বা খুব বেশি পড়া না থাকলে একটু গল্পের বই পড়বে। বিকেলে মাঝে মাঝে রাতুলের সাথে হাঁটতে বের হয়। রাতুল ক্লাশ সিক্সে পড়ে। ওদের বাসার সবাই পুলককে অনেক আদর করে।রিনা মাঝে মাঝে টিভিতে কার্টুনের চ্যানেল দিয়ে বসিয়ে দেয় ছেলেকে কিন্তু পুলকের এসবের দিকে কোনো আগ্রহই নেই। তার বাবা শাহিন একজন সাধারণ চাকুরিজীবি। বেশ সকালে বের হন, আসেন রাত ৮টা কি ৯টায়। এসেই ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। রিনা তখন চুপচাপ দেখে যায় বাপ-বেটার কাজগুলো। খুব সাধারণ একটি ছোট্ট পরিবার তাদের। কিন্তু এতে মনে হয় তারা অনেক ভালই আছে।
পুলকের স্কুল ছুটি। রোজ বিকেলে সে আর রাতুল বাইরে বের হয় গরু দেখার জন্য। কোরবানি ঈদের আর বেশিদিন দেরি নেই। তাদের বাসার আসেপাশের অনেকেই গরু কিনে ফেলেছে। খুব ভাল লাগে দেখতে। পুলক আর রাতুলের পরিবার এবার একসাথে শরিকে কোরবানি দেবে। প্রতিবার তারা গ্রামেই ঈদ করে থাকে। কিন্তু এবার কি কারণে যেনো বাড়ি যেতে পারছেনা তারা। প্রথমে এতে পুলকের মন খারাপ হলেও পরে মন ঠিক হয়ে যায়। বাড়িতে বাবা, চাচা-ফুফুরা মিলে বেশ বড় গরুই কোরবানি দেয় । তার বাবার একা তেমন সামর্থ্য নেই যে একা একটি গরু কোরবানি দেবে। রাতুলদেরও তেমন একটা পয়সা-কড়ি নেই, তাই তারা দুই পরিবারই এক সাথে চেষ্টা করবে কম দামের ভেতর একটা গরু কেনা যায় কিনা।
পুলকের মনটা ভাল নেই আজ। গতকাল এসে রাতুলের মা বলে গেছেন তারা নাকি রাতুলের বড় মামার সাথে কোরবানি দেবেন। হুট করে এটা নাকি ঠিক হল।রাতুলের বড় মামার ইচ্ছে সেটা। রিনা অবশ্য বলেছে কোনো সমস্যা নয় এটা, কিন্তু তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফোন করে শাহিনকে জানায় সেটা। পরশুই ঈদ, এর মাঝে যে কিভাবে কি হবে মাথায় আসছে না তার। শাহিন আশ্বস্ত করে ব্যবস্থা নাকি একটা হয়ে যাবে। রিনার বেশি খারাপ লাগছে ছেলেটার জন্য। কোরবানি তো সৃষ্টিকর্তার নামে কিন্তু ঈদের আনন্দই তো পূর্ণ হয় বাচ্চাদের আনন্দ দেখে। বারান্দায় বসে আছে ছেলেটা সেই দুপুর থেকে খবরটা জানার পর। লোকজন গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে আর অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখছে।
রাতে শাহিন এসে জানায় সে কাল সকালে বের হবে গরু কিনতে। রিনা অবাক হলেও ছেলের সামনে কিছু বলে না। পুলক ঘুমিয়ে গেলে বলে যে সে কিছু টাকা জমিয়েছে, দেখা যাক আগামীকাল যদি ভাগ্যে থাকে তো এই দামের ভেতর কোনো গরু পেলে তো ভালই। নয়ত অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই সকাল হতেই পুলক বারান্দায় বসে আছে। তার বাবা বের হয়েছে বেশ ভোর বেলায়। কখন তার বাবাকে দেখবে গরুর দড়ি হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা দিয়ে আসবে, এটা দেখার জন্য তার আর সহ্য হচ্ছেনা। একটু পর পর এসে রিনাকে জিজ্ঞেস করছে তার বাবা ফোন করেছিল কিনা। রিনার মনটা বেশ কষ্ট লাগে ছেলেটার আগ্রহ দেখে। দুপুরে জোর করে ভাত খাইয়ে দেয়। আবারও সেই বারান্দায় বসে অপেক্ষা। বিকেলের দিকে একটু বাইরে বের হয় পুলক।পুরনো জ্যামিতি বক্সে জমানো কিছু টাকা নিয়ে নেয় সঙ্গে করে। রাস্তার মোড় থেকে কিছু খড় আর ঘাস কিনে আনে। যদি গরু আসার পর গরুর খিদে লাগে তখনের জন্য আর কি। বাসায় এসে বারান্দায় এনে রেখে দেয় সেগুলো। রিনা কল দিয়ে অবশ্য জেনেছে এখনো শাহিন কিছু কিনতে পারেনি।
রাত প্রায় ৯টা। ছেলেটা সেই কখন থেকে মুখটা শুকনো করে বসে আছে। রিনার মনটা যে কেমন করছে সেটা শুধু সেই জানে। শাহিনের মোবাইলের চার্জ শেষ। সে দোকান থেকে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে সেটা প্রায় ঘন্টা দু'য়েক হলো। এখনো তার সাধ্যের ধারে কাছেই কিছু পায়নি শাহিন। রিনা সবসময়ই মনে করে অর্থকরি নয়, সংসারে ভালবাসাটাই আসল। যেটা তাদের ছোট্ট সংসারে ঘাটতি নেই। কিন্তু আজ মনে হয়, টাকা-পয়সাটাও জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। হঠাৎ পুলকের চিৎকার আর দ্রুত দরজা খুলে নিচে যাবার আওয়াজ পেয়ে রিনা দরজার কাছে আসে।
পুলক নিচে নেমে দেখে তার বাবা একটি সুন্দর সাদা ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
"কিরে বেটা, আমার জন্য অপেক্ষা করছিলি?"- শাহিন
"হ্যাঁ বাবা"- বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলে পুলক।
"তোর বাবার সাধ্যে তো তেমন কুলালো না তাই একটা খাসী নিয়ে এলাম। চলবে না বেটা? খুশি তো?"- শাহিন
এত্ত সুন্দর ছাগলটা যে পুলকের মনটাই আনন্দে ভরে উঠলো। মনে হয় বিরাট গরু হলেও সে এত খুশি হত না। মা'র নিষেধ সত্ত্বেও পুলক ছাগলটিকে নিজের বারান্দায় নিয়ে এনে বেঁধে রাখে। আর পাশে বসে শুরু করে দেয় যত্নআত্তি। শাহিনের সারাদিনের পরিশ্রম মনে হয় সার্থক হল ছেলেটার আনন্দ দেখে।
রাত ১২ টা বেজে গেছে। পুলক ঘুমিয়ে আছে তার মা-বাবার বিছানায়। শাহিন বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ে বিছানার উপর। ছেলেটা কি পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মনে হয় ঘুমের ঘোরে একবার আব্বু বলেও ডেকে উঠে। তার ছেলেটা আগামীকাল অন্য সবার মত আনন্দ করবে ভাবতেই শাহিনের মনটা কেমন যেনো করে উঠে। ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে একটু কোলে নিয়ে আদর করতে। থাক, ঘুমিয়ে থাকুক। চোখের কোণে মনে হয় একটু অশ্রু জমা হল মমতায়।
সন্তানের সুখ কতটাই না আনন্দের! রিনা এসে শাহিনের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়ায়। চেয়ে থাকে তাদের ঘুমন্ত সন্তানের দিকে। কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা!
ছোট্ট শিশুর অনাবিল আনন্দের চেয়ে বড় কি আর আনন্দ আছে পৃথিবীতে?
[ গল্প ]