আলোচনার পূর্বে আমার অবস্থান পরিষ্কার করে নেই। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস আমার নাগরিক কর্তব্য। নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি আমি দায়বদ্ধ। আর, আমার তুলনামূলক বিচারের সহায়িকা হল ইতিহাস। তাই, আমি দুটি প্রেক্ষিতে আলোচ্যকে বিচার করব, দেশের প্রেক্ষিতে ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। জামায়াতে ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক সর্বত্র বিরাজমান। একটি প্রসঙ্গ হল দেশের অভ্যুদয়ে তাদের ভূমিকা। অন্যান্য হলে তাদের সাংগঠনিক রীতিনীতি, চর্চা। এবং সর্বোপরি চলে আসে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রসঙ্গ।
দেশের অভ্যুদয়ের সময় তাদের রাজনৈতিক অবস্থান সর্বজনবিদিত। জামায়াতে ইসলামের নিজস্ব অবস্থান এমন , "সেসময়ের প্রেক্ষিতে তারা একটা অবস্থান নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তারা দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দেশের মঙ্গলের জন্যই কাজ করছেন। অতএব, সে প্রসঙ্গ টেনে এখন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী অবান্তর।"
আর আছে যুদ্ধাপরাধের দায়। তাদের বিভিন্ন নেতাদের প্রতি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হয়। এটা তারা অস্বীকার করেন, এবং বিনা প্রমাণে এমন অভিযোগকে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করেন।
এখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ভূমিকা কি হওয়া উচিত, সে বিচারে আমাদের ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যুদ্ধ শুধুমাত্র কোন নীতির লড়াই নয়। বরং বিভিন্ন শক্তির দ্বন্দ্বের একটি চরম মুহূর্ত। আমাদের যুদ্ধের পেছনে ভারত ও সোভিয়েতের স্বার্থ না থাকলে এটা ঠিক যুদ্ধ হত না। হয়তো পরিণত হত ইউ এন মিশনে। আর শক্তির স্বার্থ থাকবেই। রাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয় সমরসজ্জায় কোন নীতির প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। এটা তার টিকে থাকার সংগ্রাম। আর টিকে থাকার জন্য বড় বড় শক্তিদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পরাক্রম হওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা অপরপক্ষ থেমে নেই ও দুর্বলতা পেলে অপরপক্ষ গ্রাস করবে।
এই দ্বান্দ্বিক সমন্বয় মানব সভ্যতার একটি অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। আমাদের জাতির সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম ও উল্লেখিত শক্তির স্বার্থ তখন সমমুখী ছিল।
যুদ্ধ যেমন নীতির সংগ্রাম নয়, যুদ্ধ জয়ের পরের ঘটনা বিচারও কোন আদর্শ দিয়ে করা হয় না। যুদ্ধ জয়ের পর খুব সাধারণ কিছু নিয়ম আছে, যা বিজেতা পালন করে যুদ্ধ জয়ের চিহ্ন প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
১। বিজিতের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়।
২। বিজিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
লক্ষ্য করবেন, এগুলো নীতি বা আদর্শের দোহাই দিয়ে করার বিষয় নয়। কেননা যুদ্ধে কেবল এক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং যুদ্ধাপরাধীও কেবল একপক্ষে থাকে না। কিন্তু ইতিহাস লিখে বিজেতারা। এবং নীতির লড়াই বলে যদি কিছু থাকে, তার প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাপকাঠি এখানে থাকে যুদ্ধ জয়।
বাংলাদেশের পক্ষ বিচারে চিন্তা করলে আমরা এই চিহ্ন দুটির দাবীদার। আমাদের যুদ্ধ করে জয়লাভ ও স্বাধীন হওয়া আমাদের জন্য অবিসংবাদিত সত্য। আর সেই যুদ্ধের অন্য পক্ষের হয়ে কথা বলা দেশের নাগরিকের অবস্থান নয়। এটা রাষ্ট্র যন্ত্রের দায়িত্ব রাষ্ট্রে এর চিহ্নকে প্রতিষ্ঠা করা, এ ব্যাপারে অবস্থানকে দ্বিধাহীন করা। নাগরিকের দায়িত্ব সে অবস্থানকে রক্ষা করা। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র তা নিশ্চিত করে নি। কিন্তু আমাদের নাগরিক দায়িত্বে সেখানে শেষ হয়ে যায় নি।
কালের বিচারে দেখলে, এটা জাতি হিসেবে আমাদের বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধের আমাদের সংগ্রাম আমাদের একটি দিক। আরেকটি দিক হল এ অঞ্চলে বহুকাল ধরে শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি ও অর্থনীতির দৈন্যতা। এ অঞ্চলে আধুনিকতা আনয়ন করেছে ইংরেজরা। কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসু ছিল, তা নির্ভর করেছে কিভাবে আমরা তা গ্রহণ করেছি তার ওপর।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও হিন্দুসমাজের তাতে ব্যাপক অভিযোজনের ফসল কলকাতা। অপরপক্ষের এ অঞ্চলের মুসলমানদের ইংরেজ অনীহা ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার প্রতি অনীহা ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমতুল্য। তার সাথে আরো পেছনের অর্থনৈতিক কাঠামো ও জাতীয়তা বোধের প্রাক-গঠনের কথা বিচার করলে সমান পার্থক্য করা যায় পাঞ্জাবিদের সাথে এ অঞ্চলের।
ফলত বঙ্গভঙ্গ চাওয়া হয়েছিল কেননা অগ্রসর কলকাতার কাছে এ অঞ্চলের দেখভাল আশা করা যায় নি। একইভাবে পাকিস্তানভঙ্গ চাওয়া হয়েছিল, কেননা অগ্রসর পাঞ্জাবিদের কাছেও তা কোনোভাবেই আশা করা যায় নি। উন্নত জাতি সর্বদা অনগ্রসর জাতিকে ব্যবহার করে শস্যক্ষেতের মত। এ অঞ্চলকে তাই নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিতে হয়েছে।
সেই অনগ্রসর বিচ্ছিন্ন জাতি আজ নানা চরাইউতরাই শেষে এখন একত্র। এখন তার দায়িত্ব এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু উন্নত ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে তার প্রকাশ এখনো স্পষ্ট হয় নি। অভ্যুদয়ের ব্যাপারে অবস্থান দৃঢ় করা এই জাতির সেই স্পষ্টতা আনয়নে জরুরি। তথাপি, সেই প্রকাশে তার রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা রয়েছে, যা এই জাতির অপরিপক্কতারই ফসল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন বাংলাদেশের নাগরিকের কি অবস্থান হওয়া উচিত তা স্পষ্ট (হতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের অবস্থান স্পষ্ট বা দৃঢ় নয়)। সেই অবস্থান নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে, কিন্তু সেই দ্বিধাপূর্ণ অবস্থান নির্ঘাত বাংলাদেশের নাগরিকের দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান নয়।
এই পর্যন্ত, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি একমত?
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৪:২১