আমাদের শেষ গন্তব্য--সুবিখ্যাত সংসদ ভবন। চৌকোনা শিপের আকৃতিতে বানানো চরম-সুন্দর এই স্থাপত্য ভবনটি চার তলা। ছাদের উপরে জাহাজের চিমনী এবং ক্যাপ্টেন্স কেবিনের আকারে কিছু কৌশল। খুবই মুগ্ধ হলাম।
কিন্তু মোহনজী আমাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন: মহাভারতের সবচেয়ে সুন্দর পার্লামেন্ট ভবন কিন্তু এটা নয়--
তাহলে কোনটা? আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।
আপনি সেটা ভালো করেই চেনেন।
মানে?
মানে হলো বাংলাদেশ পার্লামেন্ট। লুই ক্যানের বিশ্বখ্যাত নির্মানটি হলো আপনাদের। জানেন সেটা কী?
কী?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইসলামী নিশান--চাঁদ-তারা!
আমি লা-জওয়াব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মোহনজী সহজ কন্ঠে বলেন: সংসদের পাশের লেকটির নাম কি, কবি বুলবুল?
ক্রিসেন্ট লেক--বলেই আমি প্রবলভাবে চমকে উঠি। তবে কি, ভবনটি তারকা-শেপের?
নিশ্চয়ই। কখনো হেলিকপ্টারে করে দেখলেই বুঝবেন।
আশ্চর্য!! আমি নিজের লজ্জা ঢাকতে নিজের চোখ নামিয়ে নেই।
আরে, ডক্টর, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। আচ্ছা, বলুন তো, পয়ষট্টির যুদ্ধে কে জিতেছিল--ভারত, না পাকিস্তান?
আমি জবাব দেই না। আমরা ছোটবেলা থেকেই জয়ী হিসেবে পাকিস্তানের নাম শুনে আসছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ হবার পর থেকে বিবিসি ও বিশ্ব মিডিয়া একে ভারতের জয় বলে প্রচার করতে থাকায় আমিও ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হই। তবে কি--
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। পয়ষট্টিতে সত্যিই ভারত হেরেছিল। তারই প্রতিশোধ নেয়া হয় একাত্তরে। কিন্তু জেনারেল আইয়ুব ছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য দেশপ্রেমিক শক্তি। তিনি বিবিসির মিথ্যাচারকে না-করার জন্য ডেকে আনলেন বিশ্বখ্যাত ইহুদী-স্থপতি, তাতার-বংশোদ্ভূত লুই কানকে। তাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে বললেন: এমন কিছু করবেন, যা আপনার মুখের ক্ষতের চেয়েও স্থায়ীভাবে ভারতকে লজ্জা দেয়। [----মাত্র ৩-বছর বয়সে লুই স্টোভে-জ্বলা কয়লার আগুন দেখে এতটা বিমোহিত হয়েছিলেন যে গায়ের অ্যাপ্রন দিয়ে জ্বলন্ত-কয়লা টেনে এনে নিজের বুকে-মুখে চেপে ধরেন। তার গায়ের কাপড় পুড়ে যায় এবয় মুখে স্থায়ী স্কার-মার্ক পড়ে। আমেরিকায় অভিবাসী হবার পরে তার বাবা বহুবার তাকে অপারেশন করতে বললেও তিনি রাজী হন নি। তার জবাব ছিল সরল: আমি এভাবেই পৃথিবীর বুকে আমার চিহ্ন রেখে যাবো, বাবা--যা হবে স্থায়ী আর লোকে যা কখনোই ভুলতে পারবে না। ‘চেঙ্গিশ খানের উত্তরাধিকারী’ সত্যিই তার কথা রেখেছেন--আমাদের সংসদ ভবনই তার প্রমান! ]
পাকিস্তানের পতাকার আদলে বানানো সংসদ ভবনকে ঈগলের চোখে দেখলে কেউই আইয়ুবের রাজনীতির চিরস্থায়ী বিজয়কে অস্বীকার করতে পারবে বলে আমার ১মনে হয় না।
আমি হতভম্ব হয়ে বলি: আপনি ভারতীয় হয়ে এসব বলছেন, মোহনজী?
আমার ঘরে চলুন, ডায়রীতে আকাশ থেকে তোলা একটা ছবি আছে ঢাকা-সংসদকে। দেখলেই বুঝবেন কেন আমি এসব জেনেছি।
কেন?
অঅপনাদেও আরেক জেনারেল জেনেবুঝেই এই মহান বিজয়কে কলংকিত করছেন?
কে, এরশাদ? কিভাবে?
এর ডিজাইনে হস্তক্ষেপ করে। জিয়ার মাযার বা পুল বসানোটা তো লুই কানের নকশাকে ধ্বংস করারই নামান্তর!
আমি একেবারেই বোবা হয়ে যাই। আমার দ্বিধাগ্রস্ত মন আমাকেই চাবুক মারলো:
চেন না নিজেকে, অন্যকে নিয়ে, তবু বাহাদুরী করো
শোন হে মানুষঅন্ধ তোমার চোখকে আলোতে ভরো।
*
সংসদ ভবন এবং লা-করবুজিয়ার সেন্টার দেখে আমাদের বাস থামলো বাজারের সামনে। হুড়মুড় করে নেমে গেল সবাই। শুধু আমি, মোহনজী এবং ড. জ্যানেট রয়ে গেলাম গাড়িতে।
জ্যানেট উদাস গলায় বললো: কেনাকাটায় আমি কোনো আনন্দ পাই না, বুলবুল। শুধু স্যুভেনির দু-একটা কিনিব্যাস।
আমার কিন্তু ভালো কাপড়ে লোভ আছে, জ্যানেট। বললেন মোহনজী।
সে-তো দেখেই বোঝাই যায় হে পাঞ্জাবের-রাজপুত্তুর। জ্যানেট আদুরে গলায় ফোঁড়ন কাটলো।
মোহনজী প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন।
আচ্ছা, মোহনতোমাদের গায়ের রঙ এমন আশ্চর্য কেন? দ্রাবিড়িয়ান ভারতে তোমরা কি এরিয়ান? নাকি পাহাড়ী আবহাওয়ার কারণেই মুলোর মত টকটকে তোমাদের গায়ের রঙ?
ঠিক জানিনা, জ্যানেট। তবে সত্যিই পাঞ্জাবীদের গায়ের রঙ চমৎকার। শুধু কাশ্মীরিরা ছাড়া কেউই আমাদেরকে হারাতে পারবে না।
এটা কি সেই মহাবীর আলেক্সান্ডারের গ্রীক বাহিনীর কারণে? তোমাদের নাকও তো দেখি গ্রীকদেও মতই খাড়া, লম্বা এবং বাঁকা।
হতেও পারে। তবে সব পাঞ্জাবীর নাক তীক্ষ্ম নয়। এ উপমহাদেশে নাক দেখে চেনা যায় শুধু পাঠানী আর কাশ্মীরিদের। বাকী সব মিশ্রণ। বাঙালী এক-আনা তো মগ দু-আনা; চার-আনা বিহারী তো ন-আনা দক্ষিণী। মিশ্র রক্তের উত্তরাধিকারীরাই তো আধুনিক মানুষ। কেবল “আমি” খোঁজে ইহুদী আর নাৎসীরা। এটা তো বর্বরতা! আর গ্রীক রক্ত সিন্ধু ও পাঞ্জাবে যত মিশেছেতার চেয়ে অনেক বেশি মিশেছে মোগল আর পার্সিয়ান। সাথে আবার আছেনমুহাম্মদ বিন কাশিম!
ভালো যুক্তি, মোহন। জ্যানেট প্রাণ খুলে প্রশংসা করে বলে: এত সুন্দর যে জাতীর রক্তপ্রতিশোধের পরেওচলো, ড. বুলবুলতাদের কিছু স্যুভেনীর অন্তত কিনি।
হেসে ড. জ্যানেটের অনুগামী হলাম। কিন্তু বেশি কিছু কিনলাম না আমি। স্বর্ণমন্দিরের ছোট্ট একটি মডেল আর গুরু নানকের মূল-ক্যাসেটইংরেজী তরজমা সহ।
বাকীরা যখন ফিরে এলোবাসে আর হাঁটার জায়গাও রইলো না।
ড. ওলারেরে দরাজ গলায় বললেন: সরি ভেঁইয়া-মোহনজী। যা খুঁজলাম, কোথাও পেলাম না।
মোহনজী অবাক হয়ে বললেন: কি পেলেন না, কবি?
একটি ষোলো বছরের পাঞ্জাবী-গার্ল। আমার ভাগ্য খারাপ, না-কি তোমাদের আতিথেয়তাকে জানে!
ড. জুর্গা কটাক্ষ হেনে জবাব দিলো: ওয়ান ফর ওয়ান নাইটতাতেই এত শখ? শালা, বুড়ো ভাম।
ওলারেরে বাসের ইঞ্জিনের গর্জনের চেয়েও জোরে হেসে উঠলেন।
*
পরদিন আমরা চললাম সিমলায়‘হিমাচল একাডেমী অফ আর্ট, ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার’-এর সেমিনারে যোগ দিতে। আমাদের সাথে যোগ হলো আরো পাঁচজন সাংবাদিক এবং চন্ডিগড় প্রশাসনের অতিরিক্ত দুজন মেজিস্ট্রেট।
যাত্রীদের অনেকেই এমন সুন্দর পাহাড়ী পথ আগে দেখেনি। আমার মনে পড়ে গেল দশ বছর আগের কাহিনী। আজকের বাসেও তো অনেক মেয়েএদের কেউও কি অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যাবেশিরিনের মত ?
কেউ কেউ তো ইতিমধ্যেই পালিয়েছে, বুলবুলজি। আপনি খবর পান নি?
আমি অবাক হয়ে মোহনজীর মুখের দিকে চাই। তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে নিষ্পৃহ কণ্ঠে বলেন: ড. জুর্গা আর ওলারেরে তো আসেন নি। তারা চলে গেছেন জয়পুর। দেবজী পার্মিশনও দিয়েছেন।
কেন? আমি হতবাক কণ্ঠে বলি।
রাশিয়ানরা অমনই হয়, ডাক্তার। ও নিয়ে দু:শ্চিন্তা করার দরকার নেই। সিমলায় জ্যানেট আর আপনিই কিন্তু প্রধান কবি। রেডি হন। মিডিয়া থাকবে। টিভি আসবে। জানেন তো--সিমলা ভারতের দ্বিতীয় রাজধানী?
আমার আবার ড. বারী স্যারকে মনে পড়লো। সৈয়দ আলী আহসানের একটি প্রবন্ধ ‘সাহিত্য কাকে বলে’-- ইংরেজি অনুবাদ তিনি যোগাড় করে দিয়েছেন আমায়। সেটা বের করে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। বাসে আমি লিখতে পারি, কিন্তু পড়তে গেলেই ঘুম পায়। নিজের অজান্তে বুঁজে এলো চোখ। আর স্বপ্নের মধ্যে ভেসে এলো তাজমহল আর আমার এক বন্ধুর মুখ। সেও ডাক্তার। বিরাট হৃদয় নিয়ে জন্মেছেন। সেই মহীয়সী নারীর নামটা কি আপনাদের বলে দেব? --না, থাক। পরকীয়ার চেয়ে পরকীয়ার-বদনাম বেশি ভয়ংকর--বুদ্ধিমান মানুষদের তার থেকে দূরে থাকাই উত্তম।----
সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙলো বাস উৎরাই দিয়ে নামতে শুরু করলে। সামনের সিটের ব্যাকে ধাক্কাও খেলাম। শীতও এসে থাপ্পড় মারলো কানে আর গালে। দ্রুত মাফলার ও সোয়েটার বের করলাম।
দেখুন বুলবুলপ্লেন উঠছে।
সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। ছোট একটি এয়ার স্ট্রিপ বানানো হয়েছে পাহাড় কেটেযার সামনে অতল খাঁদ। সামান্য পথটুকু দৌড়েই বিমান আকাশে লাফ দিয়ে পড়ে। কাঠমান্ডুতেও আমি এ বিপদ দেখেছি। তবু ত্রিভূবনের এয়ারস্ট্রিপ এতোটা ক্ষুদ্র নয়। অবাক হয়ে জানতে চাই: মোহনজী, কিন্তু প্লেন ওখানে নামে কিভাবে?
স্পেশাল কোর্স-করা পাইলটরাই শুধু এত শর্ট ডিসট্যান্সে নামার অনুপতি পায়, বুলবুল।
দু’একটা প্লেন নামতে দেখে আমার বুকের ধুকপুক বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। সাংঘাতিক ক্যারিকেচার ও দক্ষতা দেখিয়ে ল্যান্ড করলো থ্রি-সেভেন-থ্রি বোয়িং। রানওয়ে মাইল খানেক লম্বাও মনে হলো না। হায় আল্লাহ--আমার দরিদ্র জিয়া-এয়ারপোর্টেও তো তিন মাইল লম্বা দুটো রানওয়ে আছে। মহাভারতের দি¦তীয় রাজধানীর এ-কি হাল? ভয়ে দু-বারই চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। মোহনজী হেসে বললেন: ওয়ান অফ দ্য ডেঞ্জারাস এয়ারস্ট্রিপ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
মল রোডেক্রাইস্ট চার্চের পাশের ওয়াইএমসিএ মিলনায়তনেআমরা পৌঁছলাম আড়াইটায়। তার আগে শান-ই-হিমাচলে লাঞ্চ খেতে যেয়ে ভয়ংকর চমকে উঠলামএখানেই আমি আর শিরিন উঠেছিলাম সেবার। হার রে সময়তুই কখনো দাঁড়াস না। স্মৃতি সর্বদাই অতীতের। অথচ এখনো মনে হচ্ছে আমি আর শিরিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিমানালী যাবো, কি যাবো না।
*
শ্রী প্রেম শর্মা--হিমাচল রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি-সচিব এসে সভাপতির আসন গ্রহণ করতেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। হলঘর কানায় কানায় পূর্ণ।
কথা শুরু করলেন সুদর্শণ বাশিশাত‘একাডেমী অফ আর্ট, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার’-এর সেক্রেটারী। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করলেন: যতই রাজনীতির অ্যাটম-বোমা গর্জাক না কেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদেও ভুললে চরবে না যে বারুদের চেয়ে কলমের কালিই শক্তিশালী। মানুষ যদি সাহিত্যে ফিরে না আসে, সাংস্কৃতিক ঔদার্যকে গ্রহণ না করেতারা রয়ে যাবে ‘বেয়াদব’! আমি খুবই অবাক হলাম তার শব্দ নির্বাচন দেখে। কারণ, আরবিতে ‘আদব’ শব্দের অর্থ ‘সাহিত্য’উর্দু বা ফার্সীতে এর চল্ আছে বলে জানতাম না। অথচ বোঝাই যাচ্ছে যে সুদর্শন বাবু এটা জেনেই কথাটি বলেছেন। আমি ভাবলাম, বশিষ্ট মুনীর বংশধারার লোক তোঅলৌকিক-জ্ঞানী তো হবারই কথা!
এখানেও এক প্রস্থ উপহার পেলাম আমরা। বক্তৃতাও দিলাম। কিন্তু লোকজন চেচিয়ে উঠলো: শের-শের! কবিতা পড়লাম ‘রুবাইয়াত’ থেকে এবং গতকালের ‘হাফেজ’।
স্টেজ থেকে আমাকে প্রায় টেনেই নামিয়ে নিলো সাংবাদিক উষা নেগি। পেছনের টেবিল-চেয়ার দখল করে সে অন করলো তার টেপ রেকর্ডার।...
পরদিন ‘হিমাচল নিউজে’ বেরুলো আমার সচিত্র সাক্ষাৎকার। ‘চন্ডিগড় সমাচার’ পুনর্মুদ্রণ করলো তৃতীয় দিন ।===>>
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৪