ছোট্ট শহর খুলবাবাদ। নামটাও স¤্রাট আওরঙ্গজেবের দেয়া। কেন জানিনা, সবচেয়ে রক্ত-ঝরানো এই স¤্রাট জীবনের শেষ দিকে হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে ধার্মিক এবং পরহেজগার। হতে পারে এটা তার ‘অনুতাপজনিত’ মর্মবেদনা; হতে পারেসত্যিকারের প্রত্যাবর্তন! জানি না, মানুষের চেতনা-পরিবর্তনের গূঢ়ার্থ কি! একদল অন্ধ-সমার্থক বলে বেড়ান: আওরঙ্গজেব ছিলেন জিন্দাপীর! ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিতিনি টুপি সেলাই আর কোরান নকলের পয়সা দিয়ে দিনানিপাত করতেন। ‘পাকিস্তানী’ এই অতি-অলৌকিকতার ‘ভূত’ আমাকে এও শিখিয়েছে যে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক চৌষট্টিটা ফজলী আম খেতে পারতেন; কনুই দিয়ে ঝুনা-নারকেল ছিলতে পারতেন...। ঘটনা সত্যি হলেও আমার প্রশ্ন জাগে: সেই পাঠ্যবই-প্রণেতারা কি কখনো আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, ‘লাহোর-প্রস্তাব’ ইংল্যান্ডের গোলটেবিলে পেশ করেছিলেন এই হক-সাহেব? তিনিই জমিদারী প্রথার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে বলেছিলেন: ‘লাঙল যার জমি তার’। সেকথা যে মোসাহেবরা কোথাও উল্লেখ করেননি, তারাই আওরঙ্গজেবের মত বিশাল সা¤্রাজ্যের বিপুল ব্যস্ত-স¤্রাটকে এভাবে ‘মহান-দিনমজুর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আশ্চর্য হয়ে ভাবি: এই মহাপ্রতাপান্বিত-স¤্রাটের পীরশেখ যায়নুদ্দীন সিরাজী বা তার পীরের-পীর শেরে-খাজা হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী (সুলতানুল হিন্দ্)-ও তো এত কৃচ্ছতা সাধন করেছেন বলে ইতিহাসে প্রমান পাওয়া যায় না। আর তিন-ভাইয়ের-হত্যাকারী, বাপকে-বন্দীকারী স¤্রাট হয়ে গেলেন ‘আউলিয়া’!
বিপরীতপক্ষে আরেকদলমারাঠা-জাঠ-রাজপুতদের সুরে সুর মিলিয়ে আওরঙ্গজেবের চিহ্নিত করেনধর্মান্ধ, গোঁড়া এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবেযা আদৌ সত্য হতে পারে না বলে আমরা আগেই জেনেছি। কারণ, তিনিই মোঘল-মনার্কদের মধ্যে দীর্ঘতম শাসকযার প্রশাসনের শতকরা একত্রিশভাগই ছিল অমুসলিম। বলার মধ্যে একটাই বাকী থাকেজিজিয়া বা ‘ধর্ম-কর’। সেটা আসলে জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই পুনর্বহাল হতে শুরু করেআলমগীর যাকে শুধু সুবিন্যস্ত করেছিলেনকারণ, তিনি ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক।
খুলদাবাদের দীন-হীন সমাধী আর বিবি-কা-মকবরার মধ্যেই আমি আওরঙ্গজেবের দুটি রূপ দেখতে পাইফকিরী এবং রাজকীয়।
“রওজা” নামে পরিচিত এলাকায় ঢোকার রাস্তার মুখে দাঁড়াতেই পাগড়ি-পড়া এক শিখ এগিয়ে এসে সালাম দিলোস্যার, আপ হি তো ডাক্তার-সাব? বাংলাদেশী মেহমান?
হাঁ-জি, আপ হ্যায় কৌন?
আপকা ভাইমাথির সিং। প্রফেশনাল গাইডকৃঞ্চজী হামকো ইধার ভেজা, স্যার।
ও-ও।
এনিথিং রঙ, স্যার?
নো-নো। কাম অন। হেল্প মি টু প্রসিড, প্লিজ।
আমরা ঢুকলাম বোম্বে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাশের ছোট রাস্তা ধরে। প্রথমেই পড়লো ‘স¤্রাটের-সমাধি’। ছ-সাত ইঞ্চি-মাত্র উঁচু ঘের-দেয়া সমাধীর উপরটা খোলামাটি সামান্য উঁচুধনুকের মত; সেখানে কিছু তাজা ফুল বিছানো। পুরো কবরের উপর কালো আবলুস-কাঠের একটা কাঠামোঅনেকটা আমাদের খাটের উপর মশারী টাঙাবার স্ট্যান্ডের মতযা ইচ্ছে করলেই সরিয়ে রাখা যায়। মাথির সিং জানালো, এটাই তৈরী করে দিয়েছেন হায়দ্রাবাদের প্রথম নিযামআসফ জাহ্যার কবর সামনেই। অজ্ঞাত কারণে, ‘বিদ্রোহী’ এই সেনাপতি সমাহিত হতে চেয়েছিলেনএই বেহেশতের-বাগানেতার স¤্রাটের পাশেই।
নিযামের সমাধিটি চমৎকার সাজানোছোট ইমারতের ভেতরে দারুণ অলংকৃত। আমার ভেতরে যেতে অনীহা দেখে মাথির সিং বললো: স্যার, আপনি বোধ হয় ইতিহাসের অধ্যাপকতাই না? সে কারণেই নিযাম শাহীর প্রতি শ্রদ্ধা নেই!
আমি অবাক হয়ে বলি: না, তা কেন হবেমাথির সিং?
নইলে ‘রওজা’য় এসে কবর দেখবেন নাসে কি করে হয়স্যার?
আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে কবর দেখতে আমার আপত্তি নেই, সিংআপত্তি ফুল-চন্দনে। মহামানবদের কবরে আমি অনেক গেছিমদিনাতুন্নবীতে আমাদের প্রিয় নবীর কবর; জেরুসালেমের সেপালসার চার্চে নবী ইসার সমাধি, উত্তর প্রদেশের কুশিনগরেযেখানে সমাহিত করা হয়েছে মহামতি গৌতমকে, গুরু নানকের কার্তারপুরে , বাব এর সমাধি, নবী মুসার শেষ যাত্রাস্থল , কনুফুসিয়াসের কবর সর্বত্রই সমস্যা হচ্ছে ঐ অতি-ভক্তি। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছি সৌদি আরবে; যার সরকার বিষয়টাকে আবার বাড়াবাড়ি রকম সিরিয়াসলি নিয়েছেবৈধ্য সম্মান-প্রদর্শনেও তারা উদাসীন! যাই হোক, কবরগুলো প্রায় সর্বত্রই ‘পূজার-আখরা’এটাই আমার অপছন্দ। কেউ কি মহামানবদের জীবন থেকে শেখে না যে তারা ঈশ্বরেরই বার্তাবাহকনিজে ঈশ্বর নন?
আপনি ঠিকই বলেছেনএটা আমিও মানি, স্যার। কিন্তু কি আর করা, বলুনএটা তো হিন্দুস্থান! পূজা আমাদের রক্তে; আর ফুলচন্দনেই আমাদের প্রশান্তি ও আনন্দ। একটা উদাহরণ দেই, স্যারবেয়াদবী না নিলে?
না-না, নির্ভয়ে বলোমাথির!
ভারতীয় ‘সাহিত্যে’ বা ‘ধর্মে’ যতোটা জাযগা দখল করে আছে প্রেমতার চেয়ে কি বেশি জায়গা নেয়নি রাগ-অনুরাগ-অভিমান?
আমি আশ্চর্য হয়ে বলি: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। কিন্তু এর সাথে ওর কি সম্পর্ক?
আবার দেখুনঅভিমান বা অনুরাগ শব্দটিই পশ্চিমে পরিচিত নয়। কারণ কি, স্যার?
তুমিই বলো।
কারণ, আমরা এই ‘আবেগের’ মধ্যেই বড় হইজল-জঙ্গলের নিবিড়তা আর মরুভূমির রুক্ষতা বা বরফের কাঠিণ্যের মধ্যে ফারাক থাকবে না, স্যার? সরাসরি কথা বলার চেয়ে তীর্যকেই আমাদের বেশি তৃপ্তি। পজিটিভলি বললে বলতে হয়: আমরা আসলেই কাব্যিক-সভ্যতা এবং আমাদের এই রেনেঁসা ঘটেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেযখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে শ্রীকৃষ্ণ ‘মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই নবজীবনের জাগরণ’ বলেছিলেন।
তাহলে বর্ণাশ্রমসেটা কেন মেটালেন না কৃঞ্চ-দেব? গীতায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, চাড়াল-চন্ডাল তুলে দেবার কথা বলা হল না কেন, মাথির?
এরিস্টোটল বা প্লেটো কি দাস-প্রথার বিপক্ষে কিছু বলেছেন, স্যার?
আমি চোখ নিচু করে বলি: না, তারাও বলেন নি। বরং তারা দাসপ্রথাকে মৌন সমর্থনই দিয়ে গেছেন।
তাহলে বুঝুনশ্রীকৃষ্ণের আর দোষ কি? তিনি তো আরও হাজার বছর আগের! এসব বলে-কয়ে মাথির সিং আমাকে আসফ জাহ’র কবরে নিয়েই ছাড়লো। এবং আমি ভয়াবহ মৃত্যুচিন্তায় আপ্লুত হলামইতিহাসের শ্রেষ্ঠ-নগণ্য সব মানুষই পৃথিবী থেকে একদিন হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছে তাদের সবকিছুদু-এক শতাংশ ছাড়া। যাদের নাম বা বদনাম সমকালকে ছাড়িয়ে ওঠে, তারাই আসলে অমরসে ক্যালিগুলা বা নিরো হোক; কিংবা হোক বাবর বা আওরঙ্গজেব। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই খ্যাতির-কাঙাল-মানুষদের জীবনকাহিনীই পৃথিবীর ইতিহাস। স্পার্টাকাসের পাশাপাশিই বিশ্বপাঠকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় চেঙ্গিশ খানের নামকিন্তু ‘খ্যাতি’ নয়। এই ভবিতব্য হয়তো চাননি হিটলার কিংবা ইয়াহিয়া খানকিন্তু কর্ম তাদেরকে বাধন ছিড়ে উড়তে দেয়নি। যেমন আওরঙ্গজেবনিজেকে মেশাতে চেয়েছেন ভারতের সাধারণ-মাটিতে; মহান ধর্মপ্রচারকদের পাশেই। কিন্তু ইতিহাস তার কর্মকে ঠিকই বেঁধে রেখেছে সাদা-কালো সুতোয়। এভাবেই মানুষ নিন্দা-প্রশংসায় অমর হয়ে বাঁচে। কেউ গান্ধী, কেউ মেন্ডেলা, কেউ নেহেরু-জিন্নাহ আর কেউ শেখ-মুজিব। অর্থাৎ দেহ মরে গেলেও সত্তা বা কর্ম বেঁচে রয়। তাহলে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে দম্ভ কিসের? কেন মানুষ ফালতু বিতর্কে লিপ্ত হয় পারলৌকির জীবন নিয়ে?
ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে আমরা ঢুকি বড়সড় এক বারান্দায়। ওপাশের আঙিনাটা বেশ শক্ত পোক্ত এবং নান্দনিক।
কি এটা? আমি মাথির সিংকে প্রশ্ন করি।
ওটা হলো গোলকুন্ডার শেষ রাজা তানাশাহ’র কবর, স্যার...।
*
আমরা ঢুকি শেখ বোরহানুদ্দীনের মাযারে। আশ্চর্য প্রশান্ত জায়গাপুরোটাই পেস্ট কালারে রঞ্জিত। ভেতরের ছোট্ট সৌধটি ধবধবে সাদা মার্বেলে ছাওয়া। মাথির সিং আমাকে হযরত বুরহানউদ্দীনের জীবন কাহিনী শোনায়। দিল্লীর খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়ার ‘খলিফা’ ছিলেন তিনি। ওস্তাদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে খুলদাবাদে আসেন এবং দানশীলতা, সুফীবাদ ও চিশতিয়া-তরিকায় প্রচার শুরু করেন। কিছুকাল এখানে থেকে তিনি দক্ষিণে চলে যান। তিনি এত উঁচু মাপের দরবেশ দরবেশ ছিলেন যে, মুহাম্মদ তুঘলক তুঘলকাবাদ দূর্গে প্রবেশের আগেই বুরহানউদ্দীনকে এ-অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বলেন ।
জবাবে বুরহানউদ্দীন জানান: হে ভারতের সুলতান, মানুষ কেউ কারো ভাগ্য জানে নাআমিও না, আপনিও না। বিনয়ী হতে শিখুন; নইলে আপনি নিজেই আপনার বিপদ ডেকে আনবেন। বাদশাহী শুধু আল্লাহর এবং তিনি যাকে খুশি তাকে তা দিয়ে ধন্য করেন। আর, মহাজ্ঞানী আল্লাহ শুধু অনুগতদের পছন্দ করেন।
বুরহানউদ্দীন খুলদাবাদ ত্যাগ করার আগেইতুঘলককে রাজধানী পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হয়এবং তিনি চিরকালের জন্য দৌলতাবাদ ছেড়ে যান। কিন্তু, হযরত বুরহানউদ্দীন চার বছর পরেই দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে আসেনসেখানকার বিভিন্ন স্থানে ‘খানকা’ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেই। এবং এখানেই আবার এখানে ১৩৪৪ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আসির-গড় দুর্গ-শহরের নাম কি তারই স্মরণে রাখা হয়?
বুরহানপুর?
জি-হা, স্যার।
বলো কি?
ঠিকই বলছি, স্যার। তিনিই হলেন বুরহানউদ্দীন গরীব। দীন-দুখিদের আশ্রয়। খুবই ভালো গায়ক ছিলেন। আবার কোরানও তেলাওয়াত করতেন সুমধুর স্বরে। তার পনেরোশো ছাত্র ছিলযারা সারা ভারতেবিশেষত মধ্যাঞ্চলে আপনার ধর্মের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন বলেই হিন্দুস্তান থেকে পাকিস্তান হতে পেরেছে, স্যার!
*
খাজা-গরীবের ডানেই আসফ জাহ’র কবরবামে তার দ্বিতীয় পুত্র নাসির জং।
আমরা হেঁটে একটু দূরে যাইমালিক আম্বর এবং সোহান-বাউলির কূপ এখানে। মালিক আম্বর ছিলেন আবিসিনীয় মার্সেনারী । শিশুকাল থেকেই তিনি যুদ্ধ-বিদ্যায় ভয়ংকর ‘পারদর্শী’ হয়ে ওঠেন এবং ভাগ্যান্বেষণে এসে আহমদ নগরের রাজসভায় মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রবর্তক তিনি যা শিখে এসেছিলেন সুলতান সালাউদ্দীন আইউবীর বাহিনীর কাছ থেকে এবং প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন বাহরী-মামলুকদের হাতেযারা পরাস্ত ও বিতাড়িত করেছিল হালাকু খানের উত্তরসুরীদের! দৌলতাবাদ শহরকে তিনিই নতুন করে আবাদ করে এর নাম দেন ‘খাদকী’। কিন্তু ১৬৫৭’য় আওরঙ্গজেব একে পুনর্দখল করে নাম দেন ‘দৌলতাবাদ’।
নূরজাহানের বিপক্ষে যেয়ে তিনি স¤্রাট শাজাহানকে মসনদ দেখল করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন। পরবর্তীতে মালিক আম্বর শাজাহানের বশ্যতা স্বীকার করে বেরার ও আহমদনগর মোঘলদের হাতে সমর্পণ করেন। কিন্তু এই বিদ্রোহী কাফ্রিকে মোঘলরা বিশ্বাস করতে পারেননি বলে তিনিও তার তরবারি ছাড়েন নি। দিল্লী-আগ্রা থেকে বের হয়ে তিনি মারাঠাদের সাথে যোগ দিয়ে ক্রমাগত ১০ বছর শাজাহানকে দাক্ষিণ্যাত্যে অস্থির করে রেখেছিলেন। দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রেখে মালিক আম্বর মারা যান ১৬২৬এ। হযরত খাজা জারজারি জারা-বক্সের অনুসারী হয়ে তিনি তার পাশেই সমাহিত হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শাহজাহান সেটা হতে দেননি বলেই রওজায় তার জায়গা হয়নি। এজন্যেই তার সমাধী এখানেশহরের একটু বাইরে।
আম্বরের কোন বংশধর ছিল না, মাথির সিং?
লোকে হাবশীদের প্রায়ই ‘খোজা’ ভাবে, স্যারবাস্তবতা মোটেই সেরকম নয়। আফ্রিকার হ্রদ-অঞ্চল থেকে আসা এই মানুষগুলো আকারে ছিল বিশাল, শক্তিতে দুর্দমনীয় এবং বিশ্বস্ততায় অতুলনীয় বলেই স¤্রাটরা এদেরকে দেহরক্ষী বা হেরেমের কর্তা বানাতেন। পাকিস্তানে এরা এখনো আছে, যাদের বলা হয় সিদ্ধিপারস্যে সিদি; আর আরবে হাবশি।
দারুণ বললে তোএবার বলো তার পরিবারের কথা।
মালিক মারা যান ৮০ বছর বয়সেতার মাত্র তিন বছর আগে তার শেষ সন্তান জন্ম নেয়। তার প্রথম কন্যার জামাতা আহমদ নগরের অধিপতি হনদ্বিতীয় মর্তুজা নিযাম শাহী। আরেক কন্যা দৌলতাবাদের গভর্নরের স্ত্রী হন। বড় ছেলে ফতেহ খান হায়দ্রাবাদের দরবারের মন্ত্রী ছিলেনকিন্তু বাপের মত অতটা যোগ্য ছিলেন না।
আর শেষ ঐ-কন্যা পরবর্তীতে সিরকাশিয়ান কমান্ডার মুকাব্বার খানের গৃহকর্ত্রী হন এবং প্রখ্যাত মোঘল সেনাপতিদের অন্তর্ভূক্ত হন। যার টাইটেল ছিলখান-ই-খানান।
আমি ছোট্ট ডোমের চারপাশে হাঁটি আর বুঝতে চেষ্টা করিবাঘের মত হিং¯্র, শিয়ালের চেয়ে চতুর আর হরিণের চেয়ে ক্ষিপ্র এ-সকল মহাবীরেরা তো সকলেই মাটির-কবরে থিতু হয়েছেন। সব শক্তি, সব সাহস, সব উল্লাস আর সব নৃশংসতার পরিসমাপ্তি তো মৃত্যুতেই। হায়, খোদাকী অপূর্ব রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন আমাদেরকেচাঁদে যাও, কিংবা ক্লোন বানাওসব মাত্র একশো বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারপরই শীতলতা, ঘুম আর চির-অবকাশ।
অথচ, স্যারদেখুন, এই দৌলতাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার গড়া খাল (নাহার) এখনো সচল। সেই যুগে তিনি বায়ুকল (উইন্ডমিল) বানিয়ে পানি তুলেছেন নদী ও লেক থেকেঐ পাহাড়ের উপরেও।
সত্যি নাকিশুনিইনি কখনও।
আম্বরের আরেকটি কুখ্যাতি বা গুজব আছে, স্যার।
কি সেটা?
লজ্জা পাচ্ছি, তবে অভয় দিলে, বলি।
বলতে বলতে মাথির সিং হযরত জারজারি জারা-বক্সের সমাধির বারান্দায় বসে পড়ে; আমিও বসি।
কি জানি কেন, কবরস্থানে সব সময়ই ঠান্ডা বাতাস বয়আমার চোখে ঘুম নেমে আসতে চাইলো।
কিন্তু মাথির সিঙের মৃদুভাষ্যে আমি ধরমর করে উঠে বসতে বাধ্য হলাম।
মালিক আম্বরের পৌরুষ ছিল এত বেশি যে নিযাম-শাহী থেকে আহমদ নগর, বিজাপুর থেকে শিবাজী-মারাঠা পরিবার এবং দৌলতাবাদ থেকে দিল্লীর বহু রাজনন্দিনী বা মহিষীই তাকে প্রবলভাবে কামনা করতেন। একজন ঐতিহাসিক এও বলেছেন যে শিবাজী, বিজাপুরের সুলতান, হায়দ্রাবাদের নিযাম, দিল্লীর সুলতান সহ বহু রাজা-বাদশার ঘরে তার বেশুমার সন্তান ছিল। লোকে আম্বরকে নিয়ে ফিস ফিস করতো যে তিনি ‘মুসলমানদের শ্রীকৃষ্ণ’!
মনে হচ্ছিলে আমি তন্দ্রার ভেতর আরও কিছু নাম শুনেছিসচেতন হবার পর যা আমার আর মনে পড়লো নাযার ভেতরে অন্তত দু-তিনজন স¤্রাটের নামও আছে বলে মনে-মনে মনে হলেও, পরিস্কার স্মৃতিতে নেই।
চলুন, স্যারলাঞ্চ করি। আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন।
ক্লান্ত না হলেও আমি তার হাত ধরে উঠলাম। চলো, মাথির সিংখাঁটি দক্ষিণী-থালি চাইয়েকমপ্লিটলী ভেজ হতে হবে।