আশ্চর্যের কি জানেনআলীয়া মাদ্রাসা কিন্তু কোনো মুসলিম ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা করেননি। যেমন স্যার সৈয়দ আহমেদ গড়েছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়।
তাহলে? কে করলো ‘ম্লেচ্ছদের’ এত বড় উপকার?
ওয়ারেন হেস্টিংস। ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সির গভর্নর।
আশ্চর্যের বিষয়!
হ্যাঁ, আর এখান থেকে কারা গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরিয়েছে, জানেন?
আমার জ্ঞান কি অদ্দুর যায়, স্যার?
আমাদের ঢাকার নবাব আবদুল লতিফযার নাতী খাজা সলিমুল্লাহর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের হৃৎপিন্ডঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীবঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু! আমাদের এককালীন মূখ্যমন্ত্রী ও এরশাদ আমলের প্রধানমন্ত্রী খান আতাউর রহমান এবং অবিস্মরণীয় বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ!
মাশাল্লাহতপন আমাকে অবাক করে ঠেলে নিয়ে যায় ঘর্ঘর ট্রামের দিকে। স্যার, ট্রামে উঠে বাকীটা শুনবো। চলুন, ট্রামে আজই উঠতে হবে।
রফি আহমদ কিদোয়াই রোড থেকে (২২ নম্বর) ট্রামে চেপে আমরা বিবিদি বাগ যাই।
এই বিবিদি বাগ মানে কি, স্যার?
বিনয়-বাদল-দিনেশ। বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের তিন বীর শহীদ!
বিবিদি-বাগ থেকে মেট্রোতে চিৎপুর যাই আমরা এবং ফিরেও আসি। বিস্মিত তপন অবাক হবারও সুযোগ পায় না। কারণ, নাভী খোলা, স্লিভ-লেস দিদিদের শার্মিলা ঠাকুর-মার্কা চেহারা-সুরত দেখে তার জিভ শুকিয়ে গেছে। কানে কানে বলে সে: স্যার, এই শহরে আপনি ক্যামনে মাথা ঠিক রাখেন? আমার তো এখনই দফা-রফা।
ভিজে গেছেন, নাকি?
না-না, তবে বেশি দেরীও নেই, মনে হচ্ছে!
মধ্যরাতে খেলাম ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের ছোট্ট এক দোকানে। কাবাব-রুটি আর সালাদ। পুরো ভারতেই সালাদ কিনে খেতে হয়শুধু পশ্চিমবাংলা ছাড়া! আমি আমার আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে কত বার যে এই সালাদ-কেনা নিয়ে বিপদে পড়েছি, আল্লাহ মালুম! আমরা ঢাকার মানুষেরা শুধু যে অসহিষ্ণু তাই নয়, গ্রহণেও অপারগ। আল মাহমুদ আমায় একবার বলেছিলেনগ্রহণ শেখায় নদী। এমনকি মলকেও সে প্রত্যাখ্যান করে না। আমরা সেই নদী হত্যা-করা জাতি! একদিন দেখতে পাবিনদীই এর প্রতিশোধ নেবে! সেই শোধবোধ যে শুরু হয়ে গেছেঢাকার যে কোনো লঞ্চঘাটে গেলেই নাক তা বলে দেয়।
হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরি। ঘুমিয়ে পড়ি দ্রুত। কাল দিনটা নষ্ট হবে এয়ারপোর্টে যাই-যাই করে। তারপর আবার বিকালের ফ্লাইট। ডিলের সম্ভাবনা সমূহ। এর আগে আমি একবার হায়দ্রাবাদ পৌঁছেছিলাম রাত তিনটায়। সেদিনই ঢাকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিলযার পোষাকী-নাম ‘ওয়ান-ইলেভেন’। সেদিনের বিব্রতকর পরিস্থিতির গল্প আরেক দিন হবে!
হাজারো দোকানফুচকা, চটপটি, জামা-জুতা-সেমিজ-খেলনাকী নেই?
আমরা বসলাম ছোলা-বাটোরার দোকানে। অদ্ভুত নরম আর কম্বলের মত ফোলা ফোলা লুচিগুলো এরা কিভাবে বানায়তার সুলুক-সন্ধান কখনো পাইনি আমি। একবার অপর্না সেন আমায় বলেছিলেন: আল মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করিসপেয়ে যাবি। কি রকম, দিদি? আমি সকৌতুকে জানতে চাই। আরে, যত গোল জিনিস পৃথিবীতে আছেআমার প্রিয়তম কবি তো কেবল তার দুটো তুলনাই জানেস্তন আর নিতম্ব। এখন আবার ‘হুজুর’ হয়ে লিখছে ‘ইসলামী-প্রেম’! শালার মাল বটে, একটা!
আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি: মাহমুদ ভাইর চেয়ে সফলভাবে কেউ কি যৌনতাকে শিল্পে রূপান্তর করতে পেরেছে, দিদি?
তুই তো তার তালবে-আলেম। তোর তো তাইই মনে হবে। আমরা ওর ভেতর-বাইরের সবটাই জানি। এটা অবশ্যই ঠিক যেঅমন বড় কবি জীবনানন্দ দাশের পর কেউ জন্মেনি বাংলা ভাষায়। জসিম উদদীনের আধুনিক সংস্করণের সাথে ব্যাটা মিলিয়ে দিয়েছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাটি ও মাদকতা। তেল-জল মিশিয়ে আল মাহমুদের কবিতা যেন মকবুল ফিদা হোসেনের ছবি। না দেখেও পারা যায় না, আবার দেখলেও মাথা ঘোরে।
বলতে বলতে তিনি আবৃত্তি করতে শুরু করলেন, সোনালী কাবিনের ১০ নম্বর সনেট
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে শ্রমজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাঁদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয় ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি, নারী।
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ;
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।
অর্পনা সেনের সাথে সেবার একটা চূড়ান্ত লজ্জার ঘটনা ঘটেছিল। তার পরম-প্রিয় কবি আল মাহমুদ একটা চিঠি আর আর ‘আড়ঙ’ থেকে একটি ‘গিফট’ পাঠিয়েছিলেন আমার হাতে। দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারসাথে ফিসফিস সাবধান-বাণী: কাউকে দেখাবি না। তো, কলকাতার ভয়ংকর ল্যান্ড-ফোন থেকে তাকে ফোন দিলাম ছিয়াশির তেইশো জুনপলাশী দিবসে। বললাম: কবি আল মাহমুদের প্রেমপত্রের “মেঘদূত” আমি। কই পাবো তার ‘স্বপ্নের রাণী’কে? খুশী-হওয়া নায়ীকা ওপাশ-থেকে হেসে বললেন: ঠিক দুটোয় চলে আসুনকফি হাউসে।
কোথায় পাব আপনাকে?
তিন তলায় “জিজ্ঞাসা”র আপিসে।
এক-ঢিলে দুই-পাখি মারার তীব্র আনন্দে মাতোয়ারা আমি। দেড়টাতেই পৌঁছে যাই কফি-হাউসে। চমৎকার উর্দী, শেরোয়ানী-পালক-পাগড়ী পড়া বাটলার ডেকে কফি-কেক খাই। তারপর জেনে নেই ‘জিজ্ঞাসা’র অবস্থান কোন্ দিকে?
ঐ-তো উপরে তাকান। অবাক বাটলার আমাকে হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল।
শিব নারায়ণ রায়ের সামনেই বসেছিলেন রাজর্ষী-অপর্ণা। পরিচয় দিতেই বললেন: আসুন আসুন। আমি তো একটায় এসে বসে আছি। আপনিই তো দেরী করলেন!
সর্বনাশ! মনে মনে ভাবি: এ দেখি লাইলী-মজনুর কাহিনী! বসলাম পাশাপাশি, আর টের পেলাম পাল্স-রেট বেড়ে যাচ্ছে। শিব নারায়ন রায় হাজির-হওয়া মাত্র মিস-কলকাতা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: দিন দেখিকি পাঠিয়েছে মাহমুদ-দা?
আমি বাড়িয়ে দিলাম একটি চাবির রিঙ, একটি পাটের ব্যাগ, আর চিঠি। ব্যাগটা বুদ্ধি করে আমিই কিনেছি। কৃপণ-কবি মাত্র চাবির রিঙটাই দিয়েছেন।
চিঠি পড়া শেষ করে উপহার দুটো দেখলেন তিনি। দুটো কেন? কবি তো একটার কথা লিখেছেন চিঠিতে।
কবি মানুষহয়তো ভুলে গেছেন! আমি ঝটপট মিথ্যে বলি।
শিব নারায়ণ রায়কেও একটা চিঠি আর দুটো কবিতা পাঠিয়েছিলেন তিনি। আর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার জন্য একটা বইযেটা আমি গতকালই ফ্রী স্কুল স্ট্রিটের পোস্টাপিস থেকে ইএমএস করে দিয়েছিবন্ধু আমিরুলকে দিয়ে।
জিজ্ঞাসার প্যাডে “প্রাপ্তি পত্র” লিখে বাড়িয়ে ধরলেন শিব নারায়ন রায়। তারপর বললেন: আপনার সাথে কি ওর কি খুব সখ্যতা, শ্রীমান?
অনেকটা আছে, স্যারকেন?
তাহলে ওঁকে বলবেন: তার কবিতার বরাত দিয়ে ‘শিবুদা’ তাকে বলেছেন: সে যেন “জিগির” লেখা বাদ দেয়।
আমি খুবই হতভম্ব! কিন্তু আমাদের দুজনকেই স্তম্ভিত করে অপর্নাদি আমার মাথা টেনে নিয়ে বাম-গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন: এটা ওকে দিয়ে দিসহে “মেঘদূত”!
লজ্জায় বোবা হয়ে আমি নিচে নেমে আসি।
**
সন্ধ্যার পরপরই তপনের বনগাঁর “কাজিন” এসে পৌঁছুলো। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না তপন এমন ‘কান্ড’ করতে পারে! এ-কাজিন তো কোনও ছেলে নয়জ্বলজ্যান্ত এক সুন্দরী! রাগ হতে যেয়ে সামলে নিলাম আমার স্ত্রীর-বলা একটা গল্প মনে পড়ায়। দিলরুবা এখন কাজ করে ট্রাভেল এজেন্সিতে। প্রায়ই আফিস ফিরে গল্প বলে: আজ কি কান্ড হয়েছে, শোনো। এক হাজী-সাহেব এসেছিলেন, ব্যাংকক যাবেন। আমার সঙ্গে কথা বলবেন না, কারণ আমি ‘চুল-খোলা মেয়ে-মানুষ’। আমার সামনের চেয়ারে বসতেও নারাজ তিনি। জোড়া-প্যাকেজ নিলেন ব্যাংককের। তার সহযাত্রীর স্বামীর নাম-ঠিকানা ভিন্ন! দেখে আমি অবাক হয়ে তাকাতেই এম.ডি. স্যার চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। হাজী সাহেব চলে যাবার পর স্যার বললেন: উনি আমাদের ভি.আই.পি. কাস্টমার; প্রতি এক-দুই মাস পরপরই ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর বা দুবাই যানবান্ধবীকে নিয়ে। প্রায়ই দেখবেন, নতুন নতুন পাসপোর্ট দিচ্ছেন। হি ইজ ভেরি ইমপরট্যান্ট ক্লায়েন্ট অফ আওয়ার কোম্পানী। কে তার সঙ্গী সাথী, তা দেখা এজেন্সীর বিষয় নয়।...
সুতরাং তপনকে গালি দেবার আগেই রাগটা গিলে নিলাম। তার কাজিন একবিংশতী-বর্ষিয়া তরুণীনাম নন্দিনী! নামের মতই অপরূপা। নন্দিনীর জন্য সিঙ্গেল রুম খোঁজা হলোকিন্তু পাওয়া গেল না। শেষে ডাবল রুমই নিতে হলো। যদিও ‘ভদ্র-ছেলে’ তপন রুম পাল্টালো না।
**
ভাবতে ভাবতে আমাদের ‘ক্যাব’ নেতাজী সুভাষ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। কঠোর নিরাপত্তা বেস্টনী পার হতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল। মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার তপনকে বাংলাদেশী দেখে আটকে দেয়। আবার আমাকে পার্মিশন নিয়ে ইয়োলো দাগ পার হয়ে ফেরত আসতে হয়। অফিসারকে আমি বুঝিয়ে বলি যে আমরা দু-দিন আগেই এসেছিযাবো আগ্রা-দিল্লী ঘুরতে। ট্রেনের টিকেট না পেয়ে বিমানে যেতে হচ্ছে। কলকাতা থেকে এজন্যই কলকাতা থেকে ডমেস্টিক টিকেট কিনেছি, ম্যাম। এই যে আমাদের পাসপোর্ট; দেখুন।
শেষ পর্যন্ত ইন্ডিগো’র আরামদায়ক সিটে বসে যখন হাঁফ ছাড়লামতখন আমি বিধ্বস্ত! বরাবরের মতই কাস্টমস-ইমিগ্রেশন আমাক টেন্স করে রেখেছিল।
তপন প্রথম প্লেনে উঠে খুবই এক্সাইটেড। বাচ্চাদের মত জানালা ভেঙে বাইরে দেখতে চায়। আমি হেসে বললাম: সুন্দরীরা এসে যখন গরম ভেজা-কাপড় দেবে মুখ মুছতেতখন দুটো কটন চেয়ে নিয়েন, জনাব শয়তান!
যথারীতি সুন্দরী মহিলারা এলো আর সে কটন নেবার বদলে দেখতে লাগল তাদের গ্লাভ্স-ধরা হাত থেকে শুরু করে আট-সাঁট দেহের নিচের কম্পমান-স্ফিতবক্ষ পর্যন্ত। এরপরে আবার চকোলেট আর ম্যাঙ্গো-ড্রিংস পেয়ে আমাকেই ভুলে গেল।
ট্যাক্সিয়িং শেষে প্লেন দৌড় শুরু করলো। ভোঁ ভোঁ শব্দে কান ঝালাপালা। তপন বললো: স্যার, মাথা ব্যথা করছে ক্যান?
চোখ বুজে আরাম করুন, কমে যাবে।
স্যার কানও ব্যথা করছে যে।
তুলো গুঁজে দিন।
ওহ-হো, ভুলেই তো গেছি তুলা নিতে!
চোখ বন্ধ করে বার-বার ঢোক গিলুন, আর মুখ খুলে বড়-বড় শ্বাস নিনজোরে-জোরে।
দশ মিনিট পরে বোয়িং সোজা হতেই সুন্দরীরা ফিরে এলো, আর নিভে গেল ওয়ার্নিং সিগনাল। তপনের কান ভোঁ-ভোঁ করাও কমলো।
খাবার দেয়া হলো। নন্দিনী তপন দুজনেই খানিকটা অসুবিধায় পড়লো। প্লেনের ব্যবস্থাপনা সবসময়ই প্যাক্ড-সার্ভিস। সরু পরিবেশ সর্ব্বোচ্য আপ্যায়ন। ঢাকার চক বাজার বা দিল্লীর চাঁদনি-চকের মতোচাপাচাপি। সব কিছু ইন-অ্যান-এনভেলাপ। ছোট্ট এক বক্সে কেক, দই, মিস্টি, আলু-চপ, স্যান্ডুউইচ, চকোলেট, চায়ের কাপ এবং ন্যূডল্স নামের খানিকটা ময়দার কাঁদা।
মেহমানদারী-গৃহিনীরা সাজালে পুরো টেবিল ভরে যেত অথচ আমাদের খেতে হবে সামনের সিটের ছোট দেড়-ফুট বাই-এক-ফুট ফোল্ডিং ট্রেতে রেখে। অভ্যাস না থাকলে আসলেই এটা কষ্টকর। দুবার চামচ এবং চায়ের কাপ ফেললো ওরা দুজনে। শেষ বার পড়ে-যাওয়া জিনিস ওঠাতে যেয়ে নন্দিনীর মাথা ঠুকে গেল; তপন তা নিয়ে ভারী বিব্রত। আমি তাদের সাবধান করলাম সিট বেল্ট শক্ত করে বাধার জন্য। সামনের টেলিভিশন পর্দায় দেখাচ্ছেপাটনার ডান পাশেই ঝড়ের আনাগোনা।
বলতে না বলতেই প্লেন বাম্প করলো। উল্টে গেল তপনের ট্রের পুরো খাবার। নন্দিনী মেয়ে বলেই ঝটপট বাঁচিয়ে নিতে পারল নিজের ট্রের বেশিরভাগটা। তখনই ঘোষণা এলো ককপিট থেকে: সরিফ্রম ক্যাপ্টেন রাজেশ চৌহান। উই আর ইন লিটল টার্বুলেন্সড্রপ্ড ইন এ এয়ার-পকেট। সরি ফর ইয়োর ইনকনভিনিয়েন্স। আওয়ার কেবিন ক্রু উইল গো এসাপ ফর ইয়োর হেল্প। প্লিজ বি কাইন্ড টু বি সিটেড; কিপ ফ্যাসনিং সিট বেল্ট টাইটলি। থ্যাংকুয়্যু।
ভাগ্য ভালো, আর কোন বাম্পিং হলো না।...
নিরাপদেই রাত আটটায় নাযিল হলাম ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। দ্রুত প্রি-পেইড কাউন্টারে যেয়ে টেক্সি নিলাম।
কোথায় যাবেন?
নিউ দিল্লী স্টেশন কি পাস। হোটেল নর্থ প্যালেস।
এক ঘন্টা দশ মিনিটে পৌঁছলাম গন্তব্যে। ছোট হোটেল, কিন্তু খারাপ না। তিন তলায় দুটো ডাবল রুম নিলাম।
গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিচে নামলাম খাওয়ার জন্য।
শহীদুলকে ফোন করে জানাবার জন্য মোবাইল হাতে নিয়ে এবার আমিও তপনের মত বোকা হলাম। কলকাতার ভোডা-সিম দিল্লীতে অচল। টপ-আপ করাতে হবে মিনিমাম ছত্রিশ টাকা। তারপর আবার বাংলাদেশের জন্য পাওয়ার চার্জ উনচল্লিশ। খাবার পর ফোন রিচার্জ করে কলকাতার বন্ধু এবং ঢাকায় বউয়ের সাথে কথা বলে উপরে উঠলাম। তপন শয়তানী করে বললো: স্যার, বনগাঁর বনমালীর হাতে শেষ পর্যন্ত ইবনে-বতুতাও ধরা খেল?
আরে নাহ্। আপনাকে তো কলকাতায় জেনুইন-সিম কিনে দিয়েছিএয়ারটেলমাসিমাকে লাগান তো!
ওকে, এই তো মা-মনিকে ফোন দিচ্ছি।
আমরা চেয়ে চেয়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। তপন লজ্জায় লাল হয়ে বলে: স্যার, যাচ্ছে না যে!
আমি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। নন্দিনী হেসে কুটি কুটি। এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে যে আমরা শয়তান-টাইপের বাঁদর। সেও দলে শামিল হবার জন্য এগিয়ে এলো: জোর লাগান, দাদাবেশি দূর তো নাসামান্য একটা বর্ডারেরই বাধা তো!
তাও হলো না!
কারণ কি?
ওর সেট হাতে নিয়ে দেখিতপনের সিমও ‘আননোন নেটওয়ার্ক’ দেখিয়ে বসে আছে! তাড়াতাড়ি বললাম: নন্দিনী দিদি, একটু যান তো, ঐ দোকানে। ছত্রিশ আর উনচল্লিশ টাকা আই-টপ করে নিয়ে আনুন।
ওএকাই যাক না। ও তপন-দা, পারবে না?
না-রে নন্দি, পারবো না। চল্ -চল্, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।
ওরা নেমে গেলে আমি হিসাব লিখতে বসলাম। ভ্রমণে এ-আমার সারাজীবনের অভ্যাস। হিসাব না লিখলে আমি ঘুমাতে পারি না। একবার আমার এক বন্ধুর সাথে চীনে যেয়ে এমন বোকা হয়েছিলাম যে ‘চোর’-হবার উপক্রম। বন্ধু আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন সকালে ম্যাসেজের জন্য। ভুলে লেখা না-হওয়ার তিনি আর সেটা বলেন নি। বরং যাত্রাশেষে দাবী করে বসলেন: চুল-চেরা হিসেব! তখনই আমার মনে পড়েছিল কোরানের বাণী: হে বিশ্বাসীগণ, টাকা লেনদেনের বিষয় অবশ্যই লিখে রাখবে; এবং শর্তসমূহ হবে পরিষ্কারতারিখ উল্লেখ সহ।
কিন্তু ভুল যা হবার হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনার পর আমি কখনোই সেই ‘বন্ধুর’ সাথে আর কোথাও ভ্রমণ করিনিযদিও তিনি একজন ‘ধনী’ মানুষ। এবং বার বার আমার খরচ দেবার ওয়াদা করেগাইড হয়ে সাথে গেলে।
আজকের হিসাবটা পাই-টু-পাই মেলাতে পারলাম না। সকালে ও দুপুরে টুকটাক কিছু খরচ করেছি কলকাতায়; তার বিস্তারিত মনে নেই। গ্রস একটা কস্টিং মিলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুত।
*
(আসছে “মহবারতের পথে-তিন” এ)
১. ১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৮:৩৭ ০
আপনার সাথে যোগাযোগ হলে আনন্দিত হব। আশা করছি ফেসবুকে খুঁজে নেবেন আমাকে -- rezwan tanim