নাকিভুল বললাম?
না-না, ঠিকই বলছো। গুড-ডে কাজুর গায়ে কামড় বসাতে বসাতে কফির চুমুক যেন স্বর্গ নিয়ে এলো চেতনায়।
‘আমার আজকে রাতের খাবার তোর টুকটুক শিরিন ঠোঁট
গজল শোনাও সিরাজী দাওতন্বী সাকী জেগে ওঠ
লাজ-রাঙা তোর গালের মত, দে গোলাপাী রঙ শারাব
মনে ব্যথার বিনুনী মোর, খোপার যেমন তোর চুনোট।’
ওয়াহ-ওয়াহ। দারুণ, স্যারনিশ্চয়ই ফিটজেরান্ড?
ঠিক ধরেছো, মাথুর। তুমিও ফিটজেরাল্ডের ভক্ত নাকি?
এই দুনিয়ায় কে তার ভক্ত নয়, স্যার? ওমর খৈয়ামকে তো তিনিই জগতের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট করেছেন। নইলে সাত-আটশো বছরে কি তার খবর ছিল, বলুন?
তা অবশ্য ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমাকে বলো মাথুরতুঘলকের এত বদনাম কেন?
***
আমিও এর পুরো কারণ জানি না, স্যার। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা যার দরবারী ছিলেনতাকে তো পাগল ভাবার উপায়ই নেই। খিলজীদের পরে তিনি সবচেয়ে বড় সালাতানাতের শাসক হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদ, মাদুরাই, তামিল নাড়–, কর্নাটক পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। প্রচলন করেছিলেন নতুন ট্যাক্স-সিস্টেম। ঠেকিয়ে ছিলেন বর্বর মোঙ্গলদের নির্মম-আগ্রাসন...।
কিন্তু তৎকালীন বাগদাদ ও কায়রোর-প্রতিদ্বন্দ্বী দিল্লী নগরীকে তিনি অবজ্ঞা করেছিলেনহয়তো সে কারণেই তার এত কুখ্যাতি! হিন্দু-পুরানে আছে ‘চানক্যপুরীকে’ (দিল্লীকে) যে অবজ্ঞা করবেতার ঠাঁই হবে নরকে’।
যাই হোক, প্রথমত প্লেগের আক্রমণ, দ্বিতীয়ত পানিশূণ্যতা আর শেষে বাংলার-বিদ্রোহ তাকে বাধ্য করে দিল্লী ফিরতে। আবার, তিনি ছিলেন খুবই জ্ঞান পিপাসুযেমনটা সাধারণত হয়ে থাকে সুফি, ওলামা ও দরবেশদের পৃষ্ঠপোষক হলে।
তারপরেও তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল, তাই না?
***
এটা তো স্বাভাবিক, স্যার। দেখুন এই দুর্গকেইএকসময় যেখানে ছিল শান-শওকতের ঝকমকি; আজ সেখানে বাঁদুরের আস্তানা।
সত্যি বলেছে মাথুর। পুরো টানেলের ছাদে আমরা যত বাদুর ঝুলতে দেখেছিএকসাথে বেরুলে ‘ড্রাকুলা’ সিনেমাকে হাজারবার হার মানাবে। প্রথমে ভয়ই পেয়েছিলাম। মাথুর আমাকে আশ্বস্থ করেওগুলো রক্তচোষা তো নয়ই; আক্রমণকারীও নয়। গত দুশো-তিনশো বছরে এই দুর্গের বাদুর কোনো মানুষকে ভয় দেখায়নি, স্যার। বি কুল, প্লিজ।
আমার মনে পড়ে ইবনে বতুতার সফরনামার অংশ‘তিনি ছিলেন কঠোর মুসলমান। পাঁচ বেলা নামাজ ও রমজানের রোজা রাখায় আতিমাত্রায় নিষ্ঠাবান। সুবিবেচক, শক্তিশালী এবং অদম্য-বীর। জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রজাদের কল্যাণকামী...।’
বিখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুলও তার দরবারকে বলেছেন মধ্যযুগের ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ-কোর্ট । তুঘলক-দরবারের কবিতার গুঞ্জরণ, ন্যায়বিচারের সুবাতাস এবং দর্শন ও অংকের নিরবিচ্ছিন্ন ঘর্ষণে কেঁপে উঠেছিলেন চীনের ইউয়ান মহারাজা পর্যন্ত।
আমরা কামানের সামনে ছবি তুলি, আবারও কফি খাই এবং নিচে নামতে শুরু করি। আমার উরুর পেশিতে খিঁচ ধরে যায়। মাথিরের কাঁধে ভর দিয়ে আমি ধীরে নামি। মাথুর অবাক হয়ে বলে: আপনি অল্প বয়সে এত কাহিল কেন, স্যার? আমি তাকে গত তিন-দিনের করুণ কাহিনী শোনাইসোলেমান থেকে দিলতাজ বেগম এবং তাজ হোটেলের আশ্রয় লাভ পর্যন্ত কাহিনী শুনে সে শুধু বার-বার বলে: হাঁ ঈশ্বর-হাঁ ঈশ্বর। তবুও, এতো শারিরীকভাবে দুর্বল হবার কথা নয় আপনার, স্যার। বলুন তো আপনার হরস্কোপ কি? স্যাজিটারিয়াস, মানে ধনু নাকি
আমি হতবাক হয়ে সম্মতির মাথা নাড়ি।
এজন্যেই। ধনু রাশির পুরুষরা এমনই হয়মনের শক্তিতে চলে। দু:খ-আঘাত-বেদনা তাদেরকে কামানের গোলার মত আঘাত করলেও তারা উঠে দাঁড়ায় এবং সত্যের পক্ষে লড়াই করে। কিন্তু আবেগজনিত আঘাতে তারা এত কাবু হয় যে খোলা তরবারিকেও খাপে ঢোকাতে পারে না। সরি-স্যার, ঘটনাটা ভুলে যানশক্তি ফিরে পাবেন। নাহলে আগামীকালের অজন্তা-ইলোরা ভ্রমণ কঠিন হবে।
*
সকাল ন’টার মধ্যেই গাড়ি ছাড়লো মাথির। আমি বলি: মাথির, বিবি-কা-মকরাবায় একটা চক্কর দিয়ে যাই, ভাই?
কেন, ভোরের তাজমহলের সাথে মনছবি মেলাবেন?
ঠিক ধরেছো। কতক্ষণ লাগবে অজন্তায় যেতে?
ধরুন, আড়াই-ঘণ্টা। প্লাস-মাইনাস টুয়েন্টি মিনিটস।
ট্রাফিক খুব বেশি পথে?
না, স্যার। তবে দুটো ন্যাশনাল-হাইওয়ে পড়বে তোভাগ্য ভালো-না হলে ওখানেই দশ-দশ বিশ মিনিট পেরিয়ে যাবে।
অজন্তায় কেন মানুষের এত ভীড়, মাথুর?
মানুষের ভীড় না, স্যারবলুন বিদেশীদের ভীড়।
তাই নাকি? তোমরা যাও না নাকি?
যাই, যাবো না কেন? তবে বেশির ভাগই আপনাদের মত বিদেশীদেরকে নিয়ে। সাদা চামড়ার লোকেরা ইতিহাস-অতীত, আর খোলা-মেলা মূর্তির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। আমি তাদের অনেকের মুখেই ঘন্টার পর ঘণ্টা আলোচনা শুনেছিভারতীয় নারীদের স্তন ও নিতম্ব কিভাবে এত স্ফিত বা পুষ্ট হয়সে বিষয়ে। আসলে স্যার, আমার কি মনে হয় জানেনশ্বেতাঙ্গদের পরচর্চা ছাড়া আলোচনার বিষয় নেই; নেই নিজেদের কোনো মৌলিক ইতিহাসতাই ওরা আমাদের এই অতি-সাধারণ বিষয় নিয়ে অত মাতামাতি করে। দেখেন না, কামসুত্র নিয়ে কত ছবি বানালো হলিউড স্যার স্ট্যানলি লেনপুল, মিডেইভাল ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড।অথচ এটা বিজ্ঞান, আর পশ্চিম দেখায় থ্রি-এক্স! আর যদি কৌতুহলী হয়ে নিজের হোটেলেও খোঁজ নেন; দেখবেনসালারা কোন স্বদেশীনীকে নিয়ে এখানে ফুর্তি করছে নাঅজন্তা-ইলোরা এলেই ওদের দেশী-মার চাইসুবক্ষা; সুনিতম্বিনীযেন ফ্রয়েড এসে ভর করে চেতনায়।
****
আমি তার কথার জবাব দেই না; বরং হেসে একাকার হই। প্রত্যেক মানুষই তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গীতে জগতকে বিচার করে। বিজ্ঞান যদিও বলে, পৃথিবী কমলালেবুর মতকিন্তু আমাদের চোখ কি সেই-সত্য কখনো মানে?
ড্যাশবোর্ডে রাখা গাইড-ম্যাপ টেনে দেখিউত্তর-পূর্বে প্রায় ১০৫ কিলো যেতে হবে আমাদের। পথে পড়বে লেক, জঙ্গল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মসজিদ এবং হযরত গাইবান শাহ-অলির দরগাহ। চিল্লোড় রোড বরাবর রাস্তা আমাদের। ম্যাপ রেখে চোখ বুজলাম আমি।
মাঝেমাঝেই আমার মন ধন্দে পড়েমনে হয় ধর্মেই সবচেয়ে বেশি প্রগতি। কারণ, প্রগতির পথ যখনই রুদ্ধ করে দেয় মোল্লারা; কিংবা সেবকরা ভুলে যায় নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যতখনই আল্লাহ আরেকটি ধর্ম প্রেরণ করেন। তার দাপটে জন্ম নেয় নতুন-পুরোহিত, নতুন সৈনিক, নতুন ভক্তবৃন্দ। তারা উত্তাল সাগরের মত ভাসিয়ে নেয় পুরানো জঞ্জালযা ছিল একসময় সেই খোদারই পাঠানো সত্য-বাণীকালের ধারে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যা ভোঁতা হয়ে গেছে। এ কারণেই মন্দিরের উপরে গড়ে ওঠে গির্জা, আর গীর্জার উপরে মসজিদ। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসরাও আত্মসমর্পন করে রেহাই পায় না, প্রায়-স্বগোত্রীয় হিন্দু-প্রতিবেশিদের হাত থেকে। মেলে না বন্ধুত্ব বা সহানুভূতি। হয় স্যার স্ট্যানলি লেনপুল, মিডেইভাল ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড। হয়গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় নতুন-ধর্ম; নাহয় হারাতে হয় পুরানো বিশ্বাসের সাথে-সাথে প্রাণটাও।এই তো মানবজাতীর ইতিহাসচলছে; চলবেবই।
বিখ্যাত আব্বাসীয়-খলিফা হারুনার রশিদ তার সুশাসন, প্রজ্ঞা এবং ন্যায়বিচারের জন্য পাঠকের কাছে পরিচত ও প্রসিদ্ধ নাম। তার মানে এই নয় যে শাসনকার্যের সুরক্ষায় তিনি অন্যায় রক্তপাত ঘটাননি। নিজের বোনকেই তিনি হত্যা করে ঘরের মধ্যে পুঁতে রেখেছিলেন তথাকথিত ‘বিদ্রোহী-সেনাপতি’ বারবাকীর সাথে প্রণয়ের অজুহাতে । নবীবংশের মানুষ হয়েও তার হাত কাঁপেনি ধর্মের নামে এতবড় অধর্ম করতে...।
গীতায়ও আমরা দেখিসেই একই বিষয়: ‘হে অর্জুন, মৃত্যুকে ছুঁড়ে দাও।’
‘কাকে দেবো?’
‘সামনে যাকেই পাবে, তাকে।’
‘কিন্তু সামনে যে আমার শিক্ষক, ভাই, ছেলেবেলার বন্ধু কিংবা স্বজনরা দাঁড়িয়ে?’
‘ও হচ্ছে মায়াওসব পৃথিবীর আবর্জনা। মৃত্যু দিয়ে ধরাধামকে পরিষ্কার করার জন্যই তোমার-আমার আগমন, পার্থদায়িত্ব পালন করো সখা।’
খ্রিস্টানদের রক্তপাত তো আরো যুক্তিহীন। ক্রুসেডের সময় তারা ধর্মভিত্তিক প্রতিশোধ চালিয়েছে ফ্রান্সে, ইংল্যান্ডে, জার্মানীতে এবং স্পেনেনিজেদের ভাইদের উপরই। পাশাপাশি, ডাক দিয়েছে জেরুসালেম-উদ্ধারের। পৌনে-দুশো বছরের মধ্যে নয়টি ক্রুসেড শানিয়েছে তারা। ‘ধর্মযুদ্ধের’ নামে শুধু যে মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ জনগণকে হত্যা, খুন, গুম, গণধর্ষণ বা তাদের মাংশ ভক্ষণ করেছে তারাতাই নয়; ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয় যে, হালাকু খান দেশজয়ের জন্যেই যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন (এবং পরবর্তীতে ছুঁড়েও ফেলেন দানিউবের ¯্রােতে!) তখন তারা এই চরম-নৃশংস বর্বরদের পক্ষে বাহিনী পরিচালনা করে এবং আইন-জালুত থেকে বাগদাদ পর্যন্ত অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নির্বিচার গণহত্যায় মদদ দেয়।
এ-যুদ্ধ চিরকালের এবং এর থেকে বাঁচার জন্যই ধর্মের-অজ্ঞাতবাসআবু সিম্বেল, অজন্তা-ইলোরা, সেন্ট ক্যাথরিন, মাসিয়াফসব কি তারই প্রমান নয়? ভাবতে ভাবতে আমি হারিয়ে যাই স্বপ্নের রাজ্যে এবং মহামতি গৌতম এসে হাজির হনতার শীর্ণ বাহু, ছিন্ন বসন, ¯িœগ্ধ হাসিমুখ নিয়ে। স¯েœহে বলেন: বৎস, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর! মানুষের প্রতি সদয় হওএটাই একমাত্র ধর্ম। প্রতি সকালেই আমরা জন্ম নেইতাই সে-কাজেই রত হওযা সর্বাপেক্ষা জরুরী। কারণ, সন্ধ্যায় তুমি মরে যাবে। কে জানেআগামী সকাল তোমার কিনা! মেজাজ খারাপ হলেই ভাষা খারাপ কোর না। মেজাজের পরিবর্তন আছে, কিন্তু নি:সৃত ভাষা অপরিবর্তনশীল। কর্ম কঠিন কিনা, ভেবো নাবৎস, শুরু করাটাই কঠিন। কেউ রাজা বা ফকির নয় দুনিয়ায়প্রত্যেকেই যা-সেতাই। মন্দ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ের বহু উপায় আছে, সবার মত তুমিও তাকে চেন। হাসো এবং ভালোবাসার আহ্বানে হারিয়ে যাও। মানুষ তুমি, পরমেশ্বর তুমি, দু:খ তুমি, আনন্দ তুমি: মায়াকে ত্যাগ করে সর্বভূতে আশ্রয় নাও। সবই চক্র!
অজন্তা-পার্কিংয়ে গাড়ি ব্রেক কষতেই আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। মাথুর সিং হাসছে: স্যার, গুরুজীর সাথে কথা হল?
আমি বিস্ময়ে চমকে উঠি: কোন্ গুরুজী?
জাতক, গৌতম, সিদ্ধার্থ, তানহাংকারা, দীপংকরবলুন, কোন্ নামে ডাকবো তাকে?
আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকি। মাথুর কি সত্যিই জানে; নাকি, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে?
আমাকে চুপ দেখে সে নিজেই হেসে ওঠে। যেই আসুক, স্যারনিশ্চয়ই আপনার আত্মা বিমল হয়েছে। তাই না?
আমি অজান্তে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিই। সাথে সাথেই মনে পড়ে
‘বুদ্ধং শরণাং গাচ্ছামী
ধম্মং শরণাং গচ্ছামী
সংঘং শরনাং গচ্ছামী...
তীর্থযাত্রায় মানুষের এই-ই লাভ: জ্ঞানীর জন্য জ্ঞান, সাধকের জন্য চিন্তা, মুনীর জন্য তপস্যা আর আমজনতার জন্য শ্রদ্ধা বিলিয়ে যায় সে। অন্তরকে করে ভক্তি ও মুক্তির আবেগে উদগ্রীব। এ-তো তুচ্ছ ব্যাপার নয়! জ্ঞানী, মুনী, সাধক যা সারা জীবনের আরাধনায় পায়আমার মত অভাজন তা ভক্তিতে পেলে ক্ষতি কী? কেউই যেহেতু আত্মা, ঈশ্বর বা পরকালকে দেখেনিতাই যে যার মত বুঝে তৃপ্তি পেলেই তো হলো! প্রশান্তিই তো আসল কথা!
*
শীর্ণ ওঘুর-নদীর পাড়ের একটি জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামের নাম ‘অজন্তা’। প্রায় ত্রিশটি গোপন গুহার এই আশ্রয় ব্রিটিশ বাঘ-শিকারী জন স্মিথ আবিষ্কার করেন ১৮১৯এ। তিরিশটি গুহার সবগুলো ঘোরা সম্ভব নয় বিধায় মাথির আমাকে প্রধান গুহায় টেনে নিয়ে গেল। নয়-দশ-বারো-তেরো-পনেরো(এ)-তে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে হীনযানের। এগুলো নাকি তৈরি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব একশো বছর থেকে শুরু করে দুশো বা তিনশো বছর ধরে। শতবাহানা এবং ময়ূর রাজবংশের আনুকূল্যে এই গ্রীষ্মাবকাশ, প্রার্থনালয় ও বিদ্যাপিঠ তৈরী করেছেন প্রাচীন ভারতের গুণী স্থপতিরা। কোন কোন গুহা দোতলা-তিনতলাও আছে। নয় এবং দশ নম্বর গুহায় স্তুপ এবং চৈত্য-গৃহ; এবং বারো-তেরো-পনেরোয় রয়েছে ‘বিহার’।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে এর দ্বিতীয় ধাপ (মহাযান) তৈরী হয়েছে হরিসেনা এবং ভাতাতাকা রাজবংশের ছায়ায়। এরা হিন্দু স¤্রাট হলেও বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাবে আপ্লুত ছিলেন এবং কখনো কখনো দুই ধর্মকে এক করেও দেখেছেন। এই পর্বের গুহা হচ্ছে এক থেকে আট এবং চৌদ্দ থেকে উনত্রিশ। এর মধ্যে উনিশ, ছাব্বিশ এবং উনত্রিশতম গুহায় রয়েছে ‘চৈত্য-গৃহ’।
চৈত্য হলো, স্যারপ্রার্থনার মূল ভবনগীর্জার মেইন-হলের মত। এক পাশে থাকে স্তুপা (বৌদ্ধ মূর্তি) এবং বাকী তিন পাশে প্রার্থনা বা ধ্যানের জায়গা।
নদীর কুলুকুল ধ্বনি, দখিনা বাতাস, গাছের ছায়া এবং পাখির ডাক শুনে আমি ভাবলামআসলেই ঈশ্বর অনুসন্ধানের সঠিক জায়গা এটি। যথার্থ নির্বাচন।
কিন্তু শুধু সাধনা বা ইবাদতের জন্য নয়, স্যারঅজন্তা গড়ে উঠেছিল ‘বাণিজ্য-কেন্দ্র’ হিসেবেও। সিল্ক-রুটের ‘ভারতীয়-শাখা’ কারাকোরাম থেকে নেমে এর পাশ দিয়েই দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত গেছে...।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি দেয়াল-চিত্রগুলি। ফ্রেসকো-ধাঁচের বৌদ্ধ-ছবিগুলোর বেশিরভাগই হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। মাথির সিংও ব্যাপারটা স্বীকার করলো। তার মন্তব্য ভয়ংকর: ‘স্যার, ষাড়ই তো সওয়ার হবে গাইয়ের উপরউল্টোটা তো প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তাই না!’
আমি থ’।
একটু তাড়াহুড়া করেই আমরা ‘স্বপ্ন-কুঞ্জ’ থেকে বেরিয়ে এলাম। লাঞ্চ খেতে খেতে বললাম: এখান থেকে সরাসরি ইলোরা যাবার রাস্তা আছে, মাথির?
সরাসরি নেইএকটু এঁকে-বেঁকে যেতে হবে। স্যার কি আজই ইলোরা দেখে শেষ করতে চান?
হুম্মতুমি সাহায্য করলে।
শরীরে কুলাবে তো? গতকাল তো ভেঙে পড়েছিল, স্যার।
আজ ভাঙবে না।
কেন, মহামুনী গৌতম শক্তি দিয়েছেন বুঝি?
শক্তি নয় প্রণোদনা। তুমি বলো, যাবে কি-না?
নিশ্চয়ই যাবো, স্যারতবে কস্টিংটা একটু ধরে দেবেন, প্লিজ। বোঝেনই তোএই করেই আমরা পেট চালাই।
ওকে। তাহলে চলোওঠা যাক।
স্যার, দুটো ডীপ-ব্ল্যাক সান-গ্লাস নিয়ে নেই?
কেন?
সরাসরি রোদ পড়বে তোপশ্চিম-দক্ষিণের রাস্তা যে!
ভালো লাগলো মাথিরের পরামর্শ। ‘মাস্তান’ সেজেই রওয়ানা দিলাম শত মাইল দূরের ইলোরা-গুহা দেখতে।
ইলোরাও একটি গ্রামের নামএলাপুরার আধুনিক সংস্করণ! এটাও গুহার রাজ্যতবে অজন্তার চেয়ে ছোট এবং বয়সেও নবীন। হিন্দুধর্মের প্রভাব এখানে চোখে পড়ার মতই বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, বৌদ্ধ-ধর্মের তেজ আস্তে আস্তে গিলে নিয়েছে ভরতের শাসকেরা। সে কারণেই আজকের হিন্দু-পুরাণে বুদ্ধও দশাবতারের একজন! আবার এখানে জৈনদেরও পাঁচটি গুহা আছে! পুরো ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ ইলোরার চৌত্রিশটি গুহার মধ্যে বৌদ্ধদের বারোটি, হিন্দুদের সতেরোটি এবং জৈনদের পাঁচটি! পুরোপুরি না হলেও ইলোরাকে সেক্যুলারই বলা যেতে পারতোযদি ইসলামকে যুক্ত করা যেত!
সেটা সম্ভব নয়, স্যারকারণ, লক্ষ্য করুন যে, এর কোনো ধর্মই একেশ্বরবাদী নয়, ঠিক যেন জেরুসালেমের বিপরীত-চিত্রমাথিরের আশ্চর্য প্রতিতুলনায় আমি আবারও লা-জওয়াব হয়ে যাই।
এর কেন্দ্রের বিশাল পাথুরে-স্তম্ভটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক-শিলার নির্মান। খ্রিস্টের সময়কাল থেকে পরবর্তী পাঁচশো বছরে এই নির্মান সম্পন্ন হয় বলে গবেষকদের ধারণাএবং এর অভ্যন্তরে প্রায় একশোটি ছোট-বড় গুহা রয়েছে যার মধ্যে এ-পর্যন্ত মাত্র চৌত্রিশটি গুহা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
দক্ষিণ পাশের বারোটি গুহায় বুদ্ধের মূর্তি, জীবন যাপনের ফ্রেসকো, জন্মান্তরের দৃশ্য এবং কিছু ভাস্কর্য ও রঙিন চিত্র আঁকা। এর মধ্যে কয়েকটির গঠন ‘বিহারের’ এবং বাকীগুলো ‘স্তুপা’। নয় এবং দশ-নম্বরে বিশাল প্রার্থনালয় এবং সেখানে পর্যটকও গিজগিজ করছে।
এগারো ও বারো-নম্বর গুহা তিন তলা। দুটোতেই মূর্তি আছে, ছবি আছে, প্রার্থনাগৃহ আছে, পাঠকক্ষ আছে এবং তন্ত্রায়নের দীক্ষাও লিপিবদ্ধ আছে।
দশ নম্বর-হলটি চৈত্যালয়নাম ‘বিশ্বকর্মা গুহা’। এখানে এসেই ফিউশান হয়েছে দুই ধর্মের। অনেকটাই গীর্জার ঢংঙে বানানো এই মূল হল এবং পার্শ্ববতী দুই বারান্দা মনে করিয়ে দেয় জেরুসালেমের আল-আকসাকে। আমি হেসে উঠলাম একা একা।
তেরো থেকে উনত্রিশ নম্বর গুহা আমরা কোনো রকমে দেখলাম। শিবের নৃত্যরত সেই ঝড়ো-মূর্তি এখানে একেবারেই নতুন লাগলো। শিবের জীবন-পরিক্রমা দেখার পরই আমার নজরুলের গান মনে পড়ে যায়।
তারকা রবি শশি খেলনা তব, হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা পায়েরও কাছেরাশি রাশি।
নিত্য তুমি হে উদার,
সুখে দুখে অবিকার
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাটও শিশু আনমনে।
মাথির সিং আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। ব্যস্ততায় ধাক্কা লাগলো বেশ কিছু সুন্দরীর গায়ে। তাদের কেউ বিস্মিত হলো, কেউ ‘সরি’ বললো; কেউ চেচিয়ে উঠলো‘স্টপ, ননসেন্স’। কিন্তু মাথির সিং বেপরোয়া। আমাকে বারান্দায় এনে তবে তার নিস্তার। আসলেই আমি ভাবুক হয়ে পড়েছিলাম। জোরে জোরে গাইছিলাম নজরুলের গান। এই সুরকেই মাথুর ভেবে নিয়েছিলো ‘ভর’। তাই ‘উদ্ধারের’ মহা-ব্রত পালন করেছে সে।
*
মূলত, হিন্দু গুহাগুলিতে বর্ণিত হয়েছে শীব-পার্বতীরই জীবন ও যৌবন-লীলা। গঙ্গা-যমুনার মূর্তির সাথে নিখূঁত জ্যামিতিক মাপে বসানো হয়েছে শিবলিঙ্গ। সেই প্রাচীন আমলে এত নিখুঁত নির্মাণআধুনিক চোখকে বিমোহিত না করে ছাড়ে না। সবচেয়ে ভালো লাগলো পুরুষ আদি-শক্তি ও নারী-আদিশক্তির সম্মিলিত রূপ থেকে যে ব্রাক্ষ্ম-শক্তির উদ্ভব দেখানো হয়েছে সেই দৃশ্য দেখে। তবে পনেরোতম গুহায় যে ‘রাবনকে’ দশাবতার দেখানো হয়েছেসেটা কোন্ পুরাণ মতে; বুঝতে সক্ষম হলাম না। তবে একথা স্বীকার করতেও দ্বিধা নেই যে বিঞ্চুর নরসিংহ মূর্তিই ইলোরার শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য। যেন, কায়রোর স্পিংসকেই দেখছিখুঁদে আকারে।
*
তিরিশ-নম্বরের পর থেকে শুরু হয়েছে জৈন-গুহা। মাথির বললো: এগুলো নবম ও দশম শতাব্দীর কাজ।
এখানকার কক্ষগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। ‘জিনা’ হবার চিরায়ত কৌশল বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন শিল্পীরাতবে জৈন হওয়াটা দেখাননি। মন্দির সেবক বললেন: যেটুকু দেখানো হয়েছেতা হলো জ্ঞান; বাকীটুকু কর্ম। জৈন হতে হয় দ্বৈততার মধ্যে দিয়েই।
‘ছোট্ট কৈলাস’ ও ‘ইন্দ্রসভা’ দেখে পার্থক্য করা মুশকিল যে এটা কি হিন্দু ধর্ম না আলাদা কিছু? জগন্নাথ হলটি বিরাট কিন্তু অসম্পূর্ণ। ভেতরে নামতে নামতে আমরা রাষ্ট্রকূট স¤্রাটদের শিলালিপি দেখলাম। সুবিখ্যাত হাতির-মূর্তি সত্যিই আমাকে চুম্বকের মত টানলো। এত নিপুন এবং জান্তব তার নির্মানশৈলী যে মুগ্ধ না হয়ে উপায়ই নেই।
তবে মাঝের প্রধান-মন্দির ‘লিঙ্গম মন্ডপাম’ এক অতি-প্রাকৃতিক বিস্ময় মনে হলো আমার কাছে। প্রায় তিরিশ মিটার উচ্চতার ১৬টি খুঁটির উপর দাড়ানো এই মন্ডপ ও তার অপরূপ কারুকাজআমার দেখা ভারতের শ্রেষ্ঠ নির্মানকলা। পাশের ব্রীজটিও মারাত্মক সৌন্দর্যমন্ডিত। পুরোহিত বললেন: ঐ ব্রীজ বানাতে একশো বছর লেগেছিল। ওর ওজন দুই লক্ষ টন। কিছু দিয়ে যান, বাবু!
*
ফেরার পথে মনে মনে নমস্কার জানালাম সেই সব অজানা-শিল্পীদের, যারা তাজমহল গড়েও তার গায়ে নিজের নাম স্বাক্ষর করে যান নি। ধন্য সেই সব রাজন্যবর্গযারা ধর্মকে এঁকে গেছেন প্রস্তরের শিল্পে এবং প্রমান করেছেন যে সত্যম-শিবম-সুন্দরমই সার সত্যযা সত্য, তাই সুন্দর, তাই পরম।
মাথুর সিং আমার ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গৌধুলী আলোয় আমার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। হালকা বাতাস বারংবার আক্রমণে মাথা থেকে উপড়ে নিতে চাইলো চুলকিন্তু ব্যর্থ হয়ে মিছেই মাথা ঠুকলো গাড়ির জানালায়।
রাত্রি আটটার আগেই আমরা খুলদাবাদে ফিরলাম। ছোট্ট এই শহর কত মহান মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাজমহল দর্শনার্থীদের শতকরা আশিজনই জানেন না যেএই ভারতেই আছে ‘আরেকটি তাজমহল’যাকে বলা হয় “দক্ষিণের তাজ”। নন্দিত ও নিন্দিত স¤্রাট আওরঙ্গজেব-আলমগীর যার নির্মাতা। যার মধ্যিখানে চিরনিদ্রায় শায়ীত আছেন স¤্রাট-পতœী পারস্য রাজার কন্যাদিলরাজ বানু বেগম।
আমিও এটা জানতাম না। কিন্তু দিল্লীর এক বন্ধু আমাকে বললোওটা দেখে যেও।
কেন? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সে জবাব দিয়েছিল: আওরঙ্গজেব ও হিন্দু-বিদ্বেষ বিতর্কের অনেক জবাব পাবে তুমি সেখানে। সেগুলোতে পেয়েইছিসাথে ‘বোনাস’ পেয়েছি তুঘলকের অবিস্মরণীয় কীর্তিমালার কিছু নিদর্শন এবং অজন্তা-ইলোরা! তবুও আমার চোখে পানি দেখে মাথির সিং হতভম্ব। স্যার কি আমার ব্যবহারে কোনো কষ্ট পেয়েছেন? পেয়ে থাকলেসরি!
না-না, মাথির। আমি তোমার সঙ্গ খুবই উপভোগ করেছি। আমার বুকের মধ্যে খচখচ করছে প্রথম দিনের ঘটনা। দিলতাজের মাতৃময়ী চেহারাটা মানসপটে গেঁথে আছে। তাকে তার প্রাপ্য টাকাটা দিতে হবে আমার।
মাথুর আমাকে নিয়ে গেল সেই মহল্লায়। আমাকে গাড়িতে রেখে সে কথা বলতে গেল দিলতাজ বানুর সঙ্গে।
একটু পরেই আঙিনার লাইট জ্বলে উঠলো। হাতে পুজার-ডালি নিয়ে দিলতাজ বেরিয়ে এসে আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামালো। কপালে এঁকে দিলো চন্দন-তিলক। আমি অবাক হয়ে বলি: এ কী করছেন?
মুসলমানদের সংস্কৃতি তো বরণ-ডালা নেই, তাই প্রতিবেশিদের থেকে ধার নিয়েছি। আর আমাদের তো ধর্মই কর্ম। যে টাকা দেবে তারই ‘ধর্মপতœী’ আমি! শুনলাম তুমি নাকি যজ্ঞ ছাড়াই ভারত জয় করতে বেরিয়েছো? তাই বরণ করতে এলাম
আমি ভয়ংকর লজ্জায় মাথা নিচু করে বলি: আপা, আপনার টাকাটা দেয়া হয় নি। যদি রাখতেন!
আমার বাড়িয়ে-ধরা হাজার-টাকার নোটে চুমু খেয়ে দিলতাজ বললো: তুমি তো আজমীরই যাবে। দরগায় টাকাটা দিয়ে দোয়া কোর: আল্লাহর কাছে বলে খাজা গরীবে-নেওয়াজ যেন ভারতীয় নারীদের জন্য একজন রাবেয়া-বসরী পাঠান।
আমি চোখের জল মুছে বললাম: বলবো, প্রিয় বোনঅবশ্যই বলবো!
নাকিভুল বললাম?
না-না, ঠিকই বলছো। গুড-ডে কাজুর গায়ে কামড় বসাতে বসাতে কফির চুমুক যেন স্বর্গ নিয়ে এলো চেতনায়।
‘আমার আজকে রাতের খাবার তোর টুকটুক শিরিন ঠোঁট
গজল শোনাও সিরাজী দাওতন্বী সাকী জেগে ওঠ
লাজ-রাঙা তোর গালের মত, দে গোলাপাী রঙ শারাব
মনে ব্যথার বিনুনী মোর, খোপার যেমন তোর চুনোট।’
ওয়াহ-ওয়াহ। দারুণ, স্যারনিশ্চয়ই ফিটজেরান্ড?
ঠিক ধরেছো, মাথুর। তুমিও ফিটজেরাল্ডের ভক্ত নাকি?
এই দুনিয়ায় কে তার ভক্ত নয়, স্যার? ওমর খৈয়ামকে তো তিনিই জগতের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট করেছেন। নইলে সাত-আটশো বছরে কি তার খবর ছিল, বলুন?
তা অবশ্য ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমাকে বলো মাথুরতুঘলকের এত বদনাম কেন?
আমিও এর পুরো কারণ জানি না, স্যার। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা যার দরবারী ছিলেনতাকে তো পাগল ভাবার উপায়ই নেই। খিলজীদের পরে তিনি সবচেয়ে বড় সালাতানাতের শাসক হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদ, মাদুরাই, তামিল নাড়–, কর্নাটক পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। প্রচলন করেছিলেন নতুন ট্যাক্স-সিস্টেম। ঠেকিয়ে ছিলেন বর্বর মোঙ্গলদের নির্মম-আগ্রাসন...।
কিন্তু তৎকালীন বাগদাদ ও কায়রোর-প্রতিদ্বন্দ্বী দিল্লী নগরীকে তিনি অবজ্ঞা করেছিলেনহয়তো সে কারণেই তার এত কুখ্যাতি! হিন্দু-পুরানে আছে ‘চানক্যপুরীকে’ (দিল্লীকে) যে অবজ্ঞা করবেতার ঠাঁই হবে নরকে’।
যাই হোক, প্রথমত প্লেগের আক্রমণ, দ্বিতীয়ত পানিশূণ্যতা আর শেষে বাংলার-বিদ্রোহ তাকে বাধ্য করে দিল্লী ফিরতে। আবার, তিনি ছিলেন খুবই জ্ঞান পিপাসুযেমনটা সাধারণত হয়ে থাকে সুফি, ওলামা ও দরবেশদের পৃষ্ঠপোষক হলে।
তারপরেও তাকে পরাজিত হতে হয়েছিল, তাই না?
এটা তো স্বাভাবিক, স্যার। দেখুন এই দুর্গকেইএকসময় যেখানে ছিল শান-শওকতের ঝকমকি; আজ সেখানে বাঁদুরের আস্তানা।
সত্যি বলেছে মাথুর। পুরো টানেলের ছাদে আমরা যত বাদুর ঝুলতে দেখেছিএকসাথে বেরুলে ‘ড্রাকুলা’ সিনেমাকে হাজারবার হার মানাবে। প্রথমে ভয়ই পেয়েছিলাম। মাথুর আমাকে আশ্বস্থ করেওগুলো রক্তচোষা তো নয়ই; আক্রমণকারীও নয়। গত দুশো-তিনশো বছরে এই দুর্গের বাদুর কোনো মানুষকে ভয় দেখায়নি, স্যার। বি কুল, প্লিজ।
আমার মনে পড়ে ইবনে বতুতার সফরনামার অংশ‘তিনি ছিলেন কঠোর মুসলমান। পাঁচ বেলা নামাজ ও রমজানের রোজা রাখায় আতিমাত্রায় নিষ্ঠাবান। সুবিবেচক, শক্তিশালী এবং অদম্য-বীর। জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রজাদের কল্যাণকামী...।’
বিখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুলও তার দরবারকে বলেছেন মধ্যযুগের ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ-কোর্ট । তুঘলক-দরবারের কবিতার গুঞ্জরণ, ন্যায়বিচারের সুবাতাস এবং দর্শন ও অংকের নিরবিচ্ছিন্ন ঘর্ষণে কেঁপে উঠেছিলেন চীনের ইউয়ান মহারাজা পর্যন্ত।
আমরা কামানের সামনে ছবি তুলি, আবারও কফি খাই এবং নিচে নামতে শুরু করি। আমার উরুর পেশিতে খিঁচ ধরে যায়। মাথিরের কাঁধে ভর দিয়ে আমি ধীরে নামি। মাথুর অবাক হয়ে বলে: আপনি অল্প বয়সে এত কাহিল কেন, স্যার? আমি তাকে গত তিন-দিনের করুণ কাহিনী শোনাইসোলেমান থেকে দিলতাজ বেগম এবং তাজ হোটেলের আশ্রয় লাভ পর্যন্ত কাহিনী শুনে সে শুধু বার-বার বলে: হাঁ ঈশ্বর-হাঁ ঈশ্বর। তবুও, এতো শারিরীকভাবে দুর্বল হবার কথা নয় আপনার, স্যার। বলুন তো আপনার হরস্কোপ কি? স্যাজিটারিয়াস, মানে ধনু নাকি?
আমি হতবাক হয়ে সম্মতির মাথা নাড়ি।
এজন্যেই। ধনু রাশির পুরুষরা এমনই হয়মনের শক্তিতে চলে। দু:খ-আঘাত-বেদনা তাদেরকে কামানের গোলার মত আঘাত করলেও তারা উঠে দাঁড়ায় এবং সত্যের পক্ষে লড়াই করে। কিন্তু আবেগজনিত আঘাতে তারা এত কাবু হয় যে খোলা তরবারিকেও খাপে ঢোকাতে পারে না। সরি-স্যার, ঘটনাটা ভুলে যানশক্তি ফিরে পাবেন। নাহলে আগামীকালের অজন্তা-ইলোরা ভ্রমণ কঠিন হবে।
*
সকাল ন’টার মধ্যেই গাড়ি ছাড়লো মাথির। আমি বলি: মাথির, বিবি-কা-মকরাবায় একটা চক্কর দিয়ে যাই, ভাই?
কেন, ভোরের তাজমহলের সাথে মনছবি মেলাবেন?
ঠিক ধরেছো। কতক্ষণ লাগবে অজন্তায় যেতে?
ধরুন, আড়াই-ঘণ্টা। প্লাস-মাইনাস টুয়েন্টি মিনিটস।
ট্রাফিক খুব বেশি পথে?
না, স্যার। তবে দুটো ন্যাশনাল-হাইওয়ে পড়বে তোভাগ্য ভালো-না হলে ওখানেই দশ-দশ বিশ মিনিট পেরিয়ে যাবে।
অজন্তায় কেন মানুষের এত ভীড়, মাথুর?
মানুষের ভীড় না, স্যারবলুন বিদেশীদের ভীড়।
তাই নাকি? তোমরা যাও না নাকি?
যাই, যাবো না কেন? তবে বেশির ভাগই আপনাদের মত বিদেশীদেরকে নিয়ে। সাদা চামড়ার লোকেরা ইতিহাস-অতীত, আর খোলা-মেলা মূর্তির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। আমি তাদের অনেকের মুখেই ঘন্টার পর ঘণ্টা আলোচনা শুনেছিভারতীয় নারীদের স্তন ও নিতম্ব কিভাবে এত স্ফিত বা পুষ্ট হয়সে বিষয়ে। আসলে স্যার, আমার কি মনে হয় জানেনশ্বেতাঙ্গদের পরচর্চা ছাড়া আলোচনার বিষয় নেই; নেই নিজেদের কোনো মৌলিক ইতিহাসতাই ওরা আমাদের এই অতি-সাধারণ বিষয় নিয়ে অত মাতামাতি করে। দেখেন না, কামসুত্র নিয়ে কত ছবি বানালো হলিউড স্যার স্ট্যানলি লেনপুল, মিডেইভাল ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড।অথচ এটা বিজ্ঞান, আর পশ্চিম দেখায় থ্রি-এক্স! আর যদি কৌতুহলী হয়ে নিজের হোটেলেও খোঁজ নেন; দেখবেনসালারা কোন স্বদেশীনীকে নিয়ে এখানে ফুর্তি করছে নাঅজন্তা-ইলোরা এলেই ওদের দেশী-মার চাইসুবক্ষা; সুনিতম্বিনীযেন ফ্রয়েড এসে ভর করে চেতনায়।
আমি তার কথার জবাব দেই না; বরং হেসে একাকার হই। প্রত্যেক মানুষই তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গীতে জগতকে বিচার করে। বিজ্ঞান যদিও বলে, পৃথিবী কমলালেবুর মতকিন্তু আমাদের চোখ কি সেই-সত্য কখনো মানে?
ড্যাশবোর্ডে রাখা গাইড-ম্যাপ টেনে দেখিউত্তর-পূর্বে প্রায় ১০৫ কিলো যেতে হবে আমাদের। পথে পড়বে লেক, জঙ্গল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মসজিদ এবং হযরত গাইবান শাহ-অলির দরগাহ। চিল্লোড় রোড বরাবর রাস্তা আমাদের। ম্যাপ রেখে চোখ বুজলাম আমি।
মাঝেমাঝেই আমার মন ধন্দে পড়েমনে হয় ধর্মেই সবচেয়ে বেশি প্রগতি। কারণ, প্রগতির পথ যখনই রুদ্ধ করে দেয় মোল্লারা; কিংবা সেবকরা ভুলে যায় নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যতখনই আল্লাহ আরেকটি ধর্ম প্রেরণ করেন। তার দাপটে জন্ম নেয় নতুন-পুরোহিত, নতুন সৈনিক, নতুন ভক্তবৃন্দ। তারা উত্তাল সাগরের মত ভাসিয়ে নেয় পুরানো জঞ্জালযা ছিল একসময় সেই খোদারই পাঠানো সত্য-বাণীকালের ধারে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যা ভোঁতা হয়ে গেছে। এ কারণেই মন্দিরের উপরে গড়ে ওঠে গির্জা, আর গীর্জার উপরে মসজিদ। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসরাও আত্মসমর্পন করে রেহাই পায় না, প্রায়-স্বগোত্রীয় হিন্দু-প্রতিবেশিদের হাত থেকে। মেলে না বন্ধুত্ব বা সহানুভূতি। হয় স্যার স্ট্যানলি লেনপুল, মিডেইভাল ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড। হয়গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় নতুন-ধর্ম; নাহয় হারাতে হয় পুরানো বিশ্বাসের সাথে-সাথে প্রাণটাও।এই তো মানবজাতীর ইতিহাসচলছে; চলবেবই।
বিখ্যাত আব্বাসীয়-খলিফা হারুনার রশিদ তার সুশাসন, প্রজ্ঞা এবং ন্যায়বিচারের জন্য পাঠকের কাছে পরিচত ও প্রসিদ্ধ নাম। তার মানে এই নয় যে শাসনকার্যের সুরক্ষায় তিনি অন্যায় রক্তপাত ঘটাননি। নিজের বোনকেই তিনি হত্যা করে ঘরের মধ্যে পুঁতে রেখেছিলেন তথাকথিত ‘বিদ্রোহী-সেনাপতি’ বারবাকীর সাথে প্রণয়ের অজুহাতে । নবীবংশের মানুষ হয়েও তার হাত কাঁপেনি ধর্মের নামে এতবড় অধর্ম করতে...।
গীতায়ও আমরা দেখিসেই একই বিষয়: ‘হে অর্জুন, মৃত্যুকে ছুঁড়ে দাও।’
‘কাকে দেবো?’
‘সামনে যাকেই পাবে, তাকে।’
‘কিন্তু সামনে যে আমার শিক্ষক, ভাই, ছেলেবেলার বন্ধু কিংবা স্বজনরা দাঁড়িয়ে?’
‘ও হচ্ছে মায়াওসব পৃথিবীর আবর্জনা। মৃত্যু দিয়ে ধরাধামকে পরিষ্কার করার জন্যই তোমার-আমার আগমন, পার্থদায়িত্ব পালন করো সখা।’
খ্রিস্টানদের রক্তপাত তো আরো যুক্তিহীন। ক্রুসেডের সময় তারা ধর্মভিত্তিক প্রতিশোধ চালিয়েছে ফ্রান্সে, ইংল্যান্ডে, জার্মানীতে এবং স্পেনেনিজেদের ভাইদের উপরই। পাশাপাশি, ডাক দিয়েছে জেরুসালেম-উদ্ধারের। পৌনে-দুশো বছরের মধ্যে নয়টি ক্রুসেড শানিয়েছে তারা। ‘ধর্মযুদ্ধের’ নামে শুধু যে মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ জনগণকে হত্যা, খুন, গুম, গণধর্ষণ বা তাদের মাংশ ভক্ষণ করেছে তারাতাই নয়; ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয় যে, হালাকু খান দেশজয়ের জন্যেই যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন (এবং পরবর্তীতে ছুঁড়েও ফেলেন দানিউবের ¯্রােতে!) তখন তারা এই চরম-নৃশংস বর্বরদের পক্ষে বাহিনী পরিচালনা করে এবং আইন-জালুত থেকে বাগদাদ পর্যন্ত অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নির্বিচার গণহত্যায় মদদ দেয়।
এ-যুদ্ধ চিরকালের এবং এর থেকে বাঁচার জন্যই ধর্মের-অজ্ঞাতবাসআবু সিম্বেল, অজন্তা-ইলোরা, সেন্ট ক্যাথরিন, মাসিয়াফসব কি তারই প্রমান নয়? ভাবতে ভাবতে আমি হারিয়ে যাই স্বপ্নের রাজ্যে এবং মহামতি গৌতম এসে হাজির হনতার শীর্ণ বাহু, ছিন্ন বসন, ¯িœগ্ধ হাসিমুখ নিয়ে। স¯েœহে বলেন: বৎস, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু; তর্কে বহুদূর! মানুষের প্রতি সদয় হওএটাই একমাত্র ধর্ম। প্রতি সকালেই আমরা জন্ম নেইতাই সে-কাজেই রত হওযা সর্বাপেক্ষা জরুরী। কারণ, সন্ধ্যায় তুমি মরে যাবে। কে জানেআগামী সকাল তোমার কিনা! মেজাজ খারাপ হলেই ভাষা খারাপ কোর না। মেজাজের পরিবর্তন আছে, কিন্তু নি:সৃত ভাষা অপরিবর্তনশীল। কর্ম কঠিন কিনা, ভেবো নাবৎস, শুরু করাটাই কঠিন। কেউ রাজা বা ফকির নয় দুনিয়ায়প্রত্যেকেই যা-সেতাই। মন্দ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ের বহু উপায় আছে, সবার মত তুমিও তাকে চেন। হাসো এবং ভালোবাসার আহ্বানে হারিয়ে যাও। মানুষ তুমি, পরমেশ্বর তুমি, দু:খ তুমি, আনন্দ তুমি: মায়াকে ত্যাগ করে সর্বভূতে আশ্রয় নাও। সবই চক্র!
অজন্তা-পার্কিংয়ে গাড়ি ব্রেক কষতেই আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। মাথুর সিং হাসছে: স্যার, গুরুজীর সাথে কথা হল?
আমি বিস্ময়ে চমকে উঠি: কোন্ গুরুজী?
জাতক, গৌতম, সিদ্ধার্থ, তানহাংকারা, দীপংকরবলুন, কোন্ নামে ডাকবো তাকে?
আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকি। মাথুর কি সত্যিই জানে; নাকি, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে?
আমাকে চুপ দেখে সে নিজেই হেসে ওঠে। যেই আসুক, স্যারনিশ্চয়ই আপনার আত্মা বিমল হয়েছে। তাই না?
আমি অজান্তে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিই। সাথে সাথেই মনে পড়ে
‘বুদ্ধং শরণাং গাচ্ছামী
ধম্মং শরণাং গচ্ছামী
সংঘং শরনাং গচ্ছামী....।
তীর্থযাত্রায় মানুষের এই-ই লাভ: জ্ঞানীর জন্য জ্ঞান, সাধকের জন্য চিন্তা, মুনীর জন্য তপস্যা আর আমজনতার জন্য শ্রদ্ধা বিলিয়ে যায় সে। অন্তরকে করে ভক্তি ও মুক্তির আবেগে উদগ্রীব। এ-তো তুচ্ছ ব্যাপার নয়! জ্ঞানী, মুনী, সাধক যা সারা জীবনের আরাধনায় পায়আমার মত অভাজন তা ভক্তিতে পেলে ক্ষতি কী? কেউই যেহেতু আত্মা, ঈশ্বর বা পরকালকে দেখেনিতাই যে যার মত বুঝে তৃপ্তি পেলেই তো হলো! প্রশান্তিই তো আসল কথা!
*
শীর্ণ ওঘুর-নদীর পাড়ের একটি জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামের নাম ‘অজন্তা’। প্রায় ত্রিশটি গোপন গুহার এই আশ্রয় ব্রিটিশ বাঘ-শিকারী জন স্মিথ আবিষ্কার করেন ১৮১৯এ। তিরিশটি গুহার সবগুলো ঘোরা সম্ভব নয় বিধায় মাথির আমাকে প্রধান গুহায় টেনে নিয়ে গেল। নয়-দশ-বারো-তেরো-পনেরো(এ)-তে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে হীনযানের। এগুলো নাকি তৈরি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব একশো বছর থেকে শুরু করে দুশো বা তিনশো বছর ধরে। শতবাহানা এবং ময়ূর রাজবংশের আনুকূল্যে এই গ্রীষ্মাবকাশ, প্রার্থনালয় ও বিদ্যাপিঠ তৈরী করেছেন প্রাচীন ভারতের গুণী স্থপতিরা। কোন কোন গুহা দোতলা-তিনতলাও আছে। নয় এবং দশ নম্বর গুহায় স্তুপ এবং চৈত্য-গৃহ; এবং বারো-তেরো-পনেরোয় রয়েছে ‘বিহার’।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে এর দ্বিতীয় ধাপ (মহাযান) তৈরী হয়েছে হরিসেনা এবং ভাতাতাকা রাজবংশের ছায়ায়। এরা হিন্দু স¤্রাট হলেও বৌদ্ধধর্মের প্রবল প্রভাবে আপ্লুত ছিলেন এবং কখনো কখনো দুই ধর্মকে এক করেও দেখেছেন। এই পর্বের গুহা হচ্ছে এক থেকে আট এবং চৌদ্দ থেকে উনত্রিশ। এর মধ্যে উনিশ, ছাব্বিশ এবং উনত্রিশতম গুহায় রয়েছে ‘চৈত্য-গৃহ’।
চৈত্য হলো, স্যারপ্রার্থনার মূল ভবনগীর্জার মেইন-হলের মত। এক পাশে থাকে স্তুপা (বৌদ্ধ মূর্তি) এবং বাকী তিন পাশে প্রার্থনা বা ধ্যানের জায়গা।
নদীর কুলুকুল ধ্বনি, দখিনা বাতাস, গাছের ছায়া এবং পাখির ডাক শুনে আমি ভাবলামআসলেই ঈশ্বর অনুসন্ধানের সঠিক জায়গা এটি। যথার্থ নির্বাচন।
কিন্তু শুধু সাধনা বা ইবাদতের জন্য নয়, স্যারঅজন্তা গড়ে উঠেছিল ‘বাণিজ্য-কেন্দ্র’ হিসেবেও। সিল্ক-রুটের ‘ভারতীয়-শাখা’ কারাকোরাম থেকে নেমে এর পাশ দিয়েই দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত গেছে...।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি দেয়াল-চিত্রগুলি। ফ্রেসকো-ধাঁচের বৌদ্ধ-ছবিগুলোর বেশিরভাগই হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। মাথির সিংও ব্যাপারটা স্বীকার করলো। তার মন্তব্য ভয়ংকর: ‘স্যার, ষাড়ই তো সওয়ার হবে গাইয়ের উপরউল্টোটা তো প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তাই না!’
আমি থ’।
একটু তাড়াহুড়া করেই আমরা ‘স্বপ্ন-কুঞ্জ’ থেকে বেরিয়ে এলাম। লাঞ্চ খেতে খেতে বললাম: এখান থেকে সরাসরি ইলোরা যাবার রাস্তা আছে, মাথির?
সরাসরি নেইএকটু এঁকে-বেঁকে যেতে হবে। স্যার কি আজই ইলোরা দেখে শেষ করতে চান?
হুম্মতুমি সাহায্য করলে।
শরীরে কুলাবে তো? গতকাল তো ভেঙে পড়েছিল, স্যার।
আজ ভাঙবে না।
কেন, মহামুনী গৌতম শক্তি দিয়েছেন বুঝি?
শক্তি নয় প্রণোদনা। তুমি বলো, যাবে কি-না?
নিশ্চয়ই যাবো, স্যারতবে কস্টিংটা একটু ধরে দেবেন, প্লিজ। বোঝেনই তোএই করেই আমরা পেট চালাই।
ওকে। তাহলে চলোওঠা যাক।
স্যার, দুটো ডীপ-ব্ল্যাক সান-গ্লাস নিয়ে নেই?
কেন?
সরাসরি রোদ পড়বে তোপশ্চিম-দক্ষিণের রাস্তা যে!
ভালো লাগলো মাথিরের পরামর্শ। ‘মাস্তান’ সেজেই রওয়ানা দিলাম শত মাইল দূরের ইলোরা-গুহা দেখতে।
ইলোরাও একটি গ্রামের নামএলাপুরার আধুনিক সংস্করণ! এটাও গুহার রাজ্যতবে অজন্তার চেয়ে ছোট এবং বয়সেও নবীন। হিন্দুধর্মের প্রভাব এখানে চোখে পড়ার মতই বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, বৌদ্ধ-ধর্মের তেজ আস্তে আস্তে গিলে নিয়েছে ভরতের শাসকেরা। সে কারণেই আজকের হিন্দু-পুরাণে বুদ্ধও দশাবতারের একজন! আবার এখানে জৈনদেরও পাঁচটি গুহা আছে! পুরো ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ ইলোরার চৌত্রিশটি গুহার মধ্যে বৌদ্ধদের বারোটি, হিন্দুদের সতেরোটি এবং জৈনদের পাঁচটি! পুরোপুরি না হলেও ইলোরাকে সেক্যুলারই বলা যেতে পারতোযদি ইসলামকে যুক্ত করা যেত!
সেটা সম্ভব নয়, স্যারকারণ, লক্ষ্য করুন যে, এর কোনো ধর্মই একেশ্বরবাদী নয়, ঠিক যেন জেরুসালেমের বিপরীত-চিত্রমাথিরের আশ্চর্য প্রতিতুলনায় আমি আবারও লা-জওয়াব হয়ে যাই।
এর কেন্দ্রের বিশাল পাথুরে-স্তম্ভটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক-শিলার নির্মান। খ্রিস্টের সময়কাল থেকে পরবর্তী পাঁচশো বছরে এই নির্মান সম্পন্ন হয় বলে গবেষকদের ধারণাএবং এর অভ্যন্তরে প্রায় একশোটি ছোট-বড় গুহা রয়েছে যার মধ্যে এ-পর্যন্ত মাত্র চৌত্রিশটি গুহা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
দক্ষিণ পাশের বারোটি গুহায় বুদ্ধের মূর্তি, জীবন যাপনের ফ্রেসকো, জন্মান্তরের দৃশ্য এবং কিছু ভাস্কর্য ও রঙিন চিত্র আঁকা। এর মধ্যে কয়েকটির গঠন ‘বিহারের’ এবং বাকীগুলো ‘স্তুপা’। নয় এবং দশ-নম্বরে বিশাল প্রার্থনালয় এবং সেখানে পর্যটকও গিজগিজ করছে।
এগারো ও বারো-নম্বর গুহা তিন তলা। দুটোতেই মূর্তি আছে, ছবি আছে, প্রার্থনাগৃহ আছে, পাঠকক্ষ আছে এবং তন্ত্রায়নের দীক্ষাও লিপিবদ্ধ আছে।
দশ নম্বর-হলটি চৈত্যালয়নাম ‘বিশ্বকর্মা গুহা’। এখানে এসেই ফিউশান হয়েছে দুই ধর্মের। অনেকটাই গীর্জার ঢংঙে বানানো এই মূল হল এবং পার্শ্ববতী দুই বারান্দা মনে করিয়ে দেয় জেরুসালেমের আল-আকসাকে। আমি হেসে উঠলাম একা একা।
তেরো থেকে উনত্রিশ নম্বর গুহা আমরা কোনো রকমে দেখলাম। শিবের নৃত্যরত সেই ঝড়ো-মূর্তি এখানে একেবারেই নতুন লাগলো। শিবের জীবন-পরিক্রমা দেখার পরই আমার নজরুলের গান মনে পড়ে যায়।
তারকা রবি শশি খেলনা তব, হে উদাসী
পড়িয়া আছে রাঙা পায়েরও কাছেরাশি রাশি।
নিত্য তুমি হে উদার,
সুখে দুখে অবিকার
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন সনে
নিরজনে প্রভু নিরজনে
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাটও শিশু আনমনে।
মাথির সিং আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। ব্যস্ততায় ধাক্কা লাগলো বেশ কিছু সুন্দরীর গায়ে। তাদের কেউ বিস্মিত হলো, কেউ ‘সরি’ বললো; কেউ চেচিয়ে উঠলো‘স্টপ, ননসেন্স’। কিন্তু মাথির সিং বেপরোয়া। আমাকে বারান্দায় এনে তবে তার নিস্তার। আসলেই আমি ভাবুক হয়ে পড়েছিলাম। জোরে জোরে গাইছিলাম নজরুলের গান। এই সুরকেই মাথুর ভেবে নিয়েছিলো ‘ভর’। তাই ‘উদ্ধারের’ মহা-ব্রত পালন করেছে সে।
*
মূলত, হিন্দু গুহাগুলিতে বর্ণিত হয়েছে শীব-পার্বতীরই জীবন ও যৌবন-লীলা। গঙ্গা-যমুনার মূর্তির সাথে নিখূঁত জ্যামিতিক মাপে বসানো হয়েছে শিবলিঙ্গ। সেই প্রাচীন আমলে এত নিখুঁত নির্মাণআধুনিক চোখকে বিমোহিত না করে ছাড়ে না। সবচেয়ে ভালো লাগলো পুরুষ আদি-শক্তি ও নারী-আদিশক্তির সম্মিলিত রূপ থেকে যে ব্রাক্ষ্ম-শক্তির উদ্ভব দেখানো হয়েছে সেই দৃশ্য দেখে। তবে পনেরোতম গুহায় যে ‘রাবনকে’ দশাবতার দেখানো হয়েছেসেটা কোন্ পুরাণ মতে; বুঝতে সক্ষম হলাম না। তবে একথা স্বীকার করতেও দ্বিধা নেই যে বিঞ্চুর নরসিংহ মূর্তিই ইলোরার শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য। যেন, কায়রোর স্পিংসকেই দেখছিখুঁদে আকারে।
*
তিরিশ-নম্বরের পর থেকে শুরু হয়েছে জৈন-গুহা। মাথির বললো: এগুলো নবম ও দশম শতাব্দীর কাজ।
এখানকার কক্ষগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। ‘জিনা’ হবার চিরায়ত কৌশল বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন শিল্পীরাতবে জৈন হওয়াটা দেখাননি। মন্দির সেবক বললেন: যেটুকু দেখানো হয়েছেতা হলো জ্ঞান; বাকীটুকু কর্ম। জৈন হতে হয় দ্বৈততার মধ্যে দিয়েই।
‘ছোট্ট কৈলাস’ ও ‘ইন্দ্রসভা’ দেখে পার্থক্য করা মুশকিল যে এটা কি হিন্দু ধর্ম না আলাদা কিছু? জগন্নাথ হলটি বিরাট কিন্তু অসম্পূর্ণ। ভেতরে নামতে নামতে আমরা রাষ্ট্রকূট স¤্রাটদের শিলালিপি দেখলাম। সুবিখ্যাত হাতির-মূর্তি সত্যিই আমাকে চুম্বকের মত টানলো। এত নিপুন এবং জান্তব তার নির্মানশৈলী যে মুগ্ধ না হয়ে উপায়ই নেই।
তবে মাঝের প্রধান-মন্দির ‘লিঙ্গম মন্ডপাম’ এক অতি-প্রাকৃতিক বিস্ময় মনে হলো আমার কাছে। প্রায় তিরিশ মিটার উচ্চতার ১৬টি খুঁটির উপর দাড়ানো এই মন্ডপ ও তার অপরূপ কারুকাজআমার দেখা ভারতের শ্রেষ্ঠ নির্মানকলা। পাশের ব্রীজটিও মারাত্মক সৌন্দর্যমন্ডিত। পুরোহিত বললেন: ঐ ব্রীজ বানাতে একশো বছর লেগেছিল। ওর ওজন দুই লক্ষ টন। কিছু দিয়ে যান, বাবু!
*
ফেরার পথে মনে মনে নমস্কার জানালাম সেই সব অজানা-শিল্পীদের, যারা তাজমহল গড়েও তার গায়ে নিজের নাম স্বাক্ষর করে যান নি। ধন্য সেই সব রাজন্যবর্গযারা ধর্মকে এঁকে গেছেন প্রস্তরের শিল্পে এবং প্রমান করেছেন যে সত্যম-শিবম-সুন্দরমই সার সত্যযা সত্য, তাই সুন্দর, তাই পরম।
মাথুর সিং আমার ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গৌধুলী আলোয় আমার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। হালকা বাতাস বারংবার আক্রমণে মাথা থেকে উপড়ে নিতে চাইলো চুলকিন্তু ব্যর্থ হয়ে মিছেই মাথা ঠুকলো গাড়ির জানালায়।
রাত্রি আটটার আগেই আমরা খুলদাবাদে ফিরলাম। ছোট্ট এই শহর কত মহান মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাজমহল দর্শনার্থীদের শতকরা আশিজনই জানেন না যেএই ভারতেই আছে ‘আরেকটি তাজমহল’যাকে বলা হয় “দক্ষিণের তাজ”। নন্দিত ও নিন্দিত স¤্রাট আওরঙ্গজেব-আলমগীর যার নির্মাতা। যার মধ্যিখানে চিরনিদ্রায় শায়ীত আছেন স¤্রাট-পতœী পারস্য রাজার কন্যাদিলরাজ বানু বেগম।
আমিও এটা জানতাম না। কিন্তু দিল্লীর এক বন্ধু আমাকে বললোওটা দেখে যেও।
কেন? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সে জবাব দিয়েছিল: আওরঙ্গজেব ও হিন্দু-বিদ্বেষ বিতর্কের অনেক জবাব পাবে তুমি সেখানে। সেগুলোতে পেয়েইছিসাথে ‘বোনাস’ পেয়েছি তুঘলকের অবিস্মরণীয় কীর্তিমালার কিছু নিদর্শন এবং অজন্তা-ইলোরা! তবুও আমার চোখে পানি দেখে মাথির সিং হতভম্ব। স্যার কি আমার ব্যবহারে কোনো কষ্ট পেয়েছেন? পেয়ে থাকলেসরি!
না-না, মাথির। আমি তোমার সঙ্গ খুবই উপভোগ করেছি। আমার বুকের মধ্যে খচখচ করছে প্রথম দিনের ঘটনা। দিলতাজের মাতৃময়ী চেহারাটা মানসপটে গেঁথে আছে। তাকে তার প্রাপ্য টাকাটা দিতে হবে আমার।
মাথুর আমাকে নিয়ে গেল সেই মহল্লায়। আমাকে গাড়িতে রেখে সে কথা বলতে গেল দিলতাজ বানুর সঙ্গে।
একটু পরেই আঙিনার লাইট জ্বলে উঠলো। হাতে পুজার-ডালি নিয়ে দিলতাজ বেরিয়ে এসে আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামালো। কপালে এঁকে দিলো চন্দন-তিলক। আমি অবাক হয়ে বলি: এ কী করছেন?
মুসলমানদের সংস্কৃতি তো বরণ-ডালা নেই, তাই প্রতিবেশিদের থেকে ধার নিয়েছি। আর আমাদের তো ধর্মই কর্ম। যে টাকা দেবে তারই ‘ধর্মপতœী’ আমি! শুনলাম তুমি নাকি যজ্ঞ ছাড়াই ভারত জয় করতে বেরিয়েছো? তাই বরণ করতে এলাম
আমি ভয়ংকর লজ্জায় মাথা নিচু করে বলি: আপা, আপনার টাকাটা দেয়া হয় নি। যদি রাখতেন!
আমার বাড়িয়ে-ধরা হাজার-টাকার নোটে চুমু খেয়ে দিলতাজ বললো: তুমি তো আজমীরই যাবে। দরগায় টাকাটা দিয়ে দোয়া কোর: আল্লাহর কাছে বলে খাজা গরীবে-নেওয়াজ যেন ভারতীয় নারীদের জন্য একজন রাবেয়া-বসরী পাঠান।
আমি চোখের জল মুছে বললাম: বলবো, প্রিয় বোনঅবশ্যই বলবো!