somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় তাজমহল বা অচেনা অওরেঙ্গজেব

০৬ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আওরঙ্গাবাদ যাবার পথে হঠাৎ করেই ”বিবি-কা-মাকবারা” দেখতে খুলদাবাদ নেমে পড়লাম কেন--নিজেই জানিনা। যাবার কথা তুঘলকের তুঘলকীয়-কান্ড দৌলতাবাদ-দূর্গ দেখতে, কিন্তু পথে যেই শুনলাম--এখানে আরও একটি “তাজমহল” আছে--যা বানিয়েছেন তাজ-বিরোধী সম্রাট আওরঙ্গজেব--নাম ”দক্ষিণের তাজ” বা ”গরীবের তাজমহল”-- শুনে, আমি নিজের অজান্তেই বাস থেকে নেমে পড়লা



আওরঙ্গাবাদ যাবার পথে হঠাৎ করেই বিবি-কা-মাকবারা দেখতে খুলদাবাদ নেমে পড়লাম কে-নিজেই জানিনা। যাবার কথা তুঘলকের তুঘলকীয়-কান্ড দৌলতাবাদ-দূর্গ দেখতে, কিন্তু পথে যেই শুনলাম--এখানে আরও একটি “তাজমহল” আছে--যা বানিয়েছেন তাজ-বিরোধী স¤্রাট আওরঙ্গজেব, আমি নিজের অজান্তেই বাস থেকে নেমে পড়লাম।



সব মানুষের জীবনেই আশ্চর্য ঘটনা থাকে--যা অবিশ্বাস্য রকম অলৌকিক; আমারও আছে। অজ পাড়াগাঁ থেকে ঢাকা এসেছিলাম জেদ করে--ঢাকা কলেজে পড়বো বলে। হাতে সাড়ে চারশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে সেঝভাই আমাকে কলেজের গেটে নামিয়ে দিয়ে বললেন: যদি নকল করে পাশ না-করে থাকো--ভর্তি হয়ে দেখাও।
হাতে আমার কাপড়ের সাইড-ব্যাগ--(১৯৭৮এ পলিথিন ব্যাগ ছিল না)--তাতে দুটো কাগজ:- একটি হেডমাস্টারের প্রশংসাপত্র (টেস্টিমোনিয়াল) তাও হাত দিয়ে কেটে স্কুলের নাম শোধরানো; আরেকটি আমাদের নন-মেট্রিকুলেটেড চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে লেখা ‘নাগরিক সনদ’।


এখনকার ঢাকা কলেজের সামনে গিয়ে যে কারুর মনে হতে পারে যে এটা ‘নিউ মার্কেটের এক্সটেনশেন’ কিংবা কোনো ‘রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়’--কারণ গেটে সব থেকে ছোট করে লেখা স্বয়ং কলেজের নাম আর তার প্রতিষ্ঠাকাল (১৮৪১)। তো সে যাই হোক, আশির দশকেও এর গেট ছিল ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ--ঢাবির ভিসি ভবনের মত--দেখলে গাঁ শির-শির করতো উত্তেজনায়। খুবই ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করলাম ভেতরে। মূল ভবনের শুরুতেই ডানে সুবিশাল অডিটোরিয়াম; তারপর বাঁয়ে অধ্যক্ষের দপ্তর। ছাদ থেকে ঝোলানো নানা রকম উপদেশবাণী:- ‘মহত লোকের সঙ্গে চলার চেয়ে তার জীবনী পড়া উত্তম।’ দাঁড়িয়ে রইলাম এই লেখা পড়ে। (অনেক পরে জেনেছি: এসব কান্ড আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের। আরো তিরিশ বছর পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করে দেখেছি: কথাটা আঠারো আনা সত্য)।
বাস কন্ডাক্টর বিদেশি বলেই আমার হঠাৎ সিদ্ধান্তে রাগ করল না। বরং এক টেক্সিওয়ালাকে ডেকে বলল:
--বাবু কো মকবারা পর লে যায়েঙ্গে। বাংলাদেশ সে আয়া। কেরায়া কেতনা লাগে গা, জনাব?
অটো-ড্রাইভার বললো:-- দুসো, ভাই সাব।
ড্রাইভার হাসতে হাসতে জবাব দিলো:-- বিস পর যায়েঙ্গে, অর ঔরকে বোলাও।
--সরি, ভাইসাব, পঁচাশ দিজিয়ে। কোঈ চিটিং নেহি হোগা, সাব।
--জবাব সহিহ তো হ্যায়, ভাইসাব?
--সহি, ভাই। হাম সোলেমান হ্যায়। পয়গম্বার নাম কে নাম হ্যায়না। আল্লাহ কসম।
--আল্লাহ কসম।
***


এ-রকমই বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ঢাকা কলেজের প্রধান করিডোরে।
এক ষাটোর্ধ পিওন এসে সামনে দাঁড়ালো: কাকে চাই?
ভর্তি হতে চাই--কম্পিত গলায় বলি।
--কোহান থন আইছেন?
--গোপালগঞ্জ।
--অ, শেহের দ্যাশ? হেহানে তো কিচ্ছু নাই। কি নিয়া আইছেন?
আমি ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাবার চেষ্টা করি। কিন্তু, দেলোয়ার আমাকে নিয়ে সোজা ঢোকে প্রিন্সিপ্যালের রুমে। খাড়ান। পার্মিশনডা তো লওন ভালা, না?
বাঁশের তৈরি বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি শুনি তার কথোপকথন-- ছার, একজন শেখের পোলা আইছে--গোপালগঞ্জেত্থন--চেহারা সুরাতে এক্কেরে আইনস্টাইন। তয় বাটপার মনে অয় না। ভর্তি অইবার চায়। ডাকুম?
যদ্দুর মনে পড়ে--প্রিন্সিপ্যাল তখন জালাল স্যার। তিনি হেসে বললেন: ডাকো।
ঢুকলাম পা টিপে টিপে।
স্যার আপাদমস্তক আমাকে নিরীক্ষণ করে মোলায়েম কণ্ঠে জানতে চাইলেন:-- নাম কি, বাবা?
বললাম: বুলবুল সরওয়ার।
--বংশ?
--খন্দকার?
--মানে কি?
আমি বোকা। জবাব দিতে পারি না। জানিনা, তা কিন্তু নয়--বলতে সাহস পাচ্ছি না।
--রেজাল্ট কি?
--ফার্স্ট ডিভিশন। চারটা লেটার। সাইন্স।
--কাগজপত্র কি আছে?
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দিলাম দু-খানা দরিদ্র-কাগজ--একটি নীল; একটি গোলাপী।
স্যার দেখলেন। হাসলেন। বললেন: টেস্টিমোনিয়ালে কাটাকাটি কেন?
--স্যার, রেজিস্ট্রেশনের পর স্কুলের নাম বদলে গেছে।
--তো, কাগজপত্র বদলায়নি কেন?
--ঠিক জানি না; গ্রামের স্কুল তো...। আমি তোতলাতে থাকি।
--আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে। মার্কশীট কৈ?
হেড স্যার বলেছেন: দু’মাস পরে আসবে।
--আমার ভর্তি তো ছয়-তারিখ শেষ। মার্কশীট ছাড়া কিভাবে ভর্তি নেব? আর কোথাও চেষ্টা করেছো?
--স্যার, আমি ঢাকা কলেজেই ভর্তি হবো। অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করি নাই। করবোও না।
--দেলওয়ার? হাঁক দিয়ে পিওনকে ডাকলেন তিনি। গাধাটাকে নিয়ে যা। ঠিকই বলেছিস: পুরাই আইনস্টাইন। যা--নিউটনের কাছে নিয়ে যা।
নির্বাক আমি দেলোয়ারের পেছন-পেছন হেঁটে বিরাট বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ উইংয়ের ছোট্ট একটি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দরোজায় লেখা: প্রফেসর ডি. এস. ইসলাম
বিভাগীয় প্রধান, জুওলজি।


--স্যার, আসবো?
আসবি না তো দরজা আছে ক্যান,--শয়তান?
--স্যার, আমি দেলোয়ার, শয়তান না। জালাল স্যার পাডাইলেন। এই যে, ইনি--ভর্তি অইবার আইছেন--শেখের দেশ থেকে। নেবেন না?
--যা, ভাগ। বসো।
ভয়ে ভয়ে বসলাম।
চায়ে চুমুক দিয়ে শুনলেন তিনি সব।
--হ্যাঁ, আমি ভর্তি কমিটির সভাপতি, বাবা। কিন্তু মার্কশীট ছাড়া কিভাবে বুঝবো যে তোমার রেজাল্ট কি? ঢাকায় কোন পরিচিত গেজেটেড-অফিসার আছে?
গেজেটেড-অফিসার শব্দ সেই প্রথম শুনি। বুঝতে না পেরেই জবাব দেই:
--স্যার, পরিচিত বড় কেউ তো নেই। এক দুলাভাই আছেন, সাইন্স ল্যাবরেটরীতে--চীফ সায়েন্টিফিক অফিসার।
--কি নাম?
--ড. আবদুল খালেক।
--কী বললি? ড. খালেক? খুদরত-এ-খোদার সহযোগী বিজ্ঞানী? আরে ব্যাটা, তাহলে তো তুই আমারও শালা। যা, খালেকের কাছ থেকে কাগজে লিখিয়ে নিয়ে আয় যে তুই বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগ পেয়েছিস--চারটে লেটার নিয়ে--বুঝলি রে, আইনস্টাইন?
না বুঝেই বেরিয়ে এলাম।
সামান্য হাঁটলেই সাইন্স ল্যাব। পৌঁছে গেলাম দুলাভাইর দরোজায়। লাল বাতি জ্বলছে--দাঁড়িয়ে আছি বিভ্রান্ত হয়ে।
খানিক পরে দুলাভাই বেরিয়ে এসে আমাকে বকা শুরু করলেন: --এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে ঢোকো।
লালবাতি জ্বলছিল--। পিওন বলেছে: লাল বাতি জ্বললে আপনি ব্যাস্ত। ঢোকার নিয়ম নাই।
--আরে, ওটা সাধারণের জন্য। শালার জন্য না। বলো, কি খবর?
ঢাকা কলেজের ইতিবৃত্ত বললাম। আমার ভাগনে সেলিমও আমার সাথেই পাশ করেছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুল থেকে--তার মার্কশীট দুলাভাইর হাতে দুলছে। নিজের ছেলের মার্কশীট দেখে তিনি ফোন করলেন ঢাক্কা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে। তারপর আরেকজনকে। তারপর আরও একজনকে।
--শেষ ব্যক্তি সব সাবজেক্টের নম্বর ফোনে বলে দিলে দুলাভাই দু’বার মিলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
--এদিকে এসো।
আমি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালে তিনি বুকে টেনে পিষে ফেলতে চাইলেন। শিতাইকুন্ড স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তুমি আমার ছেলের থেকে উনিশ নম্বর বেশি পেয়েছো। সোবহানাল্লাহ! আসো, আরও একবার কোলাকুলি করি।
গ্রামে আমরা ঈদ-পূজা-বড়দিন ছাড়া কাউকে কোলাকুলি করি না। মা-ও তার সর্বোচ্চ আদর প্রকাশ করতেন কপালে চুমু খেয়ে। দুলাভাইর কাছ থেকে প্রথম শিখলাম ‘হাগ’ করে অভিনন্দন জানানোর কায়দা।
ড. খালেকের নির্দেশনামত সেলিম-মামুর মার্কশীট দেখে দেখে--স্কেল দিয়ে টেনে ঘর করে হাতে মার্ক শীট বানালাম। কার্বনে কপি করলাম তিন বার। মোট ছ-কপি হলো। দুলাভাই প্রুফ রিডারদের মত মিলিয়ে দেখলেন নির্ভুল আছে কি-না। ...আমিও গরীব ঘরের ছেলে, চুলার আগুনে পড়ে পড়ে প্রাইমারী বৃত্তি পেয়েছি; মেট্রিকে ডিস্ট্রিক্ট ফার্স্ট হয়েছি। তুমিও সেই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছো নিজের যোগ্যতায়--ব্রাভো!
--দুলাভাই-- কন্ট্রোলার, নিরীক্ষক, পরিদর্শকের স্থানে কে স্বাক্ষর করবে?
--প্রত্যেকটির উপরে লেখ: স্বাক্ষর:- অস্পষ্ট।
লিখলাম এবং শিখলাম।
দুলাভাই প্রক্যেকটিতে সত্যায়ন করে দিয়ে বললেন: ডি. এস. ইসলাম আমার বন্ধু মানুষ। নাম করা জুওলজিস্ট। যাও--অসুবিধা হবে না।



পরদিন মার্কশিট নিয়ে যখন ঢুকলাম--স্যার তখনও চা খাচ্ছিলেন। হাতে লেখা মার্কশীটে ড. আবদুল খালেকের ‘সত্যায়ন’ দেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন। নাহ--তোদের দিয়েই হবে। যা, তোর ভর্তি নিয়ে নিলাম--বলেই না-খাওয়া বাকী আধকাপ প্রায়-ঠান্ডা চা আমার মাথায় ঢেলে দিলেন।
আমি খুশি ও ব্যথায় নির্বাক; হতভম্ব। কান্না চেপে জিজ্ঞাসা করি: ইন্টারভিউ কবে হবে, স্যার?
--এই যে নিলাম, শার্ট নস্ট করে। ব্যাগে আর শার্ট আছে?
--না, স্যার। আপার বাসায় আরেকটা শার্ট আছে। যেয়ে সেটা পরে নেবো।
রাগ হয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। --আরে, দাঁড়া-দাঁড়া,এটা নিবি না--? খস খস করে সাদা কাগজে তিনি লিখে দিলেন: অ্যাপ্রুভ্ড বাই ডি.এস. ইসলাম।
আমি অবাক হয়ে জানতে চাই: --কি অ্যাপ্রুভ করলেন, স্যার?
--ওহ হো, তুই তো দরখাস্তই দিস নি, তাই না? আচ্ছা, কাগজের বাকীটুকুতে লিখে ফেল যে তুই ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান শাখায় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হতে চাস। পারবি তো?
বললাম: --পারব, স্যার।
স্যারের পাশে বসেই দরখাস্তটা লিখলাম। সেটা একবার দেখে বললেন: বাহ, হাতের লেখা দেখি বেশ। যা--এবার দেলোয়ারকে দিয়ে দে। বাকীটা সে করবে।
মনে মনে বললাম: সত্যিই নিউটন!
জালাল স্যার সাথে সাথেই আমার ভর্তি নিয়ে হাতে একশো টাকা গুজে দিয়ে বললেন: একটা শার্ট কিনে নিস, বাবা। জিনিয়াসরা একটু পাগলই হয়--এক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছাড়া

***


সোলেমানের গাড়ির স্টার্ট বন্দ হয়ে যেতেই আমি প্রচন্ড চমকে উঠি। এ-ব্যাটা আমায় কোথায় নিয়ে এসেছে? এ-দেখি রেড লাইট এরিয়া! চার দিকে পান-খেয়ে ঠোঁট লাল-করা মেয়েমানুষ আর তাদের দালাল-মাস্তানরা।
--নামুন স্যার, তাড়াতাড়ি--এসে গেছি--বিবি কা মকবরা। জেনানা মহল।
চার পাঁচজন যুবক আমাকে ঘিরে ধরলো--ক্যায়সা মাগী চাইয়ে বোলো--আঠঠারো কা কম, অউর ভাবী?
ঢাকা কলেজের দুই মাস্তান যেভাবে একবার আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হোস্টেল থেকে বের করে দিতে দিতে বলেছিল--হয় দলের সদস্য হবি, নয় আওরঙ্গভাইয়ের কাছে গিয়ে নাকে খত দিবি--সেভাবেই আমি বাধ্য হলাম বলতে: ভাবী কি পাস লে চলো।
আরে সালা--ভাবী চাইয়ে; জব্বর মাস্তি। চল্-চল্--।
মাসুদ রানার মতই মনে আশা ছিল যে বয়স্ক কোনো মেয়ের ঘরে গিয়ে পড়লে অন্তত বাঁচা যেতে পারে। আল্লাহ বোধহয় মুসাফিরের দোয়া শুনলেন; কিংবা, দুলাভাই আর ড. ডি-এস ইসলামের দোয়ার বরকতে এগারো ক্লাস-পড়া এক ভাবীর ঘরে পৌঁছার পর তিনি দুশো রুপী দালালদের দিয়ে দরোজা আঁটকালেন।
--কাঁহা সে আইয়ে, জনাব?
--চালিশবাদ সে।
--কাঁহা রহতা হ্যায়?
--আজমীর সে।
--খাজা বাবা কি আসপাস, ঔর যেয়াদা দূর?
--আসপাস নেহি--থোরা দূর--তিন কিলো পচ্চিম মে।
--লেক পর?
--নেহি। লেক কি উসপার।
--বহুত আচ্ছা। তো, কেয়া চাইয়ে মেরে পাস? বলেই সে ওড়না সরিয়ে কামিজের বাটনে হাত দিলো।

--বহিনজী?
--কেয়া বোলা--বহিনজী? কিউ হারামী, তু জানতা নেহি বহিনকো সাথ কাম নেহি চলে গা? হিন্দু হ্যায়?
--নেহি, বহিনজী। ম্যায় মুসলিম হো। আপকা ভাই হ্যায়। থোরা মদদ চাইয়ে। প্লিজ--।
এতক্ষণে দিলতাজ বেগমের হুঁশ হলো। আমার পোষাক, ভাষা ও ব্যাগে কড়া নযর বুলিয়ে বললো সে: বাঙালী বাবু আছেন?
আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম: জী, বহিনজী--। ড্রাইভার সোলেমান ইধার লে আয়ে। ও বোলা, উসকো নাম নবীজিকা নাম-- কসম সে মাকবারা লে যায়েঙ্গে।
--ইয়া আল্লাহ! আবদুল হক, আবদুল হক--ডাকতে ডাকতে সে দরোজা খুলে দিলো।
দৌড়ে এলো এক মাস্তান টাইপের যুবক।
--কেয়া কুছ গড়বড় হুয়া--দিলতাজ বেগম?
--নেহি হুয়া। অটোওয়ালা সোলেমানকে বোলাও।
--ও তো চল গিয়া।
লে আও--যাও--আভি আভি।...দুরন্ত যাও--।
***

জীবনে অনেক আশ্চর্য ঘটনার মত আমিও সে নাটক না-দেখে দিন-শেষে বিবি কা মাকবারার পাশের ভিভান্ত-তাজ হোটেলে আশ্রয় পেলাম।
আবদুল হক ঈমানদারীর সাথেই আমাকে রিসেপশনে পৌঁছে দিলো। তাঁকে আমি দু-শো টাকা দিলাম। ষাট টাকা ভাড়া আর বাকীটা বকশিশ। সে প্রথমে নিতে না চাইলেও পরে ‘শুকরিয়া’ বলে নিয়ে দ্রুত বিদায় নিলো।
সে চলে যাবার আগ পর্যন্ত আমি হোটেলে চেক-ইন করালাম না। ম্যানেজার একটু অবাক হলেও আমার অনুরোধে এক মগ কফি এনে দিলো আমাকে। ধাতস্থ হবার পর আমি বললাম: সরি, স্যার। আই ওয়াজ চিটেড এন্ড রঙলি টেকেন টু এ ব্রোথেল। লাকিলি সেভ্ড; দিস ইজ মাই পাসপোর্ট--। প্লিজ, আমাকে একটি ব্যালকনী রুম দেবেন; যেখান থেকে বিবি-কা-মাকবারা দেখা যায়।
ওকে, স্যার। বাট ইউ হ্যাভ টু নেটিফাই দিস টু পুলিশ ফার্স্ট।
আই’ল স্টে অনলি ওয়ান অর টু নাইটস, স্যার। লিভ ইট--ফর গড্স শেক--আই হ্যাভ নো স্ট্রেন্থ টু ফেইস মোর হ্যাসেল।
ওকে-ওকে--। বলতে বলতে তিনি আমার রিজার্ভেশন-ফর্ম হাতে নিয়ে বললেন: আর ইউ এ ফিজিশিয়ান, অর পি-এইচ-ডি, স্যার?
ফিজিশিয়ান।
ওকে- স্যার, প্লিজ পে অ্যান্ড চেক-ইন। ইউ আর লুকিং ড্যামেজ্ড।

আল্লাহকে শুকরিয়া জানাতে আমি বেল-বয়কে জিজ্ঞাসা করি: পশ্চিম কোন্ দিকে। সে ছাঁদে আঙুল দেখায়। সেখানে ছোট্ট একটি তীর ‘কিবলা’ নির্দেশ করছে।
আমার চোখ পানিতে ভরে এলো। সোলেমান নবীর নামে-নাম এক ড্রাইভার আমাকে নিয়ে গেছে লান্ডি-কোটালে, আর হিন্দু হোটেলের ছাদে গোপনে দেখানো আছে কিবলা--খোদার লিলা বোঝা সত্যিই ভার। বেল-বয়কে আমি জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না: তোমার নাম কি?
--মোহাম্মদ তুঘলক।
আমি তাকেও একশো টাকা বখশিশ দিয়ে জানতে চাই: মোহাম্মদ, তোমার শহর দেখার কোন গাইড পাওয়া যাবে, ভাই? আমি একজন মুসলমান--বাংলাদেশী।
--জানি, স্যার--বদনসীব; সোলেমান আপনাকে বাজে জায়গায় নিয়ে গেছে! আপনার ভাগ্য অনেক ভালো--রাহাজানি হতে পারত। দিলতাজ বেগমের কারণে বেঁচে গেছেন--আল্লাহর হাজার শোকর।
আমি অবাক হয়ে বলি: তুমি তাকেও চেন?
--অনেকেই চেনে তাকে, স্যার। লক্ষেœৗয়ের এক উঁচু খানদানের মেয়ে তিনি। দুর্ভাগ্যচক্রে এখানে এসে পড়েছেন। বহু প্রতারিত গেস্টকে তিনি আমাদের কাছে পাঠিয়ে থাকেন।
--আশ্চর্য! আমি হতবাক হয়ে বলি: এ-কী করে সম্ভব, মুহাম্মদ?
--সম্ভব, স্যার--আল্লাহর কুদরতে দুনিয়াতে সব সম্ভব। আচ্ছা স্যার, বাংলাদেশে কি ইন্ডিয়ান সিনেমা চলে?
না, কেন?
--এমনিতেই জানতে চাইলাম। ‘উমরাওজান’ নামে একটা হিন্দি ফিল্ম আছে--দিলতাজ বেগমের কাহিনী অনেকটাই সে রকম।



আমি চমকে উঠলাম। উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক রুসুয়ার এ উপন্যাসের নায়ীকা রেখা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন উমরাওয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে। ভাবলাম--তার মানে, দিলতাজ বেগম আসলে সেক্স-ওয়ার্কার নন? হে আল্লাহ--আচ্ছা, ভাই মুহাম্মদ: আমি তো তাকে তার পাওনাটাও দিতে পারিনি। তুমি কি তাকে কিছু টাকা পৌঁছে দিতে পারবে?
আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন, স্যার। তার চেয়ে এই নিন--কাবার্ডের সবচেয়ে নীচের ড্রয়ার থেকে সে একটা জীর্ণ জায়নামাজ টেনে এনে বললো: যা দেবার এখানে দিন, স্যার; সব জায়গা মত পৌঁছে যাবে।
আমাকে বোবা করে দিয়ে মোহাম্মদ দরোজা টেনে বেরিয়ে গেল।
(প্রকাশিতব্য “মহাভারতের পথে-তিন” থেকে)

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:৪৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অদৃশ্য দোলনায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৮:৩৮



ভোরের রোদ্র এসে ঘাসের শিশিরে মেঘের দেশে চলে যেতে বলে
শিশির মেঘের দেশে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঘাসের মাঝে ফিরে আসে-
বৃষ্টি হাসে শিশিরের কথায়। তাহলে আমরা দু’জন কেন প্রিয়?
এক জুটিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লায় দেছে!

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:০৯



আল্লায় দেছে। কথাটার মানে হচ্ছে- আল্লাহ দিয়েছেন।
হ্যা আল্লাহ আমাদের সব দেন। এই দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন শুধু মাত্র তার ইবাদত করার জন্য। কিন্তু মানুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। শনিবার (২৯ মার্চ) এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্রঋণ ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনুস: এক নতুন স্টেটসম্যানের উত্থান

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ড. মুহাম্মদ ইউনুস ধীরে ধীরে রাজনীতির এক নতুন স্তরে পদার্পণ করছেন—একজন স্টেটসম্যান হিসেবে। তার রাজনৈতিক যাত্রা হয়তো এখনও পূর্ণতা পায়নি, তবে গতিপথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে নেয়া,... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর কেমন হলো ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৮


প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এখনো চীন সফরে রয়েছেন। চীন সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক হাইপ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সাসেক্সফুল সফর আর কোনো দলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×