চোখে পড়া মাত্র আমি চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু আমার অজ্ঞতা আমায় বোবা করে দিলো। লক্ষ বার দেখা এই ডোম-অভ-রককেই আমি ভাবতাম মসজিদুল আকসা। কত আবেগ ভরা চোখের জলে স্নাত হয়ে আমি এই অত্যুজ্জ্বল স্বর্ণমন্দিরকে চুমু খেয়েছি আর ইজরাইলী বর্বর-শৃংখল থেকে এর মুক্তি চেয়েছি! আর আজ, যখন আমি এর সামনে উপস্থিত, আমার এই সুন্দর-দেহের অভ্যন্তরে ঘৃণা-পূর্ণ হৃদয় দেখে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এ-তো তীর্থ; এতে অসুন্দরের স্থান কোথায়?
তাজমহল দেখেও প্রথমবার প্রশ্ন করেছিলাম: বড়, বুঝলাম; কিন্তু কত বড়?--যা আমার সমুদয় কল্পনা ও চিন্তার বিশালতাকে ছাপিয়ে যায়--ততো বড় তো? ছিয়াত্তরের সেই-মন্বন্তর এবার আমায় পুরোপুরি পঙ্গু করে দিলো। বিশাল, বুঝলাম; কিন্তু কত বিশাল? সেই ৬৯২ খ্রিস্টাব্দে--নবী মুহাম্মদ (স)-এর মৃত্যুর মাত্র ৫৮ বছর পরেই--খলিফা আবদুল মালেক কি করে এই নির্মাণ সম্পন্ন করেছিলেন--যা দেড় হাজার বছরের সমস্ত দম্ভ ও সহিংসতাকে ম্লান করে শৌর্যে-বির্যে-ঔদার্যে-বিশালতায় আজো পৃথিবীর গৌরব হয়ে জ্বলজ্বল করছে? আমার ক্ষুদ্র মস্তিকে শুধু তাজমহল আর ইস্তাম্বুলের নীল-মসজিদই বার-বার ফিরে এলো এবং বিস্ময়াভূত আমি এই ডোমের নিখুঁত-জ্যামিতি ও নিপুন-সৌন্দর্যে ডুবে যেতে বাধ্য হলাম।
তেরোশো বছর বা তারও আগের পৃথিবীর এ-রকম নির্মাণ আর কি-কি আছে? স্মৃতির পাতা হাতড়ে আমি কেবল ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়াকেই খুঁজে পেলাম--যা তার অনুপম নির্মাণশৈলী নিয়ে এখনো গৌরবের-রাজটিকা হয়ে টিকে আছে। অবচেতন মন আমার হায়-হায় করে উঠলো--দুটোই যে ধর্মস্থান! আহা-রে, আমার অতি-প্রগতিশীল বন্ধুদেরকে আমি আর কোন্ রেনেসাঁসে নিয়ে যাই? যাই হোক, সেই আয়া সোফিয়ার সৌন্দর্য কিন্তু এই ডোমের ধারে কাছেও না। আমি বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম কেন্দ্রীয় গম্বুজের সোনালী শরীরে--যা নির্মাণ করা হয়েছে ৮০ কেজি খাঁটি সোনার আস্তরে--জর্দানের বাদশাহ হোসেনের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে; চৌকো চৌকা মোজাইক-মেটালের অসংখ্য আশ্চর্য সজ্জায়নে। জেরুসালেমবাসীর দাবী, একমাত্র পিরামিড ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো নির্মানে এত রহস্য নেই। আমি তাদের সেই আশ্চর্য যুক্তির কিছু কিছু আগেই শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। এখন নিজের চোখে দেখে আবিশ্বাস করার তো উপায় নেই যে আটকোনা-ইমারতটি গণিতের স্বত:সিদ্ধ নিয়মই শুধু মানে-নি, ধর্ম ও অদৃশ্য জগতেরও বহু রহস্যকেও ধারণ করে আছে। নাহলে এর গম্বুজের উচ্চতা, ব্যাস এবং প্রতি-পার্শ্বের দৈর্ঘ্য নিখুঁত ৬৭-ফিট হবার প্রশ্নই উঠতো না। সাধে কি আর এটা ফ্রি-ম্যাসনদের তীর্থ-ভূমি!
গতকাল রাতে আমি ডোম-অভ রকের নানা-রহস্য এবং ‘ম্যাজিক’ নিয়ে বন্ধুদেরকে কথা বলতে শুনেছি। এই টেম্পল মাউন্টেন নয়-ডিগ্রি বাঁকা, কারণ তাহলেই নাকি এর দিকগুলো দক্ষিণে মক্কা, উত্তরে ইস্তাম্বুলকে ভেদ করে। পশ্চিম দিক ছুঁয়ে যায় গিজার পিরামিড আর পূবদিকে--সূর্যের জাগরণে যে-দিকে জাগে স্বর্গের অনাবিল আশ্বাস--অপেক্ষা করে গেট-অভ-হ্যাভেন--যে-পথ ধরে এই টেম্পলে প্রবেশ করবেন মাসিহ্--তার শেষ বিজয়ের নিশান উড়িয়ে--তিনটি সেমেটিক ধর্মানুসারীরাই এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে আছে।
আমার পূর্ব-আন্দাজ ছিল, ইজরাইলীদের এই দেশে টেম্পল মাউন্টেও নিশ্চয়ই ইহুদীদের প্রচন্ড ভিড় থাকবে। ব্যাপারটা মোটেই সে-রকম দেখছি না। ইসলামী ওয়াকফ্ ট্রাস্ট এই মাউন্টের সব-কিছু নিয়ন্ত্রণ করে--যাদের সদর দফতর জর্দানে এবং তারা সবাই মুসলিম। এখানে, এই টেম্পল মাউন্টে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া ইহুদীদের প্রবেশাধিকারই নেই। কারণ, এটি তাওরাত বা মিসনাহ্ অনুসারে মহাপাপ। ‘পরম-পবিত্রতা’ ছাড়া এখানে কোনো ইহুদী প্রবেশ করতে পারবে না--যার ব্যতিক্রম হবেন কেবল প্রধান-রাব্বি আর সেই প্রত্যাশিত মাসিহ্। তারপরেও দু-একজন যে ঢোকে না, তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না; তবে সে-সব ঘটে কালেভদ্রে। নিউইয়র্ক-লন্ডন-ঢাকায়ও যেমন আসল-ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ-করা লোকের সংখ্যা বাস্তবিকই কম, এখানেও তেমনি--গাইডের চাদরে কিংবা পুলিশের চোখ ফাঁকি-দেওয়া দু’চার জন ছদ্মবেশি ইহুদী হয়তো থেকেই যায়! এ-নিয়ে ‘বিপ্লবী’ ইহুদী তরুণদের মধ্যে ক্ষোভও কম নয়। আরো আশ্চর্যের বিষয়, পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরের মত এখানেও ‘পান্ডাদের’ মোটেই কমতি নেই--যদিও ধর্মে তারা ভিন্ন!
দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমি চোখ বুলালাম চারদিকে। সাগরের মত বিশাল-এলাকার মাঝখানে প্রায় এগারো-বারো ফিট উঁচু প্লাটফর্মে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ডোম-অভ-রক--যার চূড়া এতোটা সোনালী যে এখান থেকেই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এই ডোম সম্ভবত এ কারণেই ইসরাইলীদের ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছে যে এই-নির্মাণ নতুন করে তৈরি করা অসম্ভব। নকল হয়তো করা সম্ভব, তবে তা যে আসলেরই অধিক গুণকীর্তন হবে, সে বুঝি বাচ্চারাও বোঝে! হয়তো, এই বোধবুদ্ধি থেকেই তারা এটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে এই ভরসা ও স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস-কুয়ো) কদ্দিন টিকবে, বলা মুশকিল। যেমন সাতষট্টির যুদ্ধ-জয়ের পরপরই ইজরাইলী সেনাবাহিনীর জেনারেল গোরেন এই নিয়ম ভাংতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং ডোম-অভ-রককে ধূলিস্যাৎ করে নিজেই ‘ইতিহাস’ হতে উঠে এসেছিলেন এই মার্চেন্ট-গেট পর্যন্ত--যেখানে আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি। যদিও তার সেই পাশবিক ইচ্ছাকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন চীফ-অভ স্টাফ জেনারেল উজি নারকিস; যিনি টেম্পল-মাউন্ট সংলগ্ন সেন্ট্রাল কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন। ভাবলাম: দুজনেই জেনারেল। দুজনেই ইহুদী। একজন ধ্বংস চেয়েছে; অন্যজন রক্ষা। যেন সৃষ্টির আদি-দ্বন্দ্ব: হাবিল ও কাবিল।
বিশালায়তনের পশ্চিম-সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি উত্তর-দক্ষিণে তাকালাম। এই পশ্চিম-বর্ডার ১৪৬৪ ফিট লম্বা। চওড়া, উত্তর-পাশে ৯৪৫ ফিট এবং দক্ষিণ-পাশে ৮৪০ ফিট। দক্ষিণ বর্ডারের প্রায় মধ্যিখানে রয়েছে আল আকসা; একতলা--এই মুহূর্তে খেজুর গাছের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেলেও যার রূপালী গম্বুজটি ঠিকই অনুজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। আশ্চর্য এই দুই-ভাই--আমি অবাক হয়ে দেখি--একই খলিফার হাতে গড়া দুই-রকম গম্বুজ;--একটি সোনার দ্যূতিতে সমুজ্জ্বল, অন্যটি রূপালী জ্যোস্নায় স্নিগ্ধ; একটি উঁচুতে, যেন মর্যাদা ও মহত্বকে তুলে ধরতে চায় ধর্ম-বর্ণ-বিভেদ-জাতিত্বের অনেক উপরে, অন্যটি পাশেই দাঁড়িয়ে সাম্য-মৈত্রীকে সগৌরবে ঘোষণা করে বলছে:- অধিকার নেই আরবের কোনো অনারবের উপর; (কিংবা) মানুষ-মাত্রেই আশরাফুল মাখলুকাত। --একটির নাম আল-কুদ্স বা পবিত্র-শহর; অন্যটি আল-আকসা বা দূরবর্তী মসজিদ।
আমি বার-বার ডানে-বামে ঘাড় ঘুরিয়ে অনুভব করতে চাই এই অসাধারণ সম্প্রীতির মাহাত্ব্য এবং মাপি আমার অস্বাভাবিক-মূর্খতা। কিন্তু এটা মানা সত্যিই কঠিন যে আল্লাহর সব সৃষ্টিরই সমান অধিকার দুনিয়ায়--সে মক্কী হোক বা বাংলাদেশী--যতোই আমি নিজেকে সাচ্চা দাবী করি না কেন। সুলতান সালাউদ্দীন আইউবী তো হযরত ওমরকে অনুসরণ করেই জেরুসালেমের সকল দুয়ার সকলের জন্য খুলে দিয়েছিলেন সব সময়ের জন্য; তবু আমাদের বেশিরভাগ উচ্চারণই কত অনুচিত-রকম ধৃষ্ঠ; কী বর্বরসুলভ অ-ধার্মিক! যেমন রাব্বি-গোরেন চেয়েছিলেন তার নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকুক এই মহিমাময় স্থাপনাগুলোর ধ্বংস আর সর্বনাশের বিনিময়ে! এ-এক আশ্চর্য উন্মাদনা। মাত্র ৪৪ মাইল চওড়া যে-দেশ লম্বায়ও ২৬৩ মাইলের অধিক নয়, সে-দেশটির মানুষ কেন এত প্রান্তিকীয় হলো, ভেবে আমি কূল-কিনারা পাই না। নিজের দেশকে নিয়ে যে-বেদনা আমায় সারাক্ষণ বিষন্ন করে রাখে যে, দেশের আয়তন ছোট হলে মানুষের মনও ছোট হয়ে যায়--হয়তো সেই সংকীর্ণতাই এখানে বিন্দুর-ক্ষুদ্রতা নিয়েও স্ফুলিঙ্গ হতে চাইছে।
আমি পা বাড়ালাম সিঁড়ির দিকে। বারো-চৌদ্দটি ধাপের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কান্তির। চতুস্কোন এই প্রাঙ্গনের প্রতিটি বর্ডারে দুটি করে কান্তির। দুই-পাশে ভারী স্তম্ভের মজবুত স্থাপনার মাঝে তিনটি অন্তস্থঃ সরু-খুঁটির সমন্বয়ে গড়া গথিক-নির্মানের পাঁচটি বড় ফোকর-- মানে দরোজার মতো বিশাল-বিশাল গহবর--যার কলামগুলো চমৎকার ধূসর কারুকার্যময় এবং দু-দিকের স্তম্ভ ও উপরের আড়ায় নীল টাইলসের আল্পনার ঈন্দ্রজাল--যা হবে শেষ-বিচারের দাঁড়িপাল্লা রাখার ভরদন্ড বলে বিশ্বাস করে জেরুসালেমবাসী--তারই নাম কান্তির। এই আশ্চর্য গভীর বিশ্বাসের প্রতি মুসলিম-খ্রিষ্টান-ইহুদী সকলেরই পরম নির্ভরতায় আমি মুগ্ধ ও হতভম্ব। কারণ, আমি আগে কখনো এসব কথা-কাহিনী শুনি নি।
পরকাল সম্পর্কে বস্তুবাদী-কল্পনায় বরাবরই আমার ক্লান্তি লাগে। এক বিদ্রোহী আরব কন্ঠ একবার লিখেছিলো: যা বলা হয়েছে, তা আমি এখানেই পাই; যা বলা হয়নি, তা আমার চাই না। আমি কি করে তা দেখবো, যা আমার জ্ঞানের অগোচর? রহস্য দিয়ে আমাকে প্রতারিত করার চেয়ে আমি বরং নিদ্রাকেই বেছে নেই...!
কান্তিরগুলো বিশাল এবং রাজকীয়--প্রায় তিন-মানুষ সমান উঁচু। কেউ বলতে পারে না, এগুলো কার হাতে তৈরি। ঐতিহাসিকদের অধিকাংশের ধারণা, মিশরীয় ধারার নির্মান এগুলো। তবে যে বা যিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা হোন না কেন, ক্রুসেডীয় টালমাটালের দু-আড়াইশো বছরের ধ্বংসলীলার পরেও যে এগুলো এমন অটুট-অক্ষত আছে, দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৭ সকাল ৯:০৮