যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ২
যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৩
যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৪
কবিতার এই পোস্ট দিতে গিয়ে খাটুনি যাচ্ছে খুব। বাংলা কবিতাগুলো ইন্টারনেটে যেন মার্ফিস ল' অনুসরণ করে। সব কবিতা খুঁজে পাই, কেবল যে কবিতাটি পোস্টের জন্য খুঁজছি; দেখি সেটাই হাওয়া! নেই! কি আর করা, লাইব্রেরীতে বসে টুকে নিয়ে আসি, আর পিসি'র সামনে বসে বসে টাইপ করি। নিজের আগ্রহে শুরু করেছিলাম লিখা। এখন তার সাথে যোগ হয়েছে ব্লগারদের অনুপ্রেরণা। সুতরাং
চলছে কবিতা...
চলবে কবিতা...
এ পর্বের কবিতাগুলোঃ
===============
২৯. আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩০. সাধারণ মেয়ে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩১. অভিশাপ-কাজী নজরুল ইসলাম
৩২. ভালো থেকো-হুমায়ূন আজাদ
৩৩. নিঃসঙ্গতা-আবুল হাসান
৩৪. প্রত্যাবর্তন-হেলাল হাফিজ
২৯. আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছিঃ
সুনীলের এই কবিতা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো নিখিলেশ হবার। ছন্নছাড়া জীবনের ডাক আমাকে হাতছানি দিত। আটপৌঢ়ে জীবনটার সাদাকালো রঙ তখন সব রঙের প্রতিনিধি হয়ে আসতো আমার ক্যানভাসে।
আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি
তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ।
এই কী মানুষজন্ম?
নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা!
প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে,
হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত;
আমি মানুষের পায়ের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি-
তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।
আমি আক্রোশে হেসে উঠি না,
আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে;
খাঁটি অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে-
(ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই!)
আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে সেজে গেছি রঙ্গালয়ে,
পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার।
নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি?
আমি শোবার ঘরে
নিজের দুই হাত পেরেকেবিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম
যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কিনা;
আমি ফুলের পাশে ফুল হয়ে ফুটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি,
তোর সঙ্গে জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার-
একি নদীর তরঙ্গে ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?
অথবা চশমা বদলের মতো কয়েক মিনিট আলোড়ন?
অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়।
মৃত গাছটির পাশে উত্তরের হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে আছে।
ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে দেখি
উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল,
তবুও অক্লেশে হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি।
আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম,
একটি ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার এই বিশেষ কথাটা তোকে।
তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত,
রাত্রে এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না,
রোজ অন্ধকার হাত্ড়ে টের পাই তিনটে ইঁদুর ।
ইঁদুর না মূষিক!
তা হলে কি প্রতীক্ষায় আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক?
পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায় কিছুই মনে পড়ে না আমার
পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে বেজে ওঠে সাইরেন।
নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের।
আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ।
এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।
৩০. সাধারণ মেয়েঃ
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটাতে আছে এক সাধারণ মেয়ের অনুযোগ, অনুরোধ। চরিত্রকল্পে কবিগুরু অদ্বিতীয় ছিলেন নিঃসন্দেহভাবে। তিনি একজন সাধারণ মেয়ের চিত্র আঁকেন এভাবেঃ
"এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।"
কি অপূর্ব কবিতা!
সাধারণ মেয়ে
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,
‘বাসি ফুলের মালা'।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে —
জিতিয়ে দিলে তাকে।
নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে —
ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।
তোমাকে দোহাই দিই,
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দুঃখ তার।
তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।
কথাটা কেন উঠল তা বলি।
মনে করো তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
না করব যে এমন জোর কই।
একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!
আর তারা কি সবাই অসামান্য —
এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।
আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।
গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে
লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে —
বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে তুলে
সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে —
তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি —
সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
‘এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;
ঝিনুকের দুটি খোলা,
মাঝখানটুকু ভরা থাক্
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে —
দুর্লভ , মূল্যহীন। '
কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।
সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে,
কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার —
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়। '
বুঝতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো
আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায় —
আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগো, নাহয় তাই হল,
নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প —
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে —
অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।
তাকে নাম দিয়ো মালতী।
ওই নামটা আমার।
ধরা পড়বার ভয় নেই।
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।
কী করে জিতিয়ে দেবে।
উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,
দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।
দয়া কোরো আমাকে।
নেমে এসো আমার সমতলে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি —
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম . এ .
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হোক
খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে —
শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে।
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয় —
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,
বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায় —
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,
সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি
সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হল নিজের মুখেই,
এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে। )
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।
আর তার পরে?
তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,
স্বপ্ন আমার ফুরোল।
হায় রে সামান্য মেয়ে!
হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!
৩১. অভিশাপঃ
অভিশাপ কবিতাটা বিদ্রোহী কবির অন্য কবিতাগুলোর মত না। অভিসম্পাত যে এমন আত্মবিশ্বাসী হতে পারে! অসামান্য এই কবিতায় কোথায় যেন কবি'র একটা অনুক্ত কান্না আছে।
অভিশাপ
(কাজী নজরুল ইসলাম)
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি'
যেদিন আমায় খুঁজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোঁয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, -
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব'সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূণ্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব'লবে সবাই - "সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?"
আসবে ভেঙে কান্না!
প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ'রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!
বুকের মালা ক'রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
৩২. ভালো থেকোঃ
অদ্ভুত ভালো থাকার কথা বলে এই মানুষটা চলে গেলেন ভালো না থেকে! তিনি বলেছিলেন 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'! আর নষ্টরা কেড়ে নিলো কিনা তার জীবনটাই আগে! কবি, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
ভালো থেকো
(হুমায়ুন আজাদ)
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো”
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
৩৩. নিঃসঙ্গতাঃ
একটি মেয়ের অব্যক্ত ইচ্ছাকে বিষয় করে এতো অল্প কথায় এতো সুন্দর করে কবিতা খুব কমই আছে। এমন কোন কিশোরী আছে যে এমনটা ভাবেনি? হায়! আমরা কেবল তাদের ভাবনাটাকে হত্যা করতে শিখেছি!
নিঃসঙ্গতা
(আবুল হাসান)
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটা চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,
চেয়েছিল-
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!
৩৪. প্রত্যাবর্তনঃ
হেলাল হাফিজের কবিতা সব সময়ই অনন্য। কম লিখেন তিনি, কিন্তু যা লিখেন তার তুলনা করা অসম্ভব। এর প্রমান পাওয়া যায় উনার নিজের কথায়ইঃ
জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল
কি দিয়ে মুছবে বলো আগুনেরই জল।
প্রত্যাবর্তন
(হেলাল হাফিজ)
প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্লি’ অতীত থেকে যায়।
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না।
কেউ ফিরে এসে কিছু পায়,
মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায়।
তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
প্রত্যাবর্তনের প্তহে
পিতার প্রস্থান থেকে,
থাকে প্রণয়ের প্রাথমিক স্কুল,
মাতার মলিন স্মৃতি ফোটায় ধ্রুপদী হুল,
যুদ্ধোত্তর মানুষের মূল্যবোধ পালটায় তুমুল,
নেতা ভুল,
বাগানে নষ্ট ফুল,
অকথিত কথার বকুল
বছর পাঁচেক বেশ এ্যানাটমিক ক্লাশ করে বুকে।
প্রত্যাবর্তনের পথে
ভেতরে ক্ষরণ থাকে লাল-নীল প্রতিনিয়তই,
তাহকে প্রেসক্লাব–কার্ডরুম, রঙিন জামার শোক,
থাকে সুখী স্টেডিয়াম,
উদ্গ্রীব হয়ে থাকে অভিজাত বিপনী বিতান,
বাথরুম, নগরীর নিয়ন্ত্রিত আঁধারের বার,
থাকে অসুস্থ সচ্ছলতা, দীর্ঘ রজনী
থাকে কোমল কিশোর,
প্রত্যাবর্তনের পথে দুঃসময়ে এইভাবে
মূলত বিদ্রোহ করে বেহালার সুর।
তারপর ফেরে, তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১২ রাত ৮:৪০