ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না!
কিছু কিছু দিনেরা হয় অন্যরকম। অনেকটা ছেঁড়া ঘুড়ির মত। যেন চলে যাওয়ার জন্যই যাওয়া। গোত্তা খেয়ে উড়তে থাকে বেখেয়ালে-যেন দলছুট কোন মেঘের টুকরো। কখনো কখনো ছুটে চলা তার পিছু পিছু-কখনো বা হাল ছেড়ে দিয়ে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আরেকটি ঘুড়ির সরঞ্জাম কেনার প্রত্যয়। জানিনা ঘুড়িরও এমন মনে হয় কিনা। হয়তো কোন ডোবার ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। কিংবা অন্য কোন দূরন্ত শিশু কোন গাছের ডাল থেকে পেড়ে নেয় অসহায় হয়ে ঝুলতে থাকা ঘুড়িটাকে। তারপর নতুন মনিবের শুশ্রূষায় মেঘের সন্তান আবার আকাশে। এভাবেই চলতে থাকে ঘুড়িচক্র।
নচিকেতার গান তখন যেন বিশল্যকরণী। ধাক্কাটা সামলে উঠতে সময় লেগেছিল। বন্ধুদের থেকে অনেকটা দলছুট হয়ে গিয়েছিলাম। হাঁটতাম কারণে-অকারণে। দলছুট কয়েকজন মিলে ছোট্ট একটা দলও ভারী করে ফেলেছিলাম। গন্তব্য সেই ছোট্ট দ্বীপ-যেখানে আমরা একহাঁটু পানি ভেঙ্গে গিয়ে বসে থাকতাম। কিছুনা। এমনি। হয়তো বসে আছি, কারো মুখে কোন কথা নেই। বয়সের সন্ধিক্ষণ গুলো খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে মাঝে মাঝে। হয়তো শৈশবের সবচে কাছের বন্ধুটিকে সে বিনা বিচারে বাতিল ঘোষনা করে, অথবা সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকা বিরক্তিকর মানুষটাকেও হাতে তুলে অধিকার দিয়ে দেয়। আমরা বসে বসে গাই জীবনমুখী গান-
"ঠিক তক্ষুণি গোনা হয় প্রণামীর থালা
লাভের ভাঁড়ার হয় পূর্ণ
দেবতাকে দিয়ে ঘুষ; জমা রেখে সব পাপ
মানুষ বাড়ায় তার পূণ্য"
জানিনা হঠাৎ নিজের ভেতরে কিসের যেন একটা প্রত্যয়! হতে পারে নিজের না পাওয়াটাকে অন্য কোন খাতে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা! নিজের ভেতর একটা তাগিদ-কিছু তো করো! কিছু একটা কর। কিন্তু কি করব-তার কোন হদিশ নেই-অনেকটা কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতই...
আমার বন্ধু সেদিন ক্লাসে ফিসফিস করে বললোঃ 'চল পালাই।'
পালালাম।
টোকে'র ঘাটে বসে সে বললোঃ 'টিলাবাজারের রাস্তায় যাবি?'
আমি বললামঃ 'চল'। কোন কিছুতেই 'না' নেই আমার। আগ্রহ হচ্ছেনা, তাই জিগ্যেসও করলাম না কেন। যাবই যখন, কথা বাড়ানোর কি দরকার?
সাইকেল ঠেলে নিয়ে দুইজন এগিয়ে যাচ্ছি। টুকটাক গল্পও করছি। আমাদের সাহিত্য সংগঠনের নতুন ত্রৈমাসিকের প্রচ্ছদ, কিংবা সাজু ভাইয়ের নতুন 'লিমেরিক'; জিন্নাহ নানার ছন্দের অপটুতা...এইতো' আরো হাবিজাবি। হঠাৎ আমার বন্ধু আমাকে থামিয়ে দিল।
একটা চলে যাওয়া রিকশা দেখিয়ে বললো-ওই মেয়েটা। ভালোবাসি।
রিকশার পেছনে নৃত্যরত সিনেমার নায়িকার ছবি। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলামঃ ওই নায়িকা!
ও বললোঃ না গাধা! ওই রিকশায় যে বসা ছিল, ঐ মেয়েটা। তুই দেখিসনি?
আমি বললামঃ হ্যাঁ দেখেছি। তার চুলের বেণীটা শুধু। তা, তুই কি ওকে দেখার জন্যই এই ৩ কিঃমিঃ আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে এলি? আজব তো!
-'যাহ, শালা! মিস হয়ে গেল! ভেবেছিলাম তোকে দেখাব'।
-পরিচয় কিভাবে? আগে বলিসনি তো!
-পরিচয় হয়নি। বাসার সামনে দিয়ে যায়, তাই চিনি। বহু কষ্টে নামটা যোগাড় করেছি।
-আমি টিপ্পনি কেটে বললামঃ আমি দেখিনি তো কি হয়েছে? তুই তো দেখলি! চল এবার বাড়ি যাই।
-ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, 'আমিও দেখিনিরে! এখানকার রিকশা গুলো বড্ড জোরে চলে! আজ রাতের ঘুমটাই হারাম হয়ে গেল!
সেদিন আমরা সেই মেয়েটির বাসার সামনের পুকুর পাড়ে ঠায় বসে ছিলাম সারাটা বিকেল। আমার বন্ধুর ঘুমের দোহাই দিয়ে এমন অনেক বিকেল কে সন্ধ্যা বানানো যায়। তাতে কার কি?
"অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাঁই।
কিছুতো চাই! কিছুটাতো চাই!"
মেয়েটাকে ওইদিন আর দেখতে পাইনি। ঠেকাতে পারিনি বন্ধুর রাতজাগা।
মাঝে মাঝে ইচ্ছের মেয়েরা যে কোথায় লুকায়!
চলবে...
ঘুড়ি ছেঁড়ার দিন (২)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:২৫