ভূতেরা যখন পাহারাদার
ডাকাতের ঝামেলা শেষ হলো কিন্তু সেরালির চিন্তা গেল বেড়ে। সে সারা রাত ঘুমোয়নি। সে ভাবছে তার অসম্ভবকে সম্ভবকারী গুণধর সন্তানদের নিয়ে। কীভাবে তাদের কাজে লাগিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় কামনার বস্তু অর্থ কামাই করা যায়!
সেরালি পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি! বলে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল।
সেরালি একটা বিরাট সাইনবোর্ড এনে টানিয়ে দিল বাইরের উঠোনে। তাতে লেখা আছে-
আপনি কি চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভীত? আপনি কি আপনার মূল্যবান মালছামানা রক্ষা করতে পারছেন না? আপনি কি বাসা-বাড়ি, খামার, কারখানার জন্য উপযুক্ত, বিশ্বাসী, সৎ, দক্ষ ও অব্যর্থ পাহারাদার খুঁজছেন? আজই যোগাযোগ করুন। ব্যর্থতায় ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা।
সেরালির বাড়িতে টানানো এই অদ্ভুত সাইনবোর্ডের খবর রাতারাতি এলাকা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে।
প্রচন্ড আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে লোকজন আসতে শুরু করেছে তার বাড়িতে। প্রতিশ্র“তি মিলে কিন্তু দরে মিলে না। তার চাহিদা অনেক বেশি। এছাড়া সেরালি প্রতিশ্র“তি ছাড়া আর কিছুই দেখতে দিচ্ছে না। খালি বলে টাকা পরিশোধ করে যান। যথাসময়ে পৌঁছে যাবে পাহারাদার। এ কথায় কেউ ভরসাও করতে পারছে না। এমনই টানাপোড়নে পড়ে কয়েকজন শিল্পপতি ও খামার মালিক এসে ফিরেও গেছে।
কাস্টমারেরা বলে, আমার বাড়ি বা খামার পাহারা দিতে হলে ত্যাগড়া জওয়ান ও সাহসী পাহারাদার লাগবে। না দেখে বিশ্বাস করি ক্যামনে?
সেরালির সাফ জবাব, এখানে দেখাদেখির কিছু নেই। যাদের দেখার তারা দেখলেই হবে। বিশ্বাস হলে কাগজপত্র করেন, না হলে রাস্তা মাপেন।
শহর থেকে এক বাড়ির মালিক এসে তার নানা সমস্যার কথা বলল। তার বিশাল বাড়ি। প্রায়ই চুরি-ডাকাতি হয়। পাহারা বসিয়েও লাভ হয়নি।
আরেক জন পোলট্রি খামারি। তার সমস্যা, এলাকার ছিঁচকে চোর ছাড়াও বড় সমস্যা শিয়ালের বড় উপদ্রব। রাতে শিয়ালেরা দলবেধে এসে বেড়া ফাঁক করে মুরগী নিয়ে খেয়ে ফেলে। এরা এতই ভয়ংকর যে, কুকুরকেও এরা পাত্তা দেয় না।
সেরালি ওদের কথা শুনে বলল, হ্যা, কাগজপত্র করেন। বাসা-বাড়ির নাম-ঠিকানা দিন। আর আপনি দিন আপনার পোলট্রি ফার্ম এর ঠিকানা। আজ রাতেই যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে যাবে পাহারাদার।
দুই ভদ্রলোক টাকা-পয়সা দিয়ে কাগজপত্র করে চলে গেল।
সেরালি সন্ধ্যার পর ছেলেদের ডেকে বাড়ি ও পোলট্রি ফার্ম পাহারা দেওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত বলে যথাযথ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
পিতার নির্দেশ পাওয়ামাত্র ছেলেরা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
বাড়িওয়ালা ও খামারি অপেক্ষায় বসে আছে, কোন সময় কোনদিক দিয়ে ভাড়া করা পাহারাদার আসে তা দেখার জন্য।
বাড়িওয়ালা তার স্ত্রীসহ কৌতূহল নিয়ে বসে আছে বাড়ির ছাদে। হঠাৎ পনপন-ভনভন শব্দে ছাদটা কেঁপে উঠল। মনে হলো পুরো বাসাটা কাৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। তারা দৌড়ে বাসায় গিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। বাড়িওয়ালার বুঝতে বাকি নেই, পাহারাদার এসে গেছে! তারা কয়েক গ্লাস পানি পান করে চুপ করে শুয়ে পড়ল। বাড়িওয়ালার স্ত্রী ভূত-পাহারাদারের কথা শুনে বারবার মাথায় পানি ঢালছে আর অস্থির ভাবে ঘরে পায়চারি করছে।
ভূতেরা প্রতিদিন জন্ম দিচ্ছে রহস্যময় আজব ঘটনার
কদিন বাদে ডাকাত পড়ল এই বাড়িতে। দুর্ধর্ষ ডাকাতদলটি গেট ও দরজা ভেঙেচুরে মূল ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান সবকিছু নিয়ে নিচ্ছে। বাড়িওয়ালা ভয়ে চিকন গলায় চিৎকার করে বলছে, হায় হায় দারোয়ান কই, দারোয়ান কই! আমার দারোয়ান কই!!!
ডাকাতেরা যা চায় তা দিয়ে দে। উপর থেকে কে যেন বলল।
বাড়িওয়ালা ডাকাতদের কথামত সব কিছু দিয়ে দিল।
ডাকাতেরা টাকা-গহনা আর মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে নির্বিঘেœ ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির মূল ফটকের সামনে গিয়ে একত্র হচ্ছে।
বাড়িওয়ালা পাহারাদারের কোনো ভূমিকা না দেখে চিৎকার করে হায়মাতম করছে আর পাহারাদার ও বাটপার সেরালির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে।
ডাকাতদল মালামাল নিয়ে গেট পেরোবার সময় থমকে দাঁড়াল। কে যেন পেছন দিক থেকে ওদের টেনে ধরেছে। তারা টর্চলাইটে কাউকে না দেখতে পেরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। বাড়িওয়ালা যখন দেখল যে, ডাকাতেরা রাস্তায় চলে গেছে, তখন সে ক্ষোভে-দঃুখে আর হতাশায় ভেঙে পড়ল।
কিন্তু না।
ডাকাতেরা মালামাল নিয়ে অপেক্ষমান একটি গাড়িতে তুলে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে ঠিক এমন সময় বাসার ছাদ থেকে একটা চিকন হাত এঁকে বেঁকে লম্বা হয়ে ডাকাতের গাড়িটা পেঁচিয়ে ধরল। তারপর গাড়িটা সামনের দিকে না গিয়ে দ্রুত পেছনের দিকে আসতে শুরু করেছে। আসতে আসতে গাড়িটা সেই বাড়ির ভেতরে চলে এল এবং পটাপট গেট বন্ধ হয়ে গেল। ডাকাতেরা গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে ভূতের চিকন হাতটা তাদের সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে আছাড় মেরে বারান্দায় বসিয়ে রাখে।
ডাকাতেরা হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িওয়ালাকে ডেকে বলছে, চাচাজান, আপনার মালামাল সব নিয়ে যান, আমরা আর বাঁচিনে, মহাবিপদে পড়ে গেছি। উহ্ আহ্ মরে গেলাম রে।
বাড়িওয়ালা তার স্ত্রীকে নিয়ে জানালার ডালা খুলে ডাকাতদের দূরবস্থা দেখে আনন্দে খাটের ওপর ব্যঙের মত লাফালাফি করতে লাগল।
বাড়িওয়ালার ফোন পেয়ে পুলিশ এসে ডাকাতদের পাকড়াও করে থানায় নিয়ে গেল।
তিনি এক দৌড়ে ছাদে চলে গেলেন এবং আঁতিপাঁতি করে খুঁজছেন পাহাড়াদারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। কিন্তু ছাদে কাউকে দেখা গেল না। ছাদের কোনে একটা বিড়াল দেখতে পেলেন। তিনি বিড়ালটাকে খাবলে ধরে কী যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু বিড়ালটা ফ্যাঁচ করে একটা ভেংচি মেরে চলে গেল নিচে। তিনি রাগ করলেন না, একটা হাসি দিয়ে বাসায় চলে গেলেন।
বাড়িওয়ালা পাহারাদারের রহস্যময় ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় এতই খুশি ও সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তিনি কীভাবে এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাড়িওয়ালা খুশিতে টগবগিয়ে স্ত্রীসহ গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলেন সেরালির কাছে। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, পোলট্রি মালিক চাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়ার আনন্দে দশ বারোটা তাগড়া মোরগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে সেরালির প্রশংসা করছে।
বাড়িওয়ালা ব্যাগ থেকে এক তোড়া টাকা বের করে দৌড়ে গিয়ে সেরালিকে ঝাপটে ধরে অন্ধভাবে কোলাকোলি করতে লাগলেন। তারপর পোলট্রি মালিকের মুখে ‘মুরগিচোর’ জব্দ করার আজব কাহিনী শুনে তারা হাসি-কাশিতে ধণুকের মত বাঁকা হয়ে গেলেন।
সেরালির সুনাম-সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের ধনী ব্যক্তিরা এসে ভিড় করছে সেরালির বাড়িতে। এরা চড়া মূল্যে ভাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে ভূত। এ ভূতেরা প্রতিদিন জন্ম দিয়ে চলেছে অসংখ্য রহস্যময় আজব ঘটনার।