মুক্তজীবিকা, বা ফ্রিল্যান্সিং এখন একটি পরিচিত শব্দ। কিন্তু মাঝে মাঝে এই পরিচিতিটা ভালোর চেয়ে খারাপ করে বেশি, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ফ্রিল্যান্সিং বলতেই অনেকে বোঝে কম্পিউটারের সামনে বসে দুইদিনে বড়লোক হবার অলীক স্বপ্নে 'টাল' হয়ে থাকা। ব্যাপারটা আসলে তা নয়। মুক্তজীবিকা বা ফ্রিল্যান্সিং এর ধারনা নতুন নয়। যখন থেকে পৃথিবীতে ব্যাবসা বাণিজ্য শুরু হয়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে, তখন থেকেই আসলে এই ফ্রিল্যান্সিং এর উৎপত্তি। ব্যাবসায়ীরা যখন দেখে সামান্য কিছু কাজ না করলেই নয়, আবার এর জন্য বড় বেতন দিয়ে আবার কর্মচারী রাখাও বিলাসিতা হয়ে যায়, তখন থেকেই আসলে ফ্রিল্যান্সের শুরু। একজন ব্যাক্তি কিছু টাকার বিনিময়ে ওই ছোটখাট কাজগুলো করে দেয়, ফলে নতুন করে কর্মচারীও রাখতে হল না, আবার কাজগুলোও করা হয়ে গেল। এরপরে আস্তে আস্তে কাজের পরিধি বাড়তে লাগলো, সেইসঙ্গে বাড়তে লাগলো মুক্তজীবিকা আর মুক্তজীবির চাহিদা। মুক্তজীবিকার আসলে রূপ অনেক, তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হলেও তাদের কাজ একই, নির্দিষ্ট কিছু সময়ের মধ্যে কিছু কাজ করে দিয়ে পাওনা বুঝে নিয়ে নিজের পথ দেখা, এবং এই চক্রের পুনরাবৃত্তি। স্কুলের কোন শিক্ষক ছুটিতে গেলে কিছু সময়ের জন্য যে শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেও একজন মুক্তজীবি, যদিও তাকে ডাকা হয় 'সাবস্টিটিউট' বলে। পত্রিকার নিয়মিত চিত্রগ্রাহক ব্যাস্ত থাকলে কয়দিনের জন্য যাকে কাজে নেওয়া হয় সে হচ্ছে 'ফ্রিল্যান্সার ফটোগ্রাফার', আর পত্রিকার যারা নিয়মিত লেখা ছাড়া বিশেষ পাতায় লেখে, তাদের কথা তো বলাই হল না, তারা হচ্ছেন 'প্রদায়ক'। নাম ভিন্ন হলেও কাজ তাদের একই।
তো যাই হোক, এই অনলাইনের যুগে সবকিছুই যেহেতু অনলাইনে, ফ্রিল্যান্সিং দোষ করলো কোথায়? সুতরাং এরও আগমন অনলাইনের জগতে এবং এসেই বাজিমাত। তার কারণ এই অনলাইন জগত হচ্ছে বিশাল এই পৃথিবীর এক আয়নাস্বরূপ। আগে একটা কাজ করাতে হলে নিজের এলাকার বড়জোর নিজের শহরের লোক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। কিন্তু এখন সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষকে পরখ করে দেখার। এবং বলাই বাহুল্য, কাজের মানটাও হচ্ছে সেরকম উচ্চমানের, কারণ এখানে প্রতিযোগিতা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সুতরাং অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং এর চাহিদা বাড়লো, সেইসঙ্গে বাড়লো প্রতিযোগিতাও। এরই মধ্যে বাংলাদেশে গুটি গুটি পায়ে শুরু হল মুক্তজীবিকা, এবং কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও ক্রমেই এর ক্ষেত্রটি বিস্তৃত হচ্ছে।
যাই হোক, ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কথা বললে কথা শুধু বাড়বেই। ওইদিকে আর যাচ্ছি না। আমার কথা হচ্ছে এখন বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং বললেই বোঝা হয় ওডেস্কে, বা নতুন পরিচিতি পাওয়া ইল্যান্সে একখানা একাউন্ট খুলে বিডের পর বিড করে যাওয়া, আর আশায় থাকা কবে কার দয়া হবে, একটা কাজ পাবো, আর কিছু উপার্জন করতে পারবো। অনেকেই বলে ধরাবাঁধা চাকরির চেয়ে এইসব 'ওডেস্ক' ফ্রিল্যান্সিং অনেক স্বাধীনতার, সত্যি কি তাই? আমার তো মনে হয় এসব বিড পদ্ধতির মুক্তজীবিকার তুলনায় ধরাবাঁধা চাকরি আরো আরামের। কারণ ধরাবাঁধা চাকরিতে খুব বেশি অনিয়ম না করলে মাসশেষে বেতনটা ঠিকই পাওয়া যায়, তারওপরে আছে সাপ্তাহিক ছুটি, বিশেষ বিশেষ দিনে ছুটি, আর বোনাস ভাতার কথা তো বলাই হল না। কিন্তু অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং এ তো এসব কিছুই নেই। ছুটি নেই কোন অজুহাত নেই নেই নিয়মিত বেতন ভাতার নিশ্চয়তা, এখানে আপনাকে কাজ করতে হবে রাতদিন, তারপরও ভালো উপার্জনের আশা কম।
আপনি একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ,এবং আপনি এসব নিয়মকানুনের চক্করের মধ্যে নেই। তাহলে কি মুক্তজীবিকার আশা শেষ? আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে? নাহে বৎস, দুনিয়ার রূপ তো আরো অনেক দেখা বাকি হে বন্ধু।
এবার আমার কথা কিছু বলি। আমিও একজন স্বাধীনচেতা মানুষ, বলাই বাহুল্য। আমার ইচ্ছা হচ্ছে নিজের কাজের নমুনা দিয়ে একটা চকচকে সুন্দর সাইট খুলবো, এবং কোন মার্কেটপ্লেসে নিজের কাজ বিশেষ করে গ্রাফিক্স ডিজাইন, সৃজনশীল কাজ বিক্রি করবো। তাহলে কোন বিড করার দরকার নেই, কোন কাজের চাপ নেই। যাদের পছন্দ হবে, তারা এসে কিনে নিয়ে যাবে, আর আমারও উপার্জন হবে, সোজা হিসাব। কিভাবে করবো, সেটা বলার জন্যই এত বড় ভূমিকা। গৌরচন্দ্রিকা শেষ, এবার আসল কথা।
বি. দ্র. : লিঙ্ক খুজে খুজে হয়রান হবেন না। আমি এখানে কোন লিঙ্ক দেইনি। ছবিগুলোই একেকটি লিঙ্ক। সামুতে সাধারণভাবে এই কাজটা করা যায় না। ছোট্ট একটা কৌশলে এটা করা হয়েছে। এ বিষয়ে নাহয় অন্য কোনদিন, অন্য কোন সময়ে আলোচনা করা যাবে।
১. গ্রাফিকরিভার
গ্রাফিক্স বেচাকেনার সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস। যদি ফটোশপ এবং ইলাস্ট্রেটরে দক্ষ হন, দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিক্স সৃষ্টি করতে পারেন, স্বাগতম আপনাকে গ্রাফিকরিভারের দুনিয়ায়। এখানে আপনি বিক্রি করতে পারেন লোগো টেমপ্লেট, পোস্টার ফ্লায়ার লিফলেট ডিজাইন, বিজনেস কার্ড ডিজাইন, আইকন সেট এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। সম্ভাবনা অনেক, তবে শর্ত আছে। আপনার কাজ যেমন মানসম্পন্ন হতে হবে, তেমনিভাবে আকর্ষণীয়ভাবে প্রদর্শনের ক্ষমতাও থাকতে হবে। নাহলে খালিহাতে ফেরার সম্ভাবনাই বেশি।
হয়তো মনে হচ্ছে এসব 'সামান্য' জিনিসপত্র কিনবে কে? কে কিনবে কেন কিনবে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দেখা যাক এই গ্রাফিকরিভার জগতের কিছু হালহকিকত...
২. থিমফরেস্ট
থিম বেচাকেনার সাইট। গ্রাফিকরিভার এবং থিমফরেস্ট সহ আরো বেশ কয়েকটি মার্কেটপ্লেস এবং টিউটোরিয়াল সাইট এনভাটো নামের একটি সৃজনশীল মুক্তিজীবি প্রতিষ্ঠানের অংশ। এই থিমফরেস্টে আছে শত রকমের নানান ধরনের থিম। ওয়ার্ডপ্রেস, জেকোয়েরি, সিএসএস, পিএসডি ডিজাইন, এইচটিএমএল এবং আরো অনেক ধরনের ওয়েবসাইট থিম। যদি ওয়েব ডেভেলোপিং সম্পর্কে দক্ষ হয়ে থাকেন তাহলে থিমফরেস্ট হতে পারে আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
সেইসঙ্গে দেখে নিন কিছু উদাহারণ এবং বিচার করুন মানদণ্ড...
৩. কোডক্যানিয়ন
এনভাটোর আরেকটি দুর্দান্ত মার্কেটপ্লেস। ওয়েবসাইটের নানা ধরনের প্লাগিন, এড অন, ইমেজ স্লাইডশো প্লাগিন অর্থাৎ একটি ওয়েবসাইট সাজাতে যতরকমের জিনিসপত্র লাগে তার বিশাল সমাহার। ওয়েব ডেভেলোপিং এবং সিএসএস, এইচটিএমএল, জাভায় দক্ষ হলে মাসশেষে বিশাল অঙ্কের উপার্জন করতে পারেন সামান্য পরিশ্রমেই।
আর এখান থেকে কিছু অনুপ্রেরণা নিয়ে নিন...
৪. একটিভডেন
ফ্ল্যাশ ফাইলের স্বর্গরাজ্য, অর্থাৎ এডোবি ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে তৈরি করা নানান ধরনের এনিমেশন, গেম এবং আকর্ষণীয় কন্টেন্টের অপূর্ব সমাহার। যদি এনিমেশন করতে এবং এডোবি ফ্ল্যাশ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন, এই মার্কেটপ্লেসটি আপনারই জন্য।
কিছু অনুপ্রেরণা...
৫. অডিওজাঙ্গল
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এখানে শব্দ এবং সুরের সমাহার। এনভাটোর সৃষ্টি আরেকটি অসাধারণ মারকেটপ্লেস। যদি সুর ভালোবাসেন, মানসম্পন্ন সুর এবং সঙ্গিত সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে আপনার সৃষ্টিগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়িত হতে পারে এখানে। এখানে আপনি পাবেন সুর, শব্দ, মিউজিক লুপ, অডিও প্যাকের অসাধারণ এক সমাহার, যা আপনার মনকে ভরিয়ে দিতে যথেষ্ট।
একই সঙ্গে দেখে নিন এখানকার মানুষেরা কি সৃষ্টি করছে...
Click This Link target='_blank' >
৬. ভিডিওহাইভ
আফটার এফেক্টস এর মারকেটপ্লেস। আফটার এফেক্টস দিয়ে তৈরি নানান ধরনের ভিডিও এবং ভিডিও প্রিসেট বিক্রি হয় এখানে। আফটার এফেক্টসে দক্ষ হলে আপনার নিজস্ব জগত হতে পারে এই ভিডিওহাইভ।
আর কিছু অনুপ্রেরণা তো থাকছেই...
৮. টার্বোস্কুইড
সবচেয়ে বড় অনলাইন থ্রিডি মার্কেটপ্লেস। ১ লক্ষের ওপর থ্রিডি মডেল এবং পিক্সার, রকস্টার, নিউইয়র্ক টাইমস, জিঙ্গা এর মত কিছু স্থায়ী আস্থাভাজন ক্রেতা। যদি থ্রিডি আপনার দক্ষতার জায়গা হয়, আপনার উপার্জনের উৎস হতে পারে এই টার্বোস্কুইড।
নিয়ে নিন কিছু অনুপ্রেরণা...
৯. থ্রিডি এক্সপোর্ট
আরেকটি বিশাল থ্রিডি মার্কেটপ্লেস। ৫০ হাজারের কাছাকাছি থ্রিডি মডেল এবং অসংখ্য আস্থাভাজন ক্রেতা। হতে পারে আপনার আয়ের বিশাল একটি উৎস, যদি আপনার মেধা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারেন।
কিছু অনুপ্রেরণা...
১০. থ্রিডিওশেন
এনভাটোর তৈরি থ্রিডি মার্কেটপ্লেস। যদিও তেমন সমৃদ্ধ নয়, মাত্র ১০ হাজারের মত থ্রিডি মডেল এবং অন্যান্য। মজার বিষয় হচ্ছে সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া প্রথম চারটি জিনিস কোন থ্রিডি মডেল নয়! এইচডিআর ইমেজ এবং টেক্সচার আছে সর্বাধিক বিক্রিত তালিকার প্রথম চারে। তারপরও মানের দিক দিয়ে কোন কমতি নেই এখানে। যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে আপনারও আয়ের উৎস হতে পারে থ্রিডিওশেন।
কিছু অনুপ্রেরণা...
১১. ফটোডিউন
এনভাটোর নতুন সংযোজন স্টক ফটোগ্রাফি মার্কেটপ্লেস, ফটোডিউন। যদিও অন্যান্য বাঘা বাঘা স্টক ফটোগ্রাফি সাইট যেমন আইস্টকফটো, শাটারস্টক, ডেপোসিটফটো ইত্যাদি সাইটের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে, তারপরও এটির সুবিধা হচ্ছে সহজবোধ্যতা এবং বিশেষ করে বাংলাদেশীদের জন্য টাকা তোলার সুবিধা। এনভাটোর সমস্ত মার্কেটপ্লেস থেকেই আপনি এক ক্লিকে টাকা তুলতে পারবেন মানিবুকারস বা পেয়োনার ডেবিট মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে। আর অন্যান্য স্টক ফটোগ্রাফি সাইটে আপনি ছবি যুক্ত করতে অনেকক্ষণ ঘুরতে হবে, সে তুলনায় এই সাইটে তা অনেক সহজ। একটি কুইজের উত্তর দিন, আপনার তোলা কিছু ছবির নমুনা দিন, যদি মানসম্পন্ন হয়, তাহলে আপনি ফটোডিউনে ছবি যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত। আপনার ডিএসএলআর এ তোলা ঝকঝকে স্পস্ট ছবি যুক্ত করতে থাকুন, প্রসঙ্গত ডিএসএলআর ক্যামেরা-ই দরকার হবে। কারণ স্টক ফটোগ্রাফির জগতে ছবির আভ্যন্তরীণ শিল্পমানের চেয়ে বাইরের চাকচিক্যই গুরুত্ব পায় বেশি। ছবি যদি সত্যিকারের মানসম্পন্ন হয়, তাহলে আপনার উপার্জন নিশ্চিত। সমস্যা একটাই, এখানে এত এত মানসম্পন্ন ছবি, খুব মানসম্পন্ন ছবিটিও হয়তো বিক্রি হবে না। সেইজন্য সমাধান হচ্ছে প্রচুর ছবি যুক্ত করা। এতে আপনার পরিচিতি বাড়বে, সেইসঙ্গে আপনার আয়ও বাড়বে।
এবার দেখে নিন কিছু উদাহারণ অন্যেরা কি করছে এখানে...
আজ এ পর্যন্তই। আশা করি আপনার আত্মনির্ভরশীল জীবনের স্বপ্নে আবার হাওয়া লেগেছে, এবং আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণ যে আপনিও পারবেন। এই লেখা থেকে যদি আপনাদের উপকার হয় তবেই আমার কষ্ট সার্থক। শুভকামনা সবাইকে।