
আমাদের হাতিরঝিল

প্রথম ছবিটা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া হান নদীর। কোরিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই নদীটি একসময় খুবই দূষিত হয়ে পড়েছিল। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর এখন যা দশা, অনেকটা সে রকম। সেই নদীটি এখন দূষণমুক্ত। মৃতপ্রায় নদীটিকে কোরিয়া সরকার আবার সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ (২০১০ সালে) দক্ষিণ কোরিয়া সফরে এসে এই হান নদীতে এক সন্ধ্যা কাটিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সফর, অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছিল প্রধানমন্ত্রীর সারা দিন। এরপর ঘণ্টা খানেকের এ ধরনের নৌবিহার নিশ্চয়ই অনেক স্বস্তির ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে তা উপভোগ করেছিলেন। নৌবিহারে সিউল মেট্রোপলিটন সরকারের মেয়র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। একসময়ের দূষিত এই নদীর পানি কীভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে, কীভাবে নদীটিকে আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন মেয়র। এ সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি চুক্তি ও দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নদীর পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য।
হান নদীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই নৌবিহার আলাদা গুরুত্ব বহন করে এবং আমাদের দেশের জন্য শিক্ষণীয়ও বটে। বর্তমানে আমাদের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর চারপাশ বেষ্টনকারী নদী চারটির অবস্থাও এক সময়ের দঃ কোরিয়ার হান নদীর ন্যায়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের পানি এখনও জীবনধারণের অনুপযোগী। পরিবেশ অধিদফতরের সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে তা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে থাকার উপযোগী মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে। কঠিন বর্জ্যের পাশাপাশি এ নদীর পানিতে তরল বর্জ্য ব্যাপক হারে মেশার ফলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দখল ও দূষণকারীদের প্রভাব, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর জনবল সংকট, সমন্বয়ের অভাব, দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা না থাকা এবং কার্যকর নাগরিক আন্দোলন না থাকায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী সুরক্ষার উদ্যোগ কাগজে-কলমেই থেমে থাকছে। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে ঢাকা মহানগরীর চারপাশ বেষ্টনকারী নদী চারটির প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে হাতিরঝিল প্রকল্প (দ্বিতীয় ছবিটা)। বছর কয়েক আগেও হাতিরঝিল ছিল রীতিমতো নর্দমা, পচা পানির আধার। হাতিরঝিল নাম নিলেই নাকে কেমন যেন দুর্গন্ধ লাগত। ময়লা-পচা পানির ডোবা ছিল এই ঝিলটি। ঝিলের চার ধার ঘিরে গড়ে ওঠা বস্তি। মহানগরীর জঞ্জাল ছিল দীর্ঘকাল হাতিরঝিল বেগুনবাড়ী খালটি। ‘হাতিরঝিল বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন মানববন্ধনও করেছিল। বর্তমানে এর বুকে বইছে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ।
বাংলাদেশে কোনো উন্নয়নকাজ করা, বিশেষ করে ঢাকা শহরে উন্নয়নকাজ করা অনেক কঠিন। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য কম, সেটাই একমাত্র বাধা নয়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় উন্নয়নকাজ করতে হলে প্রথমেই যে কাজটা করতে হয়, মানুষের জায়গা অধিগ্রহণ করতে হয়, আর তাতে ক্ষতিপূরণের অঙ্কটাই হয়ে দাঁড়ায় মূল প্রকল্পের খরচের চেয়ে বেশি। হাতিরঝিলেও তা করতে হয়েছে। তিন-চার শ বছর ধরে হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ির বর্জ্যস্তূপের ভিতরে আড়ালে ঢাকা পড়েছিল যে-ঢাকা, সেই ঢাকা আজ কী অপরূপ রূপের আলোতেই না উদ্ভাসিত হলো, উন্মোচিত হলো, আবিষ্কৃত হলো। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে কাজী নজরুল ইসলাম রোড থেকে রামপুরা ব্রীজ পর্যন্ত এর বিস্তার । দুইশত নিরানব্বই একর জলাভূমি ও বেদখলকৃত জমি দখল মুক্ত করে বাস্তবায়িত হয়েছে প্রকল্পটি । ঢাকা নগরীর অন্যান্য খাস ও বিভিন্ন সংস্থার পতিত জমির মত হয়ত বিশালাকার বস্তিই হয়ে উঠত এটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে বিশাল জমি রক্ষা পেয়েছে বেদখল ও অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে।
হাতিরঝিল প্রকল্পটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি লেক। তার পাশ ঘেষেই যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার সড়ক, চারটি সেতু, আরো চারটি ক্ষুদ্র সেতু (ভায়াডাক্ট)। রয়েছে চলাচলের জন্য চারটি ওভারপাস। বিনোদনের জন্য লেকে নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, ছোট পরিসরে পিকনিক স্পটসহ বেশকিছু সুবিধা রয়েছে। প্রকল্পটির পূর্ব অংশের রামপুরা, বাড্ডা থেকে সহজেই শহরের কেন্দ্রস্থল কারওয়ান বাজারে পৌঁছানো যাবে। এতোদিন রামপুরা, বাড্ডা থেকে কারওয়ানবাজার পৌঁছাতে সময় লাগতো এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এখন ১০ মিনিটেই আসা যাবে। হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায়, লেকের পানি টলমল করছে, রাস্তা চলে যাচ্ছে বাধাহীন, কোথাও কোনো রাস্তা আরেকটা রাস্তাকে ক্রস করছে না, ফ্লাইওভার উঠে গেছে রাস্তার ওপরে, কোনটা যে কোন দিকে যাচ্ছে, সাইন না পড়তে জানলে সে এক বিপদ। কেউ হয়তো পথ হারিয়ে মগবাজার যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন বাড্ডায়। রঙিন বাতি দেওয়া হয়েছে সেতুর রেলিংয়ে, পথের দুধারে ফুলের বাগান। আহ্, এই তো আমার ঢাকা শহর! বুক গর্বে ভরে যায়, মাথা উঁচু হয়ে আসে। প্রকল্পটি চালু হওয়ায় যানজট যেমন কমবে তেমনি নগরবাসীর বিনোদনের জন্য নতুন কেন্দ্র তৈরি হবে। যেমনটি হয়েছে হান নদীর দু'পাশ। সাপ্তহিক ছুটির দিনে থাকে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। অধিকাংশ দর্শনার্থীই তাদের প্রিয় মানুষদেরকে নিয়ে রাত্রিযাপন করে নদীর তীরেই! পুরো সপ্তাহ ব্যাপী যান্ত্রিক জীবনের কর্মমাঝে মুক্ত বাতাসে একটু সতেজতা পাওয়ার আশায়।
হান নদীর আরো কিছু ছবি..





পাশাপাশি হাতিরঝিলের..



সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:১৩