গতকাল থেকে ঢাকার আগারগাঁওস্থ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হয়েছে তিনদিনব্যাপী ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২। এই আয়োজন নিয়ে অনেকদিন থেকেই চলছিল ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রচারণা। এই মেলার দ্বিতীয় দিন গিয়ে দেখা গেল সত্যই অনেক উৎসাহী মানুষ ভিড় জমিয়েছেন মেলা প্রাঙ্গণে।
মেলার দ্বিতীয় দিনেও বিভিন্ন সেমিনার আয়োজিত হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ওডেস্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকমসহ বিভিন্ন ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে কর্মরত ফ্রিল্যান্সাররা জমজমাট এই কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন।
মেলার মূল প্রাঙ্গণে কয়েকটি স্টলের পাশাপাশি দু’টি অস্থায়ী হলের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটিতে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সব স্টল এবং অন্যটিতে রয়েছে দেশের আইটি খাতে অবদান রাখছে এমন সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্টল।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্টলে রয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে ঢোকার সুবিধা, বিভিন্ন কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্রশিউর, সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার মডেল বা অ্যানিমেশন ইত্যাদি। নির্বাচন কমিশনের স্টলে রয়েছে ই-ভোটিং-এ ব্যবহৃত নতুন ব্যালট মেশিন। আগামী সংসদ নির্বাচনে এই ই-ভোটিং চালু হলে ভোটাররা নতুন এই মেশিনের মাধ্যমেই ভোট দেবেন। তার আগে ভোটারদের এই মেশিনের মাধ্যমে কীভাবে ভোট দিতে হয় তা জানাতে এবং প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা দিতেই এই স্টলে এসব মেশিন রাখা হয়েছে। যদিও এখনও ভোটার হইনি তবুও নতুন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে কেমন লাগবে তার কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা পেলাম নির্বাচন কমিশনের স্টল থেকে।
এছাড়াও রয়েছে সেতু বিভাগ, সড়ক বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, পাওয়ার ডিভিশন, শিপিং বোর্ডসহ সরকারের প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা স্টল। এসব স্টল থেকে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম কীভাবে প্রযুক্তি নির্ভর করে তোলা হচ্ছে ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে এসব কাজ ত্বরান্বিত করা হচ্ছে তার কিছুটা ধারণা পেলাম। চলমান ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হলেও শব্দের কারণে তা খুব একটা বোঝা যায়নি।
সরকারের আরও বিভিন্ন কাজ অনলাইন-ভিত্তিক করে তোলা হয়েছে। যেমন ইন্টারনেটের মাধ্যমে রাজস্ব বা আয়কর প্রদান ইত্যাদি। রাজস্ব বোর্ডের স্টলে রয়েছে কীভাবে অনলাইনে রাজস্ব ও আয়কর দেয়া যায় তার নির্দেশিকা। দর্শনার্থীরা মুদ্রিত নির্দেশিকার পাশাপাশি হাতে-কলমে দেখে নিতে পারছেন কীভাবে কী করতে হবে। কাজেই, প্রযুক্তি বিষয়ে খুব একটা পারদর্শী না হলেও কীভাবে একজন আয়কর, মূসক বা ভ্যাট ও রাজস্ব দিতে পারবেন তা হাতে-কলমে শেখার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে এই স্টলে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্টলে রয়েছে সরকারী উদ্যোগে বাজারজাতকৃত ল্যাপটপ দোয়েলের প্রদর্শনী। এখানে ব্যবহারকারীরা ছোট থেকে বড় আকারের বিভিন্ন কনফিগারেশন ও দামের দোয়েল ল্যাপটপ ব্যবহার করে দেখার সুবিধা পাচ্ছেন। সবচেয়ে দামী ৪৮ হাজার টাকার দোয়েলে রয়েছে কোর আই-থ্রি প্রসেসর ও ১৪ ইঞ্চি ডিসপ্লে। অন্যান্য স্টলের তুলনায় তাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্টলের সামনে দেখা গেছে উৎসুক মানুষের সবচেয়ে বেশি ভিড়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্টলের পাশাপাশি মেলায় শোভা পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাব অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর আলাদা দু’টি স্টল। এসব স্টলে স্ক্রিনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাবের বিভিন্ন কার্যক্রম, অর্জন ও তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তির প্রদর্শনী চলছে। মেলার বিভিন্ন স্থানে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে কীভাবে পুরো মেলা প্রাঙ্গণের উপর নজর রাখা হচ্ছে তাও দেখা যাচ্ছে র্যা বের স্টল থেকে। এছাড়াও এই দুই বাহিনীর স্টলেই সদস্যদের কাছ থেকে উৎসুক দর্শনার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তর করতে দেখা গেছে। মেলায় আসা অনেকেই বলছেন, মন্ত্রণালয় থেকে র্যা ব-পুলিশ পর্যন্ত সব স্টলেই বিভিন্ন বিষয়ে জানা যাচ্ছে। স্টলে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকেই বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পেয়ে আমাকে মুগ্ধ হতে হয়েছে।
মেলার অন্যপাশে রয়েছে বেসরকারী উদ্যোগের বিভিন্ন স্টল। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে দেশে ই-কমার্সকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও অনলাইন কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে তার প্রদর্শনী চলছে। মেলায় আসা দর্শনার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, কীভাবে তারা লাভবান হতে পারেন ও কীভাবে তা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ ও গতিময় করে তুলতে পারে সে সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করার সুযোগ পাচ্ছেন। দেখে বেশ ভালো লাগলো যে আমরাও ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের মতোই অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারবো ও অন্যান্য সেবা-সুযোগ উপভোগ করতে পারবো।
বর্তমান সরকার ২০২১ নাগাদ দেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরের এক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছে। এই লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই শুরু করেছে তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তর ব্যবহার। সেই সঙ্গে বাংলাদেশেও ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছে ও রেকর্ড পরিমান মানুষ ইন্টারনেটের অসীম সম্ভাবনাময় দুনিয়ায় প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ৬৪ জেলার আলাদা আলাদা ওয়েবসাইট, সরকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মানুষকে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রদান যেমন পাসপোর্টের জন্য আবেদন, আয়কর প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যেই সফলতার মুখ দেখেছে। অনেকের মনে হতে পারে এসব জেলার ওয়েবসাইট তেমন কাজের না। কিন্তু আমি নিজেই নতুন কোনো জেলায় গেলে তার আগে এসব সাইট থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে ও যেসব পরিকল্পনা শিগগিরই বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে, তার প্রায় সবকিছুরই প্রদর্শনী চলছে এবারের ডিজিটাল মেলায়। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২ মেলা প্রাঙ্গণ একবার ঘুরলে দর্শনার্থী দেশের আইসিটি খাতে সরকারের কার্যক্রম দেখতে পাবেন না; বরং সরকার কীভাবে আইসিটি খাত কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যতিক্রমী সব কাজকে ত্বরান্বিত, উন্নত ও আধুনিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করছে ও কীভাবে আইসিটির ব্যবহার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে চালু করার মাধ্যমে উন্নত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাই দেখতে পাবেন।
কাজেই, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখনও গড়ে না উঠলেও ২০২১-এর আগেই যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে, সেই ধারণাই প্রবল হবে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২ এর সরকারি ও বেসরকারি স্টলগুলো ঘুরলে। মেলা আগামীকাল শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। মেলায় প্রবেশের জন্য কোনো টিকিটের প্রয়োজন নেই।
তাই হাতে সময় থাকলে চলে আসুন ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২ মেলায়। দেখে নিন ভবিষ্যতের বাংলাদেশের এক ঝলক।