অথৈ পর্ব ১
প্রথম প্রকাশ
মধ্যরাত।
এরকম অভিজ্ঞতা মাসুদ আর কখনো পায়নি। সে দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি নিতান্ত কম করেনি। বাংলাদেশের মুড়ির টিন থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার বড় বড় ক্রুজ শিপ কিংবা সাবওয়েতে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে মাসুদের। কিন্তু বাংলাদেশের লঞ্চ জার্নির এই অদ্ভূত ও অদ্বিতীয় অনুভূতি সে এই প্রথম পাচ্ছে।
ঠিক মধ্যরাতের চেয়েও গভীর হওয়ার পরও পুরো লঞ্চজুড়ে মানুষের কোলাহলের কমতি নেই। আবার লঞ্চের সব জায়গার পরিবেশ একরকম নয়। নিচতলায় গেলে দেখা যায় মেঝেতে পাটি বিছানো মানুষগুলো সবাই যার যার মতো কথা বলছে। কেউ পান চিবুচ্ছে। কেউ শুয়ে শুয়ে গল্প করছে। কেউ তাস খেলছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যেই অল্প ক'জন ঘুমোচ্ছে, তাদের কেউ শুয়ে নেই। বস্তার উপর মাথা রেখেই তারা ঘুম দিয়েছে। আর উপরের টেলিভিশনে চলমান চলচ্চিত্রের উচ্চ শব্দ তো আছেই।
দ্বোতলা আর তিন তলার দৃশ্য আবার ভিন্ন। করিডোর ধরে হেঁটে গেলে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সবাই যার যার কেবিনে। কেবল লঞ্চের ইঞ্জিনের একটানা গোঁ ধরে থাকা শব্দ। করিডরের নিভু নিভু বাতি। একটু এগোলেই দেখা যায় দু-একটা বাতি ফিউজ হয়ে আছে। সামনের অংশে গেলে চেয়ার কোচ। সেখানেও চলছে একই বাংলা ছবি। এখানে কারো কোনো কথাবার্তার আওয়াজ নেই। কেউ ছবি দেখছে বলেও মনে হচ্ছে না। মধ্যম ভাড়ার বিনিময়ে মানুষগুলো আরামদায়ক সিটে আরাম করেই ঘুমুচ্ছে।
মাসুদের ঘুম আসছে না। সে কয়েকবার ঘুমোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে এবার বেরিয়েছে লঞ্চ পরিদর্শনে। পরিদর্শনটা বেশ তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। কেবিনের ভেতর প্রচুর মশা। একটা কয়েল কিনে রাখা উচিৎ ছিল। কেনা হয়নি যেহেতু, এখন আর আফসোস করে লাভ নেই। এমনি হাঁটছে এমন একটা ভাব করলেও আসলে মাসুদ মনে মনে অথৈকে খুঁজছে। যদিও মেয়েদের প্রতি তার তেমন কোনো দুর্বলতা নেই। প্রচুর মেয়ের সঙ্গে মাসুদের অহরহ যোগাযোগ হচ্ছে। সে যেখানে কাজ করে সেখানেও মেয়ের অভাব নেই। কিন্তু অথৈকে তার অন্যরকম লাগলো। কেমন যেন রহস্যজনক। এইভাবে অচেনা কারো সঙ্গে প্রথমেই এতোটা ফ্রি মাইন্ডে কথা বলতে আর কোনো বাঙালি মেয়েকে দেখেনি সে।
'আমাকে খোঁজা হচ্ছে?'
চমকে পেছন দিকে তাকালো মাসুদ। অথৈ এর কণ্ঠের মতোই লাগলো। কিন্তু কই, কেউ তো নেই। ডান-বামে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলো না।
'এই যে মিস্টার। উপরের দিকে তাকান। আপনার উপরেও কেউ থাকতে পারে!'
উপরে তাকিয়ে অথৈকে দেখতে পেলো মাসুদ। তার খোঁচাটা বুঝলেও কিছু বললো না। উপরের তলার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। রেলিং দু'টো সমান সমান। তাই উপরের তলা থেকে নিচের তলার বারান্দায় কে হাঁটছে তা বোঝার কথা না। হাঁটার শব্দ শুনেই হয়তো আগ বাড়িয়ে তাকিয়ে তাকে দেখেছে অথৈ।
'উপরে আসুন।'
সিঁড়ি কাছেই ছিল। বেয়ে উপরে উঠলো মাসুদ।
'ঘুম আসছিল না?'
'নাহ। আপনার?'
'সেইম কেইস।'
'এতো রাতে ঘুরাঘুরি করছেন যে? একা লঞ্চে, ভয় লাগছে না?'
হাসলো অথৈ, 'ভয়, আর আমি? ঐ দু'টো একসঙ্গে যায় না কখনও।' অথৈ-এর হাসিটা একটু অদ্ভূত লাগলো মাসুদের। সে ভাবতে শুরু করলো, অথৈকে কি সে চেনে?
'তাই নাকি? মেয়েরা কিন্তু সাধারণত একটু ভীতুই হয়। অনেকে লাজুকও হয়। তবে ইদানীং সেটা কমে আসছে।'
'হুম। কিন্তু মেয়েরা কিন্তু ভীষণ একরোখা হয়, সেটা জানেন?'
'তাই নাকি? কী রকম সেটা?'
'তারা যেটা করবে বলে ঠিক করে, সেটা করেই ছাড়ে। এ জন্য যত কষ্টই করতে হোক না কেন, সে করবেই।'
'তা অবশ্য ঠিক। ভীষণ জেদি।'
'হুম।'
ঠাণ্ডা বাতাসে অথৈ-এর চুল বারবার সামনে এসে পড়ছে। অথৈ বারবারই হাত দিয়ে চুল পেছনে সরাচ্ছে। সামনে বলতে মাসুদ আর অথৈ-এর মাঝে। মাসুদ মনে মনে ভাবলো, মাসুদ না থাকলে বোধহয় চুল সরানোর ঝামেলা পোহাতে হতো না মেয়েটাকে।
অনেকক্ষণ নীরবতা। মাসুদ সাধারণত কথায় কখনো আটকায় না। কিন্তু আজ যে তার কী হলো! কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটাও কিছু বলছে না। কিন্তু মেয়েটার নড়াচড়ার ভাব দেখে মাসুদের মনে হলো ওর হাতে কিছু একটা আছে। প্রথমে মাসুদ ভাবলো, মোবাইল হবে হয়তো। কিন্তু কোনো আলো না দেখে সন্দেহ হলো। একটু উঁকি দিতে গেল আর ঠিক তখনই অথৈও তার দিকে ফিরলো। আর এতে চুলগুলো আছড়ে পড়লো মাসুদের চেহারায়।
'উপস্, সরি!' কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বললো মাসুদ। কিন্তু অথৈ হাসতে থাকলো। সরাসরি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সন্দেহটা জোরালো হলো মাসুদের। সে কি আগে কখনও অথৈকে দেখেছে? একটু আগেও তো অথৈকে পরিচিত মনে হয়নি। হঠাৎই ওকে কেন যেন আগে কোথাও দেখেছে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে মাসুদের।
'কী দেখছেন?'
'না মানে, মনে হলো আপনাকে আগে কোথায়....', থেমে গেলো মাসুদ, 'নেভার মাইন্ড। কিছু না।'
কিন্তু এতে অথৈ-এর হাসি হাসি ভাবটা যেন আরও প্রসন্ন হলো। 'আগে কোথাও দেখেছেন মনে হচ্ছে, না? ব্যাপার না। আই গেট দ্যাট এ লট।'
নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো মাসুদ। এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছে সে খোঁচা মারা কথা শুনলো। তাও দুই-দুই বার। কিন্তু কিছু বললো না। মেয়েটা সম্পর্কে আগে বুঝতে হবে।
'অপমানিত বোধ করছেন?'
'মানে?' অথৈ-এর দিকে আবারও তাকালো মাসুদ।
'আই মিন, লজ্জিত? অথবা অপ্রস্তুত? যেমনটা আপনি সাধারণত কখনও হননি?'
'না তেমন কিছু না বাট...' থেমে গেল মাসুদ। সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে সে ছেলেদের মতোই আচরণ করে। অন্য কোথাও হলে সে এই জবাবটাই বেশ কড়া করে দিতো। কিন্তু নিজের অজান্তেই মাসুদ "না তেমন কিছু না" বলে ফেলেছে। তাই এখন আর কড়া কথা সাধে না। কী আর করার। বেচারা মাসুদ কথাটা হজম করে নিলো। ভাবতে লাগলো কীভাবে মেয়েটার পেট থেকে কথা বের করা যায়।
'তো আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
'মামার বাড়িতে যাচ্ছি।'
'বেড়াতে নিশ্চয়ই?'
'ঠিক বেড়াতে না। ফেইটকে মেনে নিতে।'
'ফেইট মানে? ভাগ্য?'
'হ্যাঁ।' অথৈ-এর মুখ মলিন হয়ে যাওয়াটা এই হালকা চাঁদের আলোয়ও যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলো মাসুদ।
'আম, কী ব্যাপার আমাকে কি বলা যায়?'
'তেমন কিছু না। বাদ দিন।'
'ঠিক আছে বাদ দিলাম। আপনি পড়াশুনা করছেন নিশ্চয়ই?'
'হুম। অনার্স পড়ছি।'
'কোথায়?'
মাসুদের দিকে তাকিয়ে হাসলো অথৈ। 'হবে কোনো এক জায়গায়।' কিন্তু এই হাসির মাঝে আরেকটা খোঁচা অনুভব করলো মাসুদ। তার মনে পড়লো তার বন্ধুদের কথা। ওরা দিনের পর দিন একটা মেয়ের পেছনে ঘুরতো। সুযোগ পেলেই নম্বর জিজ্ঞেস করতো, ঠিকানা চাইতো, তখন এমনই একটা ভাব নিয়ে ছেলেগুলোকে ফিরিয়ে দিতো। মাসুদের মনে পড়ে, সে কখনও এই 'ভুল' করেনি। তার থিওরি হলো, যত কম আগ্রহ দেখানো যায়, ততোই ভালো। যদি কেউ কাছে আসার থাকে, সে এমনিতেই আসবে। জোর করে আনা যায় না। যদিও ইতিহাস অন্য কথা বলে।
মাসুদ আজ প্রথম এমন একটা ধরা খেলো। হঠাৎই ওর মনে হলো ওর কেটে পড়া উচিৎ। নিজে তো বহুত স্মার্টনেস দেখালো, হয়তো এই মেয়ে তার চেয়ে বেশি স্মার্ট। কিছুটা রহস্যময়ীও বটে। ওর সঙ্গে পেরে ওঠা বোধহয় সম্ভব না।
এমন সময় অথৈ জিজ্ঞেস করলো, 'মেয়েরা রহস্যময়ী। কথাটার সঙ্গে কি আপনি একমত?'
মাসুদ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো, 'মোটেই না। মেয়েরা রহস্যময়ী না। এটা কেবল স্টিফেন হকিং-এর মতো কিছু মেয়েপাগলের কথা।'
'সরি?' বুঝতে না পেরে অবাক হলো অথৈ। এর মধ্যে স্টিফেন হকিং আসলো কোত্থেকে? বেচারা তো কথাও বলতে পারে না।
'স্টিফেন হকিং। সেই পদার্থবিজ্ঞানী। এনবিসি চ্যানেলে একটা সাক্ষাৎকারে তিনি তার কম্পিউটারের মাধ্যমে বলেছেন, তিনি মহাশূন্যের অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলেও নারীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। নারীরা নাকি রহস্যময়ী। বুলশিট!'
'আপনি একমত না কেন?'
অথৈ-এর দিকে তাকালো মাসুদ। 'কারণ, মেয়েদের "রহস্যময়ী" উপাধিটা যেই দিক, এর পুরোট সুযোগটা নিচ্ছে মেয়েরা। যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। আজ কারো জন্য জান-প্রাণ দিয়ে দিচ্ছে, কাল পাত্তাই দিচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলে, ঐ যে, নারীরা রহস্যময়ী। এরকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যায়।'
'তার মানে কি আপনি মেয়েদের দেখতে পারেন না? নারীবিদ্বেষী টাইপ? সবাইকে একরকম মনে করেন?'
'বিদ্বেষী না, তবে আমি মেয়েদের চিনে নিয়েছি।' মাসুদ এর বেশি কিছু না বললেও সে কী বোঝাতে চাচ্ছে তা তাদের দু'জনের কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলো না।
অথৈ বললো, 'তাহলে এতো মেয়ের সাথে ঘুরেন কেন?'
এবার অবাক হবার পালা মাসুদের। সে কাউকে ভালোবাসে না। কিন্তু ডেটিং নামক ঘুরতে যাওয়ায় সে ওস্তাদ। কিন্তু এই কথা অথৈ জানলো কীভাবে? মাসুদের মাথা নষ্টের জোগাড় হলো। শুরু থেকেই মেয়েটার কথাবার্তায় মনে হচ্ছে সে মাসুদ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। কিন্তু সরাসরি কিছুই বলেনি। সে চিন্তা করতে শুরু করলো, সে কি ডায়েরি লিখেছে কখনো? ডায়েরিটা কি চুরি গেছে? অথৈ কীভাবে জানলো এসব। আজব ব্যাপার! মাসুদ কখনও ডায়েরি লিখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। তাহলে?
হঠাৎই খারাপ লাগতে শুরু করলো মাসুদের। এমনই একটা মূহুর্তে অথৈ তাকে প্রশ্নটা করেছে যে, মুখ ফসকে অনেক শক্ত কথা বলে ফেলেছে মাসুদ। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। নিজে খোঁচা খেলেও হজম করা উচিৎ ছিল। মেয়েটা কি কষ্ট পেলো? চেহারা দেখে মেয়েদের অনুভূতি খুব একটা বোঝা যায় না এটা মাসুদও মনে মনে স্বীকার করে। তবুও আর দশজনের মতোই সেও অথৈ-এর মনের অবস্থাটা বোঝার জন্য তার চেহারা দিকে প্রথমবারের মতো খেয়াল করে তাকালো।
কিন্তু মনের অবস্থা নয়, মাসুদ দেখলো সম্পূর্ণ নতুন এক জিনিস। এতোক্ষণ অথৈকে আবছা আলোয় দেখলেও ভালোমতো দেখতে পারেনি। মাত্রই সে লক্ষ্য করলো, অপরূপ সুন্দরী একটা মেয়ে অথৈ। তার সৌন্দর্য্য ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়লো মাসুদের। তার মনে হতে থাকলো, সে নিশ্চয়ই অথৈকে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায়? এতো সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখলে তার সবসময় মনে থাকতো। তাহলে?
তারচেয়ে বড় যেই ব্যাপারটা মাসুদকে ভাবিয়ে তুললো, তা হলো তার নিজের মন-মানসিকতা। সে মেয়েদের ছেলেদের মতোই দেখে। ঝগড়া করতে পিছপা হয় না। আর কেউ খোঁচা দিলে তো কথাই নেই। কিন্তু অথৈ রীতিমতো হেস্তনেস্ত করে ছাড়লো, অথচ তবুও অথৈ-এর জন্যই মাসুদের খারাপ লাগছে।
মাসুদ টের পেল, ঘটনা বে-লাইনে চলে যাচ্ছে!
(চলবে)
অন্যান্য গল্পগুলোঃ http://aisajib.wordpress.com/category/story/