পলা স্যান্ডউইচেস শেষ করে, কফিতে চুমুক দিল। ওর ঠোঁট দুটো যখন লিডের ছোট্ট ফুটোতে লাগছিল, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কাপের গরমে তা যেন খানিকটা শিহরিত হচ্ছে। ওর ঠোঁটে কোন লিপস্টিক নেই, থাকলেও তার রঙটা এমন যে আমার পুরুষালি চোখে ধরা পরছিল না, কিন্তু ঠোঁট দুটো থেকে কেমন যেন একটা গ্লিটারিং আভা ফুটে বের হচ্ছিল। হঠাৎই আমার ইচ্ছে করল, পলার ঠোঁট দুটোতে ঠোঁট ঠেকিয়ে দেখতে, সত্যিই তা কতটা উষ্ণ!
আয়েশ যেন শুষে নিতে চাইছে স্টারবাকের পেয়ালা থেকে এমন ভাবে চুমুক দেয় পলা। নিজের ক্যাপিচিনোতে চুমুক দিয়ে বুঝলাম স্বাদটা অন্যদিনের তুলনায় আলাদা। অথচ এ কফি তো আমার কাছে নতুন নয়। তাহলে কি পলার হাতের ছোঁয়ায় এর স্বাদ বদলে গেছে? নাকি কফিটা কেবল উপলক্ষ্য মাত্র, পলার সঙ্গ ভাল লাগছে বলেই কফির স্বাদটাও বদলে গেছে? ভাবনাগুলো বড্ড বেহিসাবি। নিজের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায়, অন্যের এলাকায়। এলেবেলে ছেলেমানুষী ভাবনায় নিজেরই হাসি পেল।
কফি শেষ হতেই ঘাসের বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল পলা। কনুইতে ভর করে উঁচু করে রাখল থুতনিটা। গায়ের কালো কোট খুলে ফেলেছে এর মধ্যেই। সবুজ ঘাসের বিছানায় ওর মেরুন স্কার্ট আর সাদা টপে ঢাকা শরীরকে মনে হল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের কোন পানায় ঢাকা পুকুরে ফুটে থাকা সাদা আর মেরুন শাপলা। আর নিরুত্তাপ রোদের নিচে শাপলার প্রায় গোলাপি পাপড়িগুলো বাতাসে যেন সামান্য দুলে দুলে উঠছে।
খানিকবাদেই পলার ব্যাগ থেকে যথারীতি বেরিয়ে পড়ে বই। আমি খেয়াল করেছি, বৃটিশ মেয়েদের ব্যাগে লিপিস্টিক বা এটা সেটার পাশাপাশি বইয়ের জন্য একটা জায়গা অবশ্যই থাকে। ট্রেনে, বাসে, মাঠে যেখানেই সময় পায় ব্যাগ থেকে বের করে নেয়, চারপাশ ভুলে গিয়ে তাতে মনোযোগ দেয় নিবিড়ভাবে। বইয়ের সঙ্গে আজকাল যোগ হয়েছে আইপড। বাসে ট্রেনে উঠতে না উঠতেই কানে গুঁজে দিল এয়ার পিস। কি শোনে আর কিই বা পড়ে কে জানে। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, সত্যিই পড়ছে তো? মনোযোগ দিতে পারছে তো?
লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে আমি খুব কম নারীকেই দেখেছি যারা ট্রেনে উঠেই চোখের সামনে বই মেলে ধরে না। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনগুলো খুব দ্রুত চলে বলে, এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের মধ্যখানের সময় ব্যবধান দুই তিন মিনিটের বেশি নয়। কিন্তু তার মধ্যেও খুলে বসবে বই। মেয়েদের সঙ্গে পাল¬া দিয়ে আজকাল ভদ্রলোকেরাও ঐ আচরণ করতে শুরু করেছে। তবে তারা বেশিরভাগই মেলে ধরে ডেইলি মেল বা সান। কখনো কখনো মুফতে পাওয়া মেট্্েরা। কাউকে কাউকে ফাইন্যানসিয়াল এক্্রপ্রেস পড়তে দেখেছি, কিন্তু ডেইলি টাইমস পড়তে দেখিনি। হয়ত ঐ সংবাদপত্রটির চরিত্রই এমন যে, তা ট্রেনের ধাক্কার মধ্যে বা বাসের ঘসটানিতে পড়া যায় না।
আমাদের এক আমেরিকান বন্ধু আছে, উইলিয়াম, ও অবশ্য মনে করে বাসে বা ট্রেনে পড়াপড়ি এই খেলাটি বৃটিশদের চালাকি। ওরা বই আসলে পড়ে না, মেলে রাখে চোখের সামনে যাতে সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে না হয়। বৃটিশরা হল সেই জাতি যারা ব্যবসা না থাকলে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলে না। আমরা আমেরিকানরা তেমন নই- উইলিয়াম বৃটিশদের চরিত্র বিশে¬ষণ করতে করতে আমেরিকানদের ওপরে তুলে ধরে যোগ করে - আমরা সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের খোঁজ খবর নেই। এমন কি ট্রেনে বা বাসে আমাদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, যা এমনকি বিছানা পর্যন্ত গড়ায়। আসলে বৃটিশরা এখনও পৃথিবীর সকল জাতিকেই তাদের প্রজা ভাবে। আগ বাড়িয়ে কোন প্রজার খবর কোন রাজা নেয় বল!
- আসলে বৃটিশরা যখন আমেরিকা শাসন করতে গিয়েছিল আটলান্টিক পারি দিয়ে, তখন থেকেই ওদের যত্রতত্র পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে! আমি ইচ্ছে করে উইলিয়ামের বক্তব্যের সঙ্গে এই লেজটুকু জুড়ে দেই। উইলিয়াম কপট আপত্তি করে বলে,
- না না, ভারতবর্ষ শাসন করতে গিয়ে ওরা পড়ার অভ্যাস রপ্ত করেছে। কারণ আমেরিকার তুলনায় ভারতবর্ষে যেতে বেশি সময় লাগত। জাহাজে কিছু করার থাকত না, তাই বই পড়ত।
-তার মানে দেশ ছেড়ে যাবার আগে ওদের পড়ার অভ্যাস ছিল না? উইলিয়ামের রসিকতাকে আরও খানিকটা টেনে নেই আমি।
- আমার তো মনে হয়, তার আগে ওরা পড়তেই জানতো না, খালি জানত নৌকা বাইতে।
- এজন্যই কেবল সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াত। আমার সরল সমাধান।
- কারেকশন মাই বাডি। নৌকা বাইতে জানত বলেই তো সমুদ্রে সমুদ্রে ডাকাতি করে বেড়াত। পাইরেট আব দি সি এন্ড পাইরেট অব দ্য ওয়র্ল্ড! উইলিয়ামের উপসংহার।
পলা বুঝতে পারছিল আমি আর উইলিয়াম মিলে ওকে রাগানোর চেষ্টা করছি। অন্যদিন হলে, ও নিজেও এতে যোগ দিত। কিন্তু কেন যেন পলা সেদিন ঐ সরল কৌতুককে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলনা। বিশেষত উইলিয়াম যখন পাইরেট শব্দটার ওপর অযথা জোর দিল, তখন পলা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।
- ডু য়্যু নো হোয়াট, উইলিয়াম, উই বিকেম ফেড আপ উইথ দোজ পাইরেট থিং এন্ড নাউ য়্যু টুক ওভার ফ্রম আস। হোয়াট য়্যু আমেরিকান পিপল আর ডুইং অল ওভার দ্য ওয়র্ল্ড ইজনট দ্যাট মডার্ন ফর্ম অব পাইরেটিং?
পলার এই আকসি¥ক প্রতিবাদ, যা কিনা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ, তা দেখে আমরা সবাই চুপসে গেলাম। উইলিয়াম আমার দিকে তাকাল আমি ওর দিকে। বুঝতে পারছিলাম না আমাদের কি করা উচিত। সরি বলা উচিত ওকে, অথবা প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার!
আমরা ক্রো বার-এ বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে শুক্রবারের অলস সন্ধ্যাটা যাপন করছিলাম। এটা আমাদের বেশির ভাগ ফ্রাইডে ইভিনিং-এর রুটিন। পাঁচটায় কাজ শেষ করে ঘন্টা তিনেক এখানে আড্ডা না দিলে আমাদের কারুরই সপ্তাহান্তটা ভাল যায় না। কিন্তু পলাকে ওভাবে উত্তেজিত হতে দেখে উইলিয়াম বুঝতে পারল না ওর কি করা উচিত, বিশেষত পলা ওকেই আক্রমণ করেছে।
বিব্রত এবং হতবিহ্বল উইলিয়াম বার বার বিয়ারের লম্বা গ¬াসটা ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে আবার নামিয়ে নিতে লাগল। আমার মনে হল না একটা সিপও ওর গলায় নামছে। আমরা নিজেরা কেউই কোন কথা খুঁজে পেলাম না। হঠৎই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উইলিয়াম বলল, আই বেটার গেট গোয়িং। আই অলমোস্ট ফরগট এ ফ্রেন্ড অব মাইন ইজ কামিং টু সি মি এট এইট পি.এম। বুঝলাম, উইলিয়াম আসলে চলে যেতে চাইছে। হয়ত আমাদের নৈশব্দ তাকে প্রোভোক করছে। এটা আমরা সবাই জানি, কোন বন্ধুকে সে শুক্রবার রাত আটটায় তার বাসায় আসতে বলবে না। আর যে আসবে সেও, আসতে পারবে না। কারণ ফ্রাইডে নাইট রাত আটটায় কেউ কারো বাসায় যায় না, কেবল যায় পাব-এ।
বৃটিশদেও এই কপট পাঠভ্যাস সম্পর্কে পলার সামনে উইলিয়াম যেদিন তার ঐ অন্তর্ভেদি মন্তব্য করেছিল, তার পর থেকে আমাদের গুচ্ছ আড্ডায় উইলিয়াম থাকলে পলাকে বই খুলতে দেখিনি। তার বরং উইলিয়ামের সঙ্গে পলা ছোট ও বড় বুশ নিয়ে আলোচনা করে বেশি। কে কার চেয়ে বেশি মাথা মোটা, কে কার চেয়ে বড় অস্ত্রের ব্যাপারি এই নিয়ে কথা বলে দীর্ঘ সময়। পিতা-পুত্রের নামে বর্তমান সময়ে যত জোকস প্রচলিত আছে, সেগুলো পরস্পর পরস্পরকে বলে এবং প্রাণ খুলে হাসে। তাদের হাসির খোরাক কমে গেলে দুজন মিলে আমার বাঙালি উচ্চারণের ইংরেজি নিয়ে রসিকতা করে। বিশেষ করে জু এবং জানুয়ারির মধ্যে যে জেড আর জে আছে তাদের উচ্চারণ পার্থক্য না করতে পারায় আমাকে ভেঙায়।
- দেখ, ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, তা আমার কাজের ভাষা। সুতরাং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই শিখি। তাতে উচ্চারণ ভুল থাকলেও যদি তুমি বুঝতে পার তাতেই আমার চলবে। এ নিয়ে তোমাদের রসিকতা অন্যায়। যদি আমার মাতৃভাষায় তোমাদের কাজ চালাতে হত তাহলে বুঝতে পারতে কত ধানে কত চাল। আচ্ছা তোমরা দুই ইঙ্গ-মার্কিন উচ্চারণ কর তো সোনা, কিম্ভূতকিমাকার। পলা তাকায় উইলিয়ামের দিকে, উইলিয়াম পলার দিকে। তার পর ওরা দুজনে মিলেই চেষ্টা করে উচ্চারণ করতে গিয়ে শব্দটিকে আরও বেশি কিম্ভূতকিমাকার করে তোলে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ দুপুর ২:৫১