গত তিন বছরে পলার কাছ থেকে যতবার রোদ্রস্নানের আহ্বান পেয়েছি, ততবার আমরা এসেছি, এডি ডেভিস বিল্ডিং-এর সামনের এই ঘাসের গালিচায়। আমাদের পেছনে থাকে প্রায় দুশো বছরের পুরনো স্টুডিও বিল্ডিং; এককালে সাইন্সল্যাব ছিল, এখন কেবল ক্লাস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পলা আমাকে বলেছে, জেমস রাদারফোর্ড নাকি কাজ করতেন এই বিল্ডিং-এ, তখন অবশ্য এটা ফিজিক্স ল্যাব ছিল। ’বিদ্যুত কী এখানেই আবিস্কৃত হয়েছিল?’ পলাকে জিজ্ঞেস করি আমি।
জানি না। তবে এটা জানি এখনও প্রচুর বিদ্যুত এর চারপাশে জড়ো হয়। পলা বিল্ডিংটির আশপাশে গুচ্ছ বা জোড়ে বসে থাকে ছাত্রছাত্রীদের ইঙ্গিত করে বলে।
আমরাও কি তাদের মধ্যে?
অবশ্যই। তোমার কী মনে হয় না আমরা প্রতি মুহূর্তে শরীর থেকে আয়ন নি:সরণ করছি?
আমি ভেবেছিলাম পলা বোধ করি মানবিক কোন বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছে। কিন্তু একেবারে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের আলোচনায় প্রবেশ করছে দেখে আমি ওর রাশ টেনে ধরি। ইঙ্গিত করি চারপাশের চারপাশের সজীব এবং প্রেমময় ছেলেমেয়েদের দিকে, ’এরাও কি তবে তোমার ফিজিস্কের তত্ত্বে পড়ে?
না, না, কী যে বল। জীবনে নিশ্চয়ই বিজ্ঞান পড়নি। এরা হল, ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। দেখছো না, মানুষের ঠোঁটগুলো কীভাবে ললিপপ হয়ে ওঠে ওদের কাছে! আমি পলার দিকে তাকাই পূর্ণ দৃষ্টিতে, বুঝতে চেষ্টা করি ওর বাক্যের ইঙ্গিত। কিন্তু ও আমাকে কোন সুযোগ দেয়না ওর চোখের ভাষা পড়রবার, তাকিয়ে কেবল আকাশ দেখে।
এখানে ঘাসের মধ্যে পা দিতেই কেমন একটা সংকোচ বোধ হয়, ঘাসগুলো যেন বেদনার্ত হয়ে মাটির দিকে নুইয়ে পরে। কোমল, গাঢ় এবং দৃঢ়বদ্ধ ঘাসে পা ডুবে যায়। নিজের কাছে অপরাধী মনে হয় ঘাসের বিছানায় পা দেবার জন্য। যে দেশে ঘাস বানানোর জন্য শত শত টাকা ব্যয় হয়, তাদের ঘাস যে গায়ে গতরে বাঙ্গাল ঘাসের চেয়ে নরম ও সবুজ হবে তাতে আর আশ্চর্য কী, এই ভেবে সান্ত্বনা দেই নিজেকে। তবে যে দেশে বৃষ্টি আর শীতই নিয়ম, রোদটা ভীষণ কাকতালীয় সেদেশের ঘাসের গালিচা প্রায় উদোমই পড়ে থাকে আার সে জন্যই বোধ করি হঠাত এমন মানব অত্যাচার তাদের সবুজতা নষ্ট হতে দেয় না।
এখনও পলা আসেনি। নিজের কব্জির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যথারীতি আজও ভুলে গেছি ঘড়ি আনতে। আমার এই ভুলো স্বভাবের জন্য আমি আজকাল সময় আন্দাজ করতে শুরু করেছি। নিশ্চয়ই আমি ঠিক সময়ে এসেছি। ঘাসে হেলান দিয়ে আর্টস বিল্ডিং-এর সামনে সযতেœ গড়ে তোলা বৃহদায়তন ঘাসের গালিচায় চোখ মেলে দিলাম। আগস্ট শেষ হতে চলল, এখনও ক্যাম্পাস বেশ খালি। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এমন রোদ উঠলে ঐ ঘাসের বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে শুয়ে থাকত গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলে মেয়ে। এখন কেবল কয়েকজোড়া রোদ মাখিয়ে শুয়ে আছে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে ঘাসে পা ছড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা ছেলেটির বুকের ওপর শুয়ে যেভাবে তাকে আলতো ভাবে আদর করছে, দেখে আমার বাঙালি চোখেও অস্বাভাবিক মনে হল না। কী অসামান্য অসংকোচ প্রকাশ, যাকে ভালবাসে এবং ভাললাগে, তার সবটুকু শুষে নেবার কী এক দুর্মর বাসনা!!
পলা এল মিনিট দশেক পরে। আমি দূর থেকে ওর আসবার ভঙ্গিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আজ পলা পরেছে মেরুন স্কার্ট আর সাদা টপ। যথারীতি কাল কোট। ওর দু’হাতে টুটো কফির পেয়ালা। বেশ খানিকটা দূর থেকেই আমি ওর চিকন হিলের শব্দ শুনতে পাই। ওর হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে কেমন একটা রাজসিক ব্যাপার আছে, যা আমাকে মুগ্ধ করে। পলা স্থূলাঙ্গি নয়, নয় শীর্ণা। দীর্ঘাঙ্গি নয় আবার নয় হ্রস্বও। কোমরে সামান্য মেদ থাকলেও তা সর্বশরীরে ছড়িয়ে গিয়ে ওর ক্ষিপ্রতা নষ্ট করেনি। মহাভারতে যাদেরকে মধ্যমা নারী বলা হয়েছে, ও তেমনি। কেবল জন্ম ভারতবর্ষে নয় এই যা।
সরি টু কিপ য়্যু ওয়েটিং।
তোমার জন্য আমার সময় তো ওয়েট করে না, তোমার সঙ্গে হেঁটে বেড়ায়।
হোয়াট ডু য়্যু মিন? পলা আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকায়।
যখন তুমি থাকো না, বা তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করি, তখন তোমার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে আমি মনে মনে তোমাকে খুঁজি। পেয়ে যাই এবং তোমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি। সুতরাং ওয়েট তো করি না তোমার জন্য।
আর য়্যু ফ্রম এ কান্ট্রি হোয়ার এভরিওয়ান বর্ন টু বি এ পোয়েট? অর ইট জাস্ট দ্য ইংলিস সামার দ্যাট মেকস য়্যু আ পোয়েট?
নান অব দেম। ইট জাস্ট য়্যু।
পলা কটাক্ষে আমার দিকে তাকায়। সঙ্গে এগিয়ে দেয় কফির পেয়ালা। কোন কথা বলে না।