somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি যেদিন নিজের হাতে খুন হয়েছিলাম

০৮ ই মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উচু নিচু বিল্ডিং গুলোর ফাঁকে চাঁদটাকে ধরতেই পারছিনা, আবার দেখ শালা শিকারী মেঘগুলো চাঁদটাকে কেমন ফাঁদে ফেলে বোকা বানাচ্ছে আমাকে। কিন্তু আমি চন্দ্রগ্রস্ত হবোই; সোনালী গরলে পুড়ছে কন্ঠা, অমোঘ টানের সাথে আতাঁত করে চোখের পাতা দুটো খুলতেই চাইছে না, আমি ছুটতে থাকি পতংগের মতো। জোছনায় পোড়া রাস্তাটার উজানে গনিকাদের অপেক্ষমান কাফেলা পেরুচ্ছি এমন সময় দুরাগত ঘন্টার ধ্বনি একটা গির্যার ঠান্ডা মেঝেতে আছড়ে ফেলে আমাকে। ধুস শালা, কোথায় গির্যা, একটা কুশাময় রিকশা ঘন্টি বাজাতে বাজাতে একটা অপার্থিব গলির হা করা মুখের ভেতর সেঁধিয়ে পড়লো। গির্যার ঘন্টা নাকি রিকশার ঘন্টি নাকি গনিকাদের হীরন্বয় হাসি, এই সব বিহ্ববলের মধ্যে বেজন্মা মোবাইলটা তারস্বরে হৃৎপিন্ডটাকে খামচে ধরে।

"হ্যালো"
"জী ভাই" আমার চাপ আসে, ইতি উতি তাকাই...হু ঐ তো, একটা সাদা দেয়াল কেমন ক্ষুধার্থের মতো তাকাচ্ছে।
"তুই কামটা ঝুলাই রাখলি ক্যান? সবতে ক্রসফায়ারে পড়লে তহন করবি?
আমি তো আগেই কইসি, কইসি না ক? তোর সমস্যা হইবো..হাজার হউক তুইলা আইনা শিখাইয়া পড়াইয়া তুই তো বড় করলি, এমন বড়ো করলি যে আমাগো হোগা মারতাছে তলে" আমি চাপ মুক্ত হতে থাকি। শুভ্র দেয়ালটায় ছেলেবেলার মতো আঁকাআঁকি করি, প্রস্বাবের আঁচড়ে মতিনের খানাখন্দে ভরা মুখটা কেমন হ্যাংলার মতো ঝুলে থাকে দেয়ালে এবং খানিক বাদে সেটা গোত্তা খাওয়া ষাঁড় কিংবা শুকুরের মতো আকার নিয়ে ঝরে পড়তে থাকে।
"ভাই, আমি তো কইসি দুইটা দিন সময় দেন, হইয়া যাইবো।" নিজের বিমুর্ত শিল্পের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি.......বাহ!!
"তোর খারাপ লাগলে থো, পাগলারে দিয়া দেই....."
দেয়ালের মেঘ আর হাতি-ঘোড়া গুলো পাক খেতে খেতে পাগলা সেলিম আর ৩২ টুকরা লাশের লাগেজের আকার নিলে আমি ক্ষান্ত দিই।
"ভাই, দুইটা দিন...এর মইধ্যে পাগলারে আইনেন না।"
মুঠো ফোনের ওপাশে মুহুর্তটা অনন্ত নিরবতায় ডুব দেয় টুপ করে। রাতের হ্যাংওভার, চন্দ্রাহত আমি, হত্যা নকশা আর গির্যা কিংবা রিকশার ঘন্টি, খানাখন্দে ভরা মতিন, পাগলা সেলিম আর ৩২ টুকরা লাশের লাগেজ এবং এই সব অনিবার্যতা আমাকে ছিড়ে খুড়ে ছুঁড়ে দেয়।

---------------------------------------

আমি আর রাজু চা খাই।
"উস্তাদ, এই সানুর দুকানের কথা তুমার মনে আসে? এই খান থিকা তুমি আমারে নিয়া গেসিলা"
"উম", আমি দুধের ভেতর ডুবন্ত সর দেখি, তর্জনি-মধ্যমার ফাঁকে নিকোটিনের বসত দেখি; শুধু রাজুকে দেখিনা।
"৫টা বসর!" রাজুর কন্ঠে ঘোর। "হালাই সময় কেমুন কইরা কুন চিপার মইধ্যে দিয়া দৌড়াই বুঝবার পারিনা! "
"কাইলকা বড় একটা কাম আসে রাজু।" সিগ্রেটে কড়া টান দিয়ে বলি," বশির চুতিয়ার কাছ থিকা প্যাকেট ডেলিভারি নিতে অইবো।" আংগুলের ফাঁকে সিগ্রেটটা কাঁপে, ধোঁয়ার মেঘ হামলে পড়ে চোখে। বহতা গাড়ি গুলো লাল বাতি দেখে বেমাক্কা রাশ টেনে ধরলে, রাজু ফেরে আমার দিকে, "হুমম, রাইতে না উস্তাদ? তুমি আমারে জানাইয়া দিও, চইলা আসুমনে।"
"তোর পোলাটা কতো বড়ো অইসে রে, রাজু?"
উত্তরাধিকারের কথা শুনে রাজুর চোখ দুটো চকচক করে। "আগামি মাসে ২ বসরে পড়বো, এমুন পাখনা হইসে, উস্তাদ! আমি যহন বাড়ি থিকা বারাই, ছাড়বারই চাইনা, গলার লগে চ্যাতকাইয়া থাকে, অর মা টানলে এমুন চিক্কুর মারে যে হালায় মহল্লার লোক গুলার কানে ধাপ্পি মাইরা যায়!"
রাজুর চোখে অলৌকীক চকমকি দেখে ধন্দে পড়ে যাই। আমি আর রাজু সেই বৈরী সময় যা আজীবন আমাদের পিছু ধাওয়া করে নাকি আমরাই তার সওয়ার হই, তা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। মগবাজার হোটেলে পুলিশ খুন, মিরপুরে টোটনদের দুই ভাইয়ের লাশ, উত্তরার হাইড আউটে পেটে গুলিবিদ্ধ আমাদের সহযোগি নাকি সহদর নাসিরের রক্তখরন। "তুমি চিন্তা করো উস্তাদ, সেই দিন আমরা নাসিরের জন্যে একটা ডাক্তার আনতে পারি নাই, আমার কোলের মধ্যে তরতাজা পোলাটা সাদা হইয়া গেল! একফোঁটা রক্ত আসিল না!" ঝাঁ চকচকে সুর্যের নিচে সহযোগি নাকি সহদর নাসিরের রক্ত রন্জিত আমরা হটাৎ বিব্রত হয়ে পড়ি, রাজু আপ্রান চেস্টা করে নাসিরের রক্ত মুছে ফেলতে কিন্তু বেয়াড়া লালের আক্রমনে পেরে ওঠে না সে। "উস্তাদ, পোলাটা বড়ো অইতাসে, ডর লাগে এখন।" রাজুর ভয় আর নাসিরের শ্বেত-সন্ত্রাস আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলে মতিনের খানাখন্দে ভরা মুখ আর পাগলা সেলিম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।

"রাজু, তুই বাড়ি জা গিয়া। আমি এই দিকটা সামাল দিমুনে। কাইলকা সময় মতো চইলা আসিস।"

রাজু নির্জলা রোদের নিচে এইসব বিপন্নতার মাঝে আমাকে একা ছেড়ে গেলে কাঁপা হাতে মোবাইলটা বের করি;
"ভাই আপনারে কইসিলাম দুইটা দিন সময় দেন।"
"আমি কি না করসি?"
"তাইলে সেলিম আর জহিররে সারাদিন আমার পিসে লাগাই রাখলেন ক্যান?" হটাৎ চাপ আসে আমার। ক্ষ্যাপা চোখে তৃষ্নার্ত দেয়াল খুঁজি, কিন্তু শালা দেয়াল গুলো ফাঁকতালে কেমন উধাও হয়ে গেল।
"আরে না, কি যে কস না তুই। অরা তোরে ফলো করবো ক্যালাই? তুই তো জানোস, পাগলার এই সবে আগ্রহ একটু বেশি" মতিন ভাই গা দুলিয়ে হাসে। শালা ঢাকা শহর কি দেয়াল শুন্য হয়ে গেল? দেয়াল ছাড়া ন্যাংটো বাড়ি গুলো আব্রু ঢাকবে কি দিয়ে? হঠাৎ হাতের বা'য়ে ভোজবাজির মতো সাদা দেয়াল গজিয়ে ওঠে ক্যানভাস হয়ে , আমি হাপ ছেড়ে বাঁচি!
"ভাই, আমি আপনারে কইসি দুইটা দিন। এর পরেও যদি আপনি...." অবাক এবং ঘেন্না ঝরে পড়া অনেক চোখের সামনে আমি ক্যানভাসে তুলি চালাই। ".....পাগলারে লেলান তাইলে খরচের খাতা বাড়বো।" ক্যানভাসে খানাখন্দে ভরা মতিন আর পাগলা সেলিম পরস্পরের উপর উপগত হয়ে বিমুর্ত শিল্পের সৃস্টি হলে আমি মুগ্ধ হই। "ভাই, আপনি যা কইসেন সব শুইনা আসচি। আমারে আপনার অবাধ্য কইরেন না।" জিপার টানার ফাঁকে বলি আমি। মুঠো ফোনের ওপাশে মুহুর্তটা অনন্ত নিরবতায় ডুব দেয় টুপ করে।

-------------------------------------------

সেদিনও ছিল মাতাল চাঁদ। কালো গাড়িটাতে ৪ জন সওয়ারি। "উস্তাদ, দেখসো, হালায় চান দেখি আমাগো লগে পাল্লা দিতাসে! ঐ জহিরর‌্যা, জুরে চালা চান মাতারির পোলা য্যান আমাগো টেক্কা দিবার না পারে!" রাজুর চোখে অলৌকিক চকমোকি। ওর ছেলের জন্য কেনা লাল গাড়িটা দেখায় আমাকে। "পুলার আমার গাড়ি খুব চয়েজ বুঝলা উস্তাদ! বড়ো হইয়া ডেরাইবার হইবো কিনা আল্লাই জানে!" রাজুর হাতের চেটোই লাল একটা গাড়ি, হঠাৎ দেখি মগবাজারের হোটেলে খুন হওয়া পুলিশ, মিরপুরে টোটনদের দুই ভাই আর আমাদের সহযোগি নাকি সহদর নাসির, ওরাও চাঁদ ফাকি দেওয়ার অভিযানে শরিক হয়। চোখ লাল করে এমনকি মাথা ঝাঁকিয়েও তাড়াতে পারিনা ওদের, হতচ্ছাড়া লালে এমন চেটকে থাকে ওরা যে আলাদা করতে না পারার হতাশায় চাপ আসে আমার। হাইওয়ের ধারে ধান ক্ষেতের পাশে গাড়ি থামাই। "জহির তুই গাড়িতে থাক" আমরা তিন জন বেরিয়ে আসি। রাজু চোখ সরু করে প্রায় আঁধারে বশিরকে খোঁজে।

"বশির চুতিয়া দেহি এহনো আসে নায়, উস্তাদ।"
"একটু আগাইয়া দেখ রাজু।" আমার কন্ঠ একটুও কাঁপে না কেন?
রাজু আমার সামনে কুয়াশার চাদরে জড়ালে পিস্তলটা বের করি আমি। মাত্র একটা বুলেট, সবুজ ধান ক্ষেতটা জড়িয়ে ধরে রাজুকে। আমি হামা দিয়ে রাজুর প্রায় দু বছর বয়সি ছেলেটার সেই লাল গাড়িটা খুঁজি। জহির আর বাবলু টানতে চায় আমাকে, "উস্তাদ, জলদি আহো!" "সর কইলাম খানকির পুতেরা!"আমি হ্যাচকা টানে ছাড়িয়ে নিই নিজেকে, আঁতিপাঁতি করে খুঁজি গাড়িটা। হ্যা ঐতো...লাল গাড়িটা মগবাজারের হোটেলে খুন হওয়া পুলিশ, মিরপুরে টোটনদের দুই ভাই আর আমাদের সহযোগি নাকি সহদর নাসির আর রাজুকে নিয়ে চাঁদটার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে!!














সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৪:১৯
৬০টি মন্তব্য ৫৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×