আজকাল ডে-লাইট সেভিঙয়ের কারণে বেলা বোঝা যায় না। আমরা, যারা এই বিষুবের কাছাকাছি বাস করে অভ্যস্ত, আমাদের কাছে ছয়টা মানে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এসে যাওয়া। ধীরে ধীরে আলো কমে আসা। জুলাই মানে বর্ষাকাল, আকাশে গুমগুমে মেঘ বা ঝিরঝির বৃষ্টিতে আরো আগে থেকেই আঁধার ঘনিয়ে আসে। কিন্তু আজকে কাচের দেয়ালে তৈরি অফিস থেকে বের হয়ে সুমনের মনেই হয় না যে ছয়টা বাজে! বাইরে ঝকঝকে রোদ। বাতাস হুটোপুটি খেলছে। কোথাও অনেকদূরে বৃষ্টি নেচে গেছে, তাই বাতাসে গাছের বাকল ভেজা গন্ধ, মাটির ভাপের সুবাস। সুমন নাক একটু উঁচু করে জোরে শ্বাস টেনে নেয়। ছয়টায় তার অফিস শেষ হয়। আগে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাসের লাইনে দাঁড়াতে হত, এখন এই ঝকঝকে বিকেলে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে সুমন কী করবে বুঝে পায় না!
সে এই চাকরিটা করছে প্রায় সাত বছর ধরে। ফিলোসফিতে পড়াশোনা করে এমন চাকরি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাই প্রথমে সুমনের মনে হয়েছিল এমন ভাগ্য কয়জনের ঘটে! দুইবছরের মধ্যেই চাকরি পার্মানেন্ট হলো, একটা বিয়েও করে ফেললো সে মায়ের পছন্দের মেয়েটিকে, নাম মৃন্ময়ী। এখন তাদের সাড়ে তিন বছরের একটা ছেলে আছে। সুমনের এই চাকরিতে এখন আর আগের মত ভালো লাগে না। মায়ের শরীর খারাপ থাকে ইদানীং- বয়সের কারণে নানান রোগ-বালাই। মৃন্ময়ীর সাথে সুমনের মানসিক দূরত্ব কয়েকটা ড্রয়িং রুমের সমান। প্রথম প্রথম সে পাত্তা দিতো না ব্যাপারটা, কিন্তু এখন অনেক কিছুতেই খুটখাট লেগে যায়। বিশেষত মায়ের ব্যাপারে (ঘরে কী হয়েছে কে জানে!) ইদানীং মৃন্ময়ী ভীষণ অসহিষ্ণু আচরণ করে। ছেলে বড়ো হচ্ছে তাই চাপা গলায় রাতের বেলা ঝগড়া চলে।
মাঝে মাঝে এই চাকরিটাও অসহ্য লাগে সুমনের। নয়টা-ছয়টা অফিস। সকালে এসে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকে যেতে হয় এই টাওয়ারে। সেভেন্থ ফ্লোরে তার অফিস। আশেপাশের বিল্ডিঙগুলো এমনভাবে ঘিরে রাখে যে দিনের বেলাতেও কোন আলো ঢুকে না। পুরো অফিসে তাই সারি সারি টিউবলাইট দিনরাত জ্বলে। সেন্ট্রাল এ.সি.। এই কারণে কলেজের প্রিয় শখ ধূমপানটাও ছাড়তে হয়েছে ধীরে ধীরে! সুমনের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে কাচের দেয়াল ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু সেই পথও খোলা নেই, ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ফাঁকা জায়গাই তো নেই! অফিসের এক একঘেঁয়ে কাজেও সুমন আর আনন্দ পায় না। একই স্প্রেডশীট, একই রুটিন একই ধরাবাঁধা জীবন। মাঝে মাঝে লাঞ্চের পরে সুমনের দমবন্ধ হয়ে আসে। সে নিজের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পায়, এই অফিসের বন্ধ কেবিনের মধ্যে তার সামনের বছরগুলো একে একে কেটে যাবে। তারপরে একদিন চুলে পাক ধরবে, শরীর অশক্ত হবে। রিটায়ারমেন্টের পরে ছেলেমেয়ের আশ্রয়, তারপরে একদিন ধুপ করে মরে যাওয়া। কয়েকদিন কেউ কেউ কান্নাকাটি করবে। তারপরে সব শেষ!
সেন্ট্রাল এ.সি.র ঠাণ্ডা ঘরটাকে সুমনের কাছে পাতালপুরীর কবর বলে ভ্রম হয়।
*****
আগের পর্ব
সুমনের সাথে, আমি নিজের মিল পাই। আমার চারপাশে যারা প্রতিদিন ঘুরে বেড়ান, তাদের সাথেও আমি এই একটা জায়গায় মিল খুঁজে পাই। আমারও হঠাৎ করেই নিজের বাস্তবতাকে ভয়াবহতম অ্যাবসার্ড বলে মনে হতে থাকে। একেবারে নিরর্থক এবং নিষ্ফল সংগ্রামের সমষ্টি বলে মনে হয়। আর তখনই মনে পড়ে সিসিফাসকে। হায় পরাক্রান্ত মহারাজ! দেবতাদের সাথে তার ক্রমাগত যুদ্ধ চলেছে। সীমাবদ্ধ মানুষ হবার পরেও সে কোন দেবতাকেই পূজনীয় মনে করেনি। জিউসের সাথে তো অনেক বোঝাপড়া হয়ে গেল, থানাটোসকেও চরম দুঃসময়ে ঘোল খাইয়েছে সে। কিন্তু অমোঘ নিয়তি তার ভবিষ্যত সেই টারটারাসের গহীনেই লিখে রেখেছিল, যা থেকে তার কোন পরিত্রাণ নেই।
নাহলে কিসের জন্য সে তার স্ত্রীর ভালোবাসার পরীক্ষা নিবে? যাকে সে এত ভালোবাসে, যার সাথে তার এতদিনের সংসার, তাকে কেনই-বা মিছে সন্দেহ? সিসিফাসের স্ত্রীর নাম মেরিওপি। খুব সাধারণ নারী, সিসিফাসের চৌকস বুদ্ধির তুলনায় সে কিছুটা আটপৌরেই। তাই যখন সিসিফাস তাকে বললো, "তুমি আমাকে পাবলিক স্কয়ারে জীবন্ত কবর দিয়ে দাও।", তখন সে হয়তো সেটাকে স্বামীর বিচিত্র খেয়ালের বেশি ভাবেইনি। সরলমনে করে ফেলা সেই ভয়ঙ্কর কাজের মানেই হলো সিসিফাস আর কখনোই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে না। মৃতের নগর থেকে কে কবে ফিরে এসেছে!
সিসিফাসের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে পাতালপুরীতে। বিচার শেষে তার জায়গা হয়েছে অন্ধকার কুঠুরি। সবকিছউ বুঝে উঠতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো, "নির্বোধ নারী!", ভাবলো সে, "আমাকে এভাবে কবরে নিক্ষেপ করতে তার এতটুকুনও বাঁধলো না! এই তার ভালোবাসার নমুনা?" ভয়ঙ্কর রাগে সিসিফাসের মাথায় আগুন ধরে গেল। পাতালের দেবতা হলেন প্লুটো আর দেবী পার্সিফোনি, তাদের কাছে সমানে সে ধর্না দিতে লাগলো। কত তার কথামালা, কত কাতর অনুনয়, বিনয়, আহাজারি। বেশি কিছু নয়, প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর সাথে আর একটি বার দেখা করতে চায় সে। তার সাথে মৃত্যুর আগে ঠিকমত বিদায়ও নেয়া হয়নি তার। প্লুটো ইতোমধ্যে জানেন টারটারাসে কীভাবে থানাটোসকে ঘোল খাইয়েছে সিসিফাস, তাই এইসব কথায় তাই একটুও চিঁড়ে ভিজলো না। কিন্তু পার্সিফোনি তো নারী, তায় আবার অপরূপ রূপসী। সিসিফাসের ক্রমাগত 'তেল' তাকে মোটামুটি পিচ্ছিল করে দিল। রাতের বেলা শুয়ে তিনি প্লুটোকে বলেন, "ওগো, বেচারাকে একটু সুযোগ তো দাও। কেমন কাতরকণ্ঠে আবেদন জানাচ্ছে!"
শেষ পর্যন্ত সিসিফাসের অনুমতি এলো। সে আবারও ফিরে এলো পৃথিবীতে। সেদিন তার যে আনন্দ, তা কী কোনভাবে প্রকাশ করা সম্ভব? একজন মানুষ মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে ফিরে এসেছে আবারও এই নশ্বর কিন্তু সদাপ্রাচুর্যময় সুন্দর ভুবনে। সিসিফাস ভুলেই গেল তার স্ত্রীর কথা, যে নারী তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিল, তার জন্য আর কান্না নয়। সে মহানন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলো পৃথিবীতে। এদিকে পাতালেও খবর পৌঁছে গেছে। প্লুটোর মনে হচ্ছে সিসিফাস আবারও তাকে বোকা বানিয়েছে। কিছুদিন পরপরই তাকে খবর পাঠানো শুরু হলো, "ফিরে এসো পাতালে। পৃথিবীর জীবন তোমার জন্যে শেষ হয়ে গেছে। সেখানে তোমার আর কোন স্থান নেই। এখন সেই পার্থিব জীবনের উপহারস্বরূপ তোমাকে আরেক জীবন দেয়া হয়েছে। তাকে গ্রহণ করো।"
সিসিফাসের এসব এত্তেলায় কিছু যায় আসলো না। সে তার নিজের সুখে মজে আছে। কে বলেছে যে উপহারস্বরূপ দেয়া জীবন উত্তম? তার কাছে তীব্রসুখের মর্ত্যজীবনই ভালো লাগে। সে এখানেই থাকবে। টারটারাস থেকে ধোঁকাবাজি করে ফিরে আসলাম, হুঁহ, আর এখন কোন প্লুটো এসেছে মাইকিং করতে!
এরকম ঔদ্ধত্যের সাথে উচ্চারণ খুব কম উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যায়। তার কারণ সম্ভবত পরবর্তী ফলাফলে এই উদ্ধতাচরণ খুব নৃশংসভাবেই দমন করা হয়। সিসিফাসের পরিণতিও হলো সেরকম কিছুটা। সমন জারি হলো, তার শাস্তি হবে টারটারাসে, যেখানে মারাত্মক পাপীদের নির্বাসন দেয়া হয়। যেহেতু সিসিফাস ইতোমধ্যেই "মৃত", সুতরাং তার মৃত্যুর পরবর্তী বিচার করার কোন ব্যবস্থা নেই! তাই সে কখনোই নির্বানলাভ করবে না। টারটারাসে তাকে অনন্তকাল ধরে একটা পাথর ঠেলে ঠেলে পাহাড়ে তুলতে হবে। তারপরে চূড়ায় পৌঁছানোর পরে সেই পাথরটি আবার গড়িয়ে পড়ে যাবে পাদদেশে। সিসিফাসের কাজ সেটাকে আবারও চূড়ায় তোলা। এই অন্তহীন, অর্থহীন শাস্তিতেই তার পরিণতি!
***
যে কোন গল্পের শেষে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পছন্দ করি, সহজবোধ করি। "অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো" বা "তাদের এই আত্মত্যাগ চিরঅম্লান হয়ে রইলো", এমন উপসংহারে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এবং গল্পের নায়ক, নায়িকার সাথে একাত্মবোধের স্থানটিও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়। কিন্তু এই সিসিফাসের গল্পে তো তেমন কোন পরিণতি নেই। সিসিফাসের মরণ নেই, জীবনও নেই সেইভাবে। শীতল, রুক্ষ্ণ এক পাহাড়ের পিঠে ছড়ে ছড়ে তাকে এক জগদ্দল পাথর ঠেলে ঠেলে তুলতে হচ্ছে। এই একঘেঁয়ে পুনরাবৃত্তিমূলকতায় আমরা কী করে খাপ খেতে পারি? এখন সুমনের মত, বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আমি শতশত সিসিফাসের মুখ দেখি। শ্রমবিভাগের কুহকে পড়ে আমরা এক একজন পাথর ঠেলা মানুষ হয়ে গেছি। সীমাবদ্ধ, গতিহীন, মূক, জান্তব, একাকী। নিজের পাথরভার নিজেই বয়ে চলেছি একা একা। এত কষ্টকর যাত্রায় আমাদের খেয়ালও হয় না যে আমাদের আশেপাশে কেউ নেই! যারা আছে, তারাও আমাদের মতোই স্বীয় পাথরের ভারে ন্যূজ।
সিসিফাসের মুখোমুখি হয়ে, আমি অবাক হই যখন পাথরটি চূড়ো থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যেতে থাকে। তখনকার চেহারাটি আমি কল্পনা করতে পারি। সেই মুখের রেখায় কি একফোঁটা হাসিও চোখে পড়ে? টারটারাসে অনেক আঁধার, ঠিক বুঝেও উঠি না আমি। তবে আমি টের পাই, নিজের চরম অ্যাবসার্ড বাস্তবতায় সিসিফাসের মুখ কেন হাসি ফুটে ওঠে। আমাদের জীবন এতটাই নিরর্থক যে সেখানে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা খুব বেশিই মগ্ন। জীবনের গূঢ় অর্থ বুঝে ওঠার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা, পাথর ঠেলার মতোই। আবার সকল চেষ্টার পরিণতিও আমরা জানি, জানি যে সকল উত্তোরণও এক পলকেই প্রবল পতনের সাথে সাথে আমাদেরকে শুরুতে নিয়ে যাবে। সব অনুসন্ধানেই আমাদের এই প্রয়াস মৌলিকভাবে ব্যর্থ হবে।
তাহলেই কেন এই জীবনযাপন? এই কষ্টকর, ক্লান্তিকর, অর্থহীন বয়ে চলা কি কেবল পরকালের লোভেই? সেই নিশ্চিন্তিই বা আমরা কোথায় পাবো? যদি তা অবশ্যম্ভাবীই হবে, তাহলে এত বিভ্রান্তি কেন?
সিসিফাস তো খুব সহজেই পারত আত্মহত্যা করতে। এমন পাশবিক শাস্তিপালনের চাইতে, নিজের জীবন শেষ করে দেয়াটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ হতো, তাই না? এই প্রশ্নের জবাবও আমি পেয়ে যাইঃ হতো না। অ্যাবসার্ড অপশন বলে একটা ব্যাপার আছে। সেখানে আমাদের নিরর্থক জীবনের জন্য আমরা তিনটা আলাদা পথ পেতে পারি। এক. আত্মহত্যা, দুই. নিজের চেয়ে বৃহত্তর কোন শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ, তিন. নিজের বাস্তবতার মাঝে অর্থ ফুটিয়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াস।
সিসিফাস প্রথম দুটি পথকে খুব অবলীলায় ত্যাগ করেছে, অনেকটা তাচ্ছিল্যভরেই। দেবতাদের অনুগ্রহ, ক্ষমা কোনটাই সে নিজের জন্য প্রার্থনা করেনি। বরং এই অমানবিক শাস্তি, এই অপরিমেয় জীবনকে পাথেয় করে নিয়েছে। শীতল পাতালের অন্ধকারে সিসিফাস পাথর ঠেলছে। তার চোয়াল শক্ত, পেশী দৃঢ়, এবং আলোহীনতায়ও আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার ঘামে ভেজা মুখ! আমি বুঝে যাই সিসিফাসের অর্থ। আমার মুখেও তখন তেমনই এক হাসি ফুটে ওঠে কি?
****
- অনীক আন্দালিব
১১.৭.৯
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৪০