ঐ যে যুবক, অন্ধকার পথে জম্বীর মত লক্ষ্যহীন পথ হাটছে।ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের দো'তলা বাসার বারান্দার অন্ধকার কোনে বসে।আরো অন্ধকার খুজে বেড়ায় যে যুবতী।মাছের মত নির্লিপ্ত চোখে কোন আশা নেই : ঝরে পড়ছে শুধুই একরাশ নিরাশা।
সমাজ,সংসার তাদের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়নি।
জঙ্গীবাদের এক কাল-বোশেখী ঝড়ে কক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়া দুটি জিবনের কিছু কথা বলতে এসেছি।সম্পুর্ণ কাল্পনিক নয়,আবার নির্জলা সত্যও নয়।সতেজ দুটি প্রাণ আজ স্পন্দনহীন।
রাতের অন্ধকারে ইস্কাটন থেকে নিজের আবাসের দিকে হেটে চলেছে এক যুবক।রাফির আজ সারাটা দিন খুব ঝামেলার মধ্য দিয়ে গেলো।কাল ১ লা বৈশাখের প্রস্তুতির জন্য কোন কিছুই বাকি রাখেনি।ছুটে বেড়িয়েছে মগবাজার/নয়াটোলা/মধুবাগ/ইস্কাটন-ওয়ার্লেছ।সব বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনিয় জিনিশ-পত্র দিয়ে এসেছে।বাজার সওদা থেকে ডেকোরেটর, সারাটা দিন দৌড়ের উপর কেটেছে।মাঝখানে অবশ্য বন্ধু টিপু কিছুটা সাহায্য করেছে।এবং এক সময় বৌ এবং বাচ্চার দোহাই দিয়ে কেটে পড়েছে।কাজল/সাগর/রিফু সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।সব দ্বায় যেনো রাফীর একার ।
কারন আইডিয়াটা এসেছিলো তার মাথায়,তাই দ্বায়-দায়িত্ব সবই যেনো তার ।সে হাসি মুখেই বন্ধুদের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে চলেছে।এবার নিয়ে ৩য় বারের মত সফল হবে রাফী।তবে এবারই শেষ,রাফী বলে দেবে এর পরের বার থেকে হয় সবাই কাজ ভাগ করে নেবে।নতুবা সে নিজেও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে।
আপনারা নিশ্চই দ্বিধা-দন্ধে পড়ে গেছেন! এতক্ষণ তো আপনাদের কোন ধারনাই দেওয়া হয় নাই ।কিসের আয়োজন, কি আয়োজন, কেনো এই আয়োজন।এই যে এত আয়োজন তা কিন্তু রমনা বটমূলের "বন্ধন" নামের ১লা বৈশাখের একটি স্টলকে ঘিরে।বন্ধু-বান্ধবী সবাইকে নিয়ে মজা করাই মূল উদ্দেশ্য।এই স্টলের যা লাভ হয় তার পুরোটাই ব্যায় করা হয় বাৎসরিক বন ভোজনে।আর বাকিটা দিয়ে সবাই মিলে ডিনার হয় কোন বড় রেস্টুরেন্টে।সোজা কথায় পার্টি হয় তুমুল আড্ডার হৈ-চৈ।রাফী লক্ষ করেছে ১লা বৈশাখে সবাই পান্তা-ইলিশের আয়োজন করে স্টল দেয়।তাই একটু ব্যাতিক্রম চিন্তা করে আমরা লুচি,ভাজি,পিঠা,কফি,চা এবং সফট ড্রিংকসের স্টল করি।সবকিছু অবশ্যই হোম মেইড। এটা সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দেওয়া হয় বাসায়, যে যেটাতে এক্সপার্ট সে সেটাই করবে। এতেই বাজীমাত ,গত দু'বছর হুটোপুটি লেগে গিয়েছিলো।শেষে এক রেস্টুরেন্ট থেকে সাপ্লাই নিয়ে কন্টিনিউ করতে হয়েছিলো।কারন বাসার তৈরি সবকিছু দু-ঘন্টার মধ্যেই শেষ।(আর বেশি বর্ণনা করতে পারবোনা,পাঠক আপনারা যার যার মত বুঝে নিন)
যদিও ক্লান্ত ,তবুও হেটে বাসায় ফিরতে ভালোই লাগছে তার।ইস্কাটন থেকে মগবাজার খুব একটা দুরে নয়।বাসায় ফিরে শাওয়ার নিতে হবে।তারপর রুমকী-কে ফোন দিতে হবে।কি ভাবছেন?এই রুমকী-টা আবার কে!
হা.. হা..হা..রুমকীই, রাফীর জিবন কাঠি!!রুমকীর জন্যই এত দৌড় ঝাপ।প্রতিদিন কথা হোলেও সপ্তাহে মাত্র একদিন দেখা হয় দু'জনের।তাই বিশেষ দিন গুলোতে রাফী যে করেই হোক দেখা করবেই এই মায়া-ময় মেয়েটার সাথে।রাফী-র কাছে পুরো পৃথিবী একদিকে আর রুমকী অপর দিকে।রাফীর জিবনে বসন্তের সমীরণ এনে দিয়েছে মেয়েটি।মনে হয় ওর চোখের দিকে তাকিয়েই একটা জিবন পাড় কর দিতে পারবে সে। ওর রিনিঝিনি ঝংকারের হাসির জন্য বিলিয়ে দিতে পারে জিবনটাই।১লা বৈশাখে রুমকীর সাথে দেখা হবেনা এটা কিছুতেই হবেনা।
যে করেই হোক কাল রুমকি-কে সারাদিনের জন্য পেতে হবে।
শাওয়ার করে ডিনার শেষ করতে করতেই রাত ১২টা বেজে গেলো।রুমে এসেই এসিটা অন করে রিল্যাক্স হয়ে ফোনটা নিয়ে রুমকীর নাম্বারে ডায়াল করলো।
১-২-৩ বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ভেসে আসে রিনিঝিনি কাকনের ঝংকারের মত কাংখিত সেই কন্ঠটি।
রুমকী-হ্যালো,হ্যালো-হ্যালো(ইচ্ছে করেই চুপ করে আছে রাফী)
রাফী-হ্যালো সুকণ্যা ,কেমন আছো?
রুমকী-ভালো,কিন্তু এত রাত করে কেনো ফোন করলে ! জান-না কাল খুব ভোরে উঠতে হবে!
রাফী-কি বলছো তুমি!আমি কি সময় দেখে তারপর তোমাকে ফোন করবো।আচ্ছা তাহোলে রাখি।
রুমকী-এই খবরদার যদি ফোন রাখিস,কালকে তোকে চিবিয়ে খাবো।(এটাই হোচ্ছে রাফীর,আসল রুমকী)এইজন্য কি অনুভুতি যে হয় তা বলে বোঝানো যায়না।
রাফী-হা....হা....হা..জংলী বিড়াল, তুই যে তা করবি সেটাতো আমি জানি।
রুমকী-তাহোলে এত সাহস তুই পাস কোথা থেকে?
রাফী-স্যরি দাদি, মাফ করে দেন,আর ভুল হবেনা।
রুমকী-তথাস্ত ! যা এবারের মত মাফ করে দিলাম।
রাফী-চড়ুই পাখি এবার কিচির মিচির বন্ধ করে আমার সিরিয়াস কথার পরের কথাটা শুনেনতো- মহারানী।
রুমকী-এই তুমি আমকে চড়ুই পাখি বললে কেনো?আমি ফোন রাখছি।
রাফী-ওরে আমার লক্ষী ট্যারা,উনার আবার রাগ হোয়েছে।ঠিক আছে আর বলবোনা ,এই যে তোমার কান ধরে বলছি।হা.. হা..হা....
রুমকী-এই ভালো হোচ্ছেনা কিন্তু।তুমি আবার আমাকে লক্ষী ট্যারা বললে কিন্তু।কালকে তোমার খবর আছে।
(আসলে এই খেলার কোন তুলনা হয়না-রুমকীর রেগে যাওয়াটা খুব উপভোগ করে রাফী)
রাফী-আচ্ছা এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো।কালকে আমি তোমাকে নিতে আসছি।এখন বল কয়টায় আসবো?
রুমকী-মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে! তুমি কোনভাবেই আসবেনা,যদি আসো তাহোলে কালকে দেখাই হবেনা কিন্তু।
রাফী-মানে কি! তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?
রুমকী-না,শুনো আপু আমাকে নিয়ে যাবে ।কারন আপু গান করবে ছায়ানটের অনুস্ঠানে-কাজেই সাবধান।আপু যদি টের পায় তাহোলে কি হবে নিশ্চই বুঝতে পারছো।আপু স্টেজে উঠলেই আমি বান্ধবীদের কথা বলে কেটে পড়বো।এবং তোমাদের স্টলে চলে আসবো ।সো- ততক্ষন পর্যন্ত তোমাকে ধৈর্য ধরতেই হবে।
রাফী-আচ্ছা ঠিক আছে।কিন্তু আসবে কখন সেটাতো বলবে।
রুমকী -এখন বলতে পারছিনা।আসার আগে তোমাকে ফোন করে দিবো।ওকে
রাফী-ওকে, বিড়াল রুমকী, ঘুমিয়ে পড়ো।সকালে উঠতে হবে আমিও ঘুমিয়ে যাবো এখন।
রুমকী-ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিস। ক্যাট "রুমকী" কামিং টুমোরো।গুড নাইট-স্লিপ টাইট।
পরদিন ১লা বৈশাখের সকালে সবাইকে ফোন করে ৬টার মধ্যেই রাফী চলে আসে রমনা রেস্তোরার কাছে নিজেদের স্টলে।এসে দেখে মোটা মুটি সব সাপ্লাই চলে আসছে ভ্যান গাড়িতে।প্রথমে সাগর আসলো,তারপর একে একে সবাই চলে আসলো।এবং সবকিছু সাজানো শুরু হয়ে গেলো।একজন দু'জন করে গেস্ট ও চলে আসছে কেউ চা,কেউ কফি নিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে রাফী একবার গিয়ে ছায়ানটের মঞ্চের সামনে থেকে ঘুরে আসলো।কিন্তু রাফীর চোখ যাকে খুজছে তাকে পেলোনা।যখন ফিরে আসবে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মনটা খুশিতে নেচে উঠলো।জ্বল জ্বল করছে রুমকীর নামটা।
রাফী-হ্যালো,বৈশাখী শুভেচ্ছা আমার হ্রদয়ের স্পন্দন রুমকী মনিকে।
রুমকী-আমরা আসছি, ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবো।এখন কথা বলা যাবেনা,আপু আসছে।
রাফী-আমি গেইটের সামনে আছি, বাই।
ঠিক ১৩ মিনিট পর ওদের গাড়ি পার্ক করলো গেটের সামনে।দু'জন দু,দিক দিয়ে নেমে আসলো।রাফী-র দিকে চোখ পড়া মাত্রই রুমকীর চোখে মুখে ভয় দেখতে পেলো সে।রাফী দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো রুমকীর বড় বোনের দিকে।নিস্পাপ একটি হাসি দিয়ে বললো আপু কি গান করবেন আজকে?আমি আপনার ১জন ভক্ত,আমার নাম রাফী।আপু একটি হাসি দিয়ে বললো, হ্যা গান করবো আজকে।হেটে রওয়ানা দিলো মঞ্চের দিকে,
রাফী-আপনারা যান আমি একটু পরেই আপনার গান শুনতে আসছি আপু।
রুমকী অনেক জোড় করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
ওরা কিছুদুর যাওয়ার পর রাফী ফিরে চললো স্টলের দিকে।কিন্তু কেনো যেনো রুমকী-র কাছ থেকে দুরে যেতে চাইছিলোনা মনটা।অনিচ্ছাকৃত সত্বেও ফিরে আসলো; কিন্তু মন বসছিলোনা কিছুতে।৫মিনিট পর আবার গুটি গুটি পায়ে মঞ্চের দিকে হেটে চললো অবচেতন মনে। সামনের সারির একটি চেয়ারে বসেছে রুমকী।ঠিক ওর পাশে গিয়ে দাড়ালো ,অন্য দিকে তাকিয়ে রমকী-কে বললো তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেনো?রুমকী মাথা নিচু করে বললো তুমি যাও এখান থেকে।তা-না হোলে কিন্তু আমি আসবোনা।
রাফী-তুমি যদি ১০ মিনিটের মধ্যে না আসো ,তাহোলে আমি ঠিক তোমার পাশে এসে বসবো।এন্ড আই মিন ইট,ও কে।
বিষন্ন মনে ফিরে এসে ৫ মিনিটও দাড়াতে পারেনি রাফী।বিকট শব্দ গ্রনেড অথবা বোমা ফোটার আওয়াজ আসলো মঞ্চের খুব কাছ থেকে।চারিদিকে ধোয়া আর মানুষের কান্নার চিৎকার।সবাই ছুটছে নিজের জিবন বাচাতে আর রাফী ছুটছে ঠিক মঞ্চের দিকে।রাফীর মনে হোচ্ছে এই পথটুকুই পেরোতে পারছেনা সে।ধোয়ার মেঘ পেরিয়ে পৌছে দেখলো আহত আর নিহত মানুষের ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এখানে যেনো বয়ে গেছে কাল-বোশেখীর তান্ডব।রাফীর চোখ শুধু খুজছে নিস্পাপ চেহারার সেই মেয়েটিকে।যে তার অস্তিত্যের পুরোটা জুড়ে আছে।অবশেষে তাকে পেলো রক্তস্নাত হয়ে পরে আছে মাটিতে।রুমকীই........... বলে একটা চিৎকার দিয়ে কোলে তুলে নিলো নির্জিব দেহটাকে।এর মধ্যে বড় আপুও ছুটে এসেছে ।রাফী শুধু বললো আপু ওকে বাচাতেই হবে।তা-না হোলে আমিও বাচবোনা আপু।প্লিজ আপনি আমার সাথে আসুন,এই কথা বলে গাড়ির দিকে ছুটে চললো রাফী।আপু কাদছে আর অন্ধের মত অনুসরন করছে।ঢাকা মেডিকেলে এসে ইমার্জেন্সিতে টেবিলে শুইয়ে দেওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যায় রাফী।এরপর শুধুই দুঃস্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন।
রুমকী ২ মাস বিদেশে চিকিৎসার পর হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে ফিরে আসলেও।সবচেয়ে আপন সঙ্গীকে দুরে সরিয়ে দিলো।কিছুতেই সে রাফীর সাথে দেখা করবেনা।রাফী প্রতিদিন আশা নিয়ে যা্য় আর নিরাশ হয়ে ফিরে আসে।অনেক চেস্টার পর দেখা করতে রাজি হয় একটা শর্তে।রাফীর ধারনা ছিলো দেখা করার পর রুমকী-র সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবে।রাফী সেদিন শুধু একটা কথাই বার বার বলেছিলো।যদি এটা রাফীর সাথে হোতো তাহোলে রুমকী কি করতো।কিন্তু রুমকী শুধু বলেছিলো আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি-না।তুমি শুধুই আমার অতীত...............।রুমকীর কোলে মাথা রেখে শুধুই কেদেছে রাফী।কিন্তু রুমকী-র সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি তাকে।রুমকীরা শত কস্ট পেলেও সেই কস্টের ভাগ কাউকে দিতে চায়না।সেই থেকে রাফীর একাকী পথ চলা....।
সেই থেকে রাফী লড়ছে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে।জানেনা এই যুদ্ধের পরিনতি কি?কিন্তু রাফী আর কোন রুমকী-র স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে দেবেনা এই প্রতিজ্ঞা করে আজো লড়ছে।সুন্দর স্বপ্নের মত বাংলাদেশের আশায়।
অ.ট. আশে পাশের চরিত্রগুলো নিয়ে অন্য কোথাও হয়তো লিখবো।কল্পনা এবং বাস্তবতা মিলিয়েই এটুকু লিখতে পারলাম।গতকাল রাতে কেদেছি আর এ-লেখাগুলোই লিখতে পেরেছি।ভুলগুলো, শুদ্ধ দৃস্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
শুভ নববর্ষ।
ধন্যবাদ,
নিউ ইয়র্ক
১৩ এপ্রিল-২০১৩।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:২৩