আসাদ জোবায়ের
( সাপ্তাহিক ২০০০ | প্রতিবেদন | শুক্রবার 25 ফেব্রুয়ারি 2011 ১৩ ফাল্গুন ১৪১৭)

বাংলাদেশে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। এ বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা ‘ইশারা ভাষা’। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের নিজস্ব ভাষা এ ইশারা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ইশারা ভাষা দিবস পালন ইত্যাদির দাবি ওঠে। সরকারিভাবেও আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত আশ্বাসের পর্যায়েই থেকে যায়।
ইশারা ভাষাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ভাষা দাবি করা হলেও এর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৭৫৫ সালে ফ্রান্সে। বর্তমানে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে আমেরিকায় ব্যবহৃত ইশারা ভাষা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তখনকার ফরাসি ও আমেরিকান ইশারা ভাষার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়, যা বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুসংগঠিত ইশারা ভাষা। বাংলাদেশে ব্রিটেনের ইশারা ভাষার রীতিকে অনুসরণ করা হয়। এদেশে ইশারা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে সরকারি মূক ও বধির বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন মিরপুরের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান এ ব্যাপারে সাপ্তাহিক ২০০০-কে বলেন, ‘সে সময় ওই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে ইশারার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করত। এরপর ১৯৯৪ সালে সরকারিভাবে ‘ইশারা ভাষার অভিধান’ প্রকাশ করা হয়। এটিই বাংলাদেশে প্রথম ইশারা ভাষার বই, যার মাধ্যমে এ ভাষায় কিছুটা শৃঙ্খলা আসে। বর্তমানে বেশ কিছু এনজিও এ ভাষার উন্নয়ন এবং একটি ফর্মে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছে।’
বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি), আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড ও ক্রিস্টোফেল ব্লাইন্ড মিশনের সহযোগিতায় ইশারায় বাংলা ভাষা তৈরির কাজ করছে। ইনস্টিটিউটের প্রয়াত শিক্ষক ড. নিরাফাত আনাম এই কাজের নেতৃত্ব দেন। সারাদেশের শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও নিরক্ষর ইশারাভাষী ব্যক্তি, ইশারা ভাষার প্রশিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা গবেষক, উন্নয়নকর্মী মিলে একটানা সাত বছর কাজ করে শব্দমালা তৈরি করা হয়। এর আগে কাজ চালানোর মতো কিছু বাংলা ইশারা শব্দমালা তৈরি করে দিয়েছিল জাতীয় বধির সংঘ।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ইশারা ভাষার স্বীকৃতি এবং ১ ফেব্রুয়ারিকে ইশারা ভাষা দিবস হিসাবে পালনে সরকারি ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে ‘সোসাইটি অব দ্য ডিফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্সসহ (এসডিএসএল) বেশকিছু সংগঠন। ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর এক মতবিনিময় সভায় প্রথম এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি ওঠে। এরপর ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি এ দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।
আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত বছর ২৬ মে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ইশারা ভাষা দিবস ঘোষণার একটা প্রস্তাবনা উত্থাপন করে মন্ত্রিপরিষদে। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস কেটে গেলেও মন্ত্রিপরিষদ সেদিকে এখনও সুনজর দেয়নি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইশারা ভাষার ব্যাপারে বেশকিছু ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল সব টেলিভিশন চ্যানেলে ইশারা ভাষায় সংবাদ প্রচার করার নির্দেশনা। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দুপুর ২টা ও সন্ধ্যা ৭টার সংবাদ এবং দেশ টিভিতে সন্ধ্যা ৭টার সংবাদ ইশারা ভাষায় প্রচার করা হয়। এছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা মানছে না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রেরণা’র ইশারা ভাষার দোভাষী আহসান হাবীব বলেন, ‘ইশারা ভাষার স্বীকৃতি ও দিবস পালনের দাবি ও আশ্বাস ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে স্তিমিত হয়ে আসছে। এ বছর গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী কোনো ঘোষণা কিংবা আশ্বাস দিলেন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সাইফুল মালেক বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ভাষার স্বীকৃতি জরুরি। কারণ এটা তাদের অধিকার। এছাড়াও সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি ২০১৪ সালের মধ্যেই সব শিশুকে স্কুলগামী করতে হয় তাহলে স্কুলগুলোতেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এ ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মিরপুর বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান বলেন, বেশকিছু এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গবেষণা ও কার্যক্রমের দ্বারা ইশারা ভাষা বর্তমানে একটা সুশৃঙ্খল রূপ পাচ্ছে। এখন দরকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা। এ ভাষা তো ২৬ লাখ বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীর মাতৃভাষা। তাহলে কেন এ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হবে না? তিনি আরো বলেন, শুধু প্রতিবন্ধী নয়, ওই প্রতিবন্ধীর আশপাশের মানুষদেরও ইশারা ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। তারা যে প্রতিবন্ধী নয় বরং তারা ভিন্ন একটি ভাষার মানুষ সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর ১ ফেব্রুয়ারিকে যদি ইশারা ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাহলে এ ভাষার মানুষগুলো নিজেদের আর বঞ্চিত মনে করবে না।
আরো প্রতিবেদন দেখুন
স্টাফ রিপোর্টার
সাপ্তাহিক ২০০০
zobayrasad@yahoo.com