বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগ্রহ সবারই কমবেশি আছে। সঠিক তথ্য না জানার কারণে গোলমাল বাধে। অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। তবে জানা থাকলে যাওয়া সহজ হয়
১. সিদ্ধান্ত
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ‘অর্থ’ ও ‘মেধা’ দুটোই দরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে অধ্যয়নের যোগ্য কি না। বিদেশে অবস্থান করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেই কেবল বিদেশে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা করা উচিত। বৃত্তিপ্রাপ্তির মাধ্যমেও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পড়াশোনার খরচ না লাগলেও থাকা-খাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচ বহনের সামর্থ্য থাকতে হবে। বৃত্তি নিয়ে যাবেন, না নিজ খরচে যাবেন, তা নিশ্চিত হয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নিন।
অনেকে শুধু কাজের জন্য বিদেশে পড়তে যেতে চান। আগে সিদ্ধান্ত নিন, আপনি আসলেই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে যাচ্ছেন কি না?
২. বিষয় ও দেশ নির্বাচন
চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দেয় এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিষয় নির্বাচনে সতর্কতাও জরুরি। কারণ বিদেশে চাহিদা আছে এমন অনেক বিষয়ের চাহিদা আমাদের দেশে তেমন নেই। মানসম্মত শিক্ষাদান করে, তুলনামূলক টিউশন ফি কম এমন বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করাই ভালো। শিল্পসমৃদ্ধ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে তুলনামূলক বেশি অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায়। আর দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীল এবং জাতিগতভাবে সহনশীল এমন দেশই নির্বাচন করা উচিত।
৩. তথ্য সংগ্রহ
কোথায় কেমন খরচ হয়, পার্টটাইম চাকরির সুযোগ কতটুকু তা অনলাইনের মাধ্যমেও খোঁজ নিতে পারবেন। কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ কেমন তা আগে থেকেই জেনে নিলে পরবর্তী সময়ে হয়রানি হতে হবে না। অভিজ্ঞদের কাছ থেকেও তথ্য-সহযোগিতা ও পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। বিদেশি অনেক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক অফিস বাংলাদেশে আছে, যারা শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করে থাকে। যদি শিক্ষার্থী মনে করেন, নিজে নিজে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, তাহলে বিশ্বস্ত কোনো কনসালটেন্সি ফার্মের সহযোগিতা নিতে পারেন। তবে সতর্ক থাকবেন, ফার্মটি কোনো তথ্য গোপন কিংবা অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে কি না।
৪. কাগজপত্র
দূতাবাস কিংবা সংশ্লিষ্ট ভিসা সেন্টার থেকে ‘স্টাডি পারমিট অ্যাপ্লিকেশন ফরম’ সংগ্রহ করতে হবে। প্রস্তুত রাখুন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ও নম্বরপত্র (কোনো সনদ ইংরেজিতে না থাকলে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে অনুবাদ করতে হবে), পাসপোর্ট (আবেদনের দিন থেকে অন্তত পরের এক বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকতে হবে), জন্মনিবন্ধন সনদ, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, সার্টিফিকেট ব্যাংক সলভেন্সি বা স্পন্সর-সংক্রান্ত কাগজপত্র, ভাষা দক্ষতা সনদ (আইইএলটিএস, টোফেল ইত্যাদি), পুলিশ ক্লিয়ারেন্স (প্রার্থীর নিজ এলাকার থানা থেকে সংগ্রহ করতে হবে), পাসপোর্ট সাইজের ছবি (সম্প্র্রতি তোলা) ইত্যাদি।
৫. ফান্ড ও স্পন্সর
কাঙ্ক্ষিত দেশে থাকা-খাওয়া ও টিউশন ফির জন্য শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা থাকতে হবে। প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের শেষ এক বছরের লেনদেনের কাগজপত্র অর্থাৎ ব্যাংক স্টেটমেন্ট যুক্ত করতে হবে ভিসা আবেদনপত্রের সঙ্গে। স্পন্সরের ক্ষেত্রে মা-বাবা ছাড়াও বৈধ অভিভাবকদের সহযোগিতা নিতে পারেন। তবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে অভিভাবক বানিয়ে ভুয়া স্পন্সর সংগ্রহ করে ভিসা আবেদন করতে নিষেধ করে ভিসা সেন্টার কর্তৃপক্ষ। ভুয়া কাগজপত্র প্রমাণিত হলে ভিসা প্রত্যাখ্যান ছাড়াও আইনি ঝামেলার আশঙ্কা আছে। এ জন্য কোনো মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
৬. ভাষা দক্ষতা ও কোর্স
ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয় এমন প্রায় সব দেশেই উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস স্কোর অন্তত ৫ দশমিক ০ থেকে ৬ দশমিক ০ থাকতে হয়।
আইইএলটিএস না থাকলেও ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এ ক্ষেত্রে সে দেশে পেঁৗছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইংরেজি ভাষা দক্ষতা’-বিষয়ক বিভিন্ন মেয়াদের ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়।
এটি ব্যয়বহুল হওয়ায় অভিজ্ঞরা বাংলাদেশ থেকেই আইইএলটিএস স্কোর নিশ্চিত করে বিদেশে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার টোফেল স্কোর চেয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে টোফেল করা থাকতে হবে।
৭. ভর্তি আবেদন
উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে সাধারণত বছরে দুই থেকে চারটি সেশনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকে। অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যসহ অনুরোধ পাঠালে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাডমিশন অফিস’ থেকে ডাকযোগে শিক্ষার্থীর ঠিকানায় ‘অ্যাপ্লিকেশন ফরম’ ও ‘প্রস্পেক্টাস’ পাঠায়। শিক্ষার্থী চাইলে অনলাইনেও ভর্তি আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে পারে। আবেদন ফি প্রদানের ব্যাংক রসিদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যুক্ত করে আবেদন পাঠাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাডমিশন অফিস’ বরাবর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর যোগ্য শিক্ষার্থীদের ‘অফার লেটার’ বা ‘এক্সেপটেন্স লেটার’ পাঠিয়ে থাকে।
৮. বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা
বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে (http://www.moedu.gov.bd) বৃত্তিসংক্রান্ত নোটিশ যুক্ত করা হয়। বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভিসা আবেদনের ফরমে বৃত্তি প্রদানকৃত প্রতিষ্ঠানের নাম, সেমিস্টার প্রতি বৃত্তির অঙ্ক ও মেয়াদ উল্লেখ করতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটেও বৃত্তিসংক্রান্ত তথ্য দেওয়া থাকে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচন করে।
৯. ভিসা আবেদন
অফার লেটার হাতে পাওয়ার পর ভিসার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে আবেদন করতে হবে। এ কাজটি শিক্ষার্থী নিজেই করতে পারবেন। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ভিসার আবেদন করতে হয় দূতাবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও ভিএফএস গ্লোবাল পরিচালিত ভিসা সেন্টারে। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা বেশি যায় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডায়। এসব দেশের ভিসাসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই সাইটগুলো থেকে- http://www.vfs-au.com.bd,ww w.vfs-uk-bd.com,ww w.vfs-canada.com.bd । অনেক দেশে ভিসা ইন্টারভিউর মুখোমুখি হতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রার্থীর ইংরেজিতে স্পষ্ট এবং স্বাভাবিকভাবে কথা বলার দক্ষতা থাকতে হবে।
১০. বিদেশে পৌঁছার পর
ভিসাপ্রাপ্তির পর ভিসার মেয়াদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষা সমাপ্তের আগমুহূর্ত পর্যন্ত ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করে থাকে।
কোনো শিক্ষার্থী যদি নিয়মিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেন কিংবা পড়াশোনা ছেড়ে দেন, সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভিসার মেয়াদ বাড়াবে না। তা ছাড়া বিদেশে আবাসন কিংবা পার্টটাইম চাকরি পেতে কারো সহযোগিতার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবাসন সুবিধা কিংবা চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রতারণা করে। আর প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। এসব মেনে চলতে হবে।
১১. অভিবাসনের সুযোগ
অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমান শুধু উচ্চশিক্ষার জন্যই নয়, ভবিষ্যতে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত দেশগুলো চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে বিদেশি ডিগ্রিধারীদের অভিবাসনের সুযোগ দিয়ে থাকে। দেশে বসেই আপনি অভিবাসনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এসব দেশের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকে। যেসব বিষয়ের ডিগ্রিধারী কিংবা পেশাজীবীরা অভিবাসনের সুযোগ পায়, তা ওয়েবসাইট থেকে জেনে নিতে পারেন। তবে বিভিন্ন বিষয়ের যোগ্যতার ওপর পয়েন্ট নির্ধারণ করে অভিবাসন ভিসা দিয়ে থাকে কর্তৃপক্ষ।
১২. দেশে ফেরার পর
পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পর প্রথম কাজটি হচ্ছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত ডিগ্রির সঙ্গে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত ডিগ্রির সমতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বরাবর আবেদন করা। কাগজপত্র যাচাই করে ইউজিসি আবেদনকারী শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশে প্রচলিত কোর্সের মধ্যে যে কোর্সটি অর্জিত কোর্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে কোর্সের সমমানের সনদ দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কম্পিউটিং’ কিংবা ‘ইনফরমেশন সিস্টেমস-এ তিন বছরের অনার্স কোর্স করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর সার্টিফিকেটকে তিন বছর মেয়াদি ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর সমমান দেওয়া হয়।