নিষাদের মা অর্থাৎ আমার স্ত্রী নিলুফার মারা গেছে একটা দুর্ঘটনায়। অদ্ভুত সে দুর্ঘটনা! আমাদের বাড়ির ছাদটা বর্ষাকালে শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। ছাদের রেলিং এর একটা অংশ ভাঙা। কতবার নিলুফারকে বলেছি, ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়ার সময় সাবধান থাকবে। কিন্তু সাবধান নিলুফার হয়নি, তারই প্রমান দিয়েছে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে।
নিষাদকে অন্য কি কাজে ব্যস্ত রাখা যায় ভাবতে ভাবতে প্রথমেই মাথায় এল ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার প্রশিক্ষন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। কিন্তু ছেলের খেলাধুলার প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ নেই। আর মায়ের মৃত্যুর পর তো সেটা আরও কমেছে। ভেবে ভেবে ঠিক করলাম ছেলেকে মুভি দেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। কিন্তু সে কেমন মুভি দেখতে পছন্দ করবে?
নিষাদের বয়স তখন ১২, বয়ঃসন্ধিকাল দোরগোড়ায়। এ বয়সী একটা ছেলের কি ধরনের মুভি দেখতে ভাল লাগবে? ঠিক করলাম বেশি বেশি এনিমেটেড মুভি দেখাব তাকে।
কিন্তু অফিস কলিগ সানাউল্লাহ ভাই বললেন, “আপনার ছেলেকে হরর মুভি দেখান হাসান ভাই। এ বয়সী বাচ্চাদের ভূত প্রেত টাইপের মুভি দেখতে বেশি লাগে” সানাউলাহ ভাই আমাকে একটা হিন্দি হরর মুভির নাম সাজেস্ট করে দিলেন। মুভির নামঃ ছায়া। হিট করা মুভি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই ছেলে মুভিটা পছন্দ করবে তো? প্রথম মুভিই যদি ভাল না লাগে তাহলে হয়ত আর দেখতে নাও চাইতে পারে”।
সানা ভাই বললেন বললেন, “সেইটা মাথায় রেখেই তো বলতেছি। দেখান নিয়ে গিয়ে। দেখবেন, ছেলে আপনার হরর মুভির ভক্ত হয়ে যাবে”।
আমার বাড়ির কাছেই একটা ডিভিডি স্টোর আছে। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু ঢু মারলাম। দোকানের নামটাও ভারী অদ্ভুত। স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার। আমরা সাধারণত ডিভিডি বা সিডি ক্যাসেটে দাগ পড়ে গেলে বলি স্ক্র্যাচ পড়েছে। কিন্তু ডিভিডির দোকানের নাম স্ক্র্যাচ হবে কেন? এই দোকানের সব সিডি নিশ্চয়ই স্ক্যাচ পড়া নয়! নামের ব্যাক গ্রাউন্ড স্টোরিটা জানা দরকার, একদিন দোকানের মালিকের সাথে কথা বলতে হবে।
আমি ছবির নাম বলার পর এক কর্মচারী মুভিটা খুজে দিল। অবশ্য খুজে পেতে একটু সময় লাগল। ২০০৩ সালের মুভি, মোটামুটি পুরনো বলা যায়। ইয়াং জেনারেশন নতুনের পূজারী, পুরাতন নিয়ে মেতে থাকার সময় কই ওদের?
ডিভিডি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নিষাদের রুমে উকি দিয়ে দেখি নিষাদ গালে হাত দিয়ে তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে বই খোলা। তবে যে কেউ দেখেই বলতে পারবে তার মানসিক অবস্থান এখন অন্য জগতে, বইয়ের ভেতর নয়। আমি ডাকলাম, "নিষাদ"।
নিষাদ জবাব দিলনা। আমার দিকে তাকাল না। তবে এর মানে এই নয় যে সে আমার ডাক শুনতে পায়নি। আমার ধারনা দুই তিন বার ডাকার আগে সে ইচ্ছে করেই জবাব দেয়না। আরেক বার ডাকলাম, "নিষাদ"!
এবার উত্তর দিলনা, কিন্তু আমার দিকে ঘুরে তাকাল।
আমি মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, "তোমার জন্য আমি একটা হরর মুভি এনেছি নিষাদ' আজ থেকে আমরা একসাথে বসে মুভি দেখব।
নিষাদ নির্বিকার। সে হালকা করে মাথা ঝাঁকিয়ে আবার বইয়ের দিকে নজর দিল।
রাতে খাওয়ার পর দুজনে বসে গেলাম ড্রয়িং রুমে ডিভিডি প্লেয়ার এর সামনে। মুভির শুরুর ১০ মিনিট না যেতেই নায়ক জন আব্রাহাম আর নায়িকা তারা শর্মার উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়ে গেল। বাবা-ছেলে একসাথে বসে দেখার মোটেও উপযোগী নয়। সানাউল্লাহ ভাইয়ের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? তিনি এই মুভি দেখতে রিকমেন্ড করলেন কী করে? অবশ্য আরও মিনিট দশেক পর মুভির ক্লাইমেক্স শুরু হতেই মজা পাওয়া শুরু করলাম।
একটা গ্রামে মানুষ কোন একটা রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। নায়িকা তারা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও গেল সেখানে। এবং দুদিন বাদের নায়ক খবর পেল নায়িকা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এইবার আমি কিছুটা আঁচ করতে পারলাম কেন সানাভাই আমাকে বলেছেন এই মুভিটা দেখতে বলেছেন!
এর পরের ঘটনা গুলো রীতিমত গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়ার মত। নায়িকা তারা শর্মা এখন তার স্বামীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। নায়ক জন আব্রাহাম একজন ডাক্তার। নায়িকা হাসপাতালের মৃতপ্রায় রোগীদের শরীরে প্রবেশ করে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
মুভিটা খুব একটা ভাল লাগেনি আমার কাছে, নিষাদের কাছেও লাগেনি। কিন্তু দেখলাম নিষাদ হরর বিষয়টা বেশ ফিল করতে শুরু করেছে।
পরদিন যখন আমি "নায়না' নামে আর একটা হরর মুভি নিয়ে হাজির হলাম দেখলাম নিষাদের চেহারা অনুভূতিহীন হলেও চোখদুটো চক চক করে উঠেছে। বুঝলাম কাজ হয়েছে! এভাবে ভূত, ১৯২০, ডরনা মানা হ্যায় সহ বেশ কিছু হরর হিন্দি মুভি দেখা হয়ে গেল। এবার শুরু করলাম ইংলিশ মুভি দেখা। একসময় ঝুকে পড়লাম ফ্রেঞ্চ মুভির প্রতি। ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা দুজনের জন্যই নেশায় পরিনত হল।
কোনদিন একটা হরর মুভি দেখা না হলে দুজনেরই আর ঘুম আসে না। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি এই হরর মুভি দেখার অভ্যাসটা আমার জন্য মানসিক বিপর্যয়ের বীজ হয়ে দাঁড়াবে।
***
৩ বছর পর একদিন...
গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিল অফিসে, ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছি আজ। ড্রাইভারটা ছুটি নিয়েছে কিছুদিনের জন্য। ভাবছি ব্যাটাকে ছাঁটাই করে দেব। দুদিন পর পর এই সমস্যা- সেই সমস্যার কথা বলে ছুটি নেয়। বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়ার কোন অর্থ হয় না।
আজ আমি আর নিষাদ "হাই টেনশন' নামের একটা ফ্রেঞ্চ মুভি দেখব। এটাও যথারীতি কলিগ সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাজেশন। মুভিতে কিছু যায়গায় অতিরিক্ত ভায়োলেন্স আছে। নিষাদের ভাল না লাগলে টেনে দিতে বলেছেন উনি। আমি মনে মনে হাসলাম। নিষাদের ভায়োলেন্স দেখার ক্ষমতা সম্পর্কে সানাউল্লাহ ভাইয়ের কোন ধারনাই নেই। জম্বি মুভিগুলোতে হাড় মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি যখন ভয়ে শিউরে উঠি, তখন দেখি নিষাদ আশ্চর্য এক কৌতূহল নিয়ে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
স্ক্র্যাচ ভিডিও সেন্টার এর সামনে গাড়ি থামিয়ে হাই টেনশনের একটা ডিভিডি কিনে নিলাম। ভিডিও সেন্টারের ঠিক পাশ দিয়েই একটা সরু রাস্তা আছে। ডিভিডি হাতে এসে গাড়িতে উঠতে যাব তখন রাস্তার দিকে নজর গেল। একটা মেয়েকে দেখছি সরু রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজ। কে ওটা? মমতা না?
মমতা আমার বাড়ির সামনের বাড়িতে থাকে। সম্ভবত অনার্স পড়ছে মেয়েটা, নিলুফারের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। নিলুফারের ছাঁদ থেকে পরে যাওয়ার দৃশ্যটা সে দেখে ফেলেছিল। সেই থেকে একটা মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে। অ্যাবনরমাল আচার আচরন করছে।
কিন্তু মেয়েটি ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? এদিকটাতে মানুষজন যায় কম। পরিত্যক্ত নিচু এলাকা, বর্ষা এলেই পানি ওঠে, তেমন কোন বসতিও নেই। একটা বড় জলাশয় আর পুরনো একটা কবরস্থান আছে। আজেবাজে নেশাখোর ছেলেপিলে সব আড্ডা দেয়। মমতাকে পেলে ওরা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে খাবে। আমি পা বাড়ালাম। মেয়েটিকে থামান দরকার!
মমতা হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। আমি দু তিন বার নাম ধরে ডাকলাম। সে ফিরে তাকাচ্ছে না। সামনেই একটা ডোবা, মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পরে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না তো? আমি আরও দ্রুত পা চালালাম। মমতা হঠাৎ দৌড় লাগাল। আমি বুঝতে পারছিনা কী করা উচিত। রাত হয়ে যাচ্ছে, এদিকে মানুষের চলাচল একেবারেই কম। মনে হচ্ছে আজ নেশাখোর ছেলেগুলোও আড্ডা দিচ্ছেনা। মেয়েটিকে এভাবে এখানে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? মমতার আকর্ষণীয় ফিগার ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। চকিতে একটা সম্ভাবনা খেলে গেল মাথায়। বিরান এলাকা, কাছে ধারে কেউ নেই। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন, কিছু একটা ঘটে গেলে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবেনা। আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আবিস্কার করলাম, পশুর শক্তি। প্রতিটি পুরুষের মাঝে একটা পশুর বাস, আমার ভেতরের পশুটা জেগে উঠেছে। আমিও দৌড় লাগালাম মমতার পেছন পেছন।
মেঘের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জোনাকীরা সব এক সাথে জ্বলে উঠে পৃথিবীকে আলোকিত করার বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে । দূর থেকে ভেসে আসা নৈঃশব্দ্য রজনীর নিঃসঙ্গতার করুণ বিলাপ মনে ভয় ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। তবুও মমতার পেছনে পেছনে আমি এমন ভাবে দৌড়াচ্ছি, যেন আবেগহীন, অনুভূতিহীন পাথরের এক মূর্তি। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি? কেন মমতা একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না? ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই আমার মনে জাগছে না! দৌড়ে চলেছি দ্বিধাহীন চিত্তে অজানার উদ্দেশ্যে। আমাকে এক নেশায় পেয়ে বসেছে, অন্যরকম নেশা।
মমতা হঠাৎ দাঁড়াল। তার ঠিক দুই কদম পেছনে আমিও থমকে দাড়ালাম। ভাসমান কালো মেঘের ফাঁক গলে একটু আধটু জ্যোৎস্না গলে পড়ছিল। সেই আলোয় দেখলাম আমরা পুরনো কবর স্থানে এসে পরেছি। কবরস্থানের পাশেই একটা ছোট বাঁশঝাড়। বাঁশগাছগুলোর ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে। অনেকদিন পর দৌড়েছি, হাঁপাচ্ছি কুকুরের মত।
মেঘ ফুঁড়ে হঠাৎ চাঁদটা বেরিয়ে এল। পাতলা কামিজ পড়েছে মমতা, বুকের ওড়নাটা দৌড়ানোর সময় গায়েব হয়েছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটির অপরুপ দেহসৌষ্ঠব সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। আমার শরীর শিহরিত হল । মনে হচ্ছে অপার্থিব কোন এক অনুভূতি শক্তি জমা হচ্ছে আমার মাঝে! ভেতরে ভেতরে ক্ষীণ কম্পন শুরু হয়েছে। হঠাৎ মমতা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঁট টিপে হাসছে। ওকি আহবানের হাসি? আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। ঝাঁপিয়ে পরলাম ওর উপর। মমতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে।
পিঠের নিচে আলগা মাটির মত লাগছে। সেদিকে তখন খেয়াল করার মত ধৈর্য আমার নেই। দুহাত চলে গেছে প্রয়োজনের খোঁজে, নাকে মুখে গোগ্রাসে গ্রহন করছি নারীমাংসের স্বাদ। মাতালের খেলায় মত্ত আমি। মমতা বাধা দিচ্ছেনা মোটেও। বিকারগ্রস্ত একটা মেয়ে জানেনা এই খেলার পরিনাম। হঠাৎ পিঠের কাছে নরম কিছু একটার স্পর্শ পেয়ে থমকে গেলাম আমি। মনে হচ্ছে মানুষের হাত, কি ভীষণ ঠাণ্ডা! পিঠের নিচে কি কবর ফুঁড়ে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে নাকি! ভয়ের একটা অনুভূতি নামল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমি মমতাকে ছেড়ে উঠে বসলাম।
কোথায় হাত? আমার মনের ভুল হবে হয়ত। অবশ্য কাছাকাছি একটা নতুন ঝকঝকে একটি কবর দেখতে পারছি! একেবারেই নতুন কবর! মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগেই কাউকে দাফন করা হয়েছে আমি যতদূর জানি এদিকটাতে এখন আর কাউকে কবর দেওয়া হয়না। তাহলে এটা কার কবর? আরও সামনে তাকাতেই দেখলাম ছোট একটা গর্ত। কবরে কেউ গর্ত করে রেখেছে! গর্তের কাছে গিয়ে উকি দিতেই দেখলাম দুটো কুকুর কিছু একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে । মানুষের পা-এর মতো লাগছে! সেই পা থেকে মাংস ছিড়ে মজা করে চিবোচ্ছে লাশ খেকো কুকুরদুটো।
এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল–সেই আলোয় দেখলাম কবরের অন্ধকারে এক সুন্দরী নারী শায়িত, তার গালদুটি সুডৌল, ঠোঁটদুটি লাল! নিলুফার! তাকিয়ে আছে আমার দিকেই! তার চোখ দুটোতে কষ্ট! আচমকা মৃত নিলুফার যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল!
আমি আতংকে শিউড়ে উঠে দু পা পিছিয়ে এলাম! হঠাৎ বাতাস ছাড়াই কবরের পাশের বাশের ঝোপটি এলোমেলোভাবে দুলতে শুরু করল! ভয়ে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে । ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্বস্তি! মমতার দিকে ফিরে তাকালাম। কী আশ্চার্য! মমতা কোথাও নেই! সে যেখানে দাড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে একটি কুৎসিত দর্শন কুকুর দাড়িয়ে আছে । আদমখোর সেই কুকুর বড় বড় চোখে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! কুকুরটাকে আগে কখনো না দেখলেও তার ভয়ংকর চোখ দুটো আমার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে । ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে । আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম । কুকুরটিও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে ! আমি সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি অথচ কেন যেন মনে হচ্ছে একচুলও এগুতে পারছি না।
হঠাৎ আমার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল! চমকে দেখি আমার পাশে নিষাদ দৌড়াচ্ছে! নিষাদ এখানে এল কেমন করে?
“আমাকে বাঁচাও নিষাদ” আমি অনুনয় করলাম ছেলের কাছে।
নিষাদ কিছু বলছে না। ভালভাবে খেয়াল করতেই দেখলাম আসলে এটা নিষাদ নয়! নিষাদের শরীর কিন্তু মুখটা দেখতে কুকুরের মত। নিষাদরুপী একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে! কুকুরটা আমার কাধ ধরে ঝাঁকাল, “কি হয়েছে ড্যাড!”
আমি প্রানপনে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিষাদ আবার জিজ্ঞেস করল, “ড্যাড, কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
আমার ঘোর কেটে গেল। নিজেকে আবিস্কার করলাম ড্রয়িংরুমে, টিভি স্ক্রিনের সামনে। সিনেমা চলছে "হাই টেনশন', একটা খুব ভায়লেন্সের দৃশ্য দেখাচ্ছে!
একটা ঢোঁক গিলে বললাম, “কি হয়েছিল আমার?”
“তুমি সিনেমা দেখতে দেখতে হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরন শুরু করেছিলে! উল্টা পাল্টা বকছিলে!” নিষাদ বলল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে আসলাম। শরীরটা ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। আর হরর মুভি দেখাও বন্ধ করতে হবে। মনের উপর খুব বেশি চাপ ফেলছে!
বেডে শুয়ে খেয়াল করলাম নিষাদ এসে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ভঙ্গীটা আমার খুব পরিচিত। এটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সে। এর মানে হচ্ছে নিষাদ কিছু একটা বলতে চায়, অনুমতি দরকার!
অনুমতি দিলাম, “কি বলবে বল, নিষাদ!”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পোয়েম”।
আমি হাসলাম। আমিও স্টুডেন্ট লাইফে ভাল ইংরেজি কবিতা লিখতাম। এই প্রতিভা নিষাদ জেনেটিকেলি পেয়েছে। বললাম, “তুমি পড়ে শোনাবে নাকি আমি পড়ব?”
“আমিই পড়ে শুনাই?”
“শুনাও!”
নিষাদ শুরু করল...
My Mother seems so far away from me,
On that beautiful white shore across the sea.
Yet I remember love’s soft glow upon her face,
And the feel of her touch and tender embrace.
When I am weary from the burdens I’ve borne,
And the path is unclear and I feel so forlorn,
I remember her loving support was always near,
And her advice made the path ahead seem clear.
When I feel there is no one who seems to care,
Or when the heartache seems too hard to bear,
I remember how she always stood by my side,
And would tenderly wipe away the tears I cried.
When there are moments of great joy and pride,
And I wish my Mother was standing at my side,
I remember she saw more than I thought I could be,
And know I owe my triumphs to her belief in me.
When I reminisce about the things she used to say,
And I miss her and think she is so far away,
I remember what she gave lives on through me,
And one day I’ll see her on the shore across the sea.
কবিতা শেষ করে নিষাদ আর দাঁড়াল না। ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এই কবিতা কেন লিখেছ তুমি?”
নিষাদ জবাব দিলনা। রুমের দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল।
জেনির সাথে একবার কথা বলা দরকার। নিষাদকে নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। জেনি আর আমার বিয়েটা আটকে আছে ওর কারনেই। নিষাদ ব্যাপারটা কীভাবে নেবে সেটা না বুঝে আমি ফাইনাল কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা।
জেনিকে ফোন দিলাম। সে রিসিভ করতেই বললাম, “জেনি একটা সমস্যা হয়েছে”।
জেনি বলল, “কি সমস্যা?”
“মনে হচ্ছে নিষাদ তার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে আরও বেশি কিছু জানে!”
“মানে? অসম্ভব!” জেনির কণ্ঠে অবিশ্বাস টের পেলাম।
“হ্যা... সে আজ একটা কবিতা লিখেছে তার মাকে নিয়ে। কবিতার ভাষা সন্দেহজনক!”
দুজনে এ বিষয়ে মিনিট পাঁচেক কথা বলে ফোন রাখতে যাচ্ছি তখন দরজায় নকের শব্দ হল।
আমি বললাম, “ভেতরে এস নিষাদ”।
নিষাদ ভেতরে এলনা, দরজা একটু ফাঁক করে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে “কবিতাটা আমি লিখিনি ড্যাড, বেলিন্ডা স্টলার নামে একজন মহিলা লিখেছেন” বলেই চলে যেতে উদ্যত হল।
আমি ডাকলাম, “নিষাদ! দাড়াও”।
নিষাদ দাঁড়াল।
ভেবেছিলাম কেন মিথ্যে বলেছে তা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু জানি জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবেনা! এইধরনের আচরন নিষাদ হরর মুভি দেখে দেখে শিখেছে। আমি বললাম, “কাল বিকালে তোমার কোন কাজ আছে?”
নিষাদ ঘুরে তাকাল, “না কাজ নেই। কেন?”
“কাল আমি আগে আগে অফিস থেকে ফিরব”।
“নতুন মুভি দেখার জন্য?”
“নাহ! কালকে লং ড্রাইভে যাব। অনেক দূরের পথে!”
নিষাদকে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সে বিনা বাক্যব্যয়ে আমার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেটাকে আর হরর মুভি দেখানো যাবেনা! অন্য কিছুতে আগ্রহী করে তুলতে হবে!
***
আমি সাধারণত কাউকে কথা দিলে সেটা রাখার আপ্রান চেষ্টা করি। অফিস থেকে তাই আজ আগেই ফিরেছি। নিষাদকে নিয়ে লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে গেছি লং ড্রাইভে। আমরা যাচ্ছি ময়মনসিংহের হোতাপাড়ার দিকে। উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি কিছুটা সময় কাঁটিয়ে আসা। এতে করে মাথাটা একটু হালকা হবে। নিষাদকে ঘুরাঘুরি করা, বাইরের জিনিস দেখা- এসবের প্রতি আগ্রহী করে তোলা গেলে হয়ত হরর মুভি দেখার নেশাটা একটু কাটানো যাবে।
বিকেলের নরম রোদ পড়েছে রাস্তায়। দুধারে ঘন জঙ্গল। এদিকটাতে জনবসতি খুব একটা নেই। জঙ্গলের একপাশে দেখলাম একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। মনে হচ্ছে এই রাস্তায় লোক-চলাচল বিশেষ হয় না। খুব ভাল লাগল আমার। ড্রাইভারকে বললাম রাস্তার ধারে সাইড করে গাড়িটা থামাতে।
“এখানে থামাচ্ছ কেন ড্যাড?” নিষাদের প্রশ্ন।
“দেখছ না কি সুন্দর জায়গা। চল একটু নেমে ঘুরে দেখি”।
ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে দুজনে নেমে এলাম। মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে এলাম বেশ খানিকটা পথ। এখান থেকে জঙ্গলটা ক্রমশ ঘন হয়েছে। রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে রাখা গাড়িটা আর চোখে পড়ছে না।
“তোমার ভাল লাগছে না যায়গাটা, নিষাদ?”
“না” নিষাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কেন নিষাদ?”
“আমার ভয় করছে”।
দিনরাত হরর মুভি দেখা নিষাদের মুখে ভয় পাওয়ার কথা শুনে আমার হাসি পেল। আরও কিছুদূর হেঁটে এলাম দুজনে। হঠাৎ কুকুরের কান্নার মতো একটা ডাক শুনতে পেলাম। দূর থেকে আসছিল আওয়াজটা। নিষাদ সতর্ক হয়ে দাড়িয়ে গেল।
“কি হল?” এস আর কিছুক্ষন হাটি!
“আমার মনে হচ্ছে ওটা নেকড়ের ডাক”।
আমার হাসি পেল। হাসি আটকে রেখে বললাম, “কি আবল তাবল বলছ নিষাদ? হরর মুভি দেখে মাথা গেছে তোমার! ঢাকা শহরে নেকড়ে আসবে কোত্থেকে?”
“আমি ফিরব বাবা?”
আমার তখন একটা পুরনো একটা রাস্তা চোখে পড়েছে। “যাব তো অবশ্যই, তার আগে চল ঐ রাস্তাটা কোথায় গেছে সেটা একটু দেখে আসি। মনে হচ্ছে কাছে ধারে একটা গ্রাম আছে”।
“আমি আর যাবনা” গোঁ ধরল নিষাদ।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “ঠিক আছে আমি তোমাকে জোর করছি না। তুমি গাড়িতে গিয়ে বস। আমি খানিক বাদেই আসছি”।
নিষাদ যেন হতাশ হয়েছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে গাড়ির দিকে ফিরে চলল। আমি কিছুক্ষন তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার রাস্তাটা ধরলাম নিশ্চিন্ত মনে। নিষাদের আপত্তির কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছি না। রাস্তার শেষটা কোথায় সেটা দেখার জন্য আমার মনে একটা জেদ চেপেছে।
কতক্ষন যাবত হাঁটছি বলতে পারব না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই রাস্তা আর কখনো শেষ হবেনা। বাড়িঘর বা লোকজন কিছুই চোখে পড়ল না। নির্জন পরিত্যক্ত গোছের জায়গা। এই ব্যাপারটা আগে খেয়াল হয়নি। রাস্তার বাঁকে এসে যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করছিল, তা এই জায়গাটার পরিত্যক্ত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অবচেতন মন বারবার তাগাদা দিচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। একদিনের জন্য ঘুরাঘুরি যথেষ্ট হয়েছে। আমি ফিরতি পথ ধরলাম। এতক্ষন দূর থেকে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা দুরপাল্লার যানবাহনের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এখন তাও শুনছি না। আরও একটা বিষয় হচ্ছে, ফেরার পথে জঙ্গলটা একটু বেশি ঘন মনে হচ্ছে।
আরও কিছুদূর হাটার পর বুঝলাম পথ হারিয়েছি। গাজীপুর অঞ্চলের এই জঙ্গল সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি আমি। এখানে রাত বিরাতে ডাকাতি হয়, আর মানুষ মেরে ফেলে যাওয়াটা নতুন কোন বিষয় না। এতক্ষনে ভয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি। দাঁড়িয়ে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করছি কোন দিক দিয়ে এসেছিলাম। এখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর গর্ত দেখছি। একটা রাস্তা দেখলাম এঁকেবেঁকে একটা ঘন ঝোপের দিকে এগিয়ে গেছে, তারপর তার পিছনে গিয়ে হারিয়ে গেছে। একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হল। হাত পা অবশ হয়ে এল। এই প্রথম বারের মত মনে হল, নিষাদের সাথে ফিরে গেলেই ভাল করতাম।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাথার উপর মেঘও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে গম্ভীর মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। সেই গর্জনকে ভেদ করে আবার মধ্যে মধ্যে রহস্যজনক এক চিৎকার শোনা যাচ্ছে– যেটাকে নিষাদ ভেবেছিল নেকড়ের চিৎকার। সেদিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় কনকনে ঠান্ডা বাতাস লাগল গায়ে।
হাঁটছি আমি। মনে হচ্ছে যেন পেরিয়ে এসেছি অন্তবিহীন পথ। মাঝে মধ্যেই আকাশ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে এক ঘন জঙ্গল যার শুরু বা শেষ খুজে পাওয়া সম্ভব হবেনা। জায়গাটা তুলনামূলকভাবে নিস্তব্ধ। মাথার অনেক উপরে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ঝড়ের অন্ধকার যেন মিশে গেছে রাতের অন্ধকারে। এই অবস্থায় সেই নেকড়ের অদ্ভুত শব্দটা আমার চারপাশের নানা শব্দের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
আমার মাঝে একটা ঘোরলাগা অনুভূতি সৃষ্টি হল। এই অর্ধ চৈতন্যাবস্থা স্থায়ী ছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ একটা গা-ঘিনঘিনে বমি বমি ভাব হল। প্রকাণ্ড স্থবিরতা গ্রাস করল আমাকে। মনে হল, সারা পৃথিবীটা হয় ঘুমাচ্ছে, নয় মরে গেছে– শুধু আমার কাছে বসে থাকা কতগুলো জানোয়ারের নিঃশ্বাসের আওয়াজ সেই নৈঃশব্দের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। গলার কাছে একটু উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম। তারপর ব্যাপারটা টের পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ডটা ঠান্ডা হয়ে এল ভয়ে। একটা বিরাট জন্তু আমার উপর শুয়ে আমার গলাটা চাটছে। ভয়ে নড়তে পারলাম না। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আমার উপর এক দৈত্যাকার নেকড়ের দুটো বড়ো বড়ো চোখ জ্বল জ্বল করছে। ফাঁক হয়ে থাকা বিরাট মুখের মধ্যে চকচক করছে ধারালো সাদা দাঁত। তার গরম জান্তব ক্ষুরধার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার উপর।
হঠাৎ আমার চোখ দুটো নেকড়েটাকে ছেড়ে গেল। দূরে কিছু একটার নড়াচড়া টের পাচ্ছি আমি। মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কে ওটা? অবয়বটা খুব বেশি পরিচিত। আরও কাছে এগিয়ে এল সেই ছায়ামূর্তি। এবার আর চিনতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। নিষাদ! আমার ছেলে। নিষাদের চোখদুটো নেকড়ের মতই জ্বলজ্বল করছে, মুখের ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে ভয়ংকরদর্শন দাঁত। আমি একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
হুঁশ ফেরার পর দেখলাম কোথায় জঙ্গল, কোথায় নেকড়ে, আমি বাড়িতেই বসে আছি। প্রথমে খানিকক্ষণ কিছু মনে ছিল না। তারপর মনে পড়তেই গোঙানির মত একটা আওয়াজ করে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম নিষাদ বসে আছে কাছেই। ডিভিডি প্লেয়ারে মুভি চলছে।
“কি হল ড্যাড?”
“কি ব্যাপার নিষাদ? আমরা এখানে এলাম কখন? আমরা কি লং ড্রাইভে যাইনি?”
“নাহ ড্যাড”।
“কেন?”
“তুমিই তো অফিস থেকে ফিরে বললে আজ শরীরটা ভাল লাগছেনা। আজ লং ড্রাইভে যাবেনা!”
“তাহলে মুভি দেখছি কেন?”
“নতুন কোন মুভি বাসায় নেই বলে তুমিই তো বললে ড্রাকুলাস গেস্ট মুভিটা ছাড়ার জন্য। আমি তাই করলাম!”
আমি মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। এতক্ষনে সবটা মনে পড়েছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে ভুগছি আমি। নইলে কোনটা স্বপ্ন, কোনটা বাস্তব- তা প্রায়ই গুলিয়ে যাচ্ছে কেন?
বিছানায় শুয়ে পরলাম আমি। সিলিঙের ফ্যানটা কি আস্তে ঘুরছে নাকি? বাতাস এত কম লাগছে কেন? নিষাদের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, “বাবা, ডিনার করবেনা?”
নিষাদ আমার বেডরুমের দরজায় দাঁড়ানো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না, তুমি খেয়ে নাও”।
নিষাদ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকল।
“কি ব্যাপার কিছু বলবে?”
“আমি একটা কবিতা লিখেছি ড্যাড। ইংলিশ পয়েম”।
“আবার একটা কবিতা নকল করেছ?”
“না ড্যাড, আমি নিজে লিখেছি এবার” নিষাদ তার শার্টের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলতে লাগল।
আমি বললাম, “রেখে যাও। পরে পড়ব”।
“তুমি ভুলে যাবে ড্যাড, আমি তোমাকে পড়ে শুনাই?” নিষাদ আমার মাথার কাছে চলে এসেছে।
আমি কিছু বললাম না।
নিষাদ শুরু করল...
A face that is always on my mind,
A smile I have seen a million times,
Two eyes that would light up the sky at night,
One last battle you could not fight,
The day was long, then night then morn.
I knew that soon you would be gone,
I clasped your hand so warm in mine,
Soon we would be out of time,
To stay with us you fought so hard,
A million pieces went my heart,
Now a photo I look at to see your smile,
I keep your number on my speed dial,
A video I watch to hear your voice,
This I do.... I have no choice.,
But great memories I will always keep with me,
Your love in my heart for eternity,
I never got to say goodbye,
To understand why, I can but try,
Waiting in heaven from this moment on,
'Till god asks you to bring me home....
কবিতা শেষ হতেই বললাম, “অনেক ভাল লিখেছ নিষাদ। কিন্তু এই একই থিম নিয়ে খুব বেশি লেখার দরকার আছে কি? অন্য কিছু নিয়ে লেখার চেষ্টা কর”।
নিষাদ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ আবার মাথার কাছে নিষাদের কণ্ঠস্বর শুনলাম। “ড্যাড, একটা কথা বলব”।
আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললাম, “আবার কি বলবে?”
“ড্যাড, এই কবিতাটা!”
“হুম”
“এটাও আমি লিখি নাই। লিখেছে লরনা ফারগুসন নামে বাইরের এক মহিলা কবি”।
আমি নিষাদের কথা শুনছিনা। আমার ঘুম দরকার! ঘুমিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি অতলে..
***
আজ জেনির সাথে ডেট ছিল। অফিস শেষে সরাসরি জেনির সাথে গিয়ে মিট করলাম। তারপর গেলাম বেইলি রোডে। থার্টি থ্রি তে বসে দুজনে খেলাম। জেনির পছন্দের একটা শাড়ি কিনে দিলাম। ঘুরাঘুরি করতে করতে ৮টা বেজে গেল। জেনিকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার পথে নির্জন রাস্তা দেখে দুজনে একটা লং কিস করলাম । মেজাজটা তাই খুব ফুরফুরে লাগছে।
বাড়ির কাছের ডিভিডির দোকানটা ছাড়িয়ে এলাম। আজ থেকে আর কোন হরর মুভি দেখব না। যদিও নিষাদ দুই তিন বার অনুরোধ করেছে আনডিভাইডেড মুভিটার ডিভিডি আনার জন্য। তার কোন এক ক্লাসমেট মুভিটা দেখে ভাল বলেছে। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হরর মুভি। কিন্তু আমি আর হরর মুভি দেখব না বলে ঠিক করেছি। এই হরর মুভি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে এক একটা দুঃস্বপ্নে পরিনত করেছে। আমি আর নিষাদের এই খেলার গুঁটি হবনা।
নিষাদ চুপচাপ ড্রয়িং রুমের এক কোনায় বসে ছিল। আমাকে দেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। সম্ভবত বুঝতে পেরেছে আমি মুভিটা আনিনি। আমি চেহারায় কাঠিন্য ধরে রেখে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলাম। কাপড় পালটাচ্ছি, দেখলাম নিষাদ নিঃশব্দে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
"কিছু বলবে?'
নিষাদ নিচু কণ্ঠে বলল, "একটা জিনিস দেখাব তোমাকে'।
মুভি এনেছি কিনা জিজ্ঞেস না করায় আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিষাদের সামনে মিথ্যে বলা কঠিন। আমি বললাম, "কি দেখাবে?'
"আগে ডিনার সেরে নাও। তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি রাতের খাবার খেতে খেতেই আর একবার জিজ্ঞেস করলাম, "কি দেখাতে চাও নিষাদ?'
নিষাদ বলল, "বললাম তো খাওয়ার পর দেখাব'।
"খাওয়ার পরই দেখব। আপাতত কি দেখাতে চাও, সেটা তো বলতে পার!'
"তুমি গতকাল রাতে একটা কবিতা লিখেছ' নিষাদ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল।
আমি মুখের ভেতরে ভাত চিবান বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলাম।
নিষাদ আবার বলল, "ইংরেজি কবিতা'।
"আমি কবিতা লিখেছি! অসম্ভব! কখন লিখলাম?' মুখের ভেতরে ভাত থাকায় কথাগুলো অস্পষ্ট শোনাল।
নিষাদ বলল, "খেয়ে নাও ড্যাড, তারপর দেখাচ্ছি'।
আমি আর খেতে পারলাম না। মুখের ভেতরে খাবার স্বাদহীন মনে হচ্ছে। অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। আমি কবিতা লিখলাম কখন? ঘুমের ঘোরে? কিন্তু কেন লিখব? কি নিয়ে লিখব?
এঁটো ভাত ফেলে রেখে উঠে পড়লাম। বেসিনে হাত ধুয়ে আমি নিষাদের পেছন পেছন তার রুমে ঢুকলাম। নিষাদ তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হাতে লেখা কাগজ বের করে দিল। ইংরেজিতে লেখা কবিতা। ঠিক যেমনটি নিষাদ এর আগে দুবার দেখিয়েছে আমাকে।
Alone with the raging in my soul,
I know not where to turn.
I have opened up to some,
But this raging makes me burn.
My heart and soul are screaming,
But I try to hold it in,
For, they make me feel I'm wrong,
That my hurt is like a sin.
I am fighting for a way,
To be not weak and small.
But my pain is not subsiding,
Please someone hear my call!
I've done what they have asked,
Tried going down their path.
But they know not why I'm hurting,
They haven't felt the wrath.
I look to them sincerely,
I TRY to help them SEE,
But, they just don't understand it,
So they choose to leave me be.
I long to just be normal,
Then maybe they'll accept,
The reasons why I need them,
The reason why I've wept.
The demons they hold strong,
As, they've broken my life down.
Are they afraid of these monsters?
Is that why they seem to frown?
I'm afraid to admit,
The help that I need.
I don't want them to know,
That in my pai I BLEED.
Because he was unkind,
So many years before,
I think her death, they want me,
To move on and IGNORE.
Nilufar, can you hear me?
Can you please let them know,
That special part of you
That I just can't let go?
Is anybody listening?
Does anybody SEE?
Help me to set myself in rest
Please help to set me free!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কাগজের দিকে। এই কবিতা আমি লিখেছি! নিষাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, "তুমি মিথ্যে বলছ নিষাদ! এটা আমি লিখিনি'।
নিষাদ বলল, হাতের লেখাটা দেখ ড্যাড। কি মনে হয়? ওটা কার লেখা।
মনে হওয়ার কিছু নেই। নিজের হাতের লেখা চিনতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমি এক দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ করে মাথাটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে।
"ড্যাড, মুভি এনেছ?'
"না'
"আমি জানতাম তুমি মুভিটা আনবেনা'।
আমি কিছু বললাম না। আমার হাটুর নিচ থেকে শরীরটা কেমন অবশ লাগছে।
"ড্যাড, এখন থেকে তোমাকে আর মুভি আনতে হবেনা'।
"আচ্ছা' আমি বুঝতে পারছি আমার এখনি শুয়ে পরা দরকার। শরীর খারাপ করবে বুঝা যাচ্ছে। আমি পা বাড়ালাম নিজের রুমে দিকে।
"কেন আনতে হবেনা সেটা জিজ্ঞেস করলেনা?'
আমি নিষাদের রুম থেকে বেরতে বেরতে বললাম, "তুমি আর মুভি দেখবেনা'।
"না ড্যাড। এখন আরও বেশি করে দেখতে পারব'।
আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, "কীভাবে?'
"আমার কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়েছি, ড্যাড। এখন থেকে ভাল ভাল মুভি ডাউনলোড করে নেব যাবে খুব সহজেই'।
আমি তিক্ত ভঙ্গিতে একটু হাসলাম।
রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। মাথা ঝিম ঝিম করছে, হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। মানসিক সমস্যাটাই বেশি ভোগাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে নিজের অজান্তে কবিতা লিখা শুরু করেছি। আমার জীবনে গোপন করার মত অনেক কিছুই আছে। এভাবে ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থায়, কখন কোন বেফাঁস বিষয় বেরিয়ে আসে তার ঠিক নেই। সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হওয়া কম্পালসরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশের রুম থেকে স্পিকারের আওয়াজ আসছে। নিষাদ সিনেমা ছেড়েছে। এত জোরে আওয়াজ দিয়েছ কেন? সিনেমায় বোধহয় ভায়োলেন্স অনেক বেশি। খুব বেশি চিৎকার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে। আমি বার কয়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম। নিষাদকে ভলিউম কমাতে বলে আসা দরকার।
নিষাদের রুমের সামনে গিয়ে দাড়াতেই চমকে উঠলাম। "ভেতরে এস বাবা। মুভি মাত্র শুরু হয়েছে'।
আমি মুভি দেখতে আসিনি। এসেছি ভলিউম কমাতে বলার জন্য। কিন্তু কিছু একটা আমাকে তা বলা থেকে বিরত রাখল। মুভিটা আমাকে চুম্বকের মত টানছে, নিষাদের পাশে গিয়ে বসে পরলাম।
মুভির প্রধান চরিত্র একটি অল্প বয়সী মেয়ে- অ্যানা। অগ্নিকান্ডে মায়ের মৃত্যু দেখার পর থেকে ক্রমাগত আত্মহত্যার চেষ্টা করার কারনে তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ১০ মাসে পর সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। অ্যানার বাবা ডেভিড একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ডেভিড তাকে সমুদ্রতীরের একটা নির্জন কটেজে নিয়ে আসল। বাড়িতে ফিরেই আনা দেখল তার মায়ের সেবাদান কারী নার্স এলিজাবেথ এখন তার সৎ মা। মুভি কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল অ্যানা মাঝে মাঝে তার মৃত মায়ের আত্মাকে দেখতে পাচ্ছে! ছোটবোন এলেক্স আর সে মিলে আলোচনা করে নিশ্চিত হল র্যাচেলই তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী। র্যাচেল আর ডেভিড মিলে তাদের মাকে মেরে ফেলেছে নিজেদের পথের কাটা দূর করার জন্য। অ্যানা উঠে পরে লাগল তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। প্রয়োজনে সে তার বাবাকে টর্চার করার সিদ্ধান্ত নিল।
একদিন নির্জন রুমে অ্যানা তার বাবাকে একলা পেল। ডেভিড কিছু একটা লিখছিল। দরজা আটকানোর শব্দ হতেই মুখ তুলে দেখল অ্যানার হাতে একটা ছুরি। সে একপা দুই পা করে এগিয়ে আসছে।
নাহ! অ্যানা নয়, নিষাদ! নিষাদ আমার দিকে একটা ছুরি হাতে এগিয়ে আসছে! মুহূর্তে আমার মাঝে একটা আতংক ভর করল। নিষাদ আমার পেছনে কিছু একটা দেখে হাসল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি নিলুফার দাড়িয়ে আছে। নিলুফার আমার দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসল। আমার শরীর ঘামছে, একটু পানির অভাবে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নিলুফার আমার পাশে এসে বসল। আমার কাঁধে হাত রাখল। নিষাদ নিশ্চয়ই নিকুফারকে দেখতে পায়নি। কেন পাচ্ছেনা? নিলুকে শুধু আমিই কেন দেখি, আর কেউ কেন দেখেনা?
আমি অতি কষ্টে উচ্চারন করলাম, "নিষাদকে থামতে বল নিলু'!
নিলুফার এখনও হাসছে।
নিষাদ ছোরা হাতে আরও কাছে চলে এসেছে। আমি প্রানপনে চিৎকার করে বললাম, "নিষাদকে থামতে বল নিলু, দোহাই লাগে তোমার!'
নিলুফার হাসি ধরে রেখেই বলল, "নিষাদ যা জানতে চাইছে, তা ওকে জানিয়ে দাও'।
আমি প্রবল বেগে মাথা নাড়লাম। নিলুফারের মুখের হাসি মুছে গেল।
হঠাৎ করে দম বন্ধ হয়ে আসার একটা অনুভূতি হল আমার। আমি মুখ হা করে দম নেয়ার চেষ্টা করলাম। চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি অতি কষ্টে বললাম, "বলছি আমি নিষাদ। সব খুলে বলছি'।
সশব্দে দম টানলাম আমি। নিষাদ দাড়িয়ে আছে এক হাত দূরত্বে। ওর চোখদুটো যেন দুটো জলন্ত অগ্নিকুন্ড। তাকিয়ে আত্মা হিম হয়ে গেলে আমার।
হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। আমি মোবাইলের খোঁজে হাত বাড়ালাম। জেনির ফোন! হারামজাদী আর ফোন করার সময় পেলনা! নিলুফার আর নিষাদ আমার দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি কলটা রিসিভ করলাম।
"হ্যালো'।
জেনি আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, বলতো, এখন আমি কোথায়?
আমি উত্তর দিলাম না।
"আমি এখন ঠিক তোমার বাসার সামনে। বলতো আমি তোমার জন্য কি এনেছি'?
"জাহান্নামে যা, মাগী...' আরও কয়েকটা কুৎসিত গালি দিলাম আমি। ফোন রেখে দিলাম।
নিষাদের ঠোঁটের কোনায় হাসির আভাস। সম্ভবত আমার জেনিকে গালি দেয়ার ব্যাপারটি সে উপভোগ করেছে। নিলুফারের মুখে অবশ্য হাসি নেই। তার চোখদুটো জুড়ে কেবল প্রতিহিংসা। "বল হাসান, সব বল নিষাদকে'।
"নিষাদ! তোমার ধারনা ভুল। আমি তোমার মাকে খুন করিনি। হ্যা, আমি পরিকল্পনা করেছিলাম তাকে খুন করার। আমি আর জেনি মিলে প্ল্যান করেছিলাম ছাঁদে কাপড় শুকাতে দেয়ার সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব। কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি আমি ঠিক যে প্লান করেছি, তোমার মাও ঠিক সেভাবেই মারা যাবে! ঘটনার দিন আমি অফিসেই ছিলাম নিষাদ, আমি মারিনি তোমার মাকে, এটা দুর্ঘটনা'।
আমার উত্তর সম্ভবত নিষাদের পছন্দ হয়নি। সে ছোরা হাতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। এদিকে ফ্ল্যাটের দরজায় কেউ ভীষণভাবে ধাক্কাচ্ছে। সম্ভবত জেনি এসেছে। গালি দিয়ে এত সহজে পার পেয়ে যাব জেনি তেমন মেয়ে না। সে পুলিশ কমিশনারের মেয়ে আমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে!
এগিয়ে আসছে নিষাদ,
নিলুফারের চেহারায় অপার্থিব হাসি,
জেনি মনে হচ্ছে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে...
আমার হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হল। চোখ মুখ উলটে যাচ্ছে, সম্ভবত জ্ঞান হারাতে চলেছি। "পানি... একটু পানি..'
"এইযে ড্যাড, পানি...' নিষাদ পানির গ্লাস বাড়িয়ে ধরল।
আমি হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা প্রায় কেড়ে নিয়ে ঠোঁটের কাছে ধরলাম। ঢক ঢক করে গেলার সময় বেশ কিছুটা পানি ছলকে পরে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিল।
একটু ধাতস্ত হতেই বুঝলাম আমার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছিল। নিষাদের হাতে ছুরি নেই। আমার পাশে নিলুফার বসে নেই। দরজায়ও কোন আওয়াজ হচ্ছেনা। পুরোটাই আমার মনের ভুল।
"কি হয়েছিল আমার?'
"মুভি দেখে খুব বেশি ভয় পেয়ে উলটা পালটা বকছিলে'।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। "শরীরটা দুর্বল লাগছে। আমি ঘুমাতে গেলাম'।
"ঠিক আছে ড্যাড। কাল থেকে আমরা আর হরর মুভি দেখব না ড্যাড। এখন থেকে আমরা ক্রাইম ড্রামা দেখব'।
আমি কোন কথা বললাম না। নিজের রুমে এসে মোবাইল হাতড়ে রিসিভ কলে গিয়ে দেখলাম, আসলেই জেনির কল এসেছিল! আমি রিসিভ করে ৩০ সেকেন্ড কথাও বলেছি। কি বলেছি তার সাথে? তাহলে দুঃস্বপ্নটার কি আংশিক সত্য ছিল, নাকি পুরোপুরিই সত্য ছিল? নাকি দুঃস্বপ্নটাই আসল- এখন যেটা দেখসি সেটাই স্বপ্ন? নিষাদ হরর মুভির বদলে এখন ক্রাইম ড্রামা দেখতে চাইছে কেন? সে যা জানতে চেয়েছিল, তা জানা হয়ে গেছে বলে?
মাথাটা টলে উঠল আমার। হঠাৎ বেডরুমের দরজায় নিষাদকে দেখলাম। তার হাতে একটা কাগজ ধরা। সম্ববত নতুন একটা কবিতা লিখে এনেছে! অথবা অন্যের কবিতা নকল!
আমি বললাম, "একটা প্রশ্নের সত্য উত্তর দেবে নিষাদ?'
নিষাদ নিশ্চুপ।
আমি তবু প্রশ্নটা করলাম। "ঐ কবিতাটা আমার লেখা ছিলনা, তাইনা?'
নিষাদ কোন জবাব দিলনা। শুধু ঠোঁটের কোনে ক্ষীণ একটা হাসি দেখা গেল, হ্যা! ঠিক এই হাসিটাই আমি নিষাদের মুখে দেখতে পেয়েছিলাম নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার পর!
(সমাপ্ত)
রেফারেন্সঃ
গল্পটা শ্রদ্ধেয় গল্পকার হাসান মাহবুব ভাইয়ের অনুমতি ক্রমে তার লেখা “জেনার-হরর/ক্রাইম” গল্প থেকে অনুপ্রানিত হয়ে লেখা। গল্পের জন্য কিছুটা খাটাখাটনি করতে হয়েছে। কিছু মুভি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি। আর ইংরেজি কবিতা ও অন্যান্য টুকটাক তথ্যের জন্য গুগল মামা তো ছিলই।
উৎসর্গঃ
প্রিয় ব্লগার কাল্পনিক ভালবাসা ভাইকে। ভাইয়ের দেওয়া উৎসাহ আমার পথ চলার জন্য সব সময় অনুপ্রেরনা হিসেবে কাজ করে। ওনার সুস্থ জীবন কামনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩৭