মনোযোগ দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ইনকোর্স পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন প্রোফেসর আব্দুর রশিদ চৌধুরী। নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউট এর সিনিয়র শিক্ষক তিনি। এই মুহূর্তে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। ছেলেমেয়ে গুলো লেখা পড়ায় মনোযোগ একদমই হারিয়ে ফেলেছে। ক্লাসে যা পড়ানো হয়েছে, তাই দিয়েছেন তিনি পরীক্ষায়। অথচ একজন স্টুডেন্টও ঠিক মত কিছু লিখতে পারে নি। দিন যতই যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তার কাছে মনে হয়, এই প্রজন্মকে নিয়ে আশা করার কিছু নেই। এরা কিছুই দিতে পারবেনা জাতিকে!
এমনিতেই মনটা খারাপ হয়ে আছে বেশ কিছুদিন যাবত। একসাথে অনেকগুলো সমস্যার মুখে পরেছেন তিনি। জমিজমা ভাগাভাগির ঝামেলাকে কেন্দ্র করে ভাইদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে আছেন। বড় মেয়ে মোহনা অস্ট্রলিয়া থাকে, তার স্বামীর একটা বড় ধরনের অসুখ হয়েছে বলে শুনেছেন। খুব কাছের এক বন্ধু রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন দিন দশেক আগে। আরও ছোটখাট নানান সমস্যা লেগেই আছে। তার উপর পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীদের উল্টা পাল্টা লেখা দেখে মনটা আরও বিষিয়ে যাচ্ছে! সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে তার।
“স্যার, আসতে পারি?” দরজা খুলে একজন উকি দিল।
কে এসেছে সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করলেন না প্রোফেসর রশিদ, হ্যা-বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন শুধু।
লোকটি ভেতরে ঢুকল। একটু এগিয়ে এসে বলল, “বসব স্যার?”
আবার মাথা নাড়লেন প্রোফেসর, তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খাতা দেখার প্রতি।
লোকটি মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল।
দুমিনিট পেরিয়ে গেল, প্রোফেসর রশিদ যেন ভুলেই গেছেন তার সামনে কেউ বসে আছে!
লোকটি একটু কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। প্রোফেসর রশিদ খাতা থেকে মুখ না তুলেই বললেন, “দেখছেন তো খাতা দেখছি! কি বলতে এসেছেন, তা ঝটপট বলে ফেলুন”।
লোকটি বিনয়ী কণ্ঠে বলল, “স্যার কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি কায়সার”
এবার রশিদ সাহেব খাতা থেকে মুখ তুলে চাইলেন। সামনে বসে থাকা লোকটিকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড লাগল তার। চেনার সাথে দৃষ্টি বদলে গেল। দুচোখে ফুটে উঠল ঘৃণা। এই ছেলেটা তার প্রাপ্তন ছাত্র। একটা স্যাডিস্ট! বছর দশেক আগে নিজের সহপাঠী একটি মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা খেয়ে জেল খেটেছে! প্রোফেসর রশিদ তাকে আজীবনের জন্য ইউনিভার্সিটি থেকে রেস্ট্রিকেট করে দিয়েছিলেন, এমন ব্যাবস্থা করেছিলেন যেন দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার যায়গা না হয়! এতদিন পর এই ছেলে তার কাছে কি বলতে এসেছে!
গর্জে উঠলেন প্রোফেসর, “তোমার সাহস কেমন করে হল এখানে আসার? এক্ষুনি বেরিয়ে যাও!”
“চলে যাব স্যার” কায়সার নার্ভাস ভঙ্গিতে একটু হাসল। “দু চারটা কথা বলতে এসেছি। বলেই চলে যাব”।
“তোমার সাথে আমার কোন কথা থাকতে পারেনা! বেরিয়ে যাও এক্ষুনি!”
“বলছি তো স্যার, চলে যাব। দয়া করে কথাটা শুনুন আমার!”
“ছেলে তুমি নিজে থেকে বেরিয়ে যাবে নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বের করতে হবে” গলার আওয়াজ বাড়ালেন প্রোফেসর রশিদ।
কায়সার উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি চলে যাচ্ছি স্যার, শুধু এই কাগজটা একটু দেখেন স্যার” হাতে ধরা একটা কাগজ প্রোফেসর রশিদের ডেক্সের ওপর রাখল সে।
কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রোফেসর। অনেক পুরনো আমলের একটা মলিন হয়ে যাওয়া কাগজ। তাতে মোটা কালি দিয়ে তিন রো তে কিছু ইংরেজি বর্ণ এলোমেলো ভাবে লেখা।
UGPCWJUSBPOWSTIYESPYFGRWE
NWWRNWVWDIEWRQWKCWIXKIXJ
IEUQUKKJUKKGWE
বুঝতে অসুবিধা হলনা এটা একটা সাইফার কোড। তারপরও জিজ্ঞেস করলেন, “কি এটা?”
“কোনও ধরনের বিশেষ কোড হবে হয়ত”।
গলার স্বর কিছুটা নরম হল তার, “এটা তুমি পেয়েছ কোথায়?”
“এটা আমার বাড়ির পুরনো কাগজ পত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছি। সম্ভবত আমার দাদার লেখা। বহুবছর আগে মারা গেছেন তিনি”।
“আমাকে দেখাচ্ছ কেন?”
“স্যার, সেই কথাটাই বলতে এসেছিলাম আমি। যদি অনুমতি দেন তাহলে বসে বলি” কায়সার হাসল আবার।
“হাসবেনা!” বললেন প্রোফেসর। “হাসলে তোমাকে ভয়ংকর লাগে! দাঁড়িয়েই বল। আর বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে বিদায় হও”।
“ঠিক আছে স্যার, দাঁড়িয়েই বলছি” কায়সার হাসি ধরে রাখল, প্রোফেসরের কণ্ঠে আগ্রহ টের পেতে সমস্যা হচ্ছে না তার। “আমার দাদা ছিলেন একজন খামখেয়ালী মার্কা মানুষ। নিজের জীবনের অর্ধেকটা তিনি পার করেছেন গুপ্তধনের সন্ধান করতে গিয়ে। সেই আমালে প্রায়ই খবর পাওয়া যেত অমুক যায়গায় জমিদারদের লুকান সম্পদ পাওয়া গেছে, তমুক যায়গায় সোনার মোহর ভর্তি কলসি পাওয়া গেছে। এধরনের কিছু শুনলেই দাদা ছুটে যেতেন সেখানে। নিজের পরবর্তী বংশধরদের জন্যও তিনি রেখে গেছেন এমন অসংখ্য সারপ্রাইজ। দাদার মৃত্যুর পর তার ব্যবহৃত বালিশ, তোষক, ছড়ি, হুক্কার পাইপ এসবের ভেতর থেকে পুরনো আমালের সোনার মোহর, মনি মুক্তার মালা সহ আরও বিভিন্ন জিনিস পাওয়া গেছে। এর পর অনেক বছর পর্যন্ত আমার বাবা আর চাচারা দাদার ব্যাবহার করা নানা জিনিস আর দাদার প্রিয় জায়গাগুলোতে খোঁজ করে অসংখ্য মূল্যবান জিনিস পেয়েছে। আমি অবশ্য তেমন কিছু পাইনি। আজ পুরনো কাগজ পত্র ঘেঁটে এই কাগজটা পেলাম। দেখেই বুঝেছি এটা দাদার লেখা। কোড দেখে আন্দাজ করেছি, নিশ্চয়ই দাদার রেখে যাওয়া কোনও সারপ্রাইজ এর অবস্থান লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। হয়ত দাদার ব্যাবহার করা জিনিস অথবা দাদার প্রিয় কোনও যায়গা- কোথাও না কোথাও কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছেন তিনি, অতি মূল্যবান কোনও বস্তু হবে। যে এই কোড এর অর্থ বের করতে পারবে সেই পাবে ঐ মূল্যবান বস্তুর সন্ধান। তাই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি, স্যার। আপনার মত বড় ক্রিপ্টোগ্রাফির শিক্ষক এই দেশে আর একজনও নেই। সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের হিস্টোরি অফ ক্রিপ্টোগ্রাফি পড়িয়েছিলেন, এখনও সব মনে আছে আমার! ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে আপনার ব্যাপক গবেষণা আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসা পেয়েছে। একমাত্র আপনিই পারবেন এই রহস্যের সমাধান করতে”।
“তুমি কেন ভাবছ, তোমার এই ফালতু কাজে আমি সময় নষ্ট করব? আর তোমার মত একটা বাজে লোকের হাতে কোনও মূল্যবান বস্তু না পরুক এটাই আমি চাই”।
“আপনি ভুল করছেন স্যার। আমি কোন মূল্যবান বস্তু খুঁজে পেতে চাইছি না। আমি চাই দাদার রেখে যাওয়া শেষ এই রহস্যটার সমাধান হোক। আমি আগামীকাল আমার দাদার পুরনো বাড়িটি বিক্রি করে দিচ্ছি। সেখানে দাদার ব্যবহার্য জিনিসপত্র, পুরনো আসবাবপত্র, বই-পুস্তক সহ অনেক কিছুই আছে। এই কোডের আড়ালে যদি আসলেও কোন মূল্যবান বস্তুর সন্ধান থেকে থাকে তাহলে বাড়িটি বিক্রির পর সে জিনিসের ওপর আমার আর মালিকানা থাকবে না। আপনি যদি আগামীকাল ১২টার আগে এই সাইফার কোডটি ব্রেক করতে পারেন, তবেই এই রহস্যের সমাধান সম্ভব। মূল্যবান বস্তুটি যাই হোক, আমি সেটা আপনাকে দিয়ে দেব। দাদা চেয়েছিলেন তার রেখে যাওয়া রহস্যগুলোর সমাধান হোক। আমি শুধু চাই তার ইচ্ছাটা যেন পূর্ণ হয়”।
“দেখ, এইসব কাজের জন্য সময় নেই আমার হাতে। আর তোমার মত কুলাঙ্গারের অনুরোধ রাখার জন্য আগ্রহ বোধ করছি না আমি”।
“আমি জানি স্যার। আমি বাজে মানুষ, আমার অনুরোধ আপনি রাখবেন কেন? শুধু একটু মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করে দেখুন কাজটা করার জন্য একটু সময় বের করা যায় কিনা! আমি না হয় বিবেকবর্জিত কিন্তু আপনি তো বিবেকবান মানুষ!”
“আচ্ছা দেখি সময় করতে পারি কিনা, এখন যাও!”
কায়সার তার মানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে নিল। কার্ডটা প্রোফেসর রশিদের ডেক্সের ওপর রেখে বলল, “এইটা আমার অফিসের ঠিকানা, ছোট খাট একটা বিজনেস চালাচ্ছি। যদি সময়ের আগে কোডটা ব্রেক করতে পারেন তাহলে কষ্ট করে একটু যোগাযোগ করবেন”।
প্রোফেসর রশিদ আর কথা বললেন না। আবার খাতা দেখায় মনোযোগ দিলেন।
কায়সার দরজার দিকে এগোল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল, “মনে রাখবেন স্যার, আগামীকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় আছে আপনার হাতে। এখন বাজে ১২টা। অর্থাৎ আপনার হাতে ঠিক ২৪ ঘণ্টা সময় আছে”।
প্রোফেসর কর্ণপাত করলেন না। কায়সার বেরিয়ে গেল।
কায়সার বেরিয়ে যেতেই সাইফার কোড লেখা কাগজটি ব্রিফকেসে ভরলেন প্রোফেসর রশিদ, নিজের কাছে অস্বীকার করে লাভ নেই আসলেই কোডটার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ বোধ করছেন তিনি। ক্রিপটোগ্রাফি নিয়ে অনেক দিন যাবত কাজ করছেন তিনি কিন্তু কখনো সত্যিকার একটা সাইফার কোড নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়নি তার।
আরও প্রায় ২ ঘণ্টা একনাগাড়ে খাতা দেখলেন প্রোফেসর রশিদ। তারপর টিচারদের লাউঞ্জে বসে লাঞ্চ করলেন। একটা একাডেমিক মীটিং ছিল, সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা থাকতে হল। ভেবেছিলেন মিটিঙয়ের পর তিনি কোডটা নিয়ে বসবেন। কিন্তু সেই সুযোগ হলনা। ফ্যাকাল্টির ডিন অসুস্থ থাকার কারনে তার হয়ে প্রক্সি দিতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে হল। সব ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে গেল। স্ত্রী নাজমা চৌধুরীকে বললেন দ্রুত খাবার দিতে। রাতের খাবার শেষে বিছানায় আয়েশ করে বসলেন প্রোফেসর আব্দুর রশিদ চৌধুরী। কোলের ওপর ল্যাপটপ, পাশে একটা প্যাড, এক হাতে সেই কোড লেখা কাগজ আর অন্য হাতে একটা পেন্সিল।
***
বেশ কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করছেন নাজমা চৌধুরী। ঘুম আসছে না। ঘরে আলো জ্বলছে। অনেকক্ষণ যাবত দেখছেন তার স্বামী প্রোফেসর রশিদ গভীর মনোযোগ হাতে ধরা একটা কাগজ দেখছেন, মাঝে মাঝে পেন্সিল দিয়ে প্যাডে কিছু একটা লিখছেন আবার সেটা কেটে দিচ্ছেন। বার দুয়েক ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু মনোযোগ নষ্ট হবে ভেবে করলেন না। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আপসেট হয়ে আছে, গত একমাসের মধ্যে আজই প্রথম স্বামীকে একটু আনন্দিত মনে হচ্ছে তার।
প্রোফেসর রশিদই নিরবতা ভাঙলেন। “কি হল? ঘুম আসছে না?”
“এভাবে আলো জ্বালিয়ে রাখলে কি ঘুমানো যায়? টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কাজ করলেই তো পার”!
কিছু একটা লিখতে লিখতে প্রোফেসর বললেন, “তুমি তো জানই অল্প আলোতে আমি কাজ করতে পারিনা! মিথিলা তো নেই- মামার বাড়ি বেড়াচ্ছে, সমস্যা হলে ওর ঘরে গিয়ে ঘুমাও না”।
“মিথিলার রুমে শুতে ভাল লাগেনা আমার। রুমের ভেতর সিনেমার হিরো আর ক্রিকেট প্লেয়ারদের একগাদা ছবি লাগিয়ে রেখেছে! শুয়ে থাকলে একটা বিচ্ছিরি অনুভুতি হয়, মনে হয় সব কয়টা আমার দিকে তাকিয়ে আছে”!
“মিথিলা ফিরবে কবে?”
“আজইতো ফেরার কথা ছিল, একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে, কি জন্য যেন আসতে পারেনি। মনে হয় কালকে ফিরবে”।
আবার কিছুক্ষন নিরবতা। প্রোফেসর রশিদ কাজে মনোযোগ দিলেন। নাজমা চৌধুরী আরও কিছুক্ষন ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, তারপর সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “কি করছ এত মনোযোগ দিয়ে? কিসের কাজ এটা?”
স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই প্রোফেসর বললেন, “তুমি বুঝবে না”।
“বুঝিয়ে দিলেই হয়”!
“এসব তোমার বোঝার জিনিস না”!
কথাটা খারাপ লাগল নাজমা বেগমের। একটু অভিমানী সুরে বললেন, “বুঝিয়ে বললে বুঝব না কেন?”
প্রোফেসর রশিদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “তা অবশ্য ঠিকই বলেছ, বুঝিয়ে বললে বুঝবে না কেন? উঠে পর, গভীর সমস্যায় পরে আছি, মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য ছাড়া কাজটা সমাধান করতে পারব না”।
নাজমা বেগমের মুখে হাসি দেখা দিল। দ্রুত উঠে পরলেন তিনি। বসলেন স্বামীর কাছ ঘেঁষে।
প্রোফেসর রশিদ হাতে ধরা কাগজটা দেখালেন স্ত্রীকে। এইটা হচ্ছে একটা সাইফার কোড।
“অনেক পুরনো মনে হচ্ছে”!
“হ্যা, পুরনো তো অবশ্যই। আন্দাজ করছি কাগজটা ব্রিটিশ আমলের-১৯৪০ থেকে ৫০ সালের দিকের হবে”।
“কোথায় পেলে এটা?”
“আমার এক প্রাপ্তন ছাত্র এসেছিল আজ দেখা করতে। তার দাদা ছিল একজন ট্রেজার হান্টার। নিজের পরবর্তী বংশধরদের জন্য নিজের বাড়িতে, ব্যাবহার করা জিনিসপত্রের মাঝে অনেক সারপ্রাইজ এলিমেন্ট রেখে গেছেন তিনি। ওনার পুরনো কাগজপত্রের মাঝে এটা পাওয়া গেছে। আমার ছাত্র ধারনা করছে এটা কোনও লুকনো সম্পদের সুত্র”।
“তাই!” নাজমা চৌধুরী ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। “তুমি কি এই কোড ভেঙে সেই লুকনো সম্পদ বের করতে চাও?”
“আরে না, পাগল। ঐ সব গুপ্তধন খোজাখোজির প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি আগ্রহী হয়েছি এই কোডের মিনিং বের করার জন্য। আমি জানতে চাই কি রহস্য লুকিয়ে আছে এর ভেরতে, ব্যাস”।
“কোডটা কি খুব কঠিন কিছু?”
“হ্যা, মনে হচ্ছে বেশ কঠিন!”
“এটা ভাঙতে তোমার কতদিন লাগতে পারে?”
“কতদিন লাগতে পারে, না জিজ্ঞেস করে জিজ্ঞেস কর, কতক্ষণ সময় আছে”!
“মানে?”
দেয়াল ঘড়ি দেখলেন প্রোফেসর। প্রায় ১২টা বাজে। “আর মাত্র ১২ ঘণ্টা সময় আছে আমার হাতে। আগামীকাল বেলা ১২টার দিকে ছেলেটি তার দাদার বাড়ি আর অন্যান্য পুরনো সবকিছু বিক্রি করে দিবে”।
“বল কি? তাহলে তো একদমই সময় নেই”।
“হ্যা, চল কাজ শুরু করি। তবে তার আগে সাইফার কোড সম্পর্কে তোমাকে দু চার কথা বলে নেই। মনোযোগ দিয়ে শোন”।
“ইয়েস স্যার!” বলে মনযোগী ছাত্রির মত গালে হাত দিয়ে বসলেন নাজমা চৌধুরী।
প্রোফেসর রশিদ হাসলেন। “ক্রিপ্টোগ্রাফি কি তা তো বুঝই?”
“কিছু কিছু বুঝি”।
“প্রথমে ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পর্কে কিছু বলে নেই। ক্রিপ্টোগ্রাফিকে বাংলা করলে দাঁড়ায় তথ্যগুপ্তিবিদ্যা। এটা তথ্যবিজ্ঞানের নিরাপত্তা সম্পর্কীয় একটি শাখা, যাতে তথ্য গোপন করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। এর প্রথম ব্যবহার কবে কখন কোথায় শুরু হয়েছে তার সন্তোষজনক কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি তবে সর্বপ্রথম এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন ফ্রেডরিখ কাসিস্কি আর কম্পিউটারের জনক চারলজ ব্যাবেজ সেই ১৮৫০ সালের দিকে। ক্রিপ্টোগ্রাফি অনেক পুরনো একটা বিষয়। কিন্তু ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহারিক প্রয়োগ আধুনিক তথ্যযোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বত্র রয়েছে। শুনছ তো?”
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাকালেন নাজমা। প্রোফেসর রশিদ বলতে থাকলেন, “ক্রিপ্টোগ্রাফির একটা বড় অংশ জুরে আছে সাইফার। এই সাইফারের মুলে রয়েছে দুজন মানুষের অবদান। একজন হলেন আমেরিকান ক্রিপ্টোবিদ অধ্যাপক রোনাল্ড লিন রিভেস্ট অন্যজন হল একজন ইসরাইলি কম্পিউটার বিজ্ঞানী আদি শামির। এবার আস সাইফার কি জিনিস বুঝে নেই। সাইফার হচ্ছে মুলত নির্দিষ্ট কিছু অ্যালগরিদম যা ব্যবহার করে একটা মেসেজ এনক্রিপ্ট অথবা ডিক্রিপ্ট করা যায়। বুঝতে পারছ তো?”
“একটু একটু”।
প্রোফেসর হাসি মুখে বললেন, “দাঁড়াও, ভাল করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সাইফার লেখা কাগজটি স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। কি দেখছ?”
“কিছু ইংরেজি বর্ণ লেখা আছে। এলেমেলো, অর্থহীন মনে হচ্ছে”।
“আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও এর ভিতরে একটা মেসেজ লুকিয়ে আছে। এখন কথা হচ্ছে সেটা কিভাবে সম্ভব, তাইনা? ভাল করে বর্ণগুলো দেখ”!
নাজমা চৌধুরী দেখলেন।
UGPCWJUSBPOWSTIYESPYFGRWE
NWWRNWVWDIEWRQWKCWIXKIXJ
IEUQUKKJUKKGWE
“দেখেছ?”
“হুম। বুঝতে পারছি না কিছু”।
“তুমি যে বর্ণগুলো দেখছ একে বলা হয় সাইফার টেক্সট। এর মধ্যে যে মেসেজটা লুকিয়ে আছে তাকে বলা হয় প্লেইন টেক্সট। সাইফার টেক্সটের প্রত্যেকটা বর্ণ মুল মেসেজের একটা বর্ণকে রিপ্রেজেন্ট করছে। মেসেজটা উদ্ধার করার জন্য তোমাকে সাইফার টেক্সটের প্রত্যেকটা বর্ণের বিপরীতে মুল মেসেজের বর্ণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এখন বুঝতে পারছ?”
“মনে হয় বুঝেছি”।
“একটা উদাহারন দিলে আরও পরিস্কার হবে। দেখ সাইফার টেক্সটের প্রথম লেটার দুটো হল U আর G, এদের কোণ অর্থ হয়না। মনে কর, এখানে U রিপ্রেজেন্ট করছে W কে এবং G রিপ্রেজেন্ট করছে E কে। তুমি যদি বের করতে পার U হচ্ছে W আর G হচ্ছে E তাহলে মুল মেসেজটা দাঁড়াচ্ছে WE, যার একটা অর্থ আছে! এবার নিশ্চয়ই বুঝেছ?”
“হ্যা, পুরোপুরি বুঝেছি”! নাজমা চৌধুরির মুখে হাসি দেখা গেল।
“এখণ কথা হচ্ছে কিছু কী লেটার ব্যবহার করে প্লেইন টেক্সট থেকে সাইফার টেক্সটে রুপান্তর করা হয়েছে। এই কী লেটার গুলোই হল সাইফার। এই সাইফার খুঁজে না পেলে মুল মেসেজটা উদ্ধার করা সম্ভব নয়”।
“কিন্তু সাইফারটা খুঁজে পাব কিভাবে?”
“হ্যা, এটাই হল প্রশ্ন। এতক্ষন এটাই ভাবছিলাম”।
“ভেবে কিছু পেলে?”
“মোটামোটি এগিয়েছি, দেখাচ্ছি তোমাকে। প্রথমেই যে জিনিসটা আমাদের বের করতে তা হচ্ছে এটা কোন ধরনের সাইফার”। লেকচার শুরু করলেন প্রোফেসর। “সাইফার অনেক রকম হতে পারে। এদের আবার বিভিন্ন নাম আছে। যেমন ধরঃ বেকন্স সাইফার, সাবস্টিটিউশন সাইফার, হিল সাইফার, প্লেফেয়ার সাইফার, জরিয়ান সাইফার, সিজার সাইফার, বুক সাইফার, ভিজিনিয়ার সাইফার, অ্যাফাইন সাইফার, ব্লোফিশ সাইফার, এনিগমা সাইফার এগুলো হল বেশি প্রচলিত সাইফার- এইছাড়া আরও আছে। তবে আমি ধরে নিয়েছি আমার স্টুডেন্টের দাদা নিশ্চয়ই এমন কোন সাইফার বেছে নেবেন না যেটা বের করা খুব কঠিন হবে, তাই এই প্রচলিত সাইফারগুলর কোনও একটা নিয়েই তিনি কাজ করেছেন বলে ধরে নেয়া যায়। এর মধ্যে জরিয়ান সাইফার, হিল সাইফার এবং ব্লোফিশ সাইফারকে বাদ দেয়া যায় কারন এগুলো বের করতে গেলে ব্যাপক ম্যাথামেটিকাল ক্যালকুলেশন প্রয়োজন। আমার মনে হয়না উনি এত ঝামেলার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। আর এই সাইফার উদ্ধার করতে গেলে এক রাত যথেষ্ট নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাসের মাসের মাস পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা আছে ইতিহাসে। তাই এইগুলার সম্ভবনা আমি বাদ দিয়েছি। এবার অন্য সাইফারগুলোর কথায় আসি- বেকন্স সাইফারও বাদ দেয়া যায় কারন এটা বাইনারিতে প্রকাশ করা হয়, সাইফার টেক্সটটি দেখে মনে হচ্ছেনা এটা কোনও ধরনের বাইনারি সংখ্যার প্রকাশ। বুক সাইফারের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট বইইয়ের পাতার নির্দিষ্ট প্যারার লেটারগুলোকে কী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে যেহেতু কোন বইয়ের নাম উল্লেখ নেই-এটার সম্ভাবনা বাদ দেয়া যায়। প্লেফেয়ার সাইফারে সাইফার টেক্সটের পাশাপাশি একটা প্রিসেট লেটার বক্স থাকে কিন্তু এখানে সেটা নেই দেখে এটাও আমি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাবস্টিটিউশন সাইফারে কয়েকটা লেটারের সাবস্টিটিউশন হাইন্ট দেখা থাকে, এখানে তা নেই-সুতরাং এটাও বাদ। ভিজিনিয়ার সাইফারে একটা কি-ওয়ার্ড বলা থাকে যার সাহায্যে ভিজিনিয়ার টেবিল থেকে সাইফার টেক্সটের লেটার গুলোর সাবস্টিটিউট লেটার পাওয়া যায়। কিন্তু কি-ওয়ার্ড না থাকায় এটাও বাদ। এখন বাকি থাকল সিজার আর এনিগমা। কি বললাম এতক্ষণ কিছু বুঝতে পেরেছ?”
নাজমা ওপর নিচে মাথা ঝাকালেন।
প্রোফেসর রশিদ বুঝলেন তার স্ত্রী তেমন কিছুই বোঝেনি। মৃদু হেসে বললেন, “এতক্ষন কি বলেছি তা না বুঝলেও চলবে কিন্তু এখন বুঝতে হবে”!
নাজমা চৌধুরী একটু নড়ে চড়ে বসলেন।
“সিজার সাইফার খুব সহজ একটা বিষয়। রোভার স্কাউটদের এটা শেখান হয়। আমার প্রথম চিন্তা ছিল এই সাইফার উনি ব্যবহার করবেন না। তারপরও শিওর হয়ার জন্য একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। সিজার সাইফারে ABCD লেটার গুলোর সিরিয়াল ঠিক রাখা হয়, কিন্তু A থেকে শুরু না করে অন্য কোনও বর্ণ থেকে পড়া শুরু করা হয় এবং Z এ শেষ না করে শেষ হয় অন্য বর্ণে গিয়ে। যেমন আমি শুরু করলাম PQRS…. এবং শেষ করলাম ধর ...MNO তে গিয়ে। এখন যদি কেউ লিখতে চায় CAB তাহলে তাকে লিখতে হবে RPQ, বুঝলে তো? এখানে R হচ্ছে C, P হচ্ছে A, Q হচ্ছে B। ঘণ্টা খানেক যাবত এই পদ্ধতিতে ট্রাই করছি। অনেকভাবে চেষ্টা করেও কোন মিনিং বের করতে পারলাম না”।
“তাহলে?” নাজমা প্রশ্ন করলেন।
“তাহলে আর কি? বাকি রইল কেবল এনিগমা পদ্ধতি। এটা অনেকটা সিজার সাইফারের মতই কাজ করে। ABCD.... এর বদলে অন্যভাবে বর্ণগুলো সাজানো থাকে তবে এক্ষেত্রে কোনও সিরিয়াল মেইনটেইন করা হয় না। এটা একটা সাইফার কি। সাইফার টেক্সটে যে মেসেজ পাঠানো হয় তুমি সেখান থেকে সাইফার কি অনুযায়ী আগের বর্ণ বা পরের বর্ণ ধরে একটা মেসেজ বের করে আনা যায়। এই পদ্ধতির প্রথম ব্যবহার হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। একটা উদাহারন দিয়ে বোঝাচ্ছি তোমাকে.......”
প্যাডে এলোমেলো ভাবে কিছু লেটার লিখলেন প্রোফেসর রশিদ।
PBCGTHDKESNAPLQ
“ধর, এইটা হল সাইফার কি যা তুমিও জান আমিও জানি। এবার ধর আমি তোমার কাছে একটা সাইফার টেক্সট পাঠালাম, যাতে লেখা আছে......” প্রোফেসর লিখলেন, CPATQPHSND
“কি মনে হয়? বের করতে পারবে এর অর্থ?”
নাজমা চৌধুরী অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
“ভালভাবে খেয়াল করে দেখ, সাইফার টেক্সটের প্রথম বর্ণ কি?”
নাজমা খুঁজে বের করে বললেন, “C”
“সাইফার কি থেকে C খুঁজে বের কর এবং তার আগের লেটারটি কি আছে দেখ”।
“সাইফার কি C তে আছে তিন নম্বরে, এর আগে আছে B”।
"এই তো প্রথম লেটারটা তুমি পেয়ে গেছ, এবার একিভাবে প্রতিটা বর্ণের বিপরীতে সাইফার কি থেকে আগের বর্ণগুলো খুঁজে প্যাডে লিখে দেখ কি অর্থ দাঁড়ায়"।
নাজমা চৌধুরী প্যাডটা কাছে টেনে নিয়ে লিখতে থাকলেন।
B- A- N- G- L- A- D- E- S- H
“পেয়েছি! বাংলাদেশ!” বলেই হাততালি দিয়ে উঠলেন নাজমা চৌধুরী।
প্রোফেসর রশিদ স্ত্রীর আনন্দ দেখে হাসলেন। “এই তো তুমি সাইফার বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছ! দেখলে তো বিষয়টা খুব একটা কঠিন কিছু না”।
প্রোফেসর রশিদ আবার লেকচার দিতে থাকলেন। “পরবর্তীতে জার্মানরা এই পদ্ধতির কিছুটা উন্নতি সাধন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবিষ্কৃত হয় এনিগমা মেশিন। এটা ছিল দেখতে অনেকটা টাইপরাইটারের মত। একটা মেশিন একবার ব্রিটিশ সেনাদের হাতে পরে যায়, ফলে জার্মান সেনাদের গোপনে আদান প্রদানকৃত যুদ্ধপন্থা সম্পর্কিত অনেক গোপন তথ্য তারা আগে থেকেই জেনে ফেলে। যুদ্ধে জার্মানদের ক্রমশ পরাজয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার এটাও একটা কারন। যাই হোক, এই মেশিনে প্রত্যেকটা লেটারের সাথে অন্য একটা লেটার জুড়ে দেওয়া থাকত। সাইফার টেক্সট পাওয়ার পর এনিগমা মেশিনে তা টাইপ করা হত, টাইপের সময় প্রতিটি লেটারের সাথে সম্পর্কযুক্ত লেটারটি টাইপ হত। টাইপ শেষে মূল মুল মেসেজটা বেরিয়ে আসত। বুঝেছ?”
নাজমা বেগম বললেন, “কিন্তু এজন্য তো একটা এনিগমা মেশিন দরকার। উনি কিভাবে এনিগমা মেশিন পাবেন?”
“লোকটা সৌখিন প্রকৃতির ছিলেন। গুপ্তধনের সন্ধানে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, হয়ত কোনভাবে একটা মেশিন ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন!”
“তাহলে নিশ্চয়ই লোকটার বাড়িতে পুরনো জিনিসপত্রের মাঝে অমন একটা মেশিন রয়েছে!”
“হতে পারে”।
“সেক্ষেত্রে তোমাকে তো তার বাড়িতে যেতে হবে। ঐ মেশিন ছাড়া তো এই সাইফার ব্রেক করতে পারবে না!”
প্রোফেসর রশিদ হাসলেন।
“হাসছ কেন?”
“একবিংশ শতাব্দির মানুষ হয়ে তুমি যদি একথা বল, হবে তাহলে?”
“তারমানে?
“তারমানে হচ্ছে আমি গুগল ঘেঁটে এনিগমা মেশিনের কিছু ছবি বের করেছি, এই যে দেখ”- প্রোফেসর রশিদ স্ত্রীর দিকে ল্যাপটপটি ঘুরিয়ে দিলেন।
নাজমা বললেন, "এটা তো দেখতে টাইপ রাইটারের মতই"।
“এখানে প্রত্যেকটা লেটারের সাথে জুড়ে থাকা লেটারটি দেখা যাচ্ছে। সামনের নিচু লেটার গুলো হল মুল লেটার, পিছনে উচু হয়ে থাকা লেটারগুলো হল জুড়ে থাকা লেটার”।
“বুঝলাম, কিন্তু এখান থেকে কি কিছু বের করতে পারলে?”
“নাহ! আমাদের এই সাইফার টেক্সটিকে এনিগমা মেশিনের সাথে কোনওভাবে রিলেট করতে পারছি না”।
“তাহলে? উনি কি এনিগমা মেশিনও ব্যবহার করেন নি?”
“মনে হয় না”।
“এখন তাহলে কি করবে?”
“এখন শেষ ভরসা হিসেবে আছে লেটার ফ্রিকোয়েন্সি লিস্ট। এটা না হলে আর কোনওভাবে সাইফারটি ভাঙ্গা সম্ভব হবেনা”।
“এটা আবার কি জিনিশ?”
“বলছি, দাঁড়াও” দেয়াল ঘড়ি দেখলেন প্রোফেসর রশিদ। গল্প করতে করতেই রাত দুটো বেজে গেছে! “লেটার ফ্রিকোয়েন্সি হল ইংরেজি ভাষায় কিছু লেখা সময় কোন লেটারটি কতবার ইউজ হয়, তার একটা গড়। লেটার ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে আমি গুগলে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, কিন্তু তোমাকে মনে রাখতে হবে আমরা এমন এক কোড ভাঙতে যাচ্ছি যা সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে লেখা এবং তখন আজকের মত গুগল ছিলনা, ছিলনা ইন্টারনেট, ছিলনা সহজে তথ্য সংগ্রহের কোনও মাধ্যম! তখনকার আমলে লেটার ফ্রিকোয়েন্সি বের করতে হলে গবেষণা মুলক বইয়ের কোনও বিকল্প ছিলনা। আমি একটা আর্টিকেল পেয়েছি যেখানে ৪০এর দশকে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যবহৃত কথ্য ইংলিশ ল্যাংগুয়েজের প্রায় ৪০ হাজার ওয়ার্ডের ওপর জরিপ করে একটা ফ্রিকোয়েন্সি তালিকা করা হয়েছে। তালিকাটা রিলাইয়েবল মনে হয়েছে আমার কাছে। দেখ”-
English Letter Frequency (based on a sample of 40,000 words)
E=21912
T=16587
A=14810
O=14003
I=13318
N=12666
S=11450
R=10977
H=10795
D=7874
L=7253
U=5246
C=4943
M=4761
F=4200
Y=3853
W=3819
G=3693
P=3316
B=2715
V=2019
K=1257
X=315
Q=205
J=188
Z=128
“এখান থেকে সাইফার ভাংবে কেমন করে?”
“খুব সহজ, তবে একটু সময় লাগবে। বুঝিয়ে বলছি, তার আগে আমাকে একটু সাহায্য কর। আমাদের সাইফার টেক্সটিতে কোন লেটার কতবার আছে তার একটা তালিকা তৈরি করে ফেলা যাক!”
দুজনে মিলে সাইফার টেক্সট থেকে প্রত্যেকটা বর্ণ গুনে গুনে প্যাডে লিখলেনঃ
W=11বার, K=6 বার, U=5 বার, I=5 বার, E=5 বার, G=3 বার, P=3 বার, S=3 বার, R=3 বার, C=2 বার, J=2 বার, Y=2 বার, N=2 বার, Q=2 বার, X=2 বার, B=1 বার, O=1 বার, T=1 বার, F=1 বার, V=1 বার, D=1 বার।
“এবার কি করবে?” প্রশ্ন করল নাজমা চৌধুরী।
“এবার দেখ লেটার ফ্রিকোয়েন্সি চার্ট অনুযায়ী ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লেটার হল E এবং আমাদের সাইফারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লেটার হল W। আমরা এখন W কে E দ্বারা রিপ্লেস করব”।
প্রোফেসর রশিদ ল্যাপটপে টাইপ করলেনঃ
****E******E***********E*
*EE**E*E***E**E**E******
************E*
“এবার আস K কে T দ্বারা রিপ্লেস করে ফেলি”।
****E******E***********E*
*EE**E*E***E**ET*E**T***
*****TT**TT*E*
“এবার কি করবে?” নাজমার প্রশ্ন। “U, Iএবং E তিনটি লেটারই সাইফারে ৫ বার করে আছে। কোনটাকে আগে রিপ্লেস করবে বল?”
প্রোফেসর রশিদ হাসলেন, বললেন, “এমন হতে পারে তা আমার জানা ছিল এই অবস্থায় নিয়ম অনুযায়ী আমরা দেখব সাইফারে কোন লেটারটা আগে আছে, সেটাকে আগে চেঞ্জ করব অর্থাৎ যে লেটার গুলো সমান সংখ্যক বার আছে তার মধ্যে যেটা আগে আছে সেটা আগে রিপ্লেস করতে হবে”।
“আস তাহলে U কে A দ্বারা রিপ্লেস করে ফেলি”।
A***E*A****E***********E*
*EE**E*E***E**ET*E**T***
**A*ATT*ATT*E*
তারপর ক্রমান্বয়ে দুজনে মিলে I কে O দ্বারা E কে I দ্বারা- এভাবে করে রিপ্লেস করতে লাগল।
A***E*A****E**O*I******EI
*EE**E*E*OIE**ET*EO*TO**
OIA*ATT*ATT*EI
“নাজমা, আমার মনে হচ্ছে কোনও মিনিং বের হচ্ছে না”প্রোফেসর রশিদের কণ্ঠে হতাশার সুর।
“অধৈর্য হয়নো। আগে আস G কে N দিয়ে, Pকে S দিয়ে আর Sকে R দিয়ে রিপ্লেস করে দেখি কি দাঁড়ায়!”
এভাবে রিপ্লেস করার পর টেক্সটা দাঁড়ালঃ
ANP*E*A*RP*R*SO*IRP**N*EI
*EE**E*E*OIE**ET*EO*TO**
OIA*ATT*ATTGEI
“উই আর গোয়িং নো হয়ার, নাজমা”এবার পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়লেন প্রোফেসর। “প্রথমে এসেছে ANP শেষে এসেছে ATTGEI । এগুলো কোনও মিনিংফুল ইংরেজি ওয়ার্ড না”।
“এখন তাহলে কি করবে?”
“আমার মাথায় আর কিছু আসছে না!”
“আমি বলিকি- অনেক রাত হয়েছে, এখন শুয়ে পর। সকালে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা যাবে!”
ঘড়ি দেখলেন প্রোফেসর রশিদ চৌধুরী। প্রায় তিনটা বাজে। স্ত্রীর কথা মত লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর আবার রাত জেগেছেন। কিন্তু মনটা খারাপ লাগছে ভীষণ, নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে। সারাজীবন সাইফার নিয়ে গবেষণা করেছেন অথচ কোন সৌখিন এক বৃদ্ধের শখ করে রেখে যাওয়া সামান্য এক সাইফার সমাধান করা সম্ভব হলনা! “নিশ্চয়ই সাইফার তৈরির সময় কোনও গলদ করেছে বেটা”- নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলেন প্রোফেসর। কিন্তু মন প্রবোধ মানতে চাইছে না। অবশ্য খুব বেশিক্ষন জাগতে হলনা, মিনিট দুয়েক বাদেই চোখ জুড়ে আসল রাজ্যের ঘুম।
***
ঘুম ভাঙল সকাল ৯টার দিকে। প্রোফেসর রশিদ উঠে দেখলেন স্ত্রী পাশে নেই। রান্নাঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ আসছে। মনে হয় চা বানাচ্ছেন।
আবার সাইফারটা হাতে নিয়ে বসলেন তিনি। নাজমা বেগম এলেন দুই কাপ চা হাতে নিয়ে। বললেন, “ঘুম না ভাংতেই আবার বসে পরলে ওটা নিয়ে!”
“মনটা খারাপ হয়ে আছে, নাজমা। মনে হচ্ছে হেরে গেছি আমি। এই প্রথম নিজের সুযোগ হল সত্যিকারের একটা সাইফার নিয়ে কাজ করার। অথচ আমি কিনা ব্যর্থ হলাম!”
“মন খারাপ করোনা, সময় তো এখনও আছে। কিছু একটা চিন্তা করে বের কর”।
“সারারাত ঘুমের ঘোরে সেই চিন্তাই করেছি। কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না! আমার চিন্তা-ভাবনা ঠিকই আছে, যে পদ্ধতিতে সমাধানের জন্য এগিয়েছি, সেটাই বেস্ট ওয়ে। এতক্ষনে সমাধান পেয়ে যাওয়ার কথাই। কিন্তু কেন যে মেসেজটা বের হলনা টা বুঝতে পারছি না”।
“এক কাজ করোনা” বুদ্ধি লেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন নাজমা, “বাঁকি লেটার গুলোও রিপ্লেস করে ফেল। দেখা যাক না কি বের হয়!”
“তুমি কর, আমি চা খাই”।
নাজমা বেগম আগ্রহ নিয়ে বসলেন। ল্যাপটপটা সামনে নিয়ে লেটার গুলো টাইপ করতে থাকলেন। হঠাৎ কিছু একটা দেখে থেমে গেলেন। “মোহনার বাবা!”
স্ত্রীর কণ্ঠে অন্যরকম একটা সুর শুনে চমকে উঠলেন প্রোফেসর রশিদ। “কি?”
“তুমি এনিমগা পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে তার একটা উদাহারন দিয়েছিলে রাতে, মনে আছে?”
“যেখান থেকে তুমি বাংলাদেশ খুঁজে পেলে, ওটা?”
হ্যা-বোধক মাথা নাড়লেন নাজমা।
“মনে আছে, কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছ?”
“বলছি, তার আগে আর একটা প্রস্নের জবাব দাও। পুরনো আমলের টাইপ রাইটার আর আজকের কপমিউটারের কি বোর্ড এর লেটারের এলাইনমেন্ট কি একই?”
“হ্যা, টাইপ রাইটার, কিবোর্ড সহ প্রায় সব ধরনের টাইপিং ডিভাইসে একই স্ট্যান্ডার্ড ফলো করা হয়। মানে লেটার গুলো একই সিরিয়ালে সাজানো থাকে”।
নাজমা ল্যাপটপটা স্বামীর দিকে বারিয়ে ধরলেন। “লুক এট দা কিবোর্ড”।
রশিদ চৌধুরী তাকালেন, “হোয়াট এম আই সাপোজড টু সি?”
“আমাদের সাইফারের প্রথম ৫টা লেটার কি?”
“আমি তোমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি না নাজমা”।
“আহা বলই না!”
“U-G-P-C-W”
“এবার এই লেটারগুলা কি বোর্ডে খুঁজে বের করে আগের লেটারগুলো দেখ”।
প্রোফেসর রশিদ পড়লেন, “I-H-A-V-E!”
এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন প্রোফেসর, তারপর শীষ দিয়ে উঠলেন, “আই হ্যাভ বেরিয়েছে! ওহ মাই গড! তারমানে আমি আগে যে পদ্ধতিতে চেষ্টা করছিলাম ওটাই ঠিক ছিল! ওনার কাছে কোন এনিগমা মেশিন ছিলনা, ছিল টাইপ রাইটার!”
“এক্স্যাক্টলি!” নাজমা চৌধুরী হাসলেন।
“তুমি একটা জিনিয়াস নাজমা! ইউ আর এ জিনিয়াস! কি জিনিশ বের করে ফেলেছ, তুমি নিজেই জাননা! আমার তো মাথায়ই আসেনি!”
“আমরা দুজনে একটা সুন্দর টিম বানিয়েছি, তাইনা?”
“ইয়েস, আফকোর্স!”
“এবার ঝটপট বাঁকি ওয়ার্ডগুলো বের করে ফেল”।
বিপুল বিক্রমে আবার কাজে লেগে গেলেন প্রোফেসর রশিদ। প্রথমে প্যাডে কি বোর্ডের এলাইনমেন্ট অনুযায়ী লেটারগুলো সাজালেনঃ
QWERTYUIOP
ASDFGHJKL
ZXCVBNM
এবার এখান থেকে সাইফারের লেটার গুলো খুঁজে বের করে প্রতিটি লেটারের আগের লেটারটা লিখলেন। এভাবে পুরোটা প্যাডে লিখার পর মেসেজটা দাঁড়ালঃ
IHAVEKIDNAPEDYOURDAUGHTER
MEETMEBEFORETWELVEOCLOCK
ORIWILLKILLHER
প্রোফেসর রশিদ থমকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। এবার আলাদা করে মাঝখানে স্পেস বসিয়ে বসিয়ে মেসেজটা আবার লিখলেনঃ
I HAVE KIDNAPED YOUR DAUGHTER
MEET ME BEFORE TWELVE O’CLOCK
OR I WILL KILL HER
নাজমা ভ্রু কুছকে কিছুক্ষন মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, “এটা তো মনে হয় কিডন্যাপারের হুমকি! তোমার ছাত্রের দাদা এটা লিখতে যাবেন কেন?”
প্রোফেসর রশিদ থমথমে গলায় বললেন, “তুমি বুঝতে পারছ না নাজমা। কাগজটা পুরনো কিন্তু লেখাটা নয়। এভনভাবে লেখা হয়েছে যেন দেখতে পুরনো মনে হয়। ছাত্রের দাদা নয়, ছাত্রই লিখেছে এটা!”
“কিন্তু কেন? কেন লিখতে যাবে সে এটা?”
“ও একটা স্যাডিস্ট। আমাকে নিয়ে খেলেছে। তুমি এক্ষুনি মিথিলাকে ফোন কর”।
“ওয়েট!” এতক্ষনে বিষয়টা নাজমা চৌধুরীর খেয়াল হল। “তুমি ভাবছ তোমার ঐ ছাত্র মিথিলাকে....”
প্রোফেসর রশিদ ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালেন।
নাজমা চৌধুরী মোবাইল হাতে নিয়ে দ্রুত ডায়াল করলেন মেয়ের নম্বরে। কিন্তু মোবাইল কানে দিতেই ভেসে এল..... “দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া...” নাজমা চৌধুরী কেটে দিয়ে আবার কল করলেন। একই ঘটনা ঘটল আবার। হতাশ কণ্ঠে বললেন, “মিথিলার ফোন বন্ধ!”
“ওর মামাত বোন স্বর্ণার নম্বরে ফোন দাও”।
নাজমা ফোন দিলেন। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বললেন, “স্বর্ণা! মা, মিথিলা কোথায়?...বেরিয়ে গেছে... কখন?..... কিন্তু এখনও তো ফেরেনি... মোবাইলটাও বন্ধ পাচ্ছি.... আচ্ছা, মা রাখি, পরে কথা হবে” নাজমা কল কেটে দিয়ে বললেন, “মিথিলা ওদের বাসা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে”।
“মাই গড! ওহ মাই গড! স্যাডিস্টটা আগে থেকে সব প্লান করে রেখেছিল”প্রোফেসর রশিদ দুহাতে মুখ ঢাকলেন।
নাজমা চৌধুরী বললেন, “কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব বল? সে তোমাকে যখন সাইফার লেখা কোডটা দিয়েছিল তখন তো মিথিলা ওর মামার বাড়িতেই ছিল। রাতে আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে! এখন হয়ত রাস্তায় আটকে আছে, মোবাইলের চার্জ নেই!”
“সব কিছু প্লান করাই ছিল, নাজমা। ও জানত, আমি যতক্ষণে কোডটা ব্রেক করতে পারব ততক্ষনে কিডন্যাপের কাজটা সেরে ফেলতে পারবে”।
মিসেস নাজমা আতংকিত কণ্ঠে বললেন, “এখন কি করবে?”
প্রোফেসর রশিদ ব্যস্ত উঠে দাঁড়ালেন। “এখন ওর কথা মত কাজ না করে উপায় নেই। আমি যাব ওর কাছে”।
“ঠিকানা জান?”
“একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিল আমাকে। ডেক্সের ওপর ফেলে এসেছি, আগে ওটা নিতে হবে তারপর সেই অনুযায়ী যাব”।
“নাহ, তোমার যাওয়ার দকার নেই, ঠিকানা দেখে নিয়ে পুলিশে খবর দেব আমরা”।
“না , নাজমা! ভুলেও এই কাজ করার কথা ভেবনা, তাহলে মেয়েকে আর সুস্থ দেখতে পাবেনা!”
***
ঝড়ের বেগে ঢুকলেন প্রোফেসর রশিদ। কায়সার তখন চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর দুই পা তুলে দিয়ে দোল খাচ্ছিল। প্রোফেসর রশিদকে দেখে ঝট করে পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। “কংগ্রাচুলেশন স্যার, আমি জানতাম আপনি সময়ের আগেই কোড ব্রেক করতে পারবেন!”
রাগ সামলে রাখতে পারলেন না প্রোফেসর। এগিয়ে গিয়ে কায়সারের শার্টের কলার চেপে ধরলেন। “বাস্টার্ড! বল আমার মেয়ে কোথায়?”
কায়সার মুখে হাসি ধরে রাখল, “আরে..আরে...স্যার করেন কি? রিলাক্স! রিলাক্স! আপনার মেয়ে ভাল আছে। ১২টা বাজতে এখনও আধা ঘণ্টা বাঁকি!”
রশিদ সাহেব কলার ছেড়ে দিলেন কিন্তু আগ কমছে না তার। “আমি এসেছি তোর কথা মত, এবার আমার মেয়েকে ছেড়ে দে”।
“বসেন, স্যার। রিলাক্স হয়ে বসেন” কায়সার অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাসল। “আপনার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে”।
রশিদ চৌধুরী একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন। উত্তেজনায় এতক্ষন বুঝতে পারেন নি, শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, সকালে খাওয়া হয়নি। ক্ষীণ গলায় বললেন, “আর কি চাও তুমি?”
“বলছি স্যার, সব বলছি। একটু ঠাণ্ডা হন। চা কফি কিছু খাবেন? সকালে নাস্তা খেয়েছেন বলেও তো মনে হচ্ছে না!”
প্রোফেসর রশিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, “ইউ...” কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। রাগ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন, “আমি এখানে তামাসা দেখতে আসিনি-বলেছিলে ১২টার আগে দেখা করতে পারলে আমার মেয়েকে ছেড়ে দেবে, আমি এসেছি- ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে! প্লিজ!”
কায়সার হাসিমুখে বলল, “কিঞ্চিত ভুল বলেছেন স্যার। আমি বলেছি ১২টার আগে দেখা করলে আপনার মেয়েকে খুন করা হবেনা। দেখা করলেই ছেড়ে দেব তা তো বলিনি!”
“কি চাস তুই আর?” দাঁড়িয়ে গেলেন রশিদ চৌধুরী। “বল আর কি চাস? স্যাডিস্ট! এক রাত না ঘুমিয়ে তোর খেলায় তাল দিয়েছি- আর কি চাস তুই?”
“সত্যি জানতে চাই স্যার”।
“সত্যি! কিসের সত্যি?”
“আপনি জানেন স্যার!” কায়সার থমথমে গলায় বলল, “আপনি খুব ভাল করেই জানেন আমি কোন সত্য জানতে চাইছি!”
প্রোফেসর রশিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন, তারপর বললেন, “আমি জানিনা কিসের কথা বলছ তুমি?”
“তাই? আসলেই জানেন না! তাহলে তো মনে করিয়ে দিতে হয়!” কায়সার একটু থেমে আবার শুরু করল, “আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা! আমি তখন আপনার প্রতিষ্ঠানের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। লেখাপড়ায় আমি অন্যান্যদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলাম। আমার সহপাঠী ছিল লিজা নামের একটি মেয়ে। বড়লোকের বাপের একমাত্র মেয়ে। যেমন ছিল রুপ, তেমনি ছিল অহংকার। বলতে বাধা নেই ক্লাসের অন্যান্য সব ছেলেদের মত আমিও তার প্রতি একটু দুর্বল ছিলাম। এমনিতে মেয়েটির সাথে খুব একটা কথা হতোনা, কিন্তু একদিন সে আমাকে তার বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করল। আমার কাছ থেকে কিছু পড়া বুঝে নিতে চায়। সুন্দরী মেয়ের অনুরোধ ফেলা যায় না, আমি রাজি হয়ে গেলাম। নির্ধারিত দিনে বই খাতা নিয়ে আমি তার বাসায় গিয়ে হাজির। বাড়ি ছিল একদম ফাঁকা। আমাকে দেখে লিজা মধুর হাসি হাসল তারপর ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে বেডরুমে ঢুকল। সেই যে ঢুকল আর বের হওয়ার নাম নেই। বেশ কিছুক্ষন বাদে দরজায় কড়া নকের আওয়াজ পাওয়া গেল। আমি কয়েকবার ডাকলাম লিজাকে। কিন্তু লিজার কোনও উত্তর পেলাম, ভাবলাম বাথরুমে গেছে। এদিকে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা পরতে লাগল। সমবয়সী একটা মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার বেডরুমে ঢোকা ঠিক হবেনা ভেবে বসে থাকলাম। আরও কিছুক্ষন কেটে গেল, দরজাতে ধাক্কার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল দরজাটা ভেঙেই ফেলবে। এদিকে লিজার কোনও সাড়া শব্দ পাচ্ছিনা তাই বাধ্য হয়ে নিজেই দরজা খুললাম। খুলেই দেখি বেশ কয়েকজন পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পরলাম। কয়েকজন পুলিশ আমাকে টেনে দাড় করাতে লাগল। বাকিরা লিজার বেডরুমের দিকে গেল। আমার তখন স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা ছিলনা। প্রচণ্ড ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। একটু পরে দেখি লিজা পুলিশদের সাথে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তার গালে-হাতে আঁচরের দাগ, গায়ের পোশাক কয়েক যায়গায় ছেড়া, মাথার চুল এলোমেলো-বুঝতে অসুবিধা হলনা মেয়েটা আমাকে ফাসিয়ে দিয়েছে। এক পুলিশ বলল, “শালা! মেয়ে মানুষ বাড়িতে একলা পেয়ে রেপ করতে চাইছিলা” অন্য একজন আমার পেটে প্রচণ্ড এক লাথি ঝাড়ল। তীব্র ব্যাথা নিয়ে আমি জ্ঞান হারালাম”।
কায়সার একটু থামল, প্রোফেসর রশিদ মাথা নিচু করে শুনছেন।
“জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি হাজতে। একটু সুস্থির হয়ে বসেছি তখন একজন পুলিশ অফিসার এসে ঢুকল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তার কাছ থেকেই আমি জানলাম আমার বিরুদ্ধে আগেই থানায় জিডি করে রেখেছিল লিজা। আমি নাকি তাকে রেপ করার হুমকি দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ফোন পেয়ে তারা জানতে পারে আমি লিজার বাসায় গিয়েছি। তারা আশংকা করে আমার উদ্দেশ্য রেপ করা এবং লিজার বাসায় গিয়ে তারা আমাকে হাতে নাতে ধরেছে। আমি পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করলাম। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি যদি তাহলে রেপই করতে গিয়ে থাকি তবে পুলিশ আসার পর পালিয়ে না গিয়ে নিজে থেকে দরজা খুলতে যাব কেন। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলনা। একজন রেপিস্ট ধরতে পারা পুলিশের জন্য বিশাল কৃতিত্ব। অমানুষিক টর্চার করেছিল সেদিন। বাবা মায়ের আদরের সন্তান ছিলাম, বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায় যাওয়া হয়নি খুব একটা। মাইর যে কি জিনিস আর কত ভয়ংকর হতে পারে সে সম্পর্কে আমার ধারনা ছিলনা। একসময় আর সইতে না পেরে স্বীকার করলাম সব কিছু। এরপর আমার স্বপ্নের প্রাসাদগুলো একে একে ধ্বসে পরতে লাগল। দুই বছরের জেল হয়ে গেল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হল। আমার এই ঘটনা জানতে পেরে বাবা একটা মেজর স্ট্রোক করলেন। তার চিকিৎসার জন্য মা সহায় সম্পদ সব বিক্রি করে দিলেন, তাও তাকে বাঁচানো গেলনা। বাবার কবরের পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে একসময় মাও চলে গেলেন। দু বছর শেষে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি যে অসহায় অবস্থায় পরেছিলাম তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কিন্তু আমি ভেঙে পড়লাম না। গ্রামে একটুকরো জমি ছিল, সেটা বিক্রি করে দিয়ে ঢাকায় এসে একটা ছোটখাট ব্যাবসা শুরু করলাম। এখন আমি ভাল আছি, সামলে নিয়েছি সব কিছু। কিন্তু কষ্ট একটা রয়ে গেছে- মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে আমাকে, বিনা অপরাধে জেল খেটেছি”।
আবার একটু থামল কায়সার। তারপর যোগ করল, “আমি জেল থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজ খবর নিতেই জানলাম পুলিশে যে শিক্ষক খবর দিয়েছিলেন সে আর কেউ নয়- আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব রশিদ চৌধুরী! এমনকি থানায় লিজা যে জিডি করেছিল, তাতেও আপনার সিগনেচার ছিল। বুঝতে অসুবিধা হলনা যে পুরো ঘটনাতে আপনি লিজাকে সাহায্য করেছেন”!
প্রোফেসর রশিদ বললেন, “তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও আমি চলে যাই, নইলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব”।
“পুলিশ ডাকবেন! হাসালেন স্যার! কি বলবেন আপনি পুলিশকে?”
“পুলিশকে বলব তুমি আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে”।
“তাই? পুলিশ বিশ্বাস করবে এই কথা? কি প্রমান দেবেন আপনি? ঐ সাইফার কোড দেখাবেন? বলবেন এই সাইফার কোড ভেঙ্গে আপনি বের করেছেন আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছি! আপনার স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে স্যার!”
“দেখ! আমি কিচ্ছু জানিনা এ সম্পর্কে! লিজা আমার কাছে নালিশ করেছিল তুমি নাকি তাকে রেপ করার হুমকি দিয়েছ, ব্যাস!”
“আমি বিশ্বাস করিনা স্যার। এর মধ্যে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। শুধু একটা মেয়ের নালিশের ওপর বিশ্বাস করে আপনি তাকে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করেছেন একটা নাটক সফলভাবে মঞ্চস্ত করার জন্য। যে নাটকের কারনে একজন ছাত্রের জীবন ধংস হয়ে যেতে পারে! এই কথা আর যেই বিশ্বাস করুক আমি করিনা”।
প্রোফেসর রশিদ চুপ করে থাকলেন।
“কথা বলুন স্যার!” তাগাদা দিল কায়সার। “আমাদের হাতে সময় খুবই কম। ১২টা বাজতে আর মাত্র ১০ মিনিট বাঁকি। তার আগেই যদি আমি একটা নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন দিয়ে নিষেধ না করি তাহলে ঠিক ১২টা বাজার সাথে সাথেই আপনার মেয়ের দুচোখের মাঝ বরাবর একটা তপ্ত বুলেট ঢুকে যাবে”।
প্রোফেসর দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন, “ওহ গড, ওহ গড। এই কাজ করোনা। আমি বলছি....বলছি সব কিছু”।
“একটু দ্রুত করুন স্যার। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে!”
প্রোফেসর বড় করে একটা দম নিলেন, “আমি লিজার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম সেটা লিজা বুঝতে পেরেছিল। লিজা বিষয়টাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল, নিজে থেকে এসে আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিল। কিন্তু আমার তরফ ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ অর্থে শারীরিক। আমি বিহাহিত ছিলাম, লিজার প্রতি কোনও কমিটমেন্ট ছিলনা আমার। কিন্তু...কিন্তু নিজেকে সামলানো সম্ভব হয়নি আমার। দৈহিক আকর্ষণের কাছে হার মেনেছিল আমার বিবেক, আমি ধ্যান জ্ঞান সব ভুলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে একদিন লিজা এসে আমাকে বলল আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছে কায়সার। আমার তখন পাগল হওয়ার অবস্থা! একদিকে আমার সংসার অন্যদিকে আমার ক্যারিয়ার- সব কিছু ধংস হয়ে যাবে যদি তুমি মুখ খুল। এই সময় লিজাই পুরো প্ল্যানটা করে। আমার সিগনেচার নিয়ে গিয়ে থানায় তোমার নামে সাধারন ডায়েরি করে আসে। ঘটনার দিন তুমি ওর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে সে আমাকে ফোন করে আর আমি ফোন করি থানায়। বিশ্বাস কর কায়সার! তখন আমার মাথা ঠিক ছিলনা, আমার স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা ছিলনা তখন”।
“কিভাবে একাজ করলেন স্যার?” ধরা গলায় বলল কায়সার, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। “আমি তো আপনাদের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন না কেন? লিজার কথাতেই সব বিশ্বাস করে নিলেন!”
“তুমি কিছুই জানতে না?”
“নাহ স্যার, আমি জানতাম না কিছুই। লিজা আমাকে ফাঁসানোর জন্য আপনার কাছে মিথ্যে বলেছে”।
“কিন্তু কেন সে তোমাকে ফাসাতে চাইবে?”
“আপনি বুঝতে পারেন নি স্যার! ও ছিল একটা সাইকো। ও পারেনা এমন কোনও কাজ নেই। সারাজিবন সব পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছে, জীবনে কখনো হারতে শেখেনি। যেকোনো কম্পিটিশনে ফাস্ট হওয়ার জন্য ঘৃণ্য থেকে ঘৃণ্যতম কাজ করেছে সে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে এসে আমার কারনে লিজা প্রথম হতে পারত না। অনেক চেষ্টা করেও যখন আমাকে হারাতে পারল না তখন সিদ্ধান্ত নিল সরিয়ে দেওয়ার। লিজা আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। তার প্রতি আপনার আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে সে আপনাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল। তারপর নিজের প্লানমত আপনাকে নিয়ে খেলেছে। আপনি তাকে সাহায্য করেছেন আমাকে ফাঁসানোর কাজে। আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করেছিল লিজা”!
“আই এম সো সরি, কায়সার” ভেঙে পড়লেন প্রোফেসর রশিদ। “আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও কায়সার, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও”।
“ওকি করছেন স্যার! মাফ চাওয়ার কোনও দরকার নেই। আপনার ওপর আমার কোনও রাগ নেই। আমি শুধু সত্য জানতে চেয়েছিলাম, সেটা জেনেছি। আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার”।
“আমি তোমাকে সব বলে দিয়েছি, এবার আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও!”
কায়সার হাসল, সামলে নিল নিজেকে “এক্ষুনি ছেড়ে দেব” বলে মোবাইল বের করল। নম্বর বের করে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বলল, “ম্যাডাম! স্যার এসেছেন, আপনারা আসুন”।
প্রোফেসর রশিদ কিছুই বুঝতে পারছেন না। “কাকে ডাকছ?”
কায়সার কোনও জবাব দিলনা।
খানিক বাদেই মিসেস নাজমা চৌধুরী আর তাদের ছোট মেয়ে মিথিলা এসে ঢুকল কায়সারের অফিস রুমে। দুজনের মুখেই হাসি। প্রোফেসর রশিদ চৌধুরী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। “নাজমা তুমি... মিথিলা... তোমরা একসাথে... আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
নাজমা চৌধুরী হাসলেন, কায়সারের দিকে ফিরে বললেন, “তুমি বলবে নাকি আমি বলব?”
কায়সার হেসে উত্তর দিল, “আপনিই বলেন ম্যাডাম”।
নাজমা চৌধুরী স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, “গত কয়েক মাসে অনেকগুলো নেগেটিভ ঘটনা ঘটেছিল, তোমার সময়টা যাচ্ছিল খারাপ। কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলে, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করছিলে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল- ক্রমশ হতাশ হয়ে পরছিলে। এই সময় একদিন কায়সার এল আমাদের বাসায় তোমার সাথে দেখা করার জন্য। তুমি তখন বাড়িতে ছিলেনা। কায়সারের মুখেই শুনলাম সে তোমার প্রাক্তন ছাত্র, তুমি তাকে খুব স্নেহ করতে। আমি কায়সারকে তোমার সব সমস্যাগুলো খুলে বললাম। শুনে কায়সার তোমার জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য একটা প্লান করল। প্লানটা আমার খুব পছন্দ হল। তোমার জীবনে একটা বড় অংশ পার করেছ সাইফার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কিন্তু কখনো সত্যিকার একটা সাইফার নিয়ে কাজ করার সুযোগ তোমার হয়নি। জানতাম এরকম একটা সুযোগ পেলে তুমি আবার আগের সেই উদ্যম ফিরে পাবে। হোলও তাই। নিজের চোখে দেখলাম সাইফারটা পাওয়ার পর তোমার চোখে মুখে কি আনন্দ! যে মুহূর্তে আমরা সমাধানের একবারে কাছে চলে গিয়েছিলাম তখন অসাধ্য সাধনের যে অভিব্যাক্তি তোমার চোখে মুখে দেখেছি তা বিয়ের ২৫ বছরে একবারও চোখে পড়েনি”।
রশিদ সাহেব হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকলেন। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না পুরো ঘটনাটা সাজানো!
নাজমা চৌধুরী বলে চলেছেন, “তবে এই শেষ অংশটা আমার ভাল লাগেনি। কায়সার যখন বলল কোড ভেঙে অর্থ বের হবে মেয়েকে কিদন্যাপ করা হয়েছে তখন আমি একটু আপত্তি করেছিলাম। জানতাম মিথিলাকে তুমি কতটা ভালবাস। বিষয়টা তোমার মনের ওপর চাপ ফেলবে। কিন্তু এর চেয়ে ভাল আর উত্তেজনাকর কিছু মাথায় আসছিল না বলে এতেই রাজি হতে হল”।
“আর মিথিলা? ও কি সব আগে থেকে জানত?” অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন প্রোফেসর।
মিথিলা হাসল। হ্যা-বোধক মাথা নেড়ে বলল, “আম্মু বলেছিল মোবাইলটা সকালে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে রাখতে”।
নাজমা চৌধুরী বলল, “তুমি প্লিজ রাগ করোনা। আমরা চেয়েছিলাম তোমার জীবনটাকে আবার রাইট ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে, নিজের কাজের প্রতি তোমার যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল তা যেন তুমি কাটিয়ে উঠতে পার!”
রশিদ চৌধুরী স্বাভাবিক গলায় বললেন, “বুঝেছি। চল বাসায় চল”।
নাজমা চৌধুরী খুশি হয়ে উঠলেন, “হ্যা, চল বাসায় যাই। খুব খিদে পেয়েছে-উত্তেজনায় কারো কিছু খাওয়া হয়নি” কায়সারের দিকে ফিরে বললেন, “থ্যাংক ইউ কায়সার, ইউ আর রিয়েলি জিনিয়াস”।
উত্তরে কায়সার দাঁত করে হাসল। রশিদ সাহেব মনে মনে বললেন, “জিনিয়াস! হ্যা, আসলেই সে জিনিয়াস। খেলাচ্ছলে সে নিজের উদ্দেশ্য কীভাবে হাসিল করেছে তা নাজমা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি!”
***
নিউ লাইফ কিন্ডার গার্টেন স্কুল।
এইমাত্র ছুটি হয়েছে, দল বেধে হইচই করতে করতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো বেরিয়ে আসছে। গেটের কাছে এসে কতক্ষন নিজেদের গার্ডিয়েনদের খুঁজছে, খুঁজে পেলেই কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরছে। দৃশ্যটা দেখতে খুব ভাল লাগছে কায়সারের। রাস্তার ওপাশে একটা পেপার হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে, কিন্তু পেপারের দিকে কোনও মনোযোগ নেই। তার চোখদুটো দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডিয়েনদের ভিড়ে একজনকে খুঁজছে।
লিজা!
ঐ তো লিজা!
গত কয়েকদিন যাবত লিজার গতিবিধির উপর নজর রাখছে সে। বিখ্যাত এক শিল্পপতির পত্নি, পুরোদস্তুর হাউজ ওয়াইফ। সারা দিনে বলতে গেলে বাসা থেকে বেরই হয়না। শুধু বাচ্চাকে স্কুল থেকে রিসিভ করতে আসে। গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, বাচ্চা বেরিয়ে আসলে তাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বাসায় ফিরে যায়। কথা বলতে চাইলে এই সময়ের মধ্যেই বলতে হবে।
হাতের পত্রিকাটা ছুড়ে ফেলল কায়সার, এগিয়ে গেল লিজার দিকে। কায়সারের হাতে একটা সিডি। প্রোফেসর রশিদ জানতেন না কায়সারের অফিসে গোপনে একটা সিসি ক্যামেরা বসানো ছিল। ঐ দিন প্রোফেসর রশিদের স্বীকারোক্তির পুরোটা ভিডিও কয়া হয়েছে। কায়সারের হাতে ধরা সিডিতে সেই ধারন করা ভিডিওটি রেকর্ড করা আছে। কায়সারের ইচ্ছা এই সিডির কথা লিজাকে বলে তাকে ভড়কে দেবে, তার জীবনটা বিষিয়ে তুলবে। যে নরক যন্ত্রণা সে নিজে এতদিন ভোগ করেছে তার স্বাদ লিজাকেও পেতে হবে। তারপর একসময় জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেবে সব কিছু। এই প্রতিশোধের নেশায় এতদিন দিন গুনেছে কায়সার। আজ সেই কাঙ্খিত দিনটি এসেছে।
লিজার কাছাকাছি গিয়ে একটু থামতে হল কায়সারকে। লিজার ছেলেটা স্কুল থেকে বেরিয়েছে, সে দৌড়ে গিয়ে লিজার বাড়িয়ে রাখা দুটো হাতের মধ্যে আশ্রয় নিল। লিজাও পরম মমতায় ছেলেকে বুকে জরিয়ে নিল। লিজার মুখের দিকে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকল কায়সার। এই লিজা ১০ বছর আগের সেই বড়লোকের জেদি, অহংকারী, একগুঁয়ে আর স্যাডিস্ট মানসিকতা সম্পন্ন মেয়েটি নয়, সে এখন একজন মা। চেহারার সেই কাঠিন্য সরে গিয়ে যায়গা করে নিয়েছে মমতাময়ী মায়ের মুখ। কায়সার অবাক হয়ে দেখল লিজা দেখতে অনেকটা তার নিজের মায়ের মতই। ছোটবেলায় এমনি করে মায়ের বুকে আশ্রয় নিত কায়সার। মা পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, কপালে চুমো খেত। ঠিক তেমনি ভাবেই লিজা তার সন্তানকে আদর করছে।
হঠাৎ একসাথে অনেকগুলো চিন্তা এসে ভর করল কায়সারের মাথায়। তার হাতের এই সিডি বহন করছে এক চরম সত্যের বীজ। এই সত্য লিজার সংসার ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে, বিষাক্ত করে দেবে তার জীবন-এটাই তো কায়সার চায়। কিন্তু এই সত্য একটি শিশুকে তার মায়ের মমতা থেকে অনেক দূর সরিয়ে দেবে- এটাও কি কায়সার চায়? তাছাড়া এই সিডি শুধু একটা সংসার না, দুটি সংসার ধ্বংস করে দেবে। প্রোফেসর রশিদ চৌধুরী সারাজীবন অধ্যাপনা করে যে সুনাম কুড়িয়েছেন তা মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হবে। তার স্ত্রী কন্যা তাকে ত্যাগ করবে, চাকরী চলে যাবে, সমাজের সামনে উন্মোচিত হবে তার নোংরা অতীত, সবার চোখে ঘৃণ্য ব্যাক্তিতে পরিনত হবেন। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলেছেন, “যে তোমাকে একটি বর্ণ শিক্ষা দিয়েছে সেও তোমার শিক্ষক, কখনো তার অমর্যাদা হয় এমন কাজ করোনা!”
কায়সারের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। লিজা তাকে দেখতে পেয়েছে। ভুত দেখার মত চমকে উঠেছে সে। বাচ্চার হাত ধরে দ্রুত পা চালাল। গাড়িতে উঠেই ঝড়ের বেগে চলে গেল। দৃষ্টির সীমানায় যতক্ষণ গাড়িটি ছিল কায়সার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। দৃষ্টির আড়াল হতেই হাতে ধরে থাকা সিডির দিকে নজর দিল কায়সার।
আজ আর সম্ভব হলোনা। সিডি হাতে নিজের পথে পা বাড়াল সে। আবার অন্য একদিন আসতে হবে। হয়ত সেইদিন সে বিবেকের দংশন উপেক্ষা করে সিডির কথা লিজাকে জানাতে পারবে। কিংবা হয়ত দিনের পর দিন স্কুলের সামনে এসে সিডি হাতে দাঁড়াবে কিন্তু লিজার মধ্যে মমতাময়ী মায়ের প্রতিরুপ দেখে থমকে যাবে। হয়ত কখনোই এই সিডির কথা প্রকাশ পাবেনা, একটি চরম সত্য সবার অজানাই থেকে যাবে।
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন