somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জানালার ওপাশে

২৩ শে মে, ২০১৩ রাত ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফুটপাত ধরে হাঁটছে মেয়েটি। মাঝে মাঝে আনমনে একটু হাসছে আর কাল্পনিক কারো সাথে কথা বলছে। তার চোখ মুখ বলছে নিজেকে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষের মাঝে একজন বলে মনে করে।

খুব আহামরি সুন্দরি নয় সে। কিন্তু তার চেহারায় আছে আশ্চর্য এক কমনীয়তা। সৃষ্টিকর্তা যেন জগতের সব মায়া ঢেলে দিয়েছেন তার চোখদুটিতে। পরিপাটি করে আঁচড়ান দীর্ঘ চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত নেমেছে! সুন্দর রুচিশীল সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরনে।
মেয়েটি মাঝে মাঝে গলায় ঝুলানো নেকলেসটা স্পর্শ করছে। ডায়মন্ডের লকেট! তার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল একটা ডায়মন্ডের নেকলেস গলায় দেবে। কিন্তু অভাবী ফ্যামিলিতে জন্ম হওয়ায় সেই সাধ কখনো পুরন হয়নি। আজ তার ভালবাসার মানুষ তাকে এটি উপহার দিয়েছে।

তবে মেয়েটির ভালবাসার মানুষটিও বিশাল কোন ধনী ব্যাক্তি নয়। একজন সাধারন মানের বেকার যুবক। ছেলেটি নিজের জমানো পয়সা খরচ করে তার জন্য নেকলেসটা কিনেছে। একজন মানুষ কতটা ভালবাসলে নিজের কথা না ভেবে জমানো শেষ সঞ্চয়টুকু খরচ করে ভালবাসার মানুষের জন্য উপহার কেনে! মেয়েটি নিজেকে সুখি ভাবছে নেকলেস পাওয়ার আনন্দে নয়, নিজেকে সুখি ভাবছে কারন একজন অসাধারন মানুষের ভালবাসা পেয়েছে সে। তার মত ভাগ্যবতী কতজন হয়!

মেয়েটির ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। রাস্তার পাশে একটা গাড়ি কর্কশ আওয়াজ তুলে হার্ড ব্রেক করে থামল। মেয়েটি তাকিয়ে দেখল একটা পুলিশের ভ্যান। সেখান ঝুপ ঝাপ করে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নামল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা মেয়েটিকে ঘিরে ধরল। একজন গলা থেকে নেকলেসটা খুলে নেওয়ার চেষ্টা করল। মেয়েটি চিৎকার করল, “কি করছেন আপনারা? এটা তো আমার চেইন”।

পুলিশ সদস্যটি নেকলেসটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বলল, “হ্যা, ডাকাতি হওয়া গহনার তালিকায় এটাও ছিল"।

“কি বলছেন আপনারা?” মেয়েটি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না।

পুলিশরা কেউ তার সাথে কথা বলল না। হাতদুটো পিছমোড়া করে হাতকড়া পরান হল। মেয়েটির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে কান্না জরান কণ্ঠে বলল, “দোহাই লাগে ভাই। আমাকে বলুন কেন গ্রেফতার করছেন? এইটা ডাকাতি হওয়া নেকলেস না! আমার বয়ফ্রেন্ড এটা আমাকে উপহার দিয়েছে”!

একজন পুলিশ তার ভ্যানিটি ব্যাগ কেড়ে নিয়ে চেইন খুলে উপুড় করে ধরল। ভেতর থেকে কিছু কসমেটিকস সামগ্রী, কাগজ, কলম টিস্যু পেপার ছাড়া কিছু বের হল না!

পুলিশ সদস্যটি কঠিন কণ্ঠে বলল, “দেখ মেয়ে! ভালয় ভালয় বল, ডাকাতি করা বাকি গহনাগুলো কোথায় লুকিয়েছে?”

এবার মেয়েটি কেঁদেই ফেলল, “বিশ্বাস করুন ভাই। আমি কোনও গহনার কথা জানিনা! এই নেকলেসটা আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে উপহার দিয়েছে!”

“কই থাকে তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

মেয়েটি মরিয়া হয়ে বলল, “আমি শুধু তার নামটাই জানি। আর কিছু জানিনা! মাত্র ১০ দিন আগে পরিচয় হয়েছে তার সাথে!”

পুলিশ সদস্যটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির দিকে। তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস।

***

প্রথম দিনঃ

“মুক্তি মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র”

একটা ৫ তলা বিশিষ্ট সাদা রঙের বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের ৪১১ নং কক্ষে বসে আছে একজন মানুষ। তার চোখে কাল চশমা। রুমের ভেতর দুটি বিছানা। একটি বিছানা খালি। কাল চশমা পরা লোকটি বসে আছে জানালার পাশের বিছানায়। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে।

দরজা খোলার আওয়াজ হল। কেউ একজন ঢুকল ভেতরে। লোকটি সেদিকে না তাকিয়েই বলল, “আপনি কি আমার নতুন রুমমেট?”
সদ্য রুমে প্রবেশ করা লোকটির সাথে দুই তিনটা ব্যাগ। সে ব্যাগগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “হ্যা আপনি ঠিকই ধরেছেন”।

“বাহ! আপনার উত্তর শুনেই বুঝলাম আপনি একজন অমায়িক লোক” কাল চশমা পরা লোকটি বলল, “মনে হচ্ছে আপনার সাথে সময়টা ভালই কাটবে আমার। বাই দা বাই, আমি জালাল আহমেদ। কি নাম আপনার?”

“আমি আসাদ খন্দকার”।

“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগছে, আসাদ। মনে হচ্ছে আপনি এখানে নতুন নন। মোটামোটি অভ্যস্ত, বেশ কিছুদিন যাবত আছেন!”

“হ্যা, মাসখানেক হবে আছি” আসাদ উত্তর দিল। “আগে পাঁচ তলার একটা রুমে ছিলাম”।

“ট্র্যান্সফার করা হল কেন?”

“যেই রুমটাতে ছিলাম সেখানে কি যেন একটা ঠিক ঠাক করা হবে, এই রুমটায় একটা বেড খালি তাই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে!”
“আপনার গলার স্মর শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার সমবয়সী হবেন”।

আসাদ হাসল। মনে মনে ভাবল তার এই নতুন রুমমেট লোকটার মাথায় বোধহয় কোনও গলদ আছে! লোকটা পিছন ঘুরে তাকে দেখছে না একবারও। অনুমানের ওপর বুঝতে চাইছে। সে জিজ্ঞেস করল, “আপনার বয়স কত?”

“ত্রিশ”।

“আমার আটাশ”।

“দেখেছেন! ঠিকই ধরেছি”।

আসাদ খালি বিছানায় বসে পরল।

জালাল বলল, “আরে! কি করছেন! ঐটা আপনার জন্য না। ওখানে আমি থাকি। আপনার জন্য এই জানালার পাশের বিছানাটা ঠিক করে রেখেছি আমি”।

আসাদ অবাক হল, “সমস্যা কি? একই তো”।

“না, এক নয়। আমি চাই আপনি এই বিছানায় থাকেন আর মাঝে মাঝে জানালার বাইরের যা যা দেখবেন তা আমার জন্য বর্ণনা করেন”।

“আপনি নিজে দেখতে সমস্যা কি?”

“এইটা তো আমাকে জিজ্ঞেস করলে হবেনা” জালাল মাথা নেড়ে বলল, “এটা জিজ্ঞেস করতে হবে ওপরওয়ালার কাছে। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন, দুনিয়ার এত মানুষ যখন দেখতে পায় তখন আমার দেখতে সমস্যা কি?”

“মানে!” আসাদ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার কণ্ঠের বিস্ময় চাপা থাকল না। “আপনি দেখতে পান না?”

“না। আমি দৃষ্টিশক্তিহীন”।

আসাদ উঠে এসে জালালের পাশে বসল। জালাল একটু হেসে বলল, “জানি আপনার মনে প্রস্ন জাগছে একজন অন্ধ মানুষ কীভাবে মাদকাশক্ত হয়ে পরল, তাইনা?”

আসাদ হ্যা-বোধক মাথা ঝাঁকাল।

“বলব, আস্তে আস্তে সবই বলব। আপনাকে না বললে বলব কাকে? আপনার কথাও শুনব। এখন এক কাজ করুন, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখুন তো সাদা হাসের দলটা সাতার কেটে লেকের কোনদিকে গেছে”।

“কি বলছেন এসব?”

জালাল বলে চলেছে, “যেই বাচ্চা ছেলেটা মাঝে মাঝে কাগজের নৌকা এনে লেকের পানিতে ছেড়ে দেয় সে কি এসেছে? চা ওয়ালা লোকটা কি আজ এক কাপ চাও বেচতে পেরেছে, নাকি অন্যান্য দিনের মত আজও সবাই তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে? ঐ বয়স্ক লোকটা যে মাঝে মাঝে ভিক্ষুক বাচ্ছাগুলোকে চকলেট দেয় সে এসেছে? আর হ্যা! দেখেন তো, ঐ বড় গাছটার পাশে যে বেঞ্চটা খালি পরে থাকে সব সময় আজ তাতে কেউ বসেছে কিনা”!

আসাদ অবাক কণ্ঠে বলল, “জানালার বাইরের এসব দৃশ্যের কথা আপনাকে কে বলেছে?”

“আপনার আগে আমার যে রুমমেট ছিল সে বলেছে। লোকটা ভাল হয়ে গেছে, আজই তার রিলিজ হয়েছে। কেন? সে কি কিছু ভুল বলেছে?”

আসাদ জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা বড় রাস্তা ছাড়া দেখার মত কিছুই নেই সেখানে। সেই রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু যানবাহন চলাচল করছে। রাস্তার ওপাশে সামান্য একটু ফাঁকা যায়গা। তার ঠিক পেছনেই দৃষ্টি আটকে দাড়িয়ে আছে বিশাল এক অট্টালিকা। লোকটাকে অন্ধ পেয়ে আগের রুমমেট কিছু ভুলভাল বকেছে আর লোকটা তাই বিশ্বাস করে বসে আছে। কিন্তু অন্ধ একজন মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দিতে মন চাইছে না আসাদের। সে বলল, “না না! ভুল বলবে কেন? ঠিকই আছে”।

“তাহলে একটু বলুন না কি দেখছেন?”

আসাদ দেখল রাস্তার ওপাশের ফাঁকা জায়গাটাতে একটা বেঞ্চ বসানো আছে। তাতে একজন যুবক বসে আছে। সে বলল, “ঐ বড়গাছের পাশের বেঞ্চটাতে একটা ছেলে বসে আছে”!

“বলেন কি? ছেলেটা দেখতে কেমন? বয়স কেমন হবে? জানেন! ঐ বেঞ্চটাতে না কেউ বসতে চায় না। এই প্রথম কেউ একজন বসল!”
“ছেলেটার বয়স বেশি না। ২৩-২৪ হবে হয়ত। দেখতে শুনতে ভাল। মাঝে মাঝে হাতঘরিতে সময় দেখছে। মনে হচ্ছে কার জন্য অপেক্ষা করছে!”

“তাই! কার জন্য?”

“সেটা আমি কি করে বলব?” বিরক্ত হল আসাদ।

“একটু ভাল করে দেখে অনুমান করুন না ভাই”।

আসাদ ভ্রু কুচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষন ছেলেটাকে অবজারভ করল। তারপর বলল, “মনে হচ্ছে ছেলেটি তার প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছে। এই বয়সী একটা ছেলে পার্কে বসে আর কার জন্য অপেক্ষা করতে পারে বলুন? তবে মনে হচ্ছে ছেলেটা এই প্রথম মেয়েটির সাথে দেখা করতে এসেছে। আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি! হয়ত মোবাইলে বা ফেসবুকে পরিচয়।”

“সেটা কীভাবে জানলেন আপনি?”

আসাদ হেসে বলল, “জানি না তো! আপনি অনুমান করে বলতে বললেন। আমি বললাম!”

“কি মনে হয় আপনার? আসবে মেয়েটি?”

“মনে হয় আসবে না! ধোঁকা দিয়েছে!”

সারাটা বিকাল জালালের অনুরোধে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল আসাদ। সন্ধ্যে হতেই উঠে পরল ছেলেটা। আসাদের অনুমান ঠিক হয়েছে, আসেনি তার অপেক্ষার মানুষ।


দ্বিতীয় দিনঃ

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের আযানের শব্দ ভেসে এল।

“কি মনে হয় আসাদ ভাই? আজ কি মেয়েটি আসবে?” জালাল জিজ্ঞেস করল।

চিন্তাটা আসাদকে একমুহূর্ত সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না। বিছানায় বসে এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে সে। “ঠিক বুঝতে পারছি না!”

“না বুঝার কিছু নাই ভাই। আসবে না মেয়েটা। ছেলেটি কি এখনও বসেই আছে?”

“মাঝে মাঝে একটু উঠছে। এদিক ওদিক সামান্য হাঁটছে, একটু পর এসে আবার বেঞ্চটাতে বসে পরছে”।

“ছেলের ধৈর্য আছে বলতে হবে! আজকারকার জামানায় এমন ধৈর্যশীল ছেলের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। একটা মেয়ের জন্য সেই জোহরের ওয়াক্ত থেকে অপেক্ষা করছে আর এখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে!”

“ঠিকই বলেছেন, ভাই”।

৫ মিনিট নিঃশব্দে কেটে যায়। আসাদ তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে আর জালাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে পা নাচায়।

আসাদ বলল, “জালাল ভাই, ছেলেটা পকেট থেকে মোবাইল বের করছে। মনে হচ্ছে মেয়েটার কাছে ফোন করছে!”

“এইতো বুদ্ধিমানের কাজ করেছে” জালাল হাসল। “আজকের ডিজিটাল জামানায় ওইসব পুরনো সেন্টিমেন্ট নিয়ে পরে থাকলে চলে বলেন?”

“ব্যাপারটা এত হালকাভাবে নিয়েন না জালাল ভাই” জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল আসাদ, “হয়ত ছেলেটির মন বলছিল মেয়েটি আসবেই। নিজের মনের ওপর ভরসা আছে তার। সত্যিকার ভালবাসা এমনই হয়!”

“কি জানি ভাই! আপনারাই ওসব ভাল বোঝেন! আমি জীবনে প্রেম করিনি, প্রেমের মর্ম কি বুঝব বলেন?”

“সম্ভবত অপর প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দিচ্ছে!”

“বলেন কি!”

“হ্যা, ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে তাই মনে হচ্ছে। বার বার ফোন করছে, কানে লাগাচ্ছে, নামিয়ে নিচ্ছে আর বিরক্ত হয়ে আবার ডায়াল করছে”।

মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোস করল জালাল, “তারপরও বলবেন মেয়েটি ছেলেটাকে ভালবাসে!”

“অন্তত ছেলেটিতো তাই বিশ্বাস করে!”

আরও ৫ মিনিট কেটে গেল নিরবে।

আসাদই নিরবতা ভাঙল আবার, “জালাল ভাই, ছেলেটা উঠছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে তো মেয়েটা বোধহয় আর আসবে না!”

জালাল শব্দ হেসে উঠল।

জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে জালালের দিকে তাকাল আজাদ। “কিরে ভাই, হাসছেন কেন?”

জালাল হাসিটা ধরে রেখেই জবাব দিল, “আপনার কেন মনে হচ্ছে ছেলেটি একটি মেয়ের জন্যই অপেক্ষা করছে? হতে পারে অন্য কিছু! এত দৃঢ় বিশ্বাস করাটা ঠিক হচ্ছে না ভাই”।

“জালাল ভাই, আপনি যদি দেখতে পেতেন তাহলে নিজেই বুঝতেন। ছেলেটার চোখের চাউনি, উৎসুক চোখে এদিক ওদিক তাকান, বারবার অস্থির ভঙ্গিতে ওঠা বসা এসব দেখেই বুঝে নেওয়া যায় সে নিজের ভালবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে”।

“তাহলে মেয়েটি দেখা করার কথা দিয়েও আসছে না কেন?”

“হয়ত মেয়েটি ছেলেটাকে পরীক্ষা করছে। হয়ত দেখতে চাইছে তার ভালবাসার গভীরতা কতটুকু, কতটা ধৈর্য আছে তার!”

“পর পর দুইদিন টানা চার পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে। বুঝাই যাচ্ছে ভাল ধৈর্য আছে!”


তৃতীয় দিনঃ

আসাদ ডাকল, “জালাল ভাই কি ঘুমিয়ে পরেছেন?”

“না ভাই। জেগেই আছি”।

“ছেলেটি এসেছে ভাই। ঐ বেঞ্চেই বসেছে”।

“আহারে! ছেলেটির আসলেই ধৈর্য আছে বলতে হবে। আমি তো ভেবেছিলাম আর আসবে না! পর পর দুদিন কথা দিয়ে যে আসেনি তার জন্য আবারো অপেক্ষা করতে চলে এল!”

“একেই বলে ভালবাসার জোর, জালাল ভাই”।

“হুম... কি মনে হয় আপনার আজ মেয়েটি আসবে?”

“বলা যাচ্ছে না। তবে আমার মন বলছে আসবে”।

“মন বলছে মানে? আপনি কি ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন নাকি?”
আসাদ নিঃশব্দে একটু হাসল। উত্তর দিলনা।

“আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার কথা শুনে হাসছেন! তবে আমি আপনার সাথে বাজি ধরে বলতে পারি ভাই, মেয়েটি আজও আসবে না। মেয়েটি আসলে ছেলেটাকে ঘুরিয়ে আরাম পাচ্ছে!”

“কারও সম্পর্কে না জেনে কিছু বলাটা তো ঠিক নারে ভাই। দেখা যাক কি হয়”।

মিনিট দশেক পেরিয়ে গেল। কেউ কোনও কথা বলল না।
হঠাৎ আসাদের মুখ থেকে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল।
“কি হল আসাদ ভাই?”

আসাদ বলল, “আপনি তো বাজি হেরে গেলেন জালাল ভাই! মেয়েটি এসেছে!”

মাই গড! “আপনি কি সিরিয়াসলি বলছেন? নাকি ফান করছেন?”
“আমি সিরিয়াসলি বলছি। মেয়েটি এসেছে, বেঞ্চে ছেলেটির পাশেই বসেছে”।

“দেখতে কেমন মেয়েটা?”

“খুব আহামরি গোছের সুন্দরি না, তবে সুশ্রী। গায়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু চোখদুটি খুব মায়াময়। দীঘল কাল চুল পরিপাটি করে আচরে রেখেছে, সাদা সালোয়ার কামিজ আর লাল রঙের ওড়না পরেছে। ছেলেটির সাথে মানিয়েছে বেশ!”

“ওহ! হাউ রোমান্টিক, ইস! দৃশ্যটা যদি একবার দেখতে পারতাম ভাই!”হতাশ ভঙ্গিতে বলল জালাল, “ছেলেটা কি করছে এখন? নিশ্চয়ই মেয়েটির হাত ধরে বিজয়ের হাসি হাসছে”!

“না, ছেলেটি রোবটের মত বসে আছে। কথা বলছে না, মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেও না। রাগ করেছে বোঝাই যায়!”

“মেয়েটি কি করছে?”

“চেষ্টা করছে নানান কথা বলে ছেলেটার মান ভাঙ্গানোর। লাভ হচ্ছে না!”

জালাল উচ্চ শব্দে হেসে উঠল। “এবার বোঝ ঠেলা! দুদিন অপেক্ষা করিয়ে রেখেছ, এই মান ভাঙতে দু দিন লাগবে এবার”।

আসাদ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “ওহ হ! ছেলেটা করছে কি?”

“কি করল আবার?”

“আরে.... বোকা কোথাকার! দুহাতে নিজের মুখ আড়াল করে হাপুস নয়নে কাঁদছে!”

আবার একচোট হেসে নিল জালাল, এবার আসাদও হাসল। হাসি থামতেই জালাল বলল, “ছেলেটা এত সেন্টিমেন্টাল, সেটা বোঝাই যায়নি! এই বয়সী ছেলে কাঁদছে, হায়রে!”

“মেয়েটা চেষ্টা করছে তাকে মানানোর। নিজের কান ধরে প্রতিজ্ঞা করছে আর এমন করবে না। আশে পাশের লোকজন সব উকি দিয়ে দেখছে! কি অবস্থা!” আসাদ বর্ণনা দিল।

“এই ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা!” জালাল বলল, “বিয়ের পর দেখবেন মেয়েটি বাইরে চাকরি করবে আর এই ছেলে ঘরে বসে হাউস হাসব্যান্ডের কাজ করবে। দিন শেষে বউ অফিস থেকে ফিরবে সেই আসায় পথ চেয়ে.....” কথা না শেষ করেই আবার উচ্চশব্দে হাসল জালাল।

“কান্না থামিয়েছে ছেলেটা। দু একটা কথা বলছে এখন”।

“আপনার কথাই সত্য হল আসাদ ভাই। মেয়েটা অবশেষে এল! কীভাবে আপনার সব অনুমান মিলে গেল বলেন তো! আপনি কি ভবিষ্যতবাণী করতে পারেন নাকি মানুষের মনের কথা পড়তে পারেন?”

“কোনটাই পারিনা ভাই। একটু অনুমান করেছিলাম আর কি! কীভাবে যেন মিলে গেছে!”


চতুর্থ দিনঃ

“বাহ! দুজনকে বেশ মানিয়েছে”।

“তাই?”

“হ্যা, দুজনই আজ নীল রঙের পোশাক পরে এসেছে। মেয়েটা নীল শাড়ি আর ছেলেটা নীল শার্ট। মনে হয় আগে থেকে প্লান করে এসেছিল। দুজনের মধ্যে কারও একজনের প্রিয় রঙ নীল হবে”।

“তাই নাকি? তো বলেন দেখি কার প্রিয় রঙ নীল? ছেলেটার নাকি মেয়েটার?”

“মেয়েটির”।

“উঁহু, আমার মনে হয় ছেলেটির”।

“আপনার এমন মনে হওয়ার পিছনে যুক্তি কি?”

“যুক্তি কিছু নেই, মনে হল তাই বললাম। আপনার মনে হওয়ার পিছনে কোন যুক্তি আছে নাকি?”

“যুক্তি তেমন একটা নেই, তবে ছেলেটির আচরনে মনে হচ্ছে যে নীল রঙটা তার খুব একটা পছন্দ না, কিন্তু মেয়েটাকে খুশি করার জন্য পরেছে”।

“আপনি ভাই মানুষ একটা! আচরন দেখেই কত কিছু বলে দিতে পারেন!”

“এটা বলা তেমন কিছু না। দেখতে পেলে আপনিও ধরতে পারতেন”।

“কথাটা ঠিক না ভাই” অমত পোষণ করল জালাল। “এই ক্ষমতা সবার সমান থাকেনা। এই যে দেখেন আমি চোখে দেখিনা, কিন্তু আমার অনুভুতির সাহায্যে আশে পাশে কি হচ্ছে অনেক কিছু বলে দিতে পারি। আপনার তো অনুভব করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেটা কি আমার সমান?”

আসাদ হাসল।

“ইস! খুব ভাল হত যদি এখন ওদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করা যেত যে কার প্রিয় রঙ নীল!”

আসাদ হাসি ধরে রাখল, তার মন বলছে তার অনুমানই ঠিক।

পঞ্চম দিনঃ

“আজ ছেলেটা একটা পাগলামি করেছে ভাই”।

“কি?”

“মেয়েটির জন্য একগাদা ফুল কিনে এনেছে ব্যাগে করে। মেয়েটা খুব অবাক হয়ে যাবে, এতগুলো ফুল দিয়ে সে করবে কি?”

“তার আনার কাজ সে এনেছে!” জালাল হাসল। “মেয়েটি কি করবে সেটা তার ব্যাপার!”

“তাই বলে এমন পাগলামির কোনও মানে আছে?”

“থাক! প্রেমে একটু পাগলামির প্রয়োজন আছে”।

“ঐ যে মেয়েটি এসেছে! বলেছিলাম না অবাক হয়ে যাবে!”
“ছেলেটা কি করছে?”

“আর কি করবে? মেয়েটাকে টেনে এনে বেঞ্চে বসিয়েছে, এখন ব্যাগ উলটো করে রাজ্যের ফুল সব তার কোলের ওপর ঢেলে দিচ্ছে!”

“হা হা হা.........” জালালের সেই চিরচেনা হাসি।

“মেয়েটা ফুলগুলো সব নেড়ে চেড়ে দেখছে। মনে হচ্ছে লজ্জা পেয়েছে খুব, ঠোটে লাজুক হাসি, তবে খুশিও হয়েছে বোঝাই যায়”।

“আমি বলে দিচ্ছি ভাই। ঘোষণা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল জালাল, “এই জুটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে সুখি দম্পতি, আপনি দেখে নিয়েন”।

আসাদ জালালের কথা শুনছে না, সে এখন সুন্দর কিছু মুহূর্তের ধারা বর্ণনা দিতে ব্যাস্ত। “মেয়েটা একটা গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে গন্ধ শুকছে, এবার ছেলেটার নাকের কাছে ধরল। হা হা হা.... ছেলেটা যেই মুহূর্তে গন্ধ শুকতে গেছে অমনি মেয়েটি তার নাকের ওপর ফুলটা চেপে ধরেছে... ওহ ছেলেটা যে ভয়ংকর হাচ্চি দিচ্ছে... এখন কাশছে.....”

“আর মেয়েটা কি করছে?”

আসাদ উত্তর দিলনা। ছেলেটির কাশি দেখে তার মুখের হাসি নিভে গেছে।

“ও আসাদ ভাই? থেমে গেলেন কেন?”


আসাদ কিছু বলল না। ছেলেটার কাশি দেখছে।

“আসাদ ভাআআআআআআই” চেঁচিয়ে উঠল জালাল।

“আসাদের সতবিৎ ফিরল, কি ভাই?”

“বলছি থেমে গেলেন কেন? কি হচ্ছে এখন, বলেন!”

গম্ভীর গলায় আসাদ বলল, “মেয়েটা হাসছে খুব, ছেলেটার কাশছে ভীষণ”।

“আপনার গলায় অমন দুঃখ দুঃখ ভাব চলে এল কেন? এটা তো একটা মজার দৃশ্য”!

“না মানে.... ছেলেটার কাশি কেমন যেন.......”

“কি কেমন? কাশি আবার কেমন হবে?”

“কাশির ধরনটা, ভাল লাগছে না আমার”।

“ধুর!! এক এক জন এক এক রকম ভাবে হাসে। আমার এক মামা আছেন, উনি কাশলে মনে হয় কেউ বোমা ফাটাচ্ছে....” আবার উচ্চশব্দে হেসে উঠল জালাল।

কিন্তু আসাদ চিন্তিত মুখে বসে রইল।


ষষ্ঠ দিনঃ

“আসাদ ভাই, শরীর খারাপ নাকি?”

“না ভাই। কেন?”

“শুয়ে পরেছেন যে! এই সময়টাতে আপনাকে তো জানালার পাশ থেকে সরানই যায় না”।

আসাদ উত্তর দিলনা।

“একটু দেখেন না ভাই, ছেলে মেয়ে দুটো কি করছে!”
আসাদ শুয়েই থাকল।

দুই মিনিট পর জালাল আবার বলল, “কি হল আসাদ ভাই?”
আসাদ কঠিন সুরে বলল, “আপনাকে তো বললামই ওরা পরস্পরের হাত ধরে বসে আছে আর গল্প করছে”।

“কি হয়েছে ভাই আপনার? কোনও কারনে আমার ওপরে রেগে আছেন নাকি?”

আসাদ আবার নিরুত্তর।

“ও আসাদ ভাই! আমি অন্ধ মানুষ, না জেনে কোনও ভুল করে থাকলে সেটা বলে দিন না। শুধু শুধু রাগ করে আছেন কেন ভাই?”

“আরে নারে ভাই। রাগ আপনার ওপর না। রাগ হচ্ছে ঐ ছেলেটার ওপর!”

“কেন ভাই? ছেলেটাকে তো আপনি খুব পছন্দ করতেন, হঠাৎ রাগ করছেন কেন তার ওপর?”

“আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা মেয়েটির কাছ থেকে জরুরী একটা বিষয় গোপন করেছে”।

“কি সেটা? আমাকে বলেন”।

“আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা আপনার আমার মতই একজন”।

“কি বলছেন?”

“হ্যাঁ ছেলেটা ড্রাগ আডিক্ট, মেয়েটার কাছ থেকে সেটা গোপন করেছে”।

“বলছেন কি ভাই! কীভাবে বুঝলেন?”

“বোঝা যায় ভাই, তার আচার আচরনে কিছু একটা আছে যা দেখে সহজেই বিষয়টা অনুমেয়। আর বিশেষ করে সেদিন তার কাশির ধরন দেখে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলাম। নিজে ড্রাগ আডিক্ট তো, তাই বুঝেছি। দেখতে পেলে আপনি নিজেও ধরতে পারতেন”।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জালাল। বলল, “আমার কি মনে হয় জানেন ভাই? আমার মনে হয় আপনার কোনও বিশেষ ক্ষমতা আছে, যেটা আপনি নিজেই জানেন না! আমার মনে হয় আপনি মাইন্ড রিড করতে পারেন। মানুষের মনের ভাষা আপনি বুঝতে পারেন”।

আসাদ কোনও কথা বলল না। চিন্তাটা তার মাথায়ও কাজ করছে।


সপ্তম দিনঃ

“আসাদ ভাই, দেখেন তো মেয়েটি এল কিনা!”

আসাদ জানালা দিয়ে উকি দিল, “হ্যা ভাই। এসেছে”।

“আজ এত দেরি করল কেন? কি মনে হয়?”

“মনে হয় মেয়েটি কোথাও ছোট খাট একটা চাকরি করে, কোনও মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে অথবা বড় কোন রিটেইল শপের সেলস গার্ল হবে। অফিস থেকে আগে আগে ছুটি নিয়ে এসে ছেলেটির সাথে প্রতিদিন দেখা করে। আজ আর অফিস ফাকি দিতে পারেনি”।

“আর ছেলেটি কি করে মনে হয় আপনার?”

“কাজ কর্ম কিছু করছে না। শহরের কোনও মেসে থাকে হয়ত, জোড়াতালি দিয়ে চলছে কোনরকম”।

“তাহলে কীভাবে হবে বলেন? কাজকর্ম তো কিছু একটা করতে হবে। নইলে মেয়েটাকে বিয়ে করে খাওয়াবে কি? নাকি আমার কথা মত হাউজ হাসব্যান্ড হবে? হা হা হা.........”

“তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন অন্য একটা জিনিস”।

“কি?”

“নেশা! এই নেশা তাকে ছাড়তে হবে। ছেলেটি চায় সঠিক পথে ফিরে আসতে। অন্তত আমার মন বলছে সে কথা। সে ভাল হতে চায়”।

“ভাল হতে বাধা কোথায়? আমরা সবাই ভাল হতে চাই! তাই তো আমরা এখানে এসেছি। সেও কোনও একটা ভাল মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে যাক”।

“ভর্তি হয়ে যাক বললেই তো হবে না! এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কারও কারও ৬ মাস, কারও ১ বছর।, কারও ক্ষেত্রে ৫ বছর লেগে যায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে। আমাদের হাসপাতালের মত ভাল একটা বেসরকারি যায়গায় যেতে হলে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। সেই টাকা এই ছেলে কোথায় পাবে? আর সরকারি যায়গাগুলোতে সঠিক চিকিৎসা হয় বলে মনে করেন?”

“বিষয়টা মেয়েটিকে বুঝিয়ে বললেই তো হয়। মেয়েটি নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করতে পারবে”।

“কখনোই না। মেয়েটা যেই মুহূর্তে জানবে যে ছেলেটি ড্রাগ আডিক্ট, সেই মুহূর্তে তার সংগ ত্যাগ করবে”।

“এমনটা মনে করার কোনও কারন নেই আসাদ ভাই। মেয়েটি অনেক ভালবাসে তাকে!”

“মেয়েদের সাইকোলজি আপনি বুঝবেন না ভাই। এরা কখন কি করে বসে তা আগে থেকে টের পাওয়া মুশকিল”।

“কি জানি! হয়ত আপনিই ঠিক বলেছেন! কিন্তু আমার মনে হয় সব কিছু এভাবে গোপন করে রাখাটা কোনও সমাধান না”।


অষ্টম দিনঃ

“কি ব্যাপার আসাদ ভাই? আজ এত গম্ভীর হয়ে আছেন কেন?”

“ভাবছি”।

“কি ভাবছেন?”

“ছেলেটার কথা ভাবছি”।

“কি করছে ওরা এখন?”

“মেয়েটা একনাগারে নানান কথা বলে যাচ্ছে আর ছেলেটা মাঝে মাঝে হু-হা করছে”।

“তো... এটা আপনার ভাবনা বাড়িয়ে দিল কেন?”

“ছেলেটি মেয়েটার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মাথায় অন্য কিছু আছে, অন্য কিছু ভাবছে মনে হয়”।

“কি ভাবছে বলে মনে হয়?”

“বুঝতে পারছি না। ভয়ংকর কিছু হবে”।

“ভয়ংকর কিছু? সেটা আবার কি?”

“সে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে। ভয়ংকর কোনও একটা কাজ করতে চলেছে সে”।

“কেন মনে হচ্ছে এমন?”

"কারনটা আমার জানা নেই। হয়ত আপনার কথাই ঠিক। হয়ত সত্যিই আমি মনের কথা বুঝতে পারি"।

"দেখেছেন? আমি বলেছিলাম না? এতক্ষনে বিশ্বাস হল? তাহলে এবার ঝটপট বলে ফেলুন দেখি ছেলেটা কি পরিকল্পনা করছে! দেখি ব্যাপারটা মিলে যায় কিনা!"

"সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। আরও ভাবতে হবে......"

"ঠিক আছে ভাবুন। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ভালভাবে ভেবে বের করুন ছেলেটা আসলে কি করতে যাচ্ছে!"

হুম... বলে আবার চিন্তায় মশগুল হয়ে পরল আসাদ।


নবম দিনঃ

“এভাবে অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন কেন? একটু স্থির হয়ে বসুন না!”

আসাদ বসল না। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না জালাল ভাই। ছেলেটা এখনও আসেনি। তারমানে সে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে নেমে পরেছে”।

“আপনি একটু সুস্থির হয়ে বসুন। দেখবেন আপনার ধারনা ভুল। ছেলেটা চলে আসবে”।

“আমার ধারনা ভুল হতেই পারেনা। কিন্তু যে ছেলে তিন দিন ধরে এক মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেই মেয়েটির জন্মদিনের দিন সে আসতে দেরি করবে, এটা হতেই পারেনা!”

“এই জন্মদিনের কনসেপ্টটা আপনার মাথায় কে ঢুকিয়েছে বলেন তো? কে বলেছে আজ মেয়েটির জন্মদিন?”

“দেখেই বুঝেছি আজ তার জন্মদিন। গত এক সপ্তাহ ধরে মেয়েটিকে দেখছি। তাকে কখনো এত সুন্দর দামী কাপড়- চোপড় পড়তে আর সাজগোজ করতে দেখিনি”।

“এতেই কি প্রমান হয়ে যায় আজ তার জন্মদিন? অন্য কোনও কারন থাকতে পারেনা? হয়ত কোনও দাওয়াতে গিয়েছিল, সেখান থেকে এসেছে ছেলেটার সাথে দেখা করতে!”

“ওকে! আমি মনের কথা পড়তে পারছি, ঠিক আছে? আমার মন বলছে আজ তার জন্মদিন” স্বীকার করল আসাদ।

“হতে পারে এই বিষয়ে আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু ছেলেটার ব্যাপারে আপনার ধারনা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। হয়ত কোনও কাজে আটকা পরেছে!”

“জালাল ভাই! ছেলেটা যেকোনো কাজ ফেলে এসে মেয়েটার সাথে দেখা করত ভাই! কোন কাজই তার কাছে মেয়েটির চেয়ে ইম্পরট্যান্ট না! তাছারা মেয়েটি বারবার ফোন করছে তার কাছে, কিন্তু ছেলেটি রিসিভ করছে না। হয়ত ফোনটাই অফ করে রেখেছে”।

“হতে পারে ছেলেটা কোনও ভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। সে নিজেও দুদিন অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিল। এবার মেয়েটা বুঝুক অপেক্ষার কষ্ট কাকে বলে!”

“জালাল ভাই! হাসালেন আপনি। আজ মেয়েটির জন্মদিন! আজ ছেলেটি কিছুতেই এমন কাজ করবে না!”

“তাহলে কোনও বিপদ আপদ হয়েছে হয়ত। মানুষের বিপদ তো বলে কয়ে আসেনা!”

জালাল ভাই আপনি বুঝতে পারছেন না............ আসাদ পায়চারী করার গতি বাড়িয়ে দিল। একহাত মুঠো পাকিয়ে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি মারছে। মনে মনে বলছে, “ঠিক করছে না, ছেলেটা ঠিক করছ না! মস্ত বড় ভুল করছে সে, এজন্য সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে তাকে...... ”

মেয়েটি অপেক্ষা করে বসে আছে তার ভালবাসার মানুষ আসবে সেই জন্য...... সে জানেনা কাছাকাছি কোথাও একটা কক্ষে বসে আরও দুজন মানুষ ছেলেটির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
মাগরিবের আযান দিতেই এক রাজ্যের হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। আসেনি তার ভালবাসার মানুষ!


দশম দিনঃ

“ছেলেটির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখছ আসাদ?” জিজ্ঞেস করল জালাল। গতকাল থেকেই তারা দুজন দুজনকে “তুমি” করে বলছে। পরস্পরের সান্নিদ্ধে দশটি দিন কাটিয়েছে তারা, দুজনের মাঝে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

“ঠিক বুঝতে পারছি না। দুজন তো সুন্দর আবার আগের মত গল্পে মেতে উঠেছে”।

“অস্বাভাবিক কিছু চোখে পরছে না তোমার?”

“নাহ! হয়ত তোমার ধারনাই ঠিক, হয়ত সত্যিই কোনও বিপদে পরেছিল ছেলেটা”।

“তুমি কিছু একটা গোপন করছ আসাদ। আমি বুঝতে পারছি। তোমার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে তুমি মিথ্যে বলছ”।

আসাদ চুপ করে থাকল।

আমার কাছে গোপন করোনা আসাদ। “বল কি হয়েছে!”

আসাদ প্রায় ফিস ফিস করে বলল, “অন্যান্য দিনের মত আজ সকালেও তোমাকে পত্রিকা পড়ে শুনিয়েছি.........”

আসাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জালাল বলল, “...এবং বুঝতে পেরেছি পত্রিকায় কোনও একটা বিশেষ খবর তুমি আমাকে পড়ে শোনাওনি। গোপন করে গেছ। কি সেটা?”

একমুহূর্ত ইতঃস্তত করে আসাদ বলল, “গতকাল সকালে গুলশানের একটা মার্কেটে ডাকাতি হয়েছে। সকাল বেলা দোকান খুলতেই একজন মুখোশধারী অস্ত্র হাতে ঢুকে পরে। সবে মাত্র কিছু দোকান খুলেছে, মার্কেটে মানুষজন খুব কম, সিকিউরিটি গার্ডরাও প্রস্তুত ছিলনা। সেই ডাকাত প্রায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ডায়মন্ডের গহনা হাতিয়ে নিয়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালিয়েছে”।

“মনে হচ্ছে আগে থেকেই বেশ প্ল্যান পোগ্রাম করা ছিল”।

“হ্যা... ডাকাত জানত ঠিক কখন দোকান খুলবে, সিকিউরিটি গার্ডরা কোথায় থাকবে। কোন পথ দিয়ে ঢুকলে কেউ দেখবে না, কোন পথ দিয়ে কেউ সন্দেহ করার আগেই পালাবে সব কিছুই তার আগের পরিকল্পনা করা ছিল”।

“তোমার কি মনে হয় ছেলেটাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে?”

আসাদ কিছু বলল না।

“এখন সত্যি করে বল বাইরে কি দেখছ?”

“ছেলেটা এখন মেয়েটির সাথে স্বাভাবিক আচরন করার চেষ্টা করছে কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকালই মারাত্মক কিছু একটা ঘটিয়ে এসেছে সে। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, মনে হচ্ছে সারাক্ষন একটা ভয়ের মধ্যে আছে”।

“কিন্তু কি লাভ হল আসাদ? ছেলেটা কি মনে করেছে সেই গহনা বিক্রির টাকায় সে মেয়েটিকে নিয়ে সুখের সংসার করবে? কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়! এতক্ষনে সব যায়গায় খবর ছড়িয়ে পরেছে, ওগুলো বিক্রি করতে গেলেই তো সে ধরা খেয়ে যাবে”।

“সেটা তো ছেলেটিও জানে, জালাল। তাইত আমি বলেছিলাম ভয়ংকর একটা প্ল্যান করেছে সে! তার প্লানের শেষটা এখনও বাকি!”

“কি বলছ তুমি? কি করবে সে এখন?”

“সেটা এখনই বলতে চাইছি না। আরও কিছুক্ষন দেখি, তারপর বোঝা যাবে আসলেই আমার ধারনা ঠিক কিনা!”

প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল । আসাদ কিছু বলছে না, জালাল উৎসুক হয়ে আছে কিছু একটা শোনার আশায়।

“ওহ মাই গড! ওহ মাই গড!” বলে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পরল আসাদ। “আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে জালাল”।

“কি হয়েছে আসাদ? কি হয়েছে? আমাকে বল!”

“ছেলেটি তার পকেট থেকে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস বের করেছে। সেটা এখন মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিচ্ছে”।

“এটা তো ভাল লক্ষন আসাদ। এর মানে ছেলেটি আসলে ডাকাতি করেনি, নইলে ডাকাতি করা গহনা গার্লফ্রেন্ডের গলায় পরিয়ে দেওয়ার সাহস পেতনা। হয়ত ছেলেটি নিজের জমানো সব কয়টি টাকা খরচ করে তার ভালবাসার মানুষের জন্য একটা উপহার কিনে এনেছে। এটাই তো ভালবাসার শক্তি আসাদ! তুমিই না আমাকে শিখিয়েছিলে!”

তুমি বুঝতে পারছ না জালাল। অস্থির কণ্ঠে বলল, “এটা ডাকাতি করা গহনাই! এখন ছেলেটি একটা ভয়ংকর কাজ করবে!”
“কি কাজ করবে”?

আসাদ উত্তর না দিয়ে বলল, “ওহ গড! মেয়েটি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আজ তার জরুরী কোনও কাজ আছে। সে নিজেকে আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী প্রেমিকা বলে মনে করছে কিন্তু সে জানেনা তার প্রেমিক কি করতে চলেছে!”

“কি করবে ছেলেটা?” জালালের কণ্ঠেও অস্থিরতা। “আমাকে বল আসাদ......”

আরও দুই মিনিট চলে গেল। আসাদ চুপচাপ বসে চেয়ে রইল জানালার বাইরে। জালালের মনে হল সে আসাদের হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে!

জালাল প্রায় ধরা গলায় বলল, “আসাদ”।

“কি?”

“ছেলেটা পকেট থেকে মোবাইল বের করছে”।

“এখানে অস্বাভাবিক কি আছে?”

“ছেলেটি সচরাচর যে মোবাইলটি ব্যাবহার করে এটা সেই মোবাইল না। সে এই মোবাইলটি এনেছে বিশেষ একটা নম্বরে ফোন করার জন্য। কথা বলা শেষ হতেই ফোনটা ভেঙে ফেলবে সে”।

“কাকে ফোন করছে সে?”

জবাব না দিয়ে হঠাৎ চিৎকার শুরু করল আসাদ, “নাহ.....এটা তুমি করোনা ছেলে! এই ভুল করোনা.....মেয়েটির জীবন তুমি নষ্ট করনা....” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল আসাদ।

জালাল উঠে এসে আসাদকে ধরল। “কি হল আসাদ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কাকে ফোন করছে ছেলেটা?”

আসাদ তখন হিস্ট্রিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মত কাঁপছে। “জালাল....তুমি জাননা! ছেলেটি এখন পুলিশের কাছে ফোন করেছে....সে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে সেই ডাকাতি হওয়া ডায়মন্ড একটি মেয়ের কাছের আছে....মেয়েটি কোন রাস্তা ধরে যাচ্ছে সেই ঠিকানাও পুলিশকে বলে দিয়েছে সে, জালাল!.... কয়েক মিনিটের মধ্যে মেয়েটি ধরা পরবে!”

“আর ছেলেটা?” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল জালাল, “সে কি করবে?”
আসাদ কাঁপতে কাঁপতে বলছে, “সে এখন ভাল একটা মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হবে। সে.....সে যতদিনে ভাল হয়ে বের হবে.....ততদিনে মেয়েটির জেল হয়ে যাবে, ঘটনাটা.... ঘটনাটা ঢাকা পরে যাবে....তারপর...তারপর ছেলেটি গহনাগুলো ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করে... বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে”।

“কিন্তু গহনাগুলো? গহনাগুলো কোথায় রেখেছে সে?”

ছেলেটি সে মেসে থাকে তার পাশে একটা ছোট মাঠ আছে, “মাঠের এককোনায়... এককোনায়... আছে......”

“হ্যা.. বল আসাদ! এক কোনায় কি আছে?”

“এক কোনায়.... এক কোনায় একটা বড় আমগাছ আছে”।

“হ্যা, তারপর? বল আসাদ!” জালালের কণ্ঠে তাগাদা। “থেমনা আসাদ! বল।”

সেই আমগাছের গোঁড়ায়... গভীর একটা গর্ত করে...গহনাগুলো একটা টিনের বাক্সে ভরে....পুতে রেখেছে।

জালাল আসাদকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আসাদ মেঝেতে পরে থাকল, তার মুখ থেকে গোঙ্গানির মত শব্দ হচ্ছে। ঠোঁটের কোন দিয়ে লালা গড়িয়ে পরছে। সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই জালালের। সে চোখ থেকে কাল চশমাটা খুলল। পকেট থেকে বের করল মোবাইল। একটা নাম্বারে ডায়াল করে মোবাইলটা কানে চেপে ধরল। অপর প্রান্তে রিসিভ হতেই বলল, “হ্যা, ইকবাল! বাকি গহনাগুলো কোথায় আছে আমি জানতে পেরেছি। ছেলেটি যে মেসে থাকে তার পাশেই ছোট একটা মাঠ আছে, মাঠের এক কোনায় একটা আমগাছ আছে। সেই আমগাছের গোঁড়ায় একটা গর্ত করে টিনের বাক্সে ভরে গহনাগুলো পুতে রাখা হয়েছে....”


***

আসাদ এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। সে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। তার মুখোমুখি বসে আছে জালাল।

বড় করে একটা দম নিয়ে জিজ্ঞেস করল আসাদ, “তাহলে দেখা যাচ্ছে তুমি আসলে অন্ধ নও!”

মৃদু হাসল জালাল। বলল, “না, আমি অন্ধ নই”।

“তাহলে এই নাটক কেন করলে?”

“একটি নিরপরাধ মেয়েকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য”।

একমুহূর্ত চুপ করে থাকল আসাদ। তারপর বলল, “তুমি আসলে কে?”

“জালাল আহমেদ আমার আসল নাম না। আমার নাম আশরাফ রবিন। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার, পাশাপাশি মনরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছি”।

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!” আসাদের কণ্ঠে নির্ভেজাল বিস্ময়। “তুমি এখানে কেন? কীভাবে... মানে... তুমি এসবে জড়ালে কীভাবে?”

"সব বুঝিয়ে বলছি" বলে একটু সময় নিল রবিন। তারপর শুরু করল, “মাস খানেক আগে শহরে চাঞ্চল্যকর এক ডায়মন্ড ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একজন মানুষ একাই কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ডায়মন্ড হাতিয়ে নিয়ে পালায়। এই ঘটনায় চারিদিকে সাড়া পরে যায়, পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। ঠিক পরদিনই একটা অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন পেয়ে পুলিশ রাস্তা থেকে শায়লা নামে একটি মেয়েকে ডাকাতি হওয়া একটি ডায়মন্ডের নেকলেস সহ গ্রেফতার করে। প্রাথমিকভাবে মেয়েটিকে দোষী ভাবা হয় কিন্তু মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি গহনাগুলোর কোনও খোজ পাওয়া গেল না। জুয়েলারি দোকানের মালিকের দেওয়া ডাকাতের বর্ণনার সাথেও মেয়েটিকে মেলান যাচ্ছিল না। তাই কেইসটা গিয়ে পড়ল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের উপর। এখানেই আমার আগমন।

শায়লা নামের যে মেয়েটিকে পুলিশ ধরেছিল সে ছিল আমারই ছাত্রি। মেয়েটির বাড়ি নেত্রকোনা। হলে থাকত। পার্টটাইম একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করে লেখাপড়ার খরচ মেটাত। মেয়েটিকে আমি ভালভাবেই চিনতাম এবং জানতাম যে এমন একটা কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব না। কিন্তু তাকে নিরপরাধ প্রমান করার সুযোগ আমার হাতে ছিলনা। কেইসটা যখন ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হাতে পড়ল, তখনই সুযোগটা এল। কারন ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর ইকবাল খান আমার বাল্যবন্ধু। সেই আমাকে সুযোগ করে দিল এই কেইসটাতে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করার। আমরা সবাই শায়লার সাথে বস্লাম। তার কাছ থেকে জানা গেল নেকলেসটা তাকে তার বয়ফ্রেন্ড গিফট করেছে, সেই বয়ফ্রেন্ড এখন লাপাত্তা। শায়লার কাছ থেকে তার নম্বর নিয়ে ট্রেস করা হল, জানা গেল সে মাদকাশক্ত ছিল এবং এখন একটি মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি আছে। বোঝা গেল ছেলেটি নিপুনভাবে তার ট্র্যাক কভার করেছে এবং সে যদি অস্বীকার করে যে মেয়েটিকে চেনেনা তাহলে কিছুতেই তাকে ডাকাতির ঘটনার সাথে মেলান যাবে না। প্রমানের অভাবে শায়লার শাস্তি হয়ে যাবে, ছেলেটা যতদিনে ভাল হয়ে বের হবে ততদিনে ঘটনাটা চাপা পরে যাবে আর ছেলেটা সেই গহনাগুলো ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করে নতুন জীবন শুরু করবে। এখন একটাই উপায় আছে ছেলেটাকে দোষী সাব্যস্ত করার। যদি কোনও ভাবে ডাকাতি হওয়া বাকি গহনাগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়!

তাই শায়লার সাথে ছেলেটির পরিচয়, প্রনয় সহ সবকিছু আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তারিত শুনলাম। তারপর ছেলেটির মুখ থেকে কথা বের করার জন্য সুন্দর একটা প্ল্যান করলাম। আমার দুজন ছাত্র ছাত্রিকে বেছে নিলাম শায়লা আর তার বয়ফ্রেন্ডের ভুমিকায় অভিনয় করার জন্য। মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রের কতৃপক্ষকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই তারা রাজি হল। একটা খোলা মেলা সুন্দর রুম ফাকা করে দিল, যেখানে জানালার বাইরে খোলামেলা যায়গা আছে। এখানটায় বেশকিছু ঝোপঝাড় ছিল, সেগুলো সাফ করে একটা বেঞ্চ বসান। নিজেই মাদকাশক্ত সেজে চলে এলাম এখানে ছেলেটির কাছাকাছি থাকার জন্য, ছেলেটিকে অন্যরুম থেকে ট্র্যান্সফার করে এখানে আনা হল। তারপরের ঘটনা তো তুমি জানই”।

আসাদ মাথা নিচু করে সব কিছু শুনছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সবই বুঝলাম, তোমার প্ল্যান সাকসেসফুল! আমি ধরা পড়ে গেছি কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে পারছি না! তুমি অন্ধ সেজেছিলে কেন?”

“এটা দরকার ছিল” বলল রবিন,“আমি জানতাম সিমুলেশন প্রসেসের মাধ্যমে তোমাকে পুরোপুরি কনভিন্স করা সম্ভব হবেনা। তুমি আর শায়লা সুন্দর একটা পার্কে দেখা করতে, পাশেই ছিল স্বচ্ছ পানির একটি লেক- সেখানে অনেক গুলো সাদা হাস সাতার কাটত, পার্কে অনেকগুলো বেঞ্চ ছিল-তাতে বসে মানুষজন গল্প করত, ছোটছোট ছেলে মেয়েরা খেলে বেড়াত। তাই নিজে অন্ধ সাজলাম। তোমাকে বোঝালাম আমি জানি এখানে একটা লেক আছে, লেকের পাশে একটা ছোট্ট পার্ক আছে, পার্কে বেশ কিছু বসার বেঞ্চ আছে, লেকে হাসেরা ভেসে বেড়ায়, বাচ্চারা খেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি একজন অন্ধলোকের সহানুভুতিতে আঘাত দিতে চাওনি তাই মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে স্বীকার করে নিলে। সব মিলিয়ে তোমাকে আমি বাধ্য করেছি, বলতে পার কিছুটা হিপনোটাইজ করেছি যাতে তুমি ভাবতে থাক তোমার মাইন্ড রিড করার ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার গুনেই তুমি ছেলে আর মেয়েটির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আগেই জানতে পারছ। আসলে ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। তুমি আসলে টের পাওনি যে তোমার জীবনের সত্যি ঘটনাগুলোই এখানে মঞ্চস্থ করা হচ্ছে”।

আসাদ মাথা নিচু করে শুনছিল। রবিন থামতেই বলল, কিন্তু আজকের পত্রিকা? ওটাও নকল?

"হ্যা, ওটাও আগে থেকে প্ল্যান করা" একমুহূর্ত থেমে থেকে রবিন বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি আসাদ?”

আসাদ নিরুত্তর।

রবিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আসলেই শায়লাকে ভালবাসতে নাকি পুরোটাই ছিল ভান?”

রবিন ভেবেছিল এই প্রশ্নেরও জবাব পাবে না, কিন্তু আসাদ জবাব দিল, “আমি আমার জীবনে দুজন মানুষকেই শুধু ভালবেসেছি। এক ছিলেন আমার মা, আর একজন হল শায়লা”।

“ভালই যদি বেসে থাক, তাহলে কেন করলে এই কাজ?”

আসাদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। জবাব দিল না।


***

দরজায় টোকার শব্দ হতেই খুলে দিল রবিন। দাড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর ইকবাল খান। দুই বন্ধু হাত মিলাল। ইকবাল বলল, “গুড জব, বন্ধু”।

রবিনের ঠোটে হাসি,“থ্যাংকস!”

ইকবাল খান তাকাল আসাদের দিকে। আসাদ মূর্তির মত বসে আছে বিছানায়। ইকবাল বলল, “মি. আসাদ। আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছি, ওনারা বলেছে আপনি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছেন। আমি এসেছি আপনাকে গ্রেফতার করতে। তবে একজন মানুষ আপনার সাথে একটু কথা বলতে চায়। তার অনুরোধেই আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল”।

ইকবাল আর রবিন বেরিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকল শায়লা নামের মেয়েটা। আসাদ মুখ তুলে তাকাল না।

“কেমন আছ আসাদ?” শায়লা জিজ্ঞেস করল, “এই কয়দিনে আমার কথা কি একবারও মনে পরেনি তোমার?”

আসাদ দুহাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠল। শায়লা প্রায় দৌড়ে এসে আসাদের কাধে হাত রাখল। “কি করছ পাগল? আবার সেই দিনের মত শুরু করলে! এই বয়সী ছেলে কাঁদলে কেমন দেখায়!”

কাঁদতে কাদতেই বলল আসাদ, “আমাকে মাফ করে দাও শায়লা....আমি ভুল করেছি...মস্ত বড় ভুল!”

শায়লা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, “আমি তোমার উপর একটুও রাগ করিনি আসাদ”।

মিনিট খানেক লাগল আসাদের স্বাভাবিক হতে। শায়লার নিজের চোখের পাতাও ভিজে উঠেছে। “তুমি সব কিছু আমাকে খুলে বললেই তো পারতে বোকা! আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? আমি কোনও অবস্থাতেই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না!”

“বিশ্বাস কর শায়লা! আমি এই কাজ করতে চাই নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি! শেষে কি থেকে কি হয়ে গেল, আমি এটা কি করে বসলাম। নিজের বাঁচানোর জন্য তোমাকে ফাঁসিয়ে দিলাম!”

অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাসল শায়লা, “চিন্তা করোনা। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে কথা বলেছি, উনি বলেছেন ডাকাতি হওয়া সব মাল ফেরত পাওয়া গেছে বলে তোমার খুব বেশি শাস্তি হবে না। বড় জোর ৩ থেকে ৪ বছরের জেল। এই সময় তো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে! আমার কিছু জমানো টাকা আছে, চাকরি করে আরও কিছু জমাব। তারপর তুমি ছাড়া পেলেই দুজনে ছোট্ট একটা সংসার পেতে বসব। জমানো টাকা থেকে তোমাকে একটা দোকান নিয়ে দেব। বাকি জীবনটা ভালভাবেই কেটে যাবে আমাদের!”

আসাদ মৃদু হাসল, বলল,“কথা দিচ্ছি, আমি একদিন তোমাকে নিজের রোজগার করা টাকা দিয়ে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস কিনে দেব”।

শায়লার হাসিটা আরও প্রশস্ত হল। ওদের জন্য বরাদ্দকৃত পাঁচ মিনিটের তিন মিনিট কেটে গেছে, বাকি দুমিনিট ওরা হাত ধরে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দিল।

ওদিকে দরজার বাইরে দাড়িয়ে কথা হচ্ছিল ইকবাল আর রবিনের মাঝে।

ইকবাল বলছে, তোকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন রবিন?
“কিছু একটা চোখে পড়ছে না ইকবাল! মনে হচ্ছে কিছু একটা মিস করে গেছি”।

“সব কিছু তো প্ল্যানমতই হয়েছে”।

রবিন বলল, “সেটাই তো চিন্তা করছি! সবকিছু যেন খুব সহজেই সমাধান হয়ে গেল”।

“তাতে সমস্যা কোথায়?”

“আসাদকে আমি এই দশদিনে যতটুকু দেখেছি তাকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষন ছেলে বলেই মনে হয়েছে। তুই একটা বার চিন্তা করে দেখ! এমনিতে আমি মাদকাশক্ত নই, তার ওপর অন্ধের ভান করে পরে আছি। একটা বুদ্ধিমান ছেলে দশ দিন যাবত পাশাপাশি অবস্থান করেও একবারের জন্য সন্দেহ করল না!”

“সেটাই তো তোর কেরামতি! তুই ওকে সাইকোলজিক্যালি ম্যানিপুলেটেড করতে পেরেছিলি। এর ফলে তুই যা বলছিলি ওর কাছে তাই সত্য বলে মনে হয়েছে, এর বাইরে ভাবার কোনও সুযোগ ছিলনা তার!”

"ব্যাপারটা এত সহজ না, ইকবাল। আমি জানতাম একজন মানুষকে তার অতীতের কিছু ঘটনা অভিনয় করে দেখালেই সে হিপনোটাইজড হবেনা। সেজন্য আমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। অথচ আমাকে অলমোস্ট কিছুই করতে হয়নি"।

“তার মানে তুই বলছিস চাইছিস আমরা যেমন অভিনয় করেছি, ঠিক তেমনি আসাদও আমাদের সাথে অভিনয় করেছে! আর ইউ কিডিং মি?

“আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না, শুধু সম্ভাবনার কথা ভাবছি। এমন হতে পারে কি যে ছেলেটি আসলে বুঝতে পেরেছিল আমি তাকে নিয়ে খেলছি। সে নিজেও অনুতপ্ত ছিল, পাপ মোচনের পথ খুঁজছিল, তাই আমার খেলার সাথে তাল মিলিয়েছে! ”

“বুঝেছি! দশ দিন একটা বদ্ধ ঘরে আটকে থেকে তোর ব্রেনে গিট্টু লেগে গেছে! বাইরের চল, ফ্রেস বাতাস পেলে ঠিক হয়ে যাবে! ৫ মিনিট হয়ে গেছে! বদমাইশটাকে এখন লকআপে নিয়ে ঢোকাতে পারলেই শান্তি....”

কিছুক্ষন বাদেই ৪১১ নং কক্ষটি খালি হয়ে গেল। হয়ত আজই নতুন ভর্তি হওয়া দুজন পেসেন্টকে দেওয়া হবে এই কক্ষে। তারা কখনো জানবে না গত দশ দিনে কি ঘটে গেছে এখানে!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০৬
৫৫টি মন্তব্য ৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×