(ফেব্রুয়ারী মাসে ছোটদের একটা পত্রিকায় লেখাটি দিয়েছিলাম। তারা সৌজন্যকপি দিয়ে গেছে কিন্তু পত্রিকা হারিয়ে ফেলেছি। মনে হল ব্লগে দিয়ে রাখি নাইলে ল্যাপটপ থেকেও হয়ত হারিয়ে যাবে)
বাবু পড় “অ”।
বাবুর নাম তৌসিফ। বাবুর জন্য আদর্শলিপি কেনা হয়েছে। বাবুর সামনে প্রথমবারের মত আদর্শলিপি খোলা হয়েছে। বাবু আজ অক্ষর শিখবে।
বাবু বল, স্ব রে অ।
বাবু বলল, অ।
এই তো এবার বাবু লিখ দেখি এটা। এভাবে লিখতে হয়।
বাবুকে পেন্সিল দিয়ে “অ” লিখে দেখানো হচ্ছে। যত যহজে মুখ দিয়ে অ বলা গিয়েছে দেখা যাচ্ছে এত সহজে লেখা শেখানো যাচ্ছে না। বাবুর মা তাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বাবু লিখ, অ।
কয়েকদিন পার হল। বাবু অ আ ই ঈ ... পর্যন্ত কোনরকমে শিখল। বাবুর মায়ের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। এই ছেলে এত স্লো কেন? এতদিনে মাত্র এই পর্যন্ত শিখেছে।
পরেরদিন বাবুর বাড়িতে কারো আগমণ ঘটল।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমুস সালাম।
জ্বি এটা তৌসিফের বাসা?
জ্বি। আপনাকে তো চিনতে পারছিনা।
জ্বি আমি মাণিজগঞ্জ থেকে এসেছি। পারিল বলধার গ্রাম, সিংগাইর।
আপনি কি তৌসিফের বাবার পরিচিত কেউ?
জ্বি, চাচাজান আমার পরিচিত। মানিকগঞ্জ থেকেই খবর পেয়েছিলাম তৌসিফের কথা। আজ দেখতে আসলাম আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ১০ মিনিট সময় হবে কি?
জ্বি ভিতরে আসুন।
লোকটি ভিতরে ঢুকলেন। মেঝেতে তৌসিফের আদর্শলিপি।
তৌসিফ অক্ষর শিখছে বুঝি?
হ্যা। আদর্শলিপি দিয়ে শুরু করানো হল। কিন্তু খুব বেশিদূর আগাতে পারেনি।
মায়ের ভাষা যেভাবেই হোক শিখে ফেলবে। দাড়ান আমি দেখছি।
আগুন্তক আদর্শলিপি হাতে নিল।
তৌসিফ দেখ, এটা অ, এটা আ। ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ ...
তৌসিফ বলল, এগুলো জানি।
আরেকবার দেখ। গভীর মমতায় দেখ। হাত দিয়ে ছুয়ে দেখ।
তৌসিফ অক্ষরগুলোয় স্পর্শ করল। আগেও করেছে, আজ কেমন কেমন জানি লাগছিল।
যখনই অক্ষর শিখবে, প্রত্যেকটি অক্ষর হাত দিয়ে ছুয়ে দেখবে। এগুলো রক্ত ও ভালবাসা দিয়ে কেনা অক্ষর।
(ফটো ক্রেডিটঃ আল ইমরান। প্রথম আলো ব্লগ থেকে নেওয়া)
বিকালে তৌসিফের বাবা বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফিরে দেখেন তৌসিফ আদর্শলিপির অক্ষরগুলো পড়ে ফেলতে পারছে। তৌসিফের বাবা খুশি হলেন। তৌসিফের মা বললেন,
- রফিকউদ্দিন এসেছিলেন।
- কোন রফিকউদ্দিন? অফিসের?
- না না, বাড়ির রফিকউদ্দিন। মানিকগঞ্জের।
- মানিকগঞ্জের কোন রফিকউদ্দিন?
তৌসিফের বাবা মানিকগঞ্জে পরিচিত লোকদের ফোন দিলেন কোন রফিকউদ্দিন আজ বাসায় এসেছিল। মানিকগঞ্জের এক বিখ্যাত রফিকউদ্দিন আছে তাঁর তো আসার কথা না। তিনি আজ থেকে ৫২ বছর আগে প্রেসে কাজ করতেন। আদর্শলিপি প্রেসে ছাপানোর সময় বাংলা বর্ণমালার প্রত্যেকটি অক্ষর তিনি ছুয়ে দেখতেন। তারপর একদিন ভাষা রক্ষার দাবীতে বের হয়ে যান রাস্তায়। পুলিশ গুলি চালালে মাথার খুলি উপরে যায়। ঢাকা মেডিকেলে তাঁর লাশ পরে থাকে। সেই রফিকউদ্দিন বায়ান্ন বছর পর কিভাবে আসবে? অবশ্য বাংলার আনাচে কানাচে কেউ যখন আদর্শলিপি হাতে নেয় তিনি কি আর বসে থাকেন। তিনি খোঁজখবর নেন। রক্ত ও ভালবাসা দিয়ে অর্জন করা বর্ণমালার।