লেখাটা শুরু করা যায় অনেক জায়গা থেকে। অন্তত পক্ষে আমার কাছে তিনটা সাল আছে। ১৯৮৫, ১৯৮৯ এবং ১৯৯৮। ঠিক আছে তাহলে ১৯৯৮ দিয়েই শুরু করি।
সোনারগা হোটেলে দাঁড়িয়ে আছি। ক্রিকেটারদের এতদিন খালি টিভি পর্দায় দেখেছি। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের তিন দেশীয় টুর্নামেন্ট। এত বড় বড় তারকারা এসেছেন যে বাংলাদেশের কেউ আর ঘরে বসে থাকতে চায়না। নিজ চোখে দেখতে চায় তারকাদের। আমার বয়স তখন ১৪। আমিও সোনারগা হোটেলে গেলাম। খালাতো ভাইবোন মারফত। গাড়ি থেকে নেমে যে যার মত চারিদিকে যাচ্ছে। ততক্ষনে সাইদ আনোয়ারকে দেখা হয়ে গেছে। দেখে নিলাম আকিভ জাভেদকে। দূরে দাঁড়িয়ে ইনজামাম আর জাদেজা গল্প করছে। বুঝলাম মাঠে যাই হোক মাঠের বাইরে তাদের সম্পর্ক ভালই। তখনও একটা ব্যাপার আঁচ করতে পারিনি। আমি ঠিক রিসিপশনের মত একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। তার পিছনে ফোনে কেউ একজন কথা বলছে। মোবাইল না। তখন মোবাইলের এত প্রচলন ঘটেনি। নীল শার্ট পরা খাট এই লোকটা শচীন টেন্ডুলকার। আমি কি অবাক হব কিনা বুঝলাম না। স্পর্শ করা দূরত্বে শচীন দাঁড়িয়ে। কোন রকমে প্যাডের মত একট আকাগজ নিলাম। কলম নিলাম। নিরহংকার মানুষটা কলম দিয়ে লিখে দিল শচীন টেন্ডুলকার। অনেক ভারতীয় তাকে নিজ চোখে দেখেনি। আমি দেখেছি। আমার সামনেই তিনি কলম দিয়ে তার নাম লিখে দিয়েছেন। এই বিশ্বে যার আগমন ক্রিকেট খেলার জন্য।
১৯৮৫ সালের ঘটনা যদি বলতে হয় সেখানে তার থেকে আরেকজনের অবদান আরও বেশি/ স্কুল ক্রিকেটে ৬০০ এর বেশি রানের একটা জুটি গড়েছেন দুই বন্ধু শচীন আর ভিনোদ। ভিনোদ কাম্বলির রান শচীনের থেকেও বেশি। জুটি করার মাঝে একসময় বিপক্ষ দলের খেলোয়াররা বল করতেও রাজী হননি।
এর থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চ ১৯৮৯ সালের ঘটনা। ক্রিকেটের ডন ব্র্যাডম্যান টিভি দেখছিলেন। টেস্টে অনন্য রেকর্ড তার। গড় প্রায় ১০০। তিনি হটাৎ অন্য রুম থেকে তার বউকে ডেকে আনলেন। আরে দেখো কান্ড দেখো। তার বউ বললেন কি হল? ডন ব্র্যাডম্যান বললেন, পুঁচকে ছোড়াটা পুরা আমার মত ব্যাট চালায়।
তবে গতকাল যা হল তাতে মনে হয় ১৯৮৭ সালের কাহিনীটা গল্প লেখার জন্য দারুন। ভারত বনাম ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। বল মাঠের বাইরে যাচ্ছে আর এক বল বয় বলটাকে কুড়িয়ে মাঠের ভেতর পাঠাচ্ছে। এভাবে করতে করতে ভারত হেরে গেল। তখন থেকে সেই বল বয়ের একটাই চিন্তা, দেশকে বিশ্বকাপটা এনে দিতে হবে। কাকতালীয়তা দেখুন। সেই মাঠেই বিশ্বকাপ জিতল ভারত। সেই বলবয়ের শেষ বিশ্বকাপ ছিল সেটা।
শচীনের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি কিন্তু তার ডেবু হওয়ার প্রায় ৫ বছর পর। এটা একটা মজার ব্যাপার সেটাই সম্ভবত প্রথম কোন ক্রিকেট ম্যাচ যেটা আমি পুরা দেখি। কারন তার আগের দিন বাসায় প্রথমবারের মত ডিশ কানেকশন লাগানো হয়। ১৯৯৪ সালের ঘটনা। খেলা হয়েছিল শ্রীলঙ্কাতে ভারতের বিপক্ষের দল অস্ট্রেলিয়া। শচীন করেন ১১০ ভারত ২৪৬ এবং ম্যাচটি জিতে যায়। সম্ভবত তখন থেকে আমি ক্রিকেটের ফলোয়ার। বাসায় ডিশ লাগানো হয়েছে। ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শচীনকে প্রথম খেলতে দেখলাম। পুরা খেলায় একজনই আউট হয়েছেন সেটা শচীন। মোহাম্মদ রফিকের বলে বোল্ড। শচীন যে বাংলাদেশির বলে সব থেকে বেশি আউট হয়েছেন সে মনে হয় রফিক। আমি নিজেই তিনবার দেখেছি। ক্রিকেটের সব ধরনের অর্জন তার আছে খালি একটাই মনে হয় বাকি আছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচে সেঞ্চুরি নেই (এটা আসলে মজা করার জন্য বলা)।
শচীনের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান ইন্টারনেট ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে। সেদিক না গিয়ে অন্য দিকে আলোচনা করি। তার কাছ থেকে শেখার উপকরন গুলো দেখি। সব থেকে বড় ব্যাপার তার বিনয়। তার শৃঙ্খলা। তার বাবা তাকে বলে গিয়েছিলেন কখনো মদ্যপান না করতে সে এই কাজ কখনো করেননি। সম্প্রতি ২০ কোটি টাকার এ্যড করার অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই ১০ ঘন্টা করে প্র্যাকটিস করতেন। একটা কাজই তিনি করতেন কিভাবে নিজের স্কিল বাড়ানো যায়। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তিনি তো কভার ড্রাইভ পারেন। সেখানে এত প্র্যাক্টিসের কি আছে? কুংফুতে একটা কথা আছে- দশহাজার স্কিল জানার থেকে একটা স্কিল দশহাজারবার প্র্যাক্টিস করা বেশি ভয়ঙ্কর। শচীন সেই কাজটিই করেন। সাধারন শট গুলাই তিনি বছরের পর বছর প্র্যাক্টিস করে এমন উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছেন যে সেগুলোই অসাধারন হয়ে গেছে। এখান থেকে শুধু ক্রিকেটারদের না, সবারই শেখার কিছু না কিছু আছে। কোনদিনই নাইট ক্লাবে জাননি তিনি। তার একটাই কাজ ক্রিকেট খেলা আর সেটাই সারা জীবন শৃংখলা বদ্ধ ভাবে করে গেছেন।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ চোলার সময়েই তার বাবা মারা যান। তিনি দেশের ফিরে দলের জন্য আবার ইংল্যান্ডে যান। তার ক্রিকেটার হয়ে উঠার পিছনে বাবার অনেক অবদান। পরের ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেই ব্যাটটাকে আকাশে তুলে বাবালে স্মরণ করেন। হৃদয়টা তো সবার সামনে দেখানো যাচ্ছেনা।
বৈবাহিক জীবনে তিনি সুখী। তার ছেলে আর মেয়েকে কালকে টিভিতেই দেখলাম। মনে আছে শচীনের বিয়ের ছবি পেপারে দেখেছিলাম। অঞ্জলী পেশায় ডাক্তার। শচীনের থেকে ৫ বছরের বড়। অঞ্জলীকে গিয়ে শচীন বলেছিলেন আমরা বিয়ে করতে চাই এটা তুমি আমার বাবাকে গিয়ে বল।
আশরাফুলের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন শচীন। আশরাফুলকে বলেছিলেন তুমি মাঝে মাঝে বেশি আক্রমনাত্মক হতে চাও মাঝে মাঝে একেবারেই গুটিয়ে যাও। কালকে হারভাজানের এক গাদা বল তুমি চাইলেই সিঙ্গেলস নিতে পারতে।
শচীনকে নিয়ে এত জায়গায় এত লেখা পড়বেন যে আমার আর বাকি কিছু লেখার নেই। খালি একটা ঘটনা আর একটা জবাব দিয়ে শেষ করি।
প্রথম ঘটনাটা খুব মজার। পেলে আর ম্যারাডোনার এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ফুটবলের দুই গ্রেট সারাদিন মারামারি করেন কিন্তু ক্রিকেটের দুই গ্রেটের মাঝে আছে খালি শ্রদ্ধা। ব্যাডম্যানের ৯০ তম জন্মদিনে ব্র্যাডম্যান শেন ওয়ার্ন আর শচীনকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। শচীন তাকে গিয়ে বলেন, আপনি ৯৯ দশমিক ৯৪ গড়ে রান করেছেন। এখন খেললে আপনার গড় কত হত? ব্র্যাডম্যান বললেন, ৭০। শচীন বললেন, কি বলেন ৭০! আমার ধারনা আরো বেশি হত। ব্র্যাডম্যান হেসে দিয়ে বলেছিলেন, আরে এই নব্বর বছর বয়সে ৭০ গড়টা কি তোমার কাছে কম মনে হচ্ছে? শচীন হেসে ফেললেন।
বর্তমান কালের যাদের সাথে শচীনের তুলনা হত তাদের প্রায় সবাইকে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। ব্রায়ান লারা বলেই দিয়েছেন শচীন সেরা। সাঈদ আনোয়ারের সাথে এক সময় তুলনা হত এখন শচীন অনেক দূর এগিয়ে। তবে তারা সবাই গ্রেট। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে ক্লাসে অনেক ভাল ছাত্র থাকে। কিন্তু ফার্স্ট একজনই হয়।
অনেকে বলেন শচীন রান করলেও ম্যাচ জিতাতে পারেনা। শচীন ১৭৫ করে দেওয়ার পরেও যদি দল হারে তাহলে বাকি দশ জন খেলছে ক্যান। অনেকে বলে শচীন দলের জন্য খেলেনা, নিজের জন্য খেলে। শচীন যদি নিজের জন্যই খেলত তাহলে মনে হয় না তাকে আউট করা যেত। শচীন যে মাঝে মাঝে আউট হয়- তার কারন তিনি স্বার্থপর নন- তিনি দলকেই জিতাতে চান। পৃথিবীতে তার আগমন ক্রিকেটের জন্যই।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১১ সকাল ১০:১৩