somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রঞ্জনশীলের বেঁচে যাওয়া এবং আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো।

২২ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কালি রঞ্জনশীল ঘুমাচ্ছিলেন কিন্তু যে শব্দ হচ্ছে তাতে তার পক্ষে ঘুমানো সম্ভব নয়। সাউথের ২৩৫ নম্বর রুমে তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। হটাৎ তীব্র শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গল। শব্দটা কিসের সেটা বুঝতে তার সময় লাগল। ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গুলির শব্দ বোমাতে ছাপিয়ে যাচ্ছে না বোমার শব্দের চোটে গুলি শোনা যাচ্ছেনা কে জানে। পৃথিবীর আর কোথাও নিরস্ত্র জনগনের উপর সেনাবাহিনী এভাবে ঝাপিয়ে পড়ে কিনা জানা নেই। কিন্তু আজ পড়েছে। রঞ্জনশীলের সেটা বুঝতে সময় লাগল।

রঞ্জনশীল হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করলেন। উদ্দেশ্য তিনতলা। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক সুশীল সেখানে থাকেন। কোনভাবে সুশীলের রুম পর্যন্ত যদি যাওয়া যায়। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে সুশীলের রুমে গিয়ে সুশীলকে পাওয়া গেলনা। তবে অনেক ছাত্র আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। রুমের ভিতর থেকেই একজন বলল ছাদে যেতে। রঞ্জনশীলে চিন্তা করলেন ছাদে যাওয়া ঠিক হবে কিনা! সেখানেই না বরং গুলি লাগা সম্ভাবনা বেশি। তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। নিজেকে স্বার্থপর মনে হল কিন্তু একা একা হামাগুড়ি দিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে। সাউথ বিল্ডিঙ্গের বাথরুমের জানালা দিয়ে অনেক কিছুই দেখতে লাগলেন। পাকিস্তানি আর্মি ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে রুমে রুমে ছাত্রদের খুঁজে শহীদ মিনার নিয়ে গিয়ে গুলি মারছে। প্রাণ বাঁচার আকুতি সবার কিন্তু সেই আকুতি আজ আরা টিকার নয়। পাকিস্তানিরা যেখানে পারছে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।

হটাৎ রঙ্গনশীল স্তব্ধ হয়ে গেলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন সৈণ্যরা সাউথ বিল্ডিঙ্গের দিকেই আসছে। যেই বিল্ডিঙ্গের বাথরুমেই আশ্রয় গেড়েছেন তিনি। ডাইনিং রুমের দরজা ভেঙ্গে ফেলে সেখানে আশ্রয়রত ছাত্রদের গুলি করল। হলের কেয়ারটেকার প্রিয়নাথকে অবশ্য তখনো মারেনি। তার কপালে বন্দুক ঠেকানো। দেখিয়ে দিতে বলা হল হলের অন্যান্য জায়গা যেখানে ছাত্ররা লুকিয়ে আছে। রঞ্জনশীল এরপর আর দেখতে পেলেননা। তবে বন্দুকের গুলির শব্দ সৈন্যদের পৈশাচিক উল্লাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আব বোল জয় বাংলা আব বোল। দেখতে হে ক্যায়সে বাংলাদেশ মিলতা হ্যায়। পুরা ঢাকা শহর আগুন জলছে। এস এম হল দেখা যায় সেখানেও একই অবস্থা। গনহত্যা ধ্বংসলীলা চলছেই। রঞ্জনশীল তখন আযানের শব্দ শুনতে পেলেন। হিন্দু হলেও তিনি জানেন আযান মানে তো সৃষ্টিকর্তার ডাক। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বাইরে বের হয়ে এলেন।

ভোরে কার্ফু জারি করা হয়েছে। তবে পাকিস্তানিদের গনহত্যা থেমে নেই। সারারাত যারা পালিয়েছিল তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে ধরে মারা শুরু হল। রঞ্জনশীল বাথরুম থেকে বের হয়েই সৈণ্যদের মাঝে পড়লেন। কয়েকজন ছাত্র মিলে সেই কেয়ারটেকার প্রাণনাথের মৃতদেহ ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। সৈন্যদের নির্দেশে যারা জীবিত তাদের কাজ হল মৃতদেহ গুলাকে বহন করে নিয়ে মাঠে নিয়ে যাওয়া। সেখানে মৃতদেহের স্তুপ করা। জীবিতদের মধ্যে দারোয়ানের ছেলেদের দাবী তারা বাঙ্গালী নয় তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। একজনকে মনে হয় ছেড়ে দিল। তাকে এক সৈন্য কোথাও নিয়ে গেল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষন পর সেখান থেকে এক মহিলা চিৎকার করতে করতে বের হল। না যাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল তাকেও প্রানে বাঁচতে দেওয়া হয়নি।




( ২৬ শে মার্চ দিনের বেলায় জগন্নাথ হলের মাঠের হত্যার ভিডিও )


সৈন্যদের উপহাস চলছেই। রঞ্জনশীলসহ জীবিতদের নিয়ে সব ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। দামী জিনিসপত্র লুটপাট হল। জয় বাংলা বলিস না কেন? কোন একরুমে সবুজ লাল হলুদ (তখন পতাকার সাথে মানচিত্র থাকত) পতাকা পাওয়া গেল। সেটাকে নিয়ে পাড়ানো শুরু হল। মৃতদেহের স্তুপে দর্শনের জি সি দেবকে পাওয়া গেল। যেখানে হিন্দু পেলেই মেরে ফেলা হয় তিনি কিনা সৈন্যদের নিজেই গিয়ে বলেন আমি হিন্দু। আত্মভোলা লোক ছিলেন। একবার ক্লাসে ভুলে মশারী গায়ে দিয়েই চলে যান। রঞ্জনশীল বুঝতে পারলনা সে কি করবে। সব মৃতদেহের স্তুপ টানার পর জীবিতদের একসাথে করা হল। তাদের উপর গুলি যালানো হল। অনেক দূর থেকে বুয়েটের এক শিক্ষক তার পোর্টেবল ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে সেই দৃশ্য ধারন করল। ভিডিওতে অবশ্য বোঝার উপায় নেই রঞ্জনশীল কোনজন। তবে তিনি পড়ে গেলেও মরে যাননি। ড জি সি দেভ আর দারোয়ান সুনীলের পাশেই শুয়ে ছিল সে। সৈন্যরা মনে করেছিল সে মরে গেছে। তাকে সেভাবেই রেখে চলে যায়। মৃতস্তুপগুলার মাঝে তখনও কয়েকজনের প্রাণ ছিল। বাঁচার জন্য তারা সবাই কাতরাচ্ছিল। রঞ্জন শীল হামাগুড়ি দিয়ে পাশে কর্মচারীদের বস্তির দিকে যেতে লাগল। হলের ইলেক্ট্রিশিয়ানের বাড়ির দিকে। তার বউ রঞ্জনশীলকে দেখেই কাঁদতে শুরু করল। পুরানো পুস্তক বিক্রেতার নাম ছিল ইদুর। সে রঞ্জনশীলকে দেখেই বলল, আমি বুঝছিলাম আপনি বেঁচে গেছেন। কোন দুশ্চিন্তা করবেননা। আমি আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাব। রঞ্জনশীল নিরাপদে পালাল। পুরান ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা অবশেষে বরিশাল। তবে সেটা পালানো না। পাকিস্তানিরা আঘাত এনেছে। এখন জবাব দেওয়ার পালা। জগন্নাথ হল থেকে ২৫ শে মার্চের ঘটনায় মাত্র তিনজন বাঁচতে পেরেছিল। আরেকজনের কথা জানা যায় যে দুইদিন পুকুরের এক কোনায় ডুব দিয়েছিল।


( তথ্যসুত্রঃ Century of Genocide: Eyewitness Accounts and Critical Views; New York: Garland Publishing, 1997
Chapter 10, pp. 291-316 থেকে নেয়া ।সেখানে Massacre at Jagannath Hall নামে ইংরেজি অনুবাদটি করেছিলেন সোহেলা নাজনীন। তবে গল্প আকারে সাজানোর জন্য আমাকে কিছু বদল করতে হয়েছে।)


রঞ্জনশীলদের উপর যখন আঘাত আসে সেই ২৫ সে মার্চের রাতে রাজার বাগ পুলিশ অপারেটর শাজাহান মিয়া সব পুলিশ স্থাপনা গুলাতে ক্ষুদ্র বার্তা পাঠান " ‘পাকিস্তানিরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছে, আমরা বিপদের মুখে পড়েছি’। সমগ্র দেশের পুলিশ প্রশাসন প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ২৭ মার্চের বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানের ঘোষনার পরপরই সমগ্র বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে অনির্বায্য এক পরিনতির। বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।


* (রঞ্জনশীলের ছেলে হচ্ছেন ব্লগার রাহা ভাইয়ের বন্ধু। তার ব্লগ থেকেই প্রথম জানতে পারি। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।)


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১১ রাত ৯:৪৯
২৬টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×