এ দিকে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার এম পি হোস্টেল কয়েকজন আর্মি অফিসারের মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে। ইয়াহিয়া নাকি স্বাধীন মুক্তিকামী বাঙ্গালী যাদেরকে পাকিস্তানিরা বিদ্রোহী বলছে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। এই বিষয়টা নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব চলছে। তাদের মতে এইসব দুষ্কৃতিকারীরা কোন ক্রমেই ক্ষমার যোগ্য নয়। যেহেতু ইয়াহিয়া সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করলে আইন অনুযায়ী অনেককে ছেড়ে দিতে হবে আর সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করা হবে ৫ ই সেপ্টেম্বর তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল কিছু বন্দীদের আজই মেরে ফেলবে। এমপি হোস্টেলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। মুক্তিকামী বীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা ঐ দিন শহীদ হল।
১৯৭৪ সাল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করলেন। মুক্তিযুদ্ধে ছেলে এবং স্বামী হারানো জাহানারা ইমাম জামীকে নিয়ে বেঁচে আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা চিন্তা ভাবনা করছেন। হটাৎ সেই অনুষ্ঠানে একজন একটি পোট্রেট নিয়ে আসল। তার নিজের হাতে আঁকা ছবি। স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছেন শফি ইমাম রুমি। মুক্তিযোদ্ধা জননী ছবিটি দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। "রুমি, রুমি" আওয়াজ তার মুখ দিয়ে বের হল। পার্টিতে আসা সবাই শহীদ জননীকে স্বান্তনা দিতে আসলেন। জাহানারা ইমাম থামলেন। তার কান্না দেখে অনেকে তাকে দূর্বল ভাবতে পারে। রুমির মত ছেলে মাদের দূর্বল হলে চলেনা। তিনি কান্না থামালেন। তবে ছেলের জন্য মায়ের ব্যাথা কি আর তাতে কমে? তিনি চোখ মুছলেন। তিনি ফিরে গেলেন ১৯৫১ সালের ২৯ শে মার্চ। ভাষা আন্দোলনের আগের বছর জন্ম নেওয়া তার ছেলে শফি ইমাম রুমি। তিনি শুধু রুমির মা ছিলেননা। তিনি ছিলেন তার বন্ধু।
রুমি যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন জাহানারা ইমাম একদিন দেখেন রুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কী জানি বই পড়ছেন । ছেলে তাকে লুকিয়ে কখনো কিচ্ছু করবে এমনটা তিনি ভাবতেই পারেননা। তাই ছেলেকে বলেই রেখেছেন যাই করবে তা যেন মাকে বলেই করে। সিগারেট খাওয়া জাহানারা ইমামের একদম পছন্দ না। তবে রুমি যদি কখনও সেটা খায় তা যেন মাকে জানিয়েই খায়। তাই রুমির লুকিয়ে বই পড়াটা জাহানারা ইমামের পছন্দ হলনা। কিছুক্ষন পর এসে তিনি দেখেন রুমি পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। জাহানারা ইমাম চুপ করে পা টিপে টিপে গেলেন। নাহ খারাপ কোন বই নয়। সেটা ছিল লেনিনকে নিয়ে লেখা একটা বই। রিভোলিউশনারীদের নিয়ে রুমির আগ্রহ কেন তিনি তাই চিন্তা করলেন। তবে কি রুমিদের মত ছেলেরা এখন চিন্তা করছে রাশিয়ার মত বাংলাদেশেও একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে? জাহানার ইমাম ঘুমন্ত রুমির মাথার বিলি কেটে দিলেন। দুই ভাই রুমি-জামী দুজনেরই মায়ের হাতে বিলি কেটে দেওয়া দারুন পছন্দ।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ এক দূর্যোগ এল। বিশাল জলোচ্ছাসে প্রায় দশ লাখ লোক মারা গেল। এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেননি। ইয়াহিয়া খান চীন থেকে সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেল। দশ লাখ লোক মারা গেল একটি মাত্র দোষে- কারন তারা বাঙ্গালী। বাংলাদেশের জনগন তখন থেকে পাকিস্তানী সরকারের উপর আস্থা পুরাপুরি হারিয়ে ফেলল। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের দিকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একদল অসহায়দের সাহায্য করতে যায়। তরুন রুমিও সে সফরে গেল। মানুষের কষ্ট দেখে তার হৃদয় কেদে উঠল।
৭ তারিখ শেখ মুজিবের ভাষন শুনেছিল ৩০ লাখ লোক। রেসকোর্স ময়দানে রুমিও ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার কোন স্পষ্ট ঘোষনা না আসায় রুমি খুশি হতে পারেনি।
- শেখ নিরাশ করেছে সবাইকে।
রুমির কথার বিরুদ্ধে জবাব আসে
-তোমরা চ্যাংড়া ছেলেরা কি যে বল না- ভেবেচিন্তে! শেখ যা করেছেন, একদম ঠিক করেছেন।
রুমির বলিষ্ঠ কন্ঠ, জনগন এখন স্বাধীনতাই চায়। এটাই তাদের প্রানের কথা। (আরও কিছু বাক বিতন্ডা পড়ে) আমি কোন দল্ভুক্ত নই, কোন রাজনৈতিক দলের শ্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারন বুদ্ধি সম্পন্ন, মান-অপমান জ্জান সম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ। আমার মনে হচ্ছে শেখ আজ অনায়াসে ঢাকা দখল করার মস্ত সুযোগ হারালেন।
২৫ শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট হয়ার আগেই রুমি এই ব্যাপারটা ধারনা করতে পেরেছিল তাই সকালেই তার মাকে বলে, আম্মা তুমি বুঝতে পারছনা মুজিব -ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেওয়ার অজুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দিবেনা। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশত্র সংগ্রাম করে।
আমরা কি এখনো রুপকথার জগতে বাস করছি? উপায় মনে হয়য় আর নেই আম্মা!!
জাহানারা ইমাম শেখ মুজিবকে সমর্থন করলেন। শেখ ঠিক পথেই আগাচ্ছেন। তোরা হলি মার-মার কাটকাট বাঙ্গালী। শেখ অহিংস আন্দোলন করে ঠিকি দাবী আদায় করে নিবে।
আম্মা তুমি আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছ। ওরা আলোচনার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। শেখ বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। এপথে, এভাবে আমরা বাঁচতে পারবনা।
২৯ শে অগাস্ট। এমপি হোস্টেলের সামনে ৫ জন দাঁড়ানো। ৫ জনের মুখের উপর লাইট ফেলা হল। "হু ইজ রুমি?" এক সাথে দাড়ানোর ফাঁকে রুমী অন্যদের বলে, " তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবেনা। তোমরা কেউ কিছু জাননা"।
তার কিছুক্ষন আগেই রুমীর মায়ের সামনে দিয়ে রুমি, রুমির ভাই জামী আর বাবা শরীফ সাহেবকে নিয়ে আসা হয়। রুমির সাথে আরো ৩ জন ছিল রুমে। এর কয়েকদিন আগেই দারুন সফল একটি অপারেশন করে তারা ঢাকা শহরে। ৭ জন খানসেনাকে মারে। আর্মিরা সব খবর নিয়েই আসে। অন্যদের বাঁচানোর জন্য রুমি সকল দায় বধ্যতা নিজের করে নেয়। ঠিক ঐ সময়েই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ কে ধরা হয়। তিনিও অন্যদের বাঁচিয়ে দেন। বাঁচিয়ে দেন আলভীকে।
পাকিস্তান আর্মিদের মারের কোন নির্দিষ্ট ধরন ছিলোনা। সে কী মার! বুকে ঘুষি, পেটে লাথি, হঠাৎ করে আচমকা পেছেন থেকে ঘাড়ে রদ্দা, রাইফেলের বাট দিয়ে বুকে পিঠে গুঁতো, মাথায়, পিঠে শরীরে সবখানে মার, উপুর করে শুইয়ে বুট শুদ্ধ পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাড়ানো, কনুই-কব্জি আর হাঁটুর গিটগুলি থেতলানো। এর সাথে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তো রয়েছেই। এটা ছিল মহোৎসব। বন্দীরা হল খেলার জিনিশ।
৩ সেপ্টেম্বরের দিকে বন্দী আজাদকে দেখতে তার মা আসেন। আজাদ বলে, মা আমাকে অনেক মারে। কিন্তু বলেছে সঙ্গীদের নাম বলে দিলে আর মারবেনা। আজাদের মা বলে বাবা মার খেয়ে যা। তাও কাউকে বলিস না। আজাদ বলে, মা একটাই কষ্ট, অনেকদিন ভাত খাইনা। আজাদ বড়লোকের ছেলে ছিল। এক ধাক্কায় তখনকার দিনের ১০০০ টাকার এলভিস প্রিসলীর রেকর্ড কিনে ফেলত। আজাদের মা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ততদিন পর্যন্ত তিনি আর ভাত খাননি। আর কখনও খাটে ঘুমাননি। কারন আজাদ বন্দী অবস্থায় মেঝেতে ঘুমাত।
(মুক্তিযুদ্ধের সময় রুমির লেখা চিঠি। তবে মুল চিঠিটি ইংরেজিতে ছিল)
৪ সেপ্টেম্বর রাতের দৃশ্যটা চিন্তা করি। কয়েকজন বন্দীকে একসাথে রাখা হয়েছে। তারা আসতে আসতে কথা বলছে কারন জোরে কথা বললেই মার। হটাৎ কে জানি আলতাফ মাহমুদকে বলতে লাগল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো গানটা গাওয়ার জন্য। যে বলেছে তার দুই হাতের আঙ্গুল গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রুমি আছে এককোনায়। তাকে এসে একজন বলল শুনলাম ইয়াহিয়া নাকি ক্ষমা ঘোষনা করতে পারে। রুমি তাকাল। সেটা হবে আমার জন্য সব থেকে বড় অপমান। হঠাৎ রুমি হেসে ফেলল। পাশের জন বলল, কি ব্যাপার হাসছ যে? রুমি বলল আম্মার কথা ভাবছি। কত কষ্টই না দিয়েছি। খাবার সময় প্লেট লাগত আমার ঝকঝকে। ডালের ছোকলা থাকলে খাবারই খেতাম না। দেশ আমাকে কত কিছু শিখিয়েছে। সিগারেট খাওয়ার জন্য আম্মা একদিন আমার এক বন্ধুকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আর আমি যুদ্ধ করতে গিয়ে সিগারেট ধরলাম। আলতাফ মাহমুদ কোঁকাতে কোঁকাতে বললেন, রুমি, দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন সব থেকে বেশি দরকার হবে তোমার মত মেধাবী ছেলের। রুমি বলল, আজ আমার বয়স ২০। আজ যে ছেলেটা জন্মাবে সে ২০ বছর পর এই দেশটাকে যাতে ঠিক মত এগিয়ে নিতে পারে তাই আমরা জীবন দিয়ে গেলাম। স্বাধীনতার জন্য সামান্য একটা জীবন দিয়ে গেলাম।
ঠিক তখন সেলের তালা খুলে পাকিস্তানী আসল। রুমি আলতাফ মাহমুদ সহ বাকিদের নিয়ে গেল। ঠিক করা হল ফায়ারিং করেই মারা হবে। পাকিস্তানিরা নিজেদেরি সম্মান করতে জানেনা। তাই এক আর্মি অফিসার নিজেদের দেশপ্রধান ইয়াহিয়াকে গালি দিল। বলল ওই লোকটা সবার সামনে হিরো সাজতে চায়। তাই একসময় মারার ঘোষনা দেয় একসময় ক্ষমার ঘোষনা দেয়। গুলি চলল। ঠিক তখনি ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে নতুন সেশনের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। রুমির মা বলেছিল কয়েক মাস আগে আমেরিকা চলে যেতে। রুমির কথা, আমেরিকা গেলে একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ত হব, কিন্তু বিবেকের দংশনে থাকতে হবে। গুলি খাওয়ার আগ মুহুর্তে অবশ্য রুমির চিন্তা ছিল একটাই। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটা যেটা বাসার ছাদের জন্য বানিয়েছিল সেই পতাকাটা বাসায় এখন কোথায় আছে। পাকিস্তান বোর্ডে ম্যাট্রিকে দ্বিতীয় হওয়া রুমিকে এই চিন্তায় ভবে তুলল। বাংলার মাটিতে কোথাও তারা শুয়ে আছে। রুমি, আজাদ, আলতাফ মাহমুদ। আমাদের মাটি গভীর মমতায় তাদের স্থান দিয়েছে।
১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জাহানার ইমাম বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নিজের বাকি জীবন উৎসর্গ করেন। তারপর দূরারোগ্য ক্যান্সার ব্যধিতে আক্রান্ত হন।
বহুদিন পর পরকালের কোন একজায়গায় মায়ের সাথে ছেলের দেখা হল। তাদের ঘিরে আছে ৩০ লক্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা সকলেই। মা ছেলেকে আলীঙ্গন করার সাথে সাথে ৩০ লক্ষ লোক একসাথে তালি দিয়ে উঠল।
* রুমিকে নিয়ে লেখা এত সহজ নয়। আমি খুব ব্যস্ত থাকার কারনে তেমন কোন ইনফরমেশন যোগার করা ছাড়াই লিখে ফেললাম। এর একটা কারন আছে। মেহেরজান সিনেমাটা দেখিনি কিন্তু তার সম্পর্কে জেনে বিরক্ত হলাম। সব লেখাগুলার মধ্যে অনিন্দ্য রহমানের লেখাটা বেশি ভাল লেগেছে। বাঙালি একটা ক্ষ্যাত জাতি (আমি নিজেও বাঙালি)। কিন্তু আমরা নিজেদের মনে করি খুব স্মার্ট। তাই রুমিকে ছেড়ে আমরা মেহেরজান এর মত হাস্যকর ফ্যান্টাসী টপিক নিয়ে সিনেমা বানাই।
( অনেকদিন ধরে জাহানারা ইমামের ধারনা ছিল রুমি বেঁচে আছে)
যখন আওয়ামী ক্ষমতায় থাকে আমরা জানতে পারি শেখ মুজিবের অবদান। যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে আমরা স্বাধীনতার অন্য কোন কাহিনী শুনি। আমরা কি কখনও রুমির মত ছেলেদের মুল্যায়ন করেছি? শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আমরা বলি কিন্তু স্বাধীনতা এসেছে যেই মূল্যের বিনিময়ে সেগুলো হল রুমি। শেখ মুজিব ঘোষনা করার আগেই যে বুঝে গিয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। রুমির ২০ বছর বয়সের জীবনটা নিয়ে যে কি দুর্দান্ত একটা সিনেমা বানানো সম্ভব সেটা যদি সিনে নির্মাতারা একবার বুঝত তাহলে খুব ভাল হত। আর রুমির বলে যাওয়া কথা গুলাই যেকোন চিত্রনাট্যের দারুন সব সংলাপ অনায়াসে হয়ে যাবে।
It is high time to recognize our heroes.
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১১ রাত ৯:৩৬