দুরু দুরু বুক মনে হয় এটাকেই বলে। বয়স ৭ তখনও হয়নি। কয়েকদিন বাকি আছে। শীতের সকাল। এই বয়সে মানসিক চাপ নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু নিতে হচ্ছে। এই অল্প বয়সেই আমি অস্থিরতা অনুভব করছি। ভাইভা নামক চিন্তা। শব্দটা "ভাইভা" নাকি "ভেবে" এইটা নিয়ে আমি চিন্তিত। আমার আমাকে বলা হয়েছে শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর আমাকে ভেবে-চিন্তে বলতে হবে। কয়েকদিন আগেই এখানে এলোমেলো শব্দ সাজিয়ে লিখতে হাসনাহেনার জায়গায় নানাহাসেনা লিখে দিয়ে এসেছি। আমার সমান সব কয়টা ছেলে এক লাইনে দাড় করানো হয়েছে। আমার সামনে ইকবাল হোসেন আমার পিছনে আবু বক্কর সিদ্দীক। সবাইকে একটা করে কাগজ ধরানো হচ্ছে। তখনো জানতাম না এই কাগজ পাওয়া মাত্র আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। যেই মাঠে আমি দাড়িয়ে আছি ৩০ বছর আগে ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর খান মুহম্মদ সালেক নামে একজন বলেছিলেন, “ সমাজের প্রয়োজন পূরণ এবং সমাজকে সুষ্ঠু রূপদানের উদ্দেশ্যেই বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠান”। মৌখিক পরীক্ষা বা ভাইভা নামক যন্ত্রনা ছাড়াই সেই বিদ্যায়তনের অংশ হয়ে গেলাম।
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল নামক একটা স্কুল বাস্তবায়নের পিছনে একটা কারন ছিল। ১৯৬১ সালের আগে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ যেটি কিনা টিচারদের স্কুল সেটা ছিল আরমেনিটোলাতে। সেই টিচার্স ট্রেনিং কলেজ স্কুলকে নিয়ে আসা হল ধানমন্ডী এলাকায়। তাদের প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য একটি স্কুল দরকার। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হবেন খান মুহম্মদ সালেক। স্কুলের নাম দেওয়া হল কলিজিয়েট স্কুল, ধানমন্ডী। নিয়োগ পত্রে এমনটিই লেখা ছিল। অধ্যক্ষ ওসমান গনী সাহেব প্রস্তাব করলেন, কলিজিয়েট স্কুল, ধানমন্ডী থেকে নাম হয়ে গেল গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। স্কুলের একটি সার্বক্ষনিক আদর্শ বা মোটো লাগবে। মহাকবি গ্যাটো বলেছেন Light More Light যার বাংলা অর্থ আলো আরো আলো। পরবর্তিতে স্কুলে ভর্তি হওয়া হাজারো ছাত্রদের কাছে সারা পৃথিবীতে আলো ছড়ানোটাই ব্রত হয়ে দাড়াল। আমরা সবাই শেখার জন্য সেখানো জন্য গেলাম। আমাদেরকে যোগ্য করে তোলা হল যাতে আমরা সেবা ছড়িয়ে দিতে পারি। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য তখনকার দিনে পাকিস্তান আমলে পূর্ব অঞ্চলে সব স্কুল ক্লাস থ্রী থেকে শুরু হত। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুল এদিক থেকে নতুন দিক নির্দেশনা নিয়ে আসল। প্রথম শ্রেনী থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত ব্যবস্থা রাখা হল। শুরুতেই চারটি হাউস করে দেওয়া হল। চারজন মনীষীকে চারটি মহৎ মানবিক গুনের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়েছিলঃ ১) আল-বেরুনীঃ পান্ডিত্য ২) আল-মামুনঃ সুশাসন ৩)ওমর খৈয়ামঃ তারুন্য ৪) সালাহউদ্দীনঃ বীরত্ব
সেই গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলের অংশ হয়ে গেলাম আমি। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। প্রভাতিতে ক শাখা। প্রভাতি দিবা মিলিয়ে দুটি শিফট। প্রথম দিন ক্লাসে গেলাম আমাদের সবাইকে চার লাইন কবিতা লিখতে বলা হল। আমি লিখলাম
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ
এর পরের দুই লাইন কোনভাবেই মনে পড়েনা। তাই লিখলাম
আমি এত কথা বলি
তুমি কেন বলনা বউ।
ক্লাস ওয়ানে একদিন ক্যাপ্টেন নির্বাচন করা হবে। শ্রেনী শিক্ষক আব্দুল হক স্যার। স্যার ৪০ জনের মাঝে খলিলকে নির্বাচন করলেন। পরবর্তিতে বেকুবতার কারনে খলিল তার ক্যাপ্টেনের অধিকার হারাল। আমার চাচা চৌধুরী বই নিয়ে সে ধরা খেল। কামরুল স্যার ধরলেন। উমর ফারুকের মত ন্যায় বিচার তিনি করতে পারলেন না। আমাকে ১৫০ বার কান ধরে উঠবোস করালেন। খলিলকে ৫০ বার। বিষয়টা হক স্যারের কানে যাওয়া মাত্র ক্যাপ্টেন পরিবর্তন। নতুন ক্যাপ্টেন হল আবু বক্কর সিদ্দীক আর ইমরান খান রুশো। তাদের একনায়কতন্ত্রে পরবর্তিতে কালে আমাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠল। কামরুল স্যার ইংলিশ পড়াতেন। খুব ছন্দের মত করে একটি কবিতা ছিল।
Two little black birds sitting on a wall
One called Peeter one called paul
এইটা আমরা হাত নেড়ে নেড়ে পরতাম। দিল চাহতা হ্যায় সিনেমাতে জিসে ঢুন্ডতা হু ম্যায় নামে সাইফ আলী খানের একটা গান ছিল। আমাদের হাত নাড়াটা অনেকটা সেরকম হত। টিফিন টাইমে সরকারী স্কুলে টিফিনের ব্যবস্থা থাকে। মূলত সেকারনেই বেতনটা ২৪ টাকা। কারণ টিফিন বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৫ টাকা আর ৫ টাকা জানি কি জন্য ঠিক মনে নেই। মূলত বেতন ছিল ৪ টাকা। পরবর্তিতে উপরের ক্লাসে তা সব মিলায় ৩২ টাকা হয়েছিল।
ক্লাস ওয়ানে থাকতেই একবার মেহেদী হাসান চৌধুরী রাজীব মোহতেশামকে ধাক্কা দিল। মোহতেশাম এর মাথা গিয়ে কই জানি লাগল। কিছু বুঝার আগেই খলিল চিল্লানো শুরু করল রক্ত রক্ত। মানুষ দড়ি দেখলে নিরীহ সাপ ভাবে খলিল অ্যানাকোন্ডা ভেবে বসে ছিল। হাকিম স্যার তখন অ্যাসিস্টেন্ট হেড স্যার। সে এসে চৌধুরীকে নিয়ে গেল। আমরা সবাই নিশ্চিত আজ চৌধুরীর টিসি। কোনো মাফ নেই। তা অবশ্য হয়নি।
ক্লাস থ্রীতে পরার সময় স্বপন স্যার নামক এক স্যার আমাদের জীবন দূর্বিষহ করা শুরু করলেন। কোন কারণ ছাড়াই তিনি মানসাঙ্ক পরীক্ষা নিতেন ক্লাসে বসেই। আর নম্বর কম পেলে বেদম প্রহার করতেন। ভাল কথা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ছেলেরা অন্য বিষয়ের থেকে অংকে ভাল হওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। আমাদের মূল ধারার বাইরে ২০ নম্বরের একটা পরীক্ষা হত। ছোট ছোট প্রশ্ন থাকত সেটার এক কথায় অঙ্ক করা লাগত। ২০ টা অংকের জন্য ২০ মিনিট। এই জিনিশ যতটা না ছাত্র মহলে তার থেকে অনেক বেশি অভিভাবক মহলে আতংক ছড়াতো। অংক করিয়ে করিয়ে জীবন দূর্বিষহ বানিয়ে ফেলাই ছিল তাদের কাজ।
১৯৯৩ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার পর স্কুলে খুশির বন্যা বয়ে গেল। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল ফার্স্ট স্ট্যান্ডের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু যা ঘটেছে তা আগে ঘটেনি। ৩৯ জন স্ট্যান্ড করেছে ঢাকা বোর্ড থেকে তার মধ্যে ২৭ জন আমাদের স্কুলের। সানা ভাই ফার্স্ট হয়েছেন। প্রথম থেকে ছয় টানা আমাদের স্কুল থেকে। এরকম অদ্ভুত ঘটনা এর আগে কখনো কোন স্কুলের ক্ষেত্রে ঘটেনি। এবং পরেও আর ঘটেনি। যেহেতু এখন জিপিএ সিস্টেম তাই এই রেকর্ড আর ভাঙ্গা সম্ভব না। আমার কেন জানি মনে হয় জিপিএ সিস্টেম করে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এক ধরনের প্রতারনা করা হচ্ছে। ৮০,০০০ জনকে কখনই এক কাতারে ফেলা যায়না। আইন্সটাইন আর টেকনিসিয়ান কখনো এক হতে পারেনা।
স্কুল জীবনে মার খেয়েছি অনেক। এবং সম্ভবত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে মার খায়নি। স্যাররা বেত ব্যবহার করতেন। ক্লাস ফাইভের ক্লাস টিচার ছিলেন ফজলুল হক স্যার। আমার ধারনা এর থেকে বেশি মার আর কারও কাছে খাইনি। তিনি আমাদের বাচ্চা শুয়োর বলতেন। এবং মারতেন। আবু বক্করকে একবার একুশ বেত মারা হল এবং সেটা আমি গুনলাম। আবু সায়েম ছিল। বোর্ডে তার হাত আঁকা হল। স্যার বললেন এর বাইরে হাত যেতে পারবেনা। সেভাবে রেখে তিনি মারলেন। আমাদের ক্লাসে সাদ্দাম নামে একজন ছেলে ছিল। এই ছেলের কপালে মার ছাড়া আর কখনই কিছু থাকতনা। বিটিভির রাত আটটার সংবাদ যেমন মিস নাই, সেটা হবেই। সাদ্দামের মার খাওয়াও সেরকম, দৈনিক খাদ্যগ্রহনের মত সে মার খেত।
টিফিন দেওয়া হত সিঙ্গারা-জিলাপী, পরটা-বুন্দিয়া, পরটা-বুডের ডাইল, নিমকি জিলাপি। এর মধ্যে পরটা-বুন্দিয়া ছিল বেহেশতি খানা। এটা খাওয়ার জন্য দুই চারটা হুরপরি বিসর্জন দেওয়া যায়। এটা যেদিন দেওয়া হত সেদিন আগের থেকে খবর নিয়ে রাখা হত। কেউ হয়ত বাথরুমে যাওয়ার নাম করে আগেই খবর নিয়ে রেখেছে আজ পরটা-বুডের ডাইল। ব্যাস কিভাবে একটার বেশি বাগানো যায় চলত জল্পনা কল্পনা।
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহন করতাম না। কে আর সেধে সেধে দৌড়াতে গিয়ে আট জনের মধ্যে অষ্টম হয়। তবে ফুটবলের মৌসুমটা হত দেখার মত। চারটি হাউসের কথা বলা হয়েছে। তবে সে কথা পরে আসছি। আগে আমাদের ক্লাসের ফুটবলের কথায় আসি। আমাদের ক শাখার মুল স্ট্রাইকার ছিল মিতুল যাকে আমরা লেদু বলে ডাকতাম। প্রচন্ড গতির স্ট্রাইকার যে কোন কারনে এত বিরাট পোস্টে বলটাকে দেখে শুনে গোলকিপারের গায়ে মারত। আর ছিল পাভেল। যার ধ্যান জ্ঞ্যান সব কিছুতেই ফুটবল। রাত তিনটার সময় ফুটবল নিয়ে মাঠে গেলেও তাকে পাওয়া যাবে মানে সে সঙ্গ দিতে আসবে। সে ভাল কাটাতো। এক সাথে বিপক্ষ দলের ১০ জন আর নিজ দলের ৫ জনের সাথে কাটিয়ে গোল কিপারকে দেখে বলটি বাইরে মারত। ইকবাল ছিল প্রচন্ড পরিশ্রমী খেলোয়ার আর আবরার সব থেকে ভাল খেলোয়ার। উপলের শট ভাল। তবে সে গোলপোস্টে শট নেওয়াতে তেমন বিশ্বাসী ছিলনা। সে বলটি অনেক দূরে পাঠানোতে বিশ্বাসী ছিল। এরকম অবস্থায় খ শাখার সাথে যখন গোল শূণ্য ড্র হোল আর টাইব্রেকারেও ৫-৫ হোল তখন সাডেন ডেথে আমার ডাক আসল। নবী স্যারের হাতে বাঁশি। একনায়ক আবু বক্করের তখন স্বর্ণযুগ। গোল মিস করলে আমার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ। শট মারলাম। গোল হল। খ শাখার জাভেদ মিস করল। আহা কি শান্তি। জিতে গেলাম।
আব্দুল হক স্যারের নিয়ম ছিল দ্রুত গতিতে ক্লাসে ঢুকেই বোর্ডের ডান দিকে লিখবে CW আর বাম দিকে HW। তারপর দ্রুতগতিতে তার বোর্ডে লিখা শুরু হয়ে যেত আর তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের লিখতে হত। মিস করলে শেষ। কবে জানি একবার স্যার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কে জানি লিখছেনা। স্যার এলেন। ছাত্রকে কিছু বলার আগেই দমাদম মাইর দেওয়া শুরু করলেন। ছাত্র অবাক। তার নাম শুভ্র কান্তি নাথ। সে হিন্দু। স্যার বোঝার পর লজ্জিত হলেন। শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। এটা অনেক মধুরতম একটি দৃশ্য। শিক্ষক ছাত্রের সঠিক সম্পর্ক সব সময় এরকমই কাম্য।
সবুজ-আকরাম-মুনীর তিনটি জীবন, তিনটি ইতিহাস, তিনজন ল্যাবরেটরিয়ান। তারা আমার সহপাঠী নয় তবে যেদিন থেকে তাদের কথা জানি বুকে তাদের ধারন করি। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজায়গায় যখন মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকে তখন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র সবুজ বলে, " আমি এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি, ঘাস কাটতে নয়।" বাংলা সবুজকে প্রতিষ্ঠিত কররা জন্য প্রান দিয়েছে আমাদের স্কুলের সবুজ। ধরা পড়ার পর শহর ঘুরিয়ে নিষ্ঠুর ভাবে তাকে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামানকে হত্যা কর তার ছেলে সহ ছেলের নাম ছল আকরাম। মুনীর যুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ফিরার পথে নৌ দূর্ঘটনায় মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কখনও মৃত্যু হয়না। ল্যাবরেটরিয়ানদেরও না। আমরা প্রতিটা ল্যাবরেটরিয়ান তাদের বীরত্বের কথা জেনে আনন্দিত হই, তাদের ত্যাগের কথা শুনে নিজেদের বুকে তাদেরকে ধারন করি।
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে পড়বে আর স্কুল পালাবেনা তা হবেনা। এটা আমাদের ঐতিহ্য, এটা আমাদের গৌরব। অনেকে আমাদের উপর হাসতে পারে তাদের আমরা থোরাই না কেয়ার করি। ফ্রান্সে এক সময় স্কুল পালানো ছেলেরাই পরবর্তিতে দেশটাকে গড়ে তুলেছিল। আমাদের ঐতিহ্যটা সেরকমই। আমরা জানি এখান থেকে বের হয়ে আমরা দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলাতে যাব। আমরা জানি এখান থেকে বের হয়ে আমরা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ব। কিন্তু পুথিগত বিদ্যায় আমরা আচ্ছন্ন থাকবনা। আমরা স্কুল পালাতাম কারণ আমরা বদ্ধ ঘরে থাকতে চাইনা, আমরা জগৎটাকে দেখতে চাই। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের স্কুলকে দুর্নাম হতে দিতাম না। কার এত সাহস যে আমাদের জগৎ দেখার মাঝে ফায়দা নিবে। তাই আমরা স্ট্যান্ড করতাম/ ক্লাস ফাইভের,এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় অত্র এলাকার সব আমরাই নিয়ে নিতাম। আমাদের সাথেই আমরা প্রতিযোগিতা করতাম। ক্লাস টেনে যখন পড়ি স্কুল পালানোতে ব্যর্থ হলাম। বন্ধুরা ঠিকি পালিয়ে গেল। নাম ডাকার খাতা আনা হল। ফার্স্টবয় সহ সব গায়েব। নতুন হেডস্যার নাসির উদ্দীন স্যার আসলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারলেননা রোল ১ থেকে ২০ পর্যন্ত ২-৩ জন বাদে সব গায়েব। সবাইকে ধরা হল পরে। তিনি বললেন কি করলে আমরা পালাবোনা। আমাদের মাঝে একজন কাজী হাসানুল বান্না রানা বলল ক্লাস টেস্ট নিতে। গভঃ ল্যাব স্কুলে ক্লাস টেস্টের সূচনা তখন থেকেই। স্যার বললেন ঠিক আছে। কিন্তু বন্ডে সাইন করতে হবে। আর স্কুল পালানো যাবেনা। বন্ডে সাইন করল ফার্স্ট বয় মোহতেশামুল হক। পাশে তার মা দাঁড়িয়ে। মিজান স্যার মাকে দেখে বলেন, ফার্স্ট বয় পালায় এটা আগে কখনো দেখিনি। তা দেখবে কিভাবে। এটা হচ্ছে গভ ল্যাব। এখানে আবার ফার্স্ট বয় লাস্ট বয় আলাদা কিছু আছে নাকি!!। আমাদের মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই স্বতন্ত্র। যার রোল ৬০ তার ব্যাথাতে আমাদের যন্ত্রনা হত। যার রোল-১ তার আনন্দে আমরা আনন্দিত হতাম। আমার স্কুলের সব থেকে গর্বের বিষয় আমার কাছে এটাই। সব স্কুল থেকেই স্ট্যান্ড করত আমাদের থেকেও করত। কিন্তু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে আমাদের ফার্স্ট বয় কে আর লাস্ট বয় কে সেটার কোন ভেদাভেদ ছিল না। আমরা সবাইকে সমান ভাবে ভালবাসতাম। স্কুল ছাড়ার পর এই জিনিশ আমি আর কোথাও পাইনি।
আদব কায়দা শিখেই আমরা বের হয়েছি। এই যে কয়েকদিন আগে স্কুলে গেলাম। ক্লাসরুমে ঢুকলাম। যেই ক্লাসে ফ্যান খুলে পড়ে গিয়েছিল সেটা দেখার চেস্টা করলাম। কিন্তু টিচারদের চেয়ারে বসতে যাইনি। কারনা আমরা জানি তারা আমাদের গুরুজন। আমাদের মাঝেই অনেকে এখন পিএইচডি ডিগ্রি নিতে যাবে কিন্তু যারা আমাদের "ক" শব্দটি শিখিয়েছেন তারা আমাদের শিক্ষক। শিক্ষকের মর্যাদা আমরা খালি মুখস্থ করে শিখিনি। আমরা শিখেছি ভুল করে। সেই ভুল থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি তারা আমাদের গুরুজন। তারা আমাদের শাসন করেছেন আমাদের ভালোর জন্য, তারা আমাদের ক্ষমা করেছেন আমাদের ভুলের জন্য। শিখার জন্য আমরা এখানে এসেছিলাম, তারা আমাদের দুনিয়াকে সেবা করার উপযুক্ত করে বের হতে সাহায্য করেছেন।
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের নিজেদের থীম সং আছে। এই গানটি অর্থহীনের বাসাব্বা সুমনের গাওয়া, তারই লিখা, তারই সুর করা।
গানটির কথা আমাদের পাগল করে দেয়। আমরা আবেগ আপ্লুত হয়ে যাই। গানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের সেরা সময়টা আমরা কই ফেলে এসেছি। আমাদের আনন্দের সাথে শেখার সময়। আমাদের হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর ঘুরে দাড়ানোর সময়। অন্যদের জন্য এটা খুব সাধারন একটা গান। আমাদের জন্য এটা আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের ভালবাসা। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরনা।
আলো আরও আলো
আজ আমরাই ছড়াবো
আলোয় আলোকিত চারিদিক
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল
সবই তোমারি জন্য
সবই তোমারি জন্য
( ছবি গুলো Timur Moazzem Mostakim এর ফেসবুক এলবাম থেকে নেওয়া)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:০১