২০০০ সালের ঘটনা তখন আমি ক্লাস টেন এ পড়ি। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এর খেলার মাঠের পশ্চিম দিকের একটা মাঠ এ আমাদের ক্লাস হত। ক্লাস টিচার ছিলেন ATP মিজান স্যার। টিচাররা গুরুজন তাদেরকে শ্রদ্ধা কর এইসব মহান কথা বার্তায় আমরা তেমন বিশ্বাস করতাম না। মিজান স্যার এর পেট বড় ছিল দেখে উনার নাম ATP= All Time Pregnant.
এরকম যে শুধু মিজ়ান স্যার এর ক্ষেত্রে ঘটত ব্যাপারটা তা না। বিমল স্যার নামক একজন স্যার ছিলেন। তার যন্ত্রনায় আমরা সবাই অতিষ্ঠ থাকতাম। কারন ছাত্ররা কতটুকু জানবে - তার থেকে সে কতটা অন্য টিচার থেকে কতটা আলাদা সেটা প্রমান করাতেই তার সব সময় চলে যেত। তিনি ক্লাস এ ঢুকেই সবার আগে যেটা বলতেন সেটা হল, "তোমরা যে পড় বিজ্ঞান!! বিজ্ঞান কাকে বলে সেটাই তো তোমরা জাননা"! তিনি সবাইকে জিজ্ঞেশ করতেন, "বল বিজ্ঞান মানে কি"?বলা বাহুল্য সেটার জবাব আমরা কেউ-ই দিতে পারতাম না। ক্লাস এর আতেল টাইপ পোলাপাইন ও না। কোনোভাবে আইন্সটাইন ছদ্দবেশ ধরে জবাব দিলেও লাভ হইতনা। কারন সেটা বিমল স্যার কোনভাবেই মানতেন না । বিমল স্যার এর মাইর ও খুব বিখ্যাত ছিল।বাংলা সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিঊজিক কতটা খাপ খাবে জানিনা। অনেকটা ইয়া ধিসুম ধিসুম ধমাস ধমাস টাইপ মাইর।
যাই হোক, বিমল স্যার আমাদের এক বন্ধুকে (মাসুদ)জিজ্ঞেশ করেছিলেন বিজ্ঞান কাকে বলে? (সেটাই স্বাভাবিক)।মাসুদের জবাব যাই থাকুক সেটা তো আর বিমল স্যার এর মনে ধরবেনা জানা কথা এবং বিমল স্যার এর ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ ধমাস শুরু হয়ে গেল- তবে এইবার মাসুদ একটা সাহসের কাজ করলো। স্যার কে বলল, স্যার আপনি-ই তাইলে বলেন বিজ্ঞান কাকে বলে? স্যার বেশ খুশি হয়ে তৃপ্তির সহকারে বললেন, “ বিশেষভাবে অর্জনকৃত জ্ঞ্যানকেই বলে বিজ্ঞান।“ স্যার চলে যাওরার পর মাসুদ বলল, জানিস বিমল কাকে বলে? “বিশেষভাবে ত্যাগকৃত মলকেই বলে বিমল।“
আজকে থেকে ১০ বছর আগে এই সময় ঢাকায় তখন এশিয়া একাদশ ও অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ এর খেলা হওয়ার কথা। টিকেট নিয়ে সেরকম মারামারি অবস্থা। ১২ এপ্রিল গভঃ ল্যাভ ক্লাস টেন এ সেকশন (ক শাখা) তে প্রথম ক্লাস ছিল ম্যাথ। ক্লাস নিচ্ছিলেন ক্লাস টিচার ATP মিজান স্যার। আগেরদিন রাতে একটা খবর পাওয়া গেল, হ্যান্সি ক্রনিয়ে ঘুষ নেওয়ার দায়ে ধরা পরেছে। ক্রিকেট ফ্যানদের জন্য এটা অনেক বড় খবর। আমাদের ক্লাস রুমে তখন সিলিং ফ্যান এর হুক চারটা, কিন্তু ফ্যান দুইটা।হাসার কিছু নাই সরকারি স্কুল এমনই হয়।এপ্রিল মাস তখন, কাঠাল আর কাঁচা অবস্থায় গাছে ধরেনা, গরমের চোটে একেবারে পাঁকা অবস্থায় জন্মায়।। সেই গরমে যতই আওয়াজ করুক, ফ্যান এর নিচে বসা ছাড়া উপায় নাই। ক্লাস চলাকালিন সময়ে ডাইনে বামে সামনে পিছে কথা বলা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পরে। সেই দায়িত্বকে শ্রদ্ধা করে পিছনে বসা লম্বু মাহমুদ কে বললাম, "জানিস হানসি ক্রনিয়ে ঘুষ খাইসে"। মাহমুদ এর একটা স্বভাব হইল যাই বলিনা ক্যান, সে জবাব দিবে, "মিছা কথা কস ক্যান"! যদি তাকে বলা হয় ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হইসে তাহলেও সে বলবে, যা মিছা কথা কস ক্যান।ক্রনিয়ের কথা শুনেও মাহমুদ জবাব দিল, "যা মিছা কথা কস ক্যান"!! আমি বললাম, "যদি আমি মিছা কথা বলি, তাহলে আমার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পরবে"। আমি যা বলেছিলাম সব সত্যি ছিল, ১০০% সত্যি কথা। তারপরেও আল্লাহ কারে কি হুকুম দিল কে জানে, আমার মাথার উপর আওয়াজ করা সেই ফ্যানটা খুলে পরে গেল। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে অবশ্য। ফ্যানটার মাঝখানটা আমার মাথায় পরলে আমার দোতালা ভেঙ্গে নিচে পরে যাওয়ার কথা। ফ্যান এর ব্লেড টা কোনোরকমে একটু লেগেছিলো আমার পিঠে। পুরা স্কুল তখন হুলস্থুল অবস্থা। সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় ছিল যে ব্যাথা পাইসি কি পাইনাই, সেটা বুঝার আর টাইম নাই............ উহ আহ উহ আহ আওয়াজ করা শুরু করলাম। আমাকে হেডস্যার এর রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে বরফ টরফ দেওয়া হল। আমাকে বাসায় পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হল। এক স্যার আমার আম্মাকে বলতে বললেন যাতে আমার নামে একটা খাসী মানত দাওয়া হয়।
স্কুল এ পরের ক্লাস তখন বিমল স্যার এর। বিমল স্যার ক্লাসে এসেই তার স্বভাব সুলভ ফ্যানটা কেন পরলো, কিভাবে পরলো, ফ্যান এর গঠন প্রণালী এইসব নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। সব ক্লাস এই একজন করে ইঞ্জিনিয়ার থাকে। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ছিলো নিশু। নিশু বুঝানো শুরু করল এবং বলা বাহুল্য সেটা বিমল স্যার এর পছন্দ হলোনা যদিও নিশু ঠিকই বলেছিল। চতুর্থ পিরিওডের ক্লাসে টিফিন দেওয়া হয়। সবাই টিফিন নিয়েই ফ্যান পরার প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন করলো (টিফিন নেওয়ার আগে করলে কেমন দেখায়!! লোকে কি বলবে!!)। ঐদিন টিফিন আবার ছিলো পরটা বুডের ডাইল। সে বড় উপাদেয় জিনিষ।
কাহিনী শেষ হই নায়। কাহিনী মাত্র শুরু। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে পেপারটা একটু হাতে নিলাম। প্রথম আলো পত্রিকায় ২য় পেইজ এ লিখা “ল্যাবরেটরি স্কুল এ সিলিং ফ্যান খুলে ছাত্র আহত......এর প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন।“ আমার নাম লেখা রাসয়াত রহমান জিকু (১৪), (জিকো হবে)। আজকের কাগজেও নাম আসছে, তবে সেখানে লেখা এক টিচার আমাকে বকা দিয়ে বাসায় পাঠায় দিসেন (ভুল ছিল, কেউ বকা দেই নায়)। নবী স্যারকে তিরস্কার করে লেখা। কোন পেপারে জানি আসছিল আমার মূমুর্ষূ অবস্থা। হসপিটালে এডমিট। বাসায় আত্তীয়দের ফোন আসা শুরু। কেন তাদের কিছু জানানো হয়নায়। কয়েকজন হরলিক্স কিনে ফেলসে দেখা করার জন্য। কাকে আর কি জানাব!!আসলে আমি সেভাবে ইনজুরড হইনাই। কাকে আর কি জানাবে!!
স্কুল এ গেলাম সেখানে ব্যাপক অবস্থা। ফ্যান পরার প্রতিবাদে কাল ব্যাজ পরা হবে। কি জন্য যে পরা হবে সেটা বুঝা গেলনা। আমি তো আর মরিনাই। আমাদের এক বন্ধু মাহফুযুর রহমান ওরফে তন্ময় ওরফে খামছানি (এখন ইংল্যান্ডে) সে তার মায়ের কালো শাড়ী নিয়ে আসছে আর সেটা কেচি দিয়ে কেটে কেটে সবাইকে দিচ্ছে। ৬০ জনের সবাই কালো ব্যাজ। মাঝখানে এক স্যার প্রতিবাদ করে গেলো যে আমার তো আর কিছু হয়নায়। একজন জবাব দিলো, "আয়হায় স্যার !! ফ্যানটার কথা কিছু ভাবলেন না"!৪ টা পিরিওড কালো ব্যাজ পরার পর হেডস্যার , এসিস্ট্যান্ট হেডস্যার সবাই হাজির। আগেরদিন এরটাই পেপারে আসছে এটা তো আরও সিরিয়াস ব্যাপার। কালো ব্যাজ। ঘটনা বাইরে গেলে বিপদ আছে। তখনকার হেডস্যার দূর্ণীতি করে অনেক ছাত্র ভর্তি করিয়েছিলেন। এখন এইসব হলে তার আর ১২টা বাজবে। তবে এসিস্টান্ট হেডস্যার লুৎফুর রহমান স্যার বাপারটা খুব ভালভাবে সামলালেন। তিনি খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে তাদের উচিত ছিল ফ্যান গুলার আগেই কোনো বন্দোবস্ত করা। তিনি সবাইকে অনুরোধ করলেন যাতে আমরা কালো ব্যাজ খুলে ফেলি। আমরা বুঝলাম, এত অবুঝ ও আমরা না, আমরা খুলে ফেললাম।
সমাজ টিচার ছিলেন আতাহার রহমান স্যার। তিনি বাসায় যাওয়ার পর এক গার্ডিয়ান তাকে ফোন করেন। "স্যার স্যার, ফ্যান নাকি খুইলা পইরা গেসে, একজন আহত দুইজন নিহত"? স্যার বললেন, "জ্বিনা আপা, একজন সামান্য একটু আহত হইসে"।
চিল কান নিয়ে গেলে চিলের পিছনে দৌড়ানো আমাদের পুরানো অভ্যাস।
আমাদের ক্লাস এর ফ্যান এর সমস্যার সমাধান হয়েছে। ক্লাস রুম এ এখন ৪ টা ফ্যান। ৪ টা ফ্যান ই ঘুরে। আমরা এখন বাতাস খাই।
ক্লাস টেন এর ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষার সময় শাহাদাত স্যার গার্ড দিতে এসে বললেন, “কী রে তোর মাথায় না ফ্যান খুইলা পরসিলো? তোর তো কিছু হয়নায়, ফ্যান এর অবস্থা কি?” আমি বললাম, “ ঐ ফ্যান এখন আর নাই স্যার, ঐটার মৃত্যু হইসে, জন্মিলে মরিতে হয়, Fan is Mortal.”
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১:২৯