নেপালের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রথমত অতীশ দীপংকরের বৌদ্ধধর্মের বানী নিয়ে নেপাল হয়ে তিব্বত গমন। তার পরে নেপাল রাজদরবারে চর্যাপদের আবিস্কার। তবে আজকে যে বিষয়টি নিয়ে বলছি সেটা আরো আধুনিক ইতিহাস- মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্র ভারতের অবদান এবং এর ইতিহাস আমরা অনেকভাবেই অবগত। ছোট খাট ভাবে হলেও নেপালি জনগনেরও একটা ভূমিকা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে। নেপালিদের অংশগ্রহণ মূলত দুরকমের।
প্রথমত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা অংশ গুর্খা রেজিমেন্ট। নেপালের মধ্য অঞ্চলের জনগন (তামাং, মগর, লিম্বু, রাই) সহ আরো কিছু জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গুর্খা জাতীগোষ্টী। এরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে আমাদের যুদ্ধে অংশ নেয়। সেসব সৈন্যদের এখনো অনেকে জীবিত আছেন এবং নেপালে বসবাস করছেন। তেমনি একজন হলেন লাচুমান মগর। যিনি প্যারট্রুপিং করে বাংলাদেশের মাটিতে নেমেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে।
দ্বিতীয়ত, নেপালি কংগ্রেসের মুক্তিযুদ্ধে অবদান। নেপালের রাজনীতিতে যে পরিবারটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রতাপশালী সেটি হল কৈরালা পরিবার। এ প্রসংগে কৈরালা পরিবার সম্পর্কে একটু বলে নেই। কৃষ্ণ প্রসাদ কৈরালার তিন ছেলে। মাতৃকা প্রসাদ (বলিউডি সিনেমার নায়িকা মনীষা কৈরালার দাদা), বিশ্বেশ্বর প্রসাদ (বিপি কৈরালা) এবং গিরিজা প্রসাদ (জিপি কৈরালা)। বিপি এবং জিপি কৈরালা দুজনেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জিপি কৈরালা মোট চার বার প্রধানমন্ত্রী হন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কৈরালা ভাইয়েরা ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। সেখানে গিরিজা ভাতৃদ্বয় (জিপি এবং বিপি)নেপালে গণতন্ত্রের পুনর্বাসনের জন্য জনমত সংগঠিত করছিলেন এবং রাজার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। তারা কিছু অস্ত্রও জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু তারা পরে ভারতীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের অনুরোধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেগুলো দিয়ে সাহায্য করেন।
কৈরালা ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ গিরিজা প্রসাদ গত ২০ মার্চ, ২০১০ বার্ধক্য জনিত কারনে মৃত্যু বরন করেন। ২০০৯ এর ৯ মে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার সহযোগিতার বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিটি সংগ্রহ করেছেন নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের হেড অফ চ্যাঞ্চারি সংস্কৃতিকর্মী নাসরিন জাহান লিপি। বিবৃতিটি ইংরেজিতে। তিনি বলেন—
“প্রথমেই সে সময়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে বলি।স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে আমাদের এই অঞ্চল স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ইন্দো-রুশ ব্লক এবং সিনো-মার্কিন ব্লক। সে সময়ে আমাদের পার্টি নেপালি কংগ্রেস এর নেতারা ভারতে নির্বাসিত ছিল। আমরা নির্বাসিত ছিলাম কারন সে সময়ে রাজা নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকার কে উচ্ছেদ করে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আমরা ভারতে থেকেই নেপালে গনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছিলাম। তারই অংশ হিসাবে আমরা বেশ কিছু অস্ত্র শস্ত্র জোগাড় করেছিলাম।
বামপন্থী নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন আমাদের খুব ভালো বন্ধু। বিশেষকরে আমার বড় ভাই বিপি কৈরালা (যিনি তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু রাজা সে ক্ষমতা দখল করে নেন) ও জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ।
মুক্তিযুদ্ধ যখন একটি গুরুত্বপুর্ণ অবস্থা পার করছিল তখন জয় প্রকাশ নারায়ণ নেপালি কংগ্রেসকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন, বিশেষকরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে। উল্লেখ্য যে, মি নারায়ণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোগী ছিলেন।
আমরা বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা করি। জয় প্রকাশ, আমার ভাই বিপি কৈরালা এবং আমি উত্তর প্রদেশের মোগলসরাই রেল স্টেশনে ট্রেনের একটি বগিতে বসে আলোচনা করি। জয় প্রকাশ সেই ট্রেনে করে দিল্লী ফিরছিলেন। এ সময়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আমি সরোজমিনে দেখার সিদ্ধান্ত নেই এবং চুপি চুপি বাংলাদেশের একটি অঞ্চলে প্রবেশ করি ও কয়েকদিন সেখানে কাটাই। ফিরে আসার পরে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা মনে করেছি যে বাংলাদেশের এই যুদ্ধ এ অঞ্চলের উন্নতি ও সংহতিতে ভূমিকা রাখবে।
আমরা তখন আমাদের লোকজনদের বলি (চক্র প্রসাদ বাসতলা, কর্নেল বিডি রাই এবং আমার শ্যালক সুধীর উপাধ্যায়) আমাদের অস্ত্র ও গোলা বারুদ গেরিলাদের কাছে হস্তান্তর করতে। আমি বিশেষভাবে নির্দেশ দেই যাতে অস্ত্র হস্তান্তরের আগে তারা যেন আকাশের দিকে একটা গুলি বর্ষণ করে আমাদের সংহতির প্রতীক হিসাবে। তারা ঠিক সেভাবেই কাজ করে।
আজ অতীতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধে আমি জড়িয়েছিলাম মূলত তিনটি কারনে-
প্রথমত, বাঙ্গালি জনতার সাথে আমার একটি আবেগ জড়িয়ে আছে। আমার বাবা কৃষ্ণ প্রসাদ কৈরালা, বাংলাদেশ থেকে একজন ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বিরাটনগর (কৈরালার গ্রামের বাড়ি) হাসপাতালের জন্য, যাতে করে বিরাটনগর শহর আরো উন্নত হয়। তখন বৃটিশ উপনিবেশ চলছে, ভারত পাকিস্তান কেউই স্বাধীন নয়। বিরাটনগরে সেই ডাক্তার পরিবারের অভিবাবক-বন্ধু ছিলাম আমরাই। আমার বাবার অনুমতি স্বাপেক্ষে আমি সেই ডাক্তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশে তাদের বাড়িতে যায় এবং বেশ কয়েকমাস সেখানে কাটাই। আমি বেশ আনন্দেই ছিলাম সেই সময়টাতে। এই পারিবারিক বন্ধন আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করতে। আমার মনে হয়েছে বাঙ্গালিদের নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের দরকার।
দ্বিতীয়ত, আমাদের এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশের যুদ্ধের পরে আমাদেরকেও যথা সময়ে সাহায্য করা হবে নেপালে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য,
তৃতীয়ত, আঞ্চলিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই অঞ্চলের স্থিতি, গনতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে”
এই হল জিপি কৈরালার বিবৃতি। আমাদের গেরিলা বাহিনীর দিক থেকেও এই তথ্যগুলো ভেরিফাই করা গেলে ভালো হত। হয়ত করাও যাবে। তবে মি কৈরালা কোন নাম মনে করতে পারেন নি। তবে এর বাইরেও নেপালে অনেক ঘটনা ঘটেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, লিটল ম্যাগ এ প্রকাশিত হয়েছে প্রবন্ধ। এমনকি খোদ কাঠমুন্ডুর রাস্তায় হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল। সে সবের রেফারেন্স এখন তেমনভাবে সংরক্ষিত নেই। অনেকের স্মৃতিও হয়ে গেছে ফ্যাকাসে। তবে অনেক কিছুই উদ্ধার করা যেতে পারে এখনো।
হয়ত নেপালের বরফে ঢাকা নিরিবিলি পাহাড়ের কোলে বসে যে বৃদ্ধ তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, একদিন সেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আকাশ থেকে আরেকটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ভেতর- যে অগ্নিকুণ্ডের নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যে আগুন এখনো অনির্বাণ আমাদের রক্তে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও নেপালঃ একটি অজানা অধ্যায়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন