-হারুন ইয়াহিয়া
মহাবিশ্বের সকল তথ্যই একটি উচ্চতর সৃষ্টি শক্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। পক্ষান্তরে, জড়বাদ বা বস্তুবাদ, যা বিশ্বে সৃষ্টিতত্ত্বকে অস্বীকার করে, একটি ভ্রমাত্মক মতবাদ বই কিছু নয়।
বস্তুবাদ বাতিল হলে সেই দর্শনের ভিত্তির ওপর দন্ডায়মান অন্যান্য মতবাদও বাতিল হয়ে যায়। এই অন্য মতবাদগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হচ্ছে ডারউইনিজম তথা বিবর্তনবাদ। বিবর্তনবাদ দাবি করে যে, প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে নিস্প্রাণ জড়বস্তু থেকে আকস্মিক যোগাযোগের ফলে। এই তত্ত্ব ধুলিসাৎ করা হয়েছে বিশ্বসৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তায়ালা এই সত্যের স্বীকৃতির মাধ্যমে। মার্কিন জ্যোতি: পদার্থবিদ হিউ রস এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:
নাস্তিক্যবাদ বা এ্যাথেইজম, ডারউইনিজম্ তথা অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর দর্শনসমূহ থেকে উদ্ভুত সকল ইজম্-এর ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা, এই ভ্রান্ত ধারণা, যে মহাবিশ্ব অনন্ত, অসীম। কিন্তু এ ভ্রান্তির বিনাশী প্রতীতি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় বিশ্ব ও জীবনসহ যা কিছু সে ধারণ করে আছে তার পশ্চাতে / ঊর্ধ্বে / সম্মুখে / যে কারণ বা কারক রয়েছে তার মুখোমুখী।
আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয় যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এর ক্ষুদ্রতম অংশসহ সবকিছুর রূপকার। কাজেই বিবর্তনবাদের এই তত্ত্ব সত্য হওয়া অসম্ভব যে, জীবন্ত সত্তাসমূহ আল্লাহর সৃষ্টি নয়, তারা শুধু ঘটনাপুঞ্জের যোগাযোগের ফসল।
এতে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই যে বিবর্তনবাদের দিকে যখন আমরা দৃষ্টিপাত করি, দেখতে পাই যে, বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী এই তত্ত্বকে ধিক্কার দিচ্ছে। জীবনের রূপ নিরতিশয় জটিল ও চমকপ্রদ। জড় জগতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কি সংবেদনশীল ভারসাম্যের ওপর বস্তুনিচয়ের পরমাণুসমূহ সংস্থিত। আবার জীবজগতের দিকে তাকালে ভেবে অবাক হতে হয় কি জটিল নক্সার ভিত্তিতে এসব পরমানুর সমাহার ঘটেছে এবং তাদের সহযোগে কি অসাধারণ বস্তুসমূহ যথা প্রোটিন, এনজাইম ও কোষ গঠন করা হয়েছে।
প্রাণের এ অসাধারণ রূপবিন্যাস বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে ডারউইনিজম্-এর কবর রচনা করে।
প্রসঙ্গটির গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা মনে করি এখানেও বিষয়টির একটা সার সংক্ষেপ তুলে ধরা সমীচীন হবে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ডারউইনিজম পরাজিত
সেই সুদূর অতীতের গ্রীসেও একটি ধারণা হিসেবে প্রচলিত থাকলেও বিবর্তনবাদের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে ঊনিশ শতকে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটি বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের জগতে শীর্ষ প্রসঙ্গ করে তোলে তা হচ্ছে ১৮৫৯ সালে চার্লস্ ডারউইন রচিত একটি পুস্তকের প্রকাশ, যার নাম 'প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি' (The origin of species)। এই বইতে ডারউইন অস্বীকার করেন যে, পৃথিবীতে বিরাজমান বিভিন্ন জীবন্ত প্রজাতি আল্লাহ পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করেছেন। ডারউইনের মতে, সকল প্রাণীরই আদি উৎস এক ও অভিন্ন ছিল, সময়ের পরিধিতে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।
ডারউইনের তত্ত্বটি কোন বাস্তব বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, এটি একটি "ধারণা" মাত্র। অধিকন্তু এই বইয়ের "তত্ত্বটির কতিপয় সমস্যা" (Difficulties of the theory) শীর্ষক দীর্ঘ একটি অধ্যায়ে তিনি স্বীকার করেছেন যে, বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিতে তত্ত্বটি অপারগ।
ডারউইন তাঁর সকল আশা ন্যস্ত করেছিলেন বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারে, যেগুলো "তত্ত্বটির কতিপয় সমস্যা" সমাধানের উপায় উপহার দেবে। কিন্তু তাঁর কপাল দোষে বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার ওই সমস্যাগুলোর মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় শুধু।
বিজ্ঞানের হাতে ডারউইনের পরাজয়ের বিষয়টি তিনটি মূল প্রসঙ্গের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা যেতে পারেঃ
১. পৃথিবীতে প্রাণের অভ্যুদয় কিভাবে হল তা এই তত্ত্ব কোনভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে না।
২. এই তত্ত্বে প্রস্তাবিত 'বিবর্তনী প্রক্রিয়া'গুলোর বিবর্তন করার কোন ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা তা প্রতিপাদন করার যোগ্য কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নেই।
৩. জীবাশ্মের ইতিহাস বিবর্তনতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা স্বপ্রমাণ করে।
এখন আমরা এ তিনটি মূল প্রসঙ্গ সাধারণভাবে আলোচনা করব।
প্রথম অনতিক্রম্য বাধা
বিবর্তনবাদী তত্ত্ব দাবি করে যে, আদিম পৃথিবীর বুকে ৩৮০ কোটি বছর আগে একটিমাত্র জীবিত কোষের উদ্ভব হয় এবং সেটি থেকেই সকল প্রাণধারী প্রজাতির অভ্যুদয় ঘটে। একটি মাত্র কোষ কি করে লক্ষ লক্ষ জটিল জীবন্ত প্রজাতির জন্ম দিতে পারে এবং সত্যি যদি এরকম কোন বিবর্তন ঘটে থাকে তাহলে জীবাশ্মের ইতিহাসে এর কোন চিহ্নমাত্র কেন পাওয়া যাচ্ছে না এ রকম বহু প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগ এ তত্ত্ব। তবে, অনুমিত বিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ সম্পর্কে, প্রথম ও প্রধান প্রশ্ন হচ্ছেঃ এই "প্রথম কোষ"-এর উৎপত্তি কিভাবে হল?
বিবর্তনতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব কোন প্রকার আধিভৌতিক শক্তি অস্বীকার করে বিধায় দাবি করে যে, "প্রথম কোষ"-টি প্রকৃতির নিয়মাবলীর মধ্যেই যোগাযোগের কারণে উদ্ভুত হয়, এর পেছনে কোন নক্সা, বিন্যাস বা পরিকল্পনা ছিল না। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মিশ্রণের কারণে জড় বা অজৈব বস্তু থেকে জৈব কোষের উদ্ভব ঘটে। জীববিদ্যার অলঙ্ঘনীয় নিয়মাবলীর সঙ্গে এ দাবি অসঙ্গতিপূর্ণ।
প্রাণের উৎস প্রাণ
ডারউইন তাঁর বইতে কোথাও প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে কিছু বলেননি। তাঁর সমকালে বিজ্ঞানের আদিম ব্যুৎপত্তি এ ধারণার বশবর্তী ছিল যে সকল প্রাণীই সরল শরীর সংস্থান বিশিষ্ট। বিভিন্ন জড়বস্তুর সংশ্লেষণে প্রাণের উৎপত্তি হয়। এ অজীবজনি তত্ত্বটি মধ্যযুগ থেকেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিল। সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, পোকা-মাকড়ের জন্ম হয় খাদ্যের উচ্ছিষ্ট থেকে এবং ইঁদুরের জন্ম হয় গম থেকে। এ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য অনেক কৌতুককর পরীক্ষা চালানো হয়। এক টুকরো নোংরা কাপড়ের ওপর কিছু গম রেখে দিয়ে ভাবা হত খানিক পরেই ওখান থেকে ইঁদুর লাফিয়ে ছুটবে।
অনুরূপ, মাংসে উৎপন্ন কীট মনে করা হত অজীবজনি-তত্ত্বের অভ্রান্ত প্রমাণ। কিন্তু অল্পকাল পরেই জানা যায় ওই কীট মাংসে স্বতঃজনিত হয়ে আবির্ভূত হয়নি, বরং মাছিরা তাকে ওখানে বয়ে নিয়ে গেছে লার্ভা আকারে, খোলা চোখে যা দেখা যায়নি।
এমনকি ডারউইনের ওই বই লেখার সময়ও বিজ্ঞানের জগতে রোগজীবানু (ব্যাকটেরিয়া) অজীবজনি এ বিশ্বাসটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিল।
ডারউইনের বইটি প্রকাশের পাঁচ বছর পর লুই পাস্তুর তাঁর বহু বছরব্যাপী দীর্ঘ গবেষণার ফল প্রকাশ করেন যা ডারউইনের তত্ত্বের অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ বিবেচিত অজীবজনি তত্ত্ব অপ্রমাণিত করে। ১৮৬৪ সালে সরবোন-এ তাঁর বিজয়োল্লসিত ভাষণে পাস্তুর বলেন, "এ সরল গবেষণা যে মরণাঘাত হেনেছে তা সয়ে আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না অজীবজনি তত্ত্ব।"
বিবর্তনবাদের প্রবক্তারা বহুদিন পাস্তুরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রাণীদেহের কোষের যে জটিল গঠন উদঘাটিত করে তা', প্রাণ যে নিছক সংমিশ্রণ থেকে উত্থিত হতে পারে - এ ধারণাকে আরও কঠিন সঙ্কটে ফেলেছে।
বিশ শতকের নিষ্ফল প্রয়াস
প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীতে প্রথম যে বিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রবৃত্ত হন তিনি হচ্ছেন প্রখ্যাত রুশ প্রাণীবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন। ১৯৩০-এর দশকে প্রণীত বিভিন্ন তাত্ত্বিক অভিসন্দর্ভে তিনি স্বপ্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, জড়জগতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার আকস্মিক যোগাযোগ থেকে জীবকোষের উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু তাঁর সব গবেষণার ব্যর্থতা ছিল অবধারিত। ওপারিনকে এই স্বীকারোক্তি প্রদান করতে হয়ঃ দুর্ভাগ্যক্রমে, জীবকোষের উৎপত্তির সমস্যাটিই হচ্ছে জৈব বিবর্তনের অন্বেষায় সবচাইতে অস্পষ্ট বিষয়।
ওপারিনের বিবর্তনবাদী অনুসারীরা প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত সমস্যাটি সমাধানের জন্য অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। সর্বাপেক্ষা সুবিদিত পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন মার্কিন রসায়নবিদ স্ট্যানলী মিলার, ১৯৫৩ সালে। আদিম পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলে যেসব গ্যাস বিরাজমান ছিল বলে তিনি দাবী করেন, একটি পরীক্ষায় সেসব গ্যাস সম্মিলিত করে তিনি সেই মিশ্রণের সঙ্গে শক্তি (এনার্জি) যুক্ত করেন, তারপর তার সঙ্গে সংশ্লেষিত করেন বিভিন্ন প্রোটিনের সংযুক্তিতে বিদ্যমান কতিপয় জৈব অণু (এ্যামাইনো এসিডস্)।
মাত্র কয়েক বছর পার হতে না হতেই স্পষ্ট বোঝা যায় বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উপস্থাপিত এই পরীক্ষা অসিদ্ধ। কারণ এতে ব্যবহৃত আবহাওয়ামন্ডল ছিল পৃথিবীর বাস্তব পার্থিব পরিপার্শ্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
দীর্ঘ নীরবতার পর মিলার স্বীকার করেন যে, তিনি যে আবহাওয়া মাধ্যম ব্যবহার করেন তা ছিল অবাস্তব।
বিংশ শতাব্দীতে প্রাণের উৎপত্তি ব্যাখ্যার জন্যে সকল বিবর্তনবাদী প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। স্যান ডিয়েগোর স্ক্রিপ্স্ ইন্সটিট্যুটের ভূ-রসায়নবিদ জেফ্রি বাডা এটা স্বীকার করেছেন ১৯৯৮ সালে 'আর্থ' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধেঃ
আজ এই বিংশ শতাব্দীর বিদায় লগ্নে আমরা এখনো সেই বৃহত্তম অমীমাংসিত সমস্যাটির সম্মুখীন হয়ে আছি যার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নেঃ পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল? ... (চলবে)
*** অনুবাদ করেছেনঃ আবুল বাশার ***