সকাল সকাল মজিদ ভাইকে দেখে অবাক হলাম। সাধারণত উনি ঘুম থেকে অনেক দেরী করে উঠে। আমাকে দেখেই ডাক দিলো। তোমার জন্যই এতো সকাল সকাল বাজারে আসলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার। বললো কালকে তুমি যে ঘটনাটা ঘটাইছো। বলেই দাঁত বের করে হাসলো। কিছুটা দৃষ্টিকটু তার দাঁতের দিকে আমার নজর পরলো দেখলাম দাঁত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। মজিদ ভাই বলতেছে ভাবতাছি আজকে তোমাকে জোঁকা বিলে মাছ ধরতে না নিয়ে গেলে তুমি একাই চলে যাও কিনা।কথার মাঝ খানে ওয়াক থু। থুথুর সাথে কিছুটা রক্তও বের হয়েছে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তুমি রেডি থাইকো আমি রাইত দশটার দিকে তোমারে আইসা নিয়া যাবো। না না এক কাজ কইরো ব্রীজের কাছে চইলা যাইয়ো। আমার ভিতরে উদ্বেগ, কৌতুহল, উৎকন্ঠা সবই এসে ভীড় করলো।
জোঁকা বিল অদ্ভুধ এক নাম। শুনেছি সেখানে জোঁকের প্রচন্ড প্রকোপ বলে এর নাম জোঁকা বিল দেওয়া হয়েছে। আমি অবশ্যই অনেকবার জোঁকা বিলের পাশ দিয়ে গিয়েছি দিনের বেলা। কিন্তু কখনও বিলটা ঘুরে দেখা হয় নাই। অবশ্যই রাস্তা থেকে খানিকটা দূরেই এ বিলের মূল অংশটুকু। দূর থেকে বিলের মাঝখানে একটা হিজল গাছ দেখা যায়। পাতা আসেনা গাছটায়। কভে কখন এই গাছটায় কেউ পাতা দেখেছে কেউ মনে করতে পারেনা। দূর থেকে গাছটাকে কঙ্কালসার মনে হয়।
দশটা বাজার দশ মিনিট আগেই বাজারের রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে এসে দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়ির কাটা সাড়ে দশটায় চলে গেলো মজিদ ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই। হাটতে হাটতে ব্রীজটার কাছে চলে গেলাম। এটা পূর্ণিমাও না আবার অমাবস্যাও না। আকাশে চাঁদ নেই কিন্তু মিটিমিটি তারার আলোতে ব্রীজটা বড় অদ্ভুদই লাগছে। শো শো শব্দ করে ব্রীজের নিচ দিয়ে পানি যাচ্ছে। গতকালকের ব্যাপারটা মনে পড়ছে। লক্ষ্য করলাম মাঝে মাঝেই ব্রীজটা যেনো একটু করে কেঁপে উঠছে। আমি ব্রীজ থেকে নামতে যাবো এমন সময়........... মজিদ ভাইয়ের ডাক শুনতে পেলাম। আরে মিয়া তুমি দেহি বিরাট কামেল মানুষ বলেই মজিদ ভাই হেসে উঠলো। আমি উনার মুখে টর্চ মারলাম। দেখি উনার দাঁত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আমি মজিদ ভাইয়ের প্রতি চরম বিরক্তি প্রকাশ করলাম। উনি বার বার দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। বললো তোমার ভাবীতো আজকে ছাড়তেই চাচ্ছিলোনা। কিছুটা কি লজ্জা! না আতঙ্ক! মনের মাঝে জেগে উঠলো বুঝলাম না। উনার পিছনে পিছনে জোঁকা বিলের দিকে যাওয়া শুরু করলাম...........
চারদিকে সুনসান নিরবতা। দূর আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুএকটি তারা আমাদের সঙ্গী হয়ে জেগে আছে। বড় বড় রেন্টি, কড়ই গাছের ফাঁক দিয়ে সেই তারার আলো একটা মায়াময় আবহ তৈরী করেছে। কি অদ্ভুধ! সেই আলো-আধাঁরির খেলা। হি-সসসস করে শব্দ করে উঠলো সাপ পাশের ঝোপটায়। মজিদ ভাই ইশারা করলো বামের রাস্তা দিয়ে নেমে যাওয়ার জন্য।
ভ্যাপসা গরম। সরু রাস্তার দুই দিকেই গাছপালা। দূর আকাশের মিটি মিটি তারার আলো সেই গাছপালা ভেদ করে এখানে পৌছাচ্ছেনা। মজিদ ভাইকে বললাম টর্চ জ্বালাতে বললে সে বললো চার্জ শেষ করার কি দরকার! আমার পিছনে পিছনে হাটঁ। আমি মজিদ ভাইয়ের পিছনে পিছনে হাঁটছি। খুব ভয় পাচ্ছি। যদি এই অন্ধকারে মজিদ ভাইকে খুঁজে না পাই। যদি পিছন থেকে কেউ আমাকে ঝাপটে ধরে।
ঘন থেকে আর ঘনও হচ্ছে চারদিকের গাছপালা। মজিদ ভাইকে আমি অনুরোধ করলাম নালবাতি জ্বালানোর জন্য। মজিদ ভাই কিছুটা রেগে উঠে নালবাতি জ্বালালো। নালবাতির আলোতে মজিদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুবই বিরক্ত হইছে। আমি কিছু না বলে চুপচাপ হেটেঁ চলছি তার পিছনে।
মজিদ ভাই ইশারা করে বললো চলে এসেছি মাছ ধরার সেই জায়গার কাছে। পানিতে কিছু একটা ঝাপিয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মজিদ ভাই হোঁ হোঁ করে হেসে বললো, মিয়া এই সাহস ঐদিন ঐ জায়গায় গেছিলা?
অন্ধকার পেরিয়ে ঝোঁকা বিলের তীরে আমরা দাঁড়িয়ে। পানিতে একটা কম্পন দেখা যাচ্ছে। মজিদ ভাই একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললো ভোদঁর আমাদের আসার শব্দ পেয়ে এই জায়গায় লাফ দেওয়াতে এমন কম্পন সৃষ্টি হয়েছে।
দূর থেকে হিজল গাছটা দেখা যাচ্ছে। মজিদ ভাইয়ের নালবাতি দিয়ে আমার নালবাতিটাও ধরালাম। হাতে কোচঁটা নিয়ে মাছ ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। মজিদ ভাই এক হাতে কোঁচটা ঠিক করতে করতে অন্য হাতে বিড়িটা পানির কম্পনের দিকে ছুঁড়ে মারলো। সামনের পানিটা মনে হয় কেঁপে উঠলো। অর্ধেক পচেঁ যাওয়া দুইটা গাছের পাতা সরে গেলো। মজিদ ভাই সতর্ক ভাবে পাতার উপর দিয়ে কোচঁ চালালো। গগনবিদারী আর্ত চিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। মজিদ ভাই তার সর্বশক্তি দিয়ে কোচেঁর উপর ধরে রাখলো। পানির কম্পন বাড়ছে। সেই সাথে আর্ত চিৎকারও। আমি কম্পন বরাবর টর্চ মারলাম। উপস ভয়ংকর সেই দৃশ্য। একটা মেয়ের নাক পর্যন্ত ভেসে আছে। মেয়েটা দুহাত দিয়ে তার চুল টানছে। লক্ষ্য করলাম মেয়েটার চুল মজিদ ভাইয়ের কোঁচে প্যাচিয়ে গেছে। আমি মজিদ ভাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই কোচঁ সহ মেয়েটা পানি ডুবে গেলো। হতভম্ব মজিদ ভাইকে টানতে টানতে অন্ধকার সেই সরুপথ দিয়ে হাটাঁ শুরু করলাম।