[এটি একটি লোহমর্ষক ঘটনা।][আগের পর্ব আ্যাড করে দেওয়া হয়েছে]
আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো। আমি ছিলাম সে গ্রুপের প্রধান। কাকতালীয় ভাবে আমি ছাড়া আর বাকি চারজন সবাই ছিলো হিন্দু। সুজন সে ছিলো আমাদের প্ল্যানিং প্লাষ্টার। যাবতীয় কাজের আইডিয়া সবার আগে তার মাথা থেকে বের হতো। যদিও তার একটি সমস্যা ছিলো সেটা হলো তার হার্ট খুব দুর্বল। সুবাস যার বামহাত পোলিও আক্রান্ত হয়ে অকেজো হয়ে গেছে। তারপরও তার ডানহাতে যে শক্তি তা আমরা কতজন দুইহাতে মিলে রাখি তা নিয়ে একটা পরীক্ষাও করা যেতে পারে। উজ্জল যাকে আমরা পটু বলে ডাকতাম আর সমীর ছিলো সবচেয়ে ভীরু। তবে আমাদের টিমওয়ার্কটা ছিলো চমৎকার, বোঝাপড়াটাও ধারুন। এলাকাতে আমরা মজার, ভয়ংকর, উদ্ভুদ অনেক ঘটনায় ঘটাতাম।
আমাদের এলাকায় তখন বিদ্যুৎ নেই। তাই সন্ধা হওয়ার সাথেই সাথেই যেন মৃত্যুপুরী। মোটামুটি সবাই আটটা থেকে নয়টার মাঝে শুয়ে পড়ে। ঠিক এমনি এক সময় আমি রাত দশটার দিকে বাসা থেকে বের হলাম পেশাব করার উদ্দেশ্য। লক্ষ্য করলাম আমাদের বাসার পূর্বে যে পুরাতন মন্দিরটা আছে সেখানে হালকা আলো জ্বলছে। আমি আশ্বর্য হয়ে গেলাম। কেননা এই মন্দিরে মানুষজন দিনে দুপুরে যেতে ভয় পায় আর সেখানে রাত্রে কে আলো জ্বালাল? এই মন্দির নিয়ে এলাকায় অনেক কথা প্রচারিত আছে যা শুনলে গায়ের লোম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। আমার আবার খুব ছোটবেলা থেকেই কৌতুহলের শেষ নেই। ভেবেছি যাব কি যাবনা। শেষে আর সাহস হলোনা।
পরেরদিন এই ঘটনা আমি আমাদের গ্রুপের সবাইকে জানালাম। কেউই এই কথা বিশ্বাসই করতে চাইলোনা। শেষে সাবই মিলে ঐ দিন রাত্রে আমদের বাসায় আসলো হোম স্টাডি করার জন্য। দশটার সময় সবাই চলে যাওয়ার জন্য বের হলো, আমিও বের হলাম। ঐ জায়গাটাই যে জায়গা থেকে আমি গতকাল দেখেছিলাম সবাই মিলে সেইখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুহুর্তেই সবাই এক সাথে জড়ো হয়ে গেলো। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম সেইখান থেকে হালকা নীল একটা ধোঁয়ার মতো আলো উপরের দিকে উঠছে। মাঝে মাঝে সেই ধোঁয়াটা দেখা যায়না। তখন শুধু একটা হালকা আলো চোখে পড়ে। আমরা সবাই সবার বাসায় চলে যায়।
পরদিন এইটা নিয়ে আমাদের বিরাট গভেষণা। কেউ কেউ বলছে সাপের মনি যা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কেউবা বলছে সব ভৌতিক কাজ-কারবার। শেষে আমি বললাম যাই হোক চল সবাই মিলে আজকে রাতে যাই। সবাই সম্মত হলো। নিরাপত্তার জন্য আমরা সবাই একটি করে টর্চলাইট, একটি লাইটার, একটি চাকু এবং সাথে বেলুন বোমা নিব সিদ্ধান্ত হলো।
রাত দশটার দিকে আমরা সবাই নিচু এলাকা দিয়ে সামনে আগাচ্ছি। অর্থাৎ মন্দির হলো উচুঁ এলাকায় আমরা এর নিচ দিয়া সরিষা ক্ষেতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। সরিষা ফুলের ঘ্রাণ যে কত চমৎকার হতে পারে সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। তাইতো শুনতাম সরিষা ফুলের ঘ্রাণে পরী নেমে আসে। যাক আমার একটু একটু ভয়ও করছিলো। কেননা সবার সাহস সম্পর্কে আমার আইডিয়া আছে। আবার মন্দরের ডানপাশেই হলো আমাদের পুরাতন গোরস্থান।
এই গোরস্থান নিয়ে এলাকায় অনেক কথা চালু আছে। এই গোরস্থানের ভিতরে যে বড়ই গাছটা আছে সেখানে কিছুদিন আগেও একজন ফাঁস নিয়ে মারা গিয়েছিলো। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ভীবৎস দৃশ্য। জ্বিহবাটা মনে হয় একহাত বের হয়ে পরেছিলো। মনে হইছিলো চোখ দুটো বের করে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। যদিও এর অনেক আগেই এ কবরস্থানকে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়েছে। সেটাও এক বিরাট ইতিহাস। অনেকই নাকি এখানে রাতে মৃত মানুষের নাঁকিঁ কান্না শুনেছে। আরও কিছু উদ্ভুদ ব্যাপারও ছিলো।
যাই হোক আমরা যেভাবে প্ল্যান করেছি সেই ভাবে এই গোরস্থান কে এরিয়েই যাবো। এই কথাটা এইজন্য আলোচনায় এসেছিলো যদি আমরা সেই খান থেকে দৌড় দিয়ে পালাতে হয় তাহলে যেন সেইদিকে না যাই। নিচথেকেও আলোটা দেখা যাচ্ছে একটু একটু। মাঝেই ধোয়ার একটা কুন্ডুলী পাকিয়ে উপরে উঠে যায়। আমরা পাঁচহাত সামনে গেলে মনে হয় দশহাত পিছিয়ে পড়ি। টর্চলাইট মারা, ফিসফিস করা, কোন রকম শব্দ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরিষা ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। মাঝে মাঝেই আমি গোরস্থানের দিকে তাকাচ্ছি। ফোঁস....... ফোঁস করে একটা শব্দ করলো। আমি দাড়িয়ে পড়লাম। পিছন থেকে সবাই দাড়িয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম কোন সাপের কাজ এটা। আমি গতিপথটুকু একটু পরিবর্তন করে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমরা মন্দিরের কাছাকাছি এসে পৌছে গেছি। নাকে একটা আঁশটে গন্ধ আসছে। কিছুটা গাজার গন্ধের মতো। আমরা ঠিক মন্দিরটার নিচের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি। মন্দিরের সামনে একটা গোল পাকা জায়গা আছে যেখানে আগে হিন্দুরা কীর্ত্তন গাইতো। তার চারপাশটায় ছোট ছোট কিছু আগাছা জন্মেছে। গোল জায়গা থেকেই আলোটা আসছে। খুব সাবধানে আমি একটু উপরে উঠলাম। আলোর মাঝে একটা ছায়ামূর্তি নড়ে উঠল। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। বুকের ভিতর একটু থু থু ছিটালাম। আরেকটু উপরে উঠলাম। যা দেখলাম তা কখনই কল্পনা করিনি। আমার ভাষাজ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা। দেখলাম..............................।
দেখলাম আনুমানিক পাঁচ বা ছয়জন মিলে গাঁজা খাচ্ছে। তখন বুঝলাম এরাই লোকচুক্ষের আড়ালে এইখানে একটা ভৌতিকতা সৃষ্টি করেছে। আমি তারাতারি নিচে নেমে আসলাম। সবাইকে আমি এই ঘটনা খুলে বললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আমাদের কাছে যে বেলুন বোমা গুলো আছে সেগুলো ছুড়ে মারব। তারপর দ্রুত নিচে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যাবো। সেই মোতাবেক আমরা ধীরে ধীরে উপরে উঠলাম। তারপর বেলুন বোমা গুলো ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। আকস্মিক আক্রমনে গাঁজাখোররা ভয় পেয়ে এমন অদ্ভুধ চিৎকার শুরু করলো যে সুজন ভয়ে দিলো দৌড়, পিছন দিক দিয়া আমরাও সবাই দৌড় শুরু করলাম
আমি আবার খুব ভালো দৌড়াইতে পারতাম। তাই সবাইকে পিছনে চরের ঠিক মাঝখানে যে রেন্টি গাছটা আছে সেখানে দাঁড়ালাম। একে একে সবাই এসে এই জায়গায় এসে পৌছালো। সুজন কে তো দেখছিনা। সবাই অবাক। এর মাঝে সুবাস বললো সে কাউকে কিছু ভেঙ্গে নিচে পরে যেতে শুনেছে। আমার কান গরম হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম সুজন কবর ভেঙ্গে নিচে পরে গেছে। আমি সবাইকে বললাম চল সুজনকে গিয়া নিয়ে আসি। কেউ যেতে সাহস পাচ্ছে না। এর মাঝে একটা অস্ফুট গোংরানোর আওয়াজ শোনা গেলো। সেই সময় কিছু একটার চিৎকার-চেঁচামেচিও শোনা গেলো। ঠিক যেমন হায়েনারা কাঁচা মাংসের জন্য নিজেদের মাঝে কামড়া-কামরি করছে। আমার ঘাম ছুটে গেলো। কেননা এই পুরাতন কবর খানায় শেয়ালের উৎপাতও বেশী।
আমি সবাইকে বুঝিয়ে বললাম কেউ যেতে রাজী হচ্ছেনা। আমি বললাম মনে কর যদি সুজন মরে যায় তাহলে এইখান থেকে আমরা চলে গেলে কিছুই হবেনা। আর যদি সুজন কোন ভাবে এই খান থেকে বেঁচে ফিরে আসে তাহলে কোনদিন কি আমরা তাকে বন্ধু হিসাবে মুখ দেখাতে পারবো? আর এই সমাজ কি আমাদের ভালভাবে নিবে? এর মাঝে হিংস প্রানীগুলোর জোর চিৎকার শোনা গেলো। সাথে সাথে সুজনেরও একটা জোড়ে গোঙড়ানোর আওয়াজ শুনে গেলো। সব মিলিয়ে হয়তো ১০ সেকেন্ট এর মাঝেই সুজনের আর কোন আওয়াজ শোনা গেলোনা। আমি কোন কিছু না ভেবেই সুজন বলে দৌড় দিলাম। ভয়ে টর্চলাইটের কথাও ভুলে গেছি। অন্ধকারে হাতরিয়ে যা দেখলাম আমার শরীর শিউরে উঠলো.....
চারদিকে কিছু শেয়াল জটলা বেধে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। কামড় দেওয়ার সাহস পাচ্ছেনা। নিজেরা নিজেরা কামড়া-কামড়ি করছে। আমাকে দেখেই শেয়ালগুলো সরে গেলো। এইদিকে ওরাও চলে আসলো। সুবাস লাইট মারলো। দেখি সুজন অর্ধেক কবরের ভিতরে। বেহুশের মতো গোংরাচ্ছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আমরা তাকে কোলে করে সোজা নদীর পাড়ে চলে আসলাম। সেখানে অনেকক্ষণ পানি দিলাম মাথা ও চোখে। প্রায় ঘন্টাখানি পরে হুশ হলো তারপর সবাই মিলে একটু আড্ডা মারলাম নিজেদের স্বাভাবিক করার জন্য। শেষে বাসায় রওনা হলাম। শিতলাবাড়ির কাছে যে শ্যাওড়া গাছটা আছে এইখানে সবাই দাড়ালাম সুজন প্রস্রাব করবে। হঠাৎ দেখি আমরা কবর খানার এইখানে যে রেন্টি গাছটার এইখানে দাড়িয়ে ছিলাম সেইখানে একটা বাতি জ্বলছে। মনে হচ্ছে আমাদের দিকেই আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো হালকা বাতাসেও বাতিটি কাপছেনা। মনে হচ্ছে এক টুকরো লোহা কোন কামার আগুনে পুড়ে এই মাত্র বের করেছে। প্রস্রাব না করে বাজারে দৌড় লাগালাম। বাজারের কাছে গিয়ে পিছনে তাকালাম দেখি একটি কাল হাত বাতিটি ধরে আছে। হাত ছাড়া আর কোন অংশই নেই। আমরা বাজারে ঢুকে পড়লাম। তখন দেখি কাল হাতটি আবার পিছনে ফিরে যাচ্ছে।
সুজন বলছে কিরে মার কান্না শোনা যাচ্ছেনা? আমরা শুনলাম সুজনদের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। সবাই ঐ জায়গায় গিয়া হাজির। সুজনদের বাসায় অনেক লোক। আমাদের দেখে অবাক হলো। সুজনের মা-বাবা সুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আমার সোনা মানিক কই গেছিলি। আমরাতো হতভম্ভ। পরে শুনলাম রাত্রে কে নাকি সুজনদের বাসায় এসে বলে গেছে সুজন কবর ভেঙ্গে পরে মারা গেছে। আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:৫৩