
< চাকরী জীবনে এখনও সেভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠি। কিছুটা আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করি পুরনো দিনের গানে।
জীবনমুখী গান হিসেবে অগ্রজ মহীনের ঘোড়াগুলির সাথে আমার প্রথম পরিচয় সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতার সাথে পরিচয়ের অনেক পরে। সব গান তেমন ভালোও লাগে না। তবে গত কয়দিন ধরে ঘুরেফিরে শুনছি তাদের দুটি গান "মানুষ চেনা দায়" আর "হায় ভালোবাসি"("ভালোবাসি জোৎস্নায়" নামেও পরিচিত)। শুনতে শুনতে আজ ভাবলাম নেট এ একটু খুঁজে দেখি এই অদ্ভুত নামের ব্যান্ডের ইতিহাস কিছু পাওয়া যায় কিনা। খুঁজতে গিয়ে পেলাম উইকিপিডিয়াতে একটি বেশ তথ্যবহুল ভুক্তি । আরেকটি সাইটে পেলাম ইমেজ হিসেবে আপলোড করা, তারিখ বিহীন এই লেখাটি। অসাধারণ লাগলো, তাই টাইপ করে তুলে দিলাম >
পুরনো নথি বলছে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১, এই ছয়বছর কলকাতার বুকে বিচরণ করেছিল তারা - 'মহীনের ঘোড়াগুলি'। গোটা পনেরো অনুষ্ঠান, তিনটি রেকর্ড এবং তথ্যসুত্রে প্রাপ্ত ভালো মন্দ মেশানো বেশ কিছু সমালোচনা। এইমাত্র সম্বল করে আপাত বিস্মৃতির আড়ালে চলে যান গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল। বাংলা ব্যান্ডের পথিকৃৎ হিসেবে আজ তাদের যে স্বীকৃতি, সেটা ১৯৮১-৮২ তে পাওয়া সম্ভব ছিল না। মহীনী অশ্বারোহীরা বরাবরই দৌড়েছেন সময়ের আগে। অপ্রস্তুত ক্ষেত্রের উপর দিয়ে ধূলো উড়িয়ে সবেগে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। আজকের তরুন ব্যান্ড গায়করা সে পথে সশ্রদ্ধ বিষ্ময়ে লক্ষ্য করছেন সেই দর্পিত পদচিহ্ন।
কদিন আগে এরকমই নবীনদের এক অনুষ্ঠানে শোনা গেল রবীন্দ্রসদনে বাংলা ব্যান্ড নাকি এই প্রথম! ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। রবীন্দ্রসদনে বাংলা ব্যান্ড প্রথম বেজেছিল ১৯৭৯ এর ১২ই আগস্ট। টিকিট ছাপা হয়েছিল পুরনো খবরের কাগজের টুকরোয়। অভিনব মঞ্চসজ্জা হয়েছিল বাঁশের ভারা বেঁধে।
আর শুধু রবীন্দ্রসদনেই কেন? যোগেশ মাইম একাডেমী (১৯৭৭), স্টার থিয়েটার (১৯৭৮), ম্যাক্সমূলার ভবন (১৯৭৯), সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল প্রাঙ্গন (১৯৮০), ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিক (১৯৮১), কোথায় বাজেনি গৌতম চট্টপাধ্যায়ের সুর? 'মহীন'এর প্রতিটি অনুষ্ঠানেই কিছু অভিনব ব্যাপার-স্যাপার থাকত। পুরনো কাগজে ছাপা টিকেট ছাড়াও কখনও সদস্যদের ছিপছাপ দেওয়া আমন্ত্রণী, কখনও টেলিগ্রামের মতো দুলাইন "ARRIVING ON ... AT ... STOP ATTEND"। চমকে উঠার মতো আহবান। সদস্যরা একাধিক বাদ্যযন্ত্রে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন যন্ত্রের হাত বদল ঘটতো অনায়াস দক্ষতায়। নিজেদের সঙ্গীতকে একবার পরিচয় দিয়েছিলেন 'বাউল-জ্যাজ' হিসেবে। গিটারের ইলেকট্রিক শীৎকারের সঙ্গে দোতারা, স্যাক্সোফোরের সঙ্গে সাপুড়ের বাঁশি, বা বীণের সঙ্গে ভায়োলিনের সহাবস্হান। ডাল-ভাত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে বেড়ে উঠা বঙ্গ সংস্কৃতির গোড়া ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন তাঁরা। মনে রাখতে হবে এইসব ঘটনা ঘটছে ৯৭৬ থেকে '৮১র মধ্যে যখন গিটার যন্ত্রটির পরিচিতি পার্কস্ট্রীটের সাহেবপাড়া ছেড়ে শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও ১৯৮১'র পর আর মহীনী ব্যান্ড বাজেনি। কেন? কেন শুনতে চাননি তখনকার শ্রোতারা? আর কেনই বা ১৯৯৫ এর বইমেলায় আবার কুড়ি বছর পরের বিষ্ময়কর বিস্ফোরণ? "ধুর মশাই, আপনারা কেউ কিছু শুনতে চাইলেন না" বলে "ছন্ন ছাড়লো" মহীনের ঘোড়ারা। ছিটকে গেল পেশার টানে। কিন্তু তাদের গান হারাল না। প্রাচীন সাম স্তোত্রের মতো গভীর "ভালোবাসি জোৎস্নায়" বা হু হু করে শূন্যতার "রানওয়ে", বাংলা গানের রুক্ষ প্রান্তরের মধ্যে বেঁচে রইল চোরা স্রোতের মতো। সঞ্চারিত হল এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মুখে, গৃহীত হল বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মতো পবিত্র শুদ্দতায়। আজ থেকে বছর দশেক আগে প্রেসিডেন্সি কলেজের অলস ক্যান্টিন, দুপুরে ক্লাশ পালানো সহপাঠীর গলায় এই গান শুনে চমকে উঠেছিল কিছু তরুণ, নিজেদের বিপন্ন নিঃসঙ্গতার সুর, এমন নির্ভুল করে বাজতে শোনে নি অন্য কোন গানে। কে এই সুরকার? কারা এই "মহীন"? শুরু হল অনুসন্ধান। আপন কুলপরিচয় জানার মত অপ্রতিরোধ্য তাগিদে শেষে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁকে। "আমাদের গান এখনো গাওয়া হয় কলেজ ক্যান্টিনে? ভাল লাগে তোদের?" অবাক বিষ্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। উঠে বসেছিলেন আধশোয়া শয্যা ছেড়ে। আর তারই ফলশ্রুতি পরের বছর বইমেলায় "আবার কুড়ি বছর পর"। এরপর ক্রমান্বয়ে আসবে "ঝরা সময়ের গান", "মায়া", "ক্ষ্যাপার গান"। শুরু হবে আলোচনা, লেখালেখি। নতুন করে ঔৎসক্য সৃষ্টি হবে ঘোড়াদের গতিময় অতীত সম্পর্কে। ইতিহাসের পাতায় নিজেদের ন্যয্য দখল, নিশ্চিতভাবে কায়েক করবে মহীনের ঘোড়ারা।
কুড়ি বছরের ব্যবধানে উৎপন্ন এই বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ যদি হয় শ্রোতাদের নতুন গান শোনার আগ্রহ, অপর কারণ অবশ্যই লিরিসিস্ট গৌতমের আত্মপ্রকাশ। মহীনের গৌতম ছিলেন মূলতঃ সুরকার গায়ক ও যন্ত্রী। অথচ ১৯৯৫ থেকে শুরু তাঁর ইনিংসে দেখি যন্ত্র এবং গলার দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মেকে। নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন দুই সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি - কথা ও সুর। গৌতমের কথা, 'মহীনে'র মতই কবিত্মময় এবং প্রয়োজনীয়, স্হির-লক্ষ্য, আমোঘ।
আধুনিক নাগরিক অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত "পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে", ক্রমশঃ বৃহৎ হতে হতে ঢেকে ফেলছিল ১৯৯৫-এর বইমেলা। এরপর "রাবেয়া কি রুকসানা", "এই মুহূর্তে", "টেলিফোন" - গৌতমের এই পর্যায়ের সব রচনাতেই লক্ষ্য করুন এই সহজিয়া নাগরিকতার অকাট্ট অনুষঙ্গ। কুড়ি বছর পুরনো পৃথিবী অতঃপর তাঁর সামনে মন্ত্রমুগ্ধের সরীসৃপের মত দন্ডায়মান থাকবে। দুলতে থাকবে তাঁর সুরে তাঁর তালে তাঁর কথায়
- জয়জিৎ লাহিড়ী
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:১৯