২০০৪ সালে যখন লুইস পিনটো কোস্টারিকার কোচ হবার জন্য আবেদন করলেন, কেউ তাঁকে পাত্তাই দিল না। পিনটো নিজে কখনও পেশাদারী ফুটবল খেলেন নি। তার কোচ হবার যোগ্যতা পুরোটাই পুঁথিগত বিদ্যার উপর নির্ভরশীল। মাত্র ৪৭ লক্ষ মানুষের এই ছোট দেশে জাতীয় ফুটবল দলের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে বিপক্ষ দলের খেলার পর্যালোচনা করে কেউ দলকে জেতাতে পারে – এইসব কথাকে গনাতেই ধরল কোস্টারিকার ফুটবল ফেডারেশন।
পিনটোর জেদ চেপে গেল। কলম্বিয়াতে ফিরে এসে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ২য় বিভাগের একটি ক্লাব ডেপোরটিভোর কোচের দায়িত্ব পেলেন। ১৯৫০ সালে থেকে এই ক্লাবটি তখনও পর্যন্ত তাদের ৫৫ বছরের ইতিহাসে একবারও প্রিমিয়ার ডিভিশনের শিরোপা জিততে পারে নি। বরং ২০০৪ সালে নেমে গেছে ২য় বিভাগে। এই ক্লাব নিয়ে কারও তেমন কোন আশা নেই, সুতরাং অপেশাদার পিনটোর নিয়োগ নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য হল না।
২০০৫ সালে পিনটোর দল ২য় বিভাগের শিরোপা জয় করে আবার ফিরে এলো প্রিমিয়ার ডিভিশনে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে তারা ৫৬ বছর পর প্রথম বারের মতন প্রিমিয়ার ডিভিশন জয় করল। পিনটোর অসাধারণ কোচিঙয়ের স্টাইল নিয়ে টানা হেঁচড়া পড়ে গেল। খোদ কলম্বিয়ার জাতীয় দলে তাঁর ডাক পড়ল। এইবার আর কোস্টারিকার জাতীয় দলের জন্য তাঁর আবেদন করতে হল না, কোস্টারিকা ফেডারেশনই তাঁকে দলে আনার জন্য উঠেপড়ে লাগল।
চার বছর কলম্বিয়ার কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১১ তে পিনটো সাড়া দিলেন কোস্টারিকার ডাকে। একটা জবাব দেবার তখনও তাঁর বাকি ছিল।
কোচ হিসেবে পিনটোর বেশীরভাগ সময়ই কাটে মাঠের বাইরে। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খেলোয়াড়দের বায়োগ্রাফি নিয়ে বসে থাকেন। তাঁর অধীনে তিনজন সহকারী কোচের একটা ভিডিও এনালাইসিস টিম থাকে। এদের কাজ হয় বিপক্ষ দলের খেলা দেখে খুঁটিনাটি রিপোর্ট তৈরি করা। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে পিনটো তাঁর দল সাজান।
তিন বিশ্বকাপ জয়ী দেশের গ্রুপে কোস্টারিকাকে কেউ গণনাতে না ধরলেও পিনটোর ফর্মুলা সফল হয়েছে। ইংল্যান্ড, ইতালির মতন তারকা খচিত দলকে তাঁর দল ঘরে ফেরত পাঠিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ২য় রাউন্ডে উন্নীত হয়েছে। সেখানেই তারা থেমে যায় নি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এই প্রথম কোস্টারিকা শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট গুলিয়ের্মো খেলা উপলক্ষে সকল সরকারী অফিস আদালতে ২ ঘণ্টার বিরতি ঘোষণা করেছিলেন। ২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও অবশ্য কেউ কাজে ফিরে গেল না। রাজধানী সান জোসের পূর্বাঞ্চলে একটি জাতীয় মিলনায়তনে খোদ প্রেসিডেন্ট লুইস গুলিয়ের্মোকে দেখা গেল জাতীয় জার্সি পরে পাগলের মতন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে। সেখানে হাজার মানুষের ঢল। রাস্তার মাঝখানে গাড়ী ফেলে রেখে মানুষ আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছে। শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ, চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবার মুখে উচ্ছ্বাসের হাসির সাথে সাথে অনেকের চোখে আনন্দের অশ্রু।
এত বড় আনন্দের ঘটনা এই ছোট দেশটির ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি।
পিনটো সাহেবের অবশ্য আনন্দ ফুর্তি করার সময় নেই। আগামী ৬ই জুলাইয়ের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার আগেই নেদারল্যান্ডের গত কয়েক বছরের সব ভিডিও ফুটেজর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে পরের খেলার পরিকল্পনায় ব্যস্ত তিনি।